অধুনা পণ্যায়িত নাগরিক নিবারণ চক্কোত্তিদেরকে লেখা খোলা চিঠি – সুমন চক্রবর্তী

অধুনা পণ্যায়িত নাগরিক নিবারণ চক্কোত্তিদেরকে লেখা খোলা চিঠি – সুমন চক্রবর্তী

শেয়ার করুন
এমনটাই কি কথা ছিল নিবারণ বাবু? তুমিই না একদিন চেয়ে ছিলে এক-একটা কবিতা যেন ফিরিয়ে আনে সুতানুটি-গোবিন্দপুরের রাত্রিকে … তোমারই না দাবী ছিল কবিতারাশি যেন অকস্মাৎ ঠেলে দেয় ময়দানের সবুজ গালিচাকে গঙ্গাসাগরের দিকে এগিয়ে যাওয়া যাত্রি-বোঝাই নৌকার দিকে? তোমার কবিতারই না কথা ছিল নিয়তির কণ্ঠস্বর হওয়ার ঝড়ের ভিতরে … তোমার কবিতারই না কথা ছিল বিষাক্ত ফুলের মতো ফোটার রমনীর নখে, ওষ্ঠে, জঙ্ঘাদেশে, হাতের মুদ্রায়? কোথায় হল,নিবারণ বাবু? তুমিও কি তাহলে সেই ছেলেবেলায় দেখা কথা না-রাখা বোষ্টুমী, যার প্রতিক্ষায় কেটেছে কত না চন্দ্রভূক অমাবস্যার নিষ্প্রদীপ রাত? নাকি – তোমার মধ্যেই খুঁজব সেই মাঝি-মল্লাদের একজনকে যে কি না কথা দিয়েছিল আমাকে কোন এক তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবে, যার বুক চিরে উঁকি মারা পদ্মফুলের মাথায় সর্প, ভ্রমরেরা খেলে বেড়ায়? যন্ত্রণাটা কোথায় জানো নিবারণ বাবু, এখনও চেতনে-অচেতনে-অধচেতনে তোমার সেই ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পাই; তোমার সেই নিদারুন বিলাপ আজও কানে বাজে দূর থেকে ভেসে আসা কোন অজ্ঞাত, অশ্রুত বন্দীশের মতো। নিবারণ বাবু, তোমাকেই দেখেছি গগণবিহারী চিলের মত উড়ে যেতে তেজস্বী ও মুকুটবিহীন সম্রাটের রাজকীয় স্বচ্ছন্দে, চেনা আকাশ থেকে অচেনা আকাশের দিকে; যেতে যেতে মেখলা থেকে যেমন উল্কা খসে পড়ে, তুমিও সহসা সেইরকম ঊর্ধ্বাকাশ থেকে এই প্রাত্যহিকতার রঙে আঁকা গেরস্থালির চৌহদ্দিতে ছিটকে পড়েছিলে…সোল্লাসে চেঁচিয়ে বলেছিলাম-এই তো পেয়েছি আমার কবিকে, যে কি না আমারই কথাগুলো, আমারই মতন করে দূরতর দ্বীপ সুচেতনার কাছে পৌঁছে দেবে। রাস্তাগুলি ক্রমে আরও তপ্ত হয়ে ওঠে… স্বজন, সঙ্গীরা দেন স্বভাবসিদ্ধ পিঠটান, স্বাভাবিক নিয়মেই সংখ্যা ক্রমে আরও কমে আসে। হাতের মুদ্রায় তবু জিইয়ে রেখেছ বরাভয়, আমার সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে সেদিন শুধু তুমিই নিবারণ বাবু, শুধুই তুমি । আর তাই চতুর্দিকে ছত্রাকার ধড়মুণ্ড-আলাদা-করা শব দেখেও আমি এগিয়ে যাই আগুনের দিকে-কোন এক অনিবার্য অমোঘ আহ্বানে…যেমনটা একদা শুনেছিলেন কুবলা খান তাঁর প্রমোদ-প্রাসাদে বসে…. নিবারণ বাবু, তোমার হাত ধরেই শিখেছিলাম সমকালকে আকরে ধরতে; চলতি পথের কাব্যে সমকালের দেয়াল লিখনকে পড়ে নেওয়ার পাঠ –সেও তোমার কাছ থেকেই নেওয়া। বৈষম্যেভরা রাষ্ট্রে নিত্য অনূর্মিল কল্লোলে পার গড়ে আবার ভাঙেও, কখনও মিছিলে কখনও বা জাঠায়, কখনও-বা মরিয়া বানের জলোচ্ছাসে – এই সমস্ত পাঠও তোমারই দান। নিবারণ বাবু… জানো নিবারণ বাবু, লোভ আমাকে অচেনা নির্ভেদ্য এক অরণ্যের দিকে টেনে নিয়ে যায়, তারপর অচেনা সেই অরণ্যের মধ্যে ভয় আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়। তোমার জীবনবোধ আমাকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল এই যুগল-রিপুকে আমি শেষ না করে ছাড়ব না – আমি আগে লোভের মরামুখ দেখব, তারপর ভয়ের। কিন্তু কী আশ্চর্য নিবারণ বাবু, পারলাম কই,! আজও যখন একলা ঘরে আয়নার মুখোমুখি বসে সিগারেটের নীলাভ ধোঁয়ায় নিজের ক্লেদাতুর মুখাবয়বটাকে দেখি, শপথগুলোর স্মৃতি যেন দূরপাল্লার বাসের ক্রমান্বয়ে বাজতে থাকা হর্নের মত আমায় বিরক্ত করতে থাকে, অব্যক্ত সব অপরাধবোধ সেনসেক্সের মত লাফিয়ে-লাফিয়ে বাড়তে থাকে, আর আমি আরও মরিয়া হয়ে খুঁজতে থাকি আমার মধ্যে খেলতে থাকা সেই সত্যবাদী, সরল, অকুতোভয় শিশুটিকে, যে কি না সাত-পাঁচ না ভেবেই জিজ্ঞেস করতে পারে – রাজা, তোর কাপড় কোথায়? প্রত্যেক দিন রক্তাক্ত হই আমরা – কখনও শ্রমিক , কখনও কৃষক, কখনও বা পথচলতি নিষ্পাপ প্রত্যেক দিন আমি রক্তাক্ত হই, কখনও শ্রমিক, কখনও কৃষক, কখনও পথচলতি নিষ্পাপ শিশু, কখনও শিক্ষক কখনও বা ছাত্রের বেশে। আমারই রক্ত ঝড়ে মাঠ, মেরু, বন্দর কিন্তু রক্তের ঋণ রক্তে আদায় করে নেওয়ার শপথ নেওয়ার মানুষেরা কোথায় হারিয়ে গেলেন, নিবারণ বাবু? কথা ছিল তো কোলাহল নিষিদ্ধ চরাচরে সহনাগরিকদের অব্যক্ত সংহত সমর্থন স্তব্ধতার গান হয়ে ছড়িয়ে পড়বে নগরে-বন্দরে, জন্ম দেবে নতুন এক কলরবের। কথা ছিল তো বিবেক বর্জিত মানুষের বিরুদ্ধে কবিতা হয়ে উঠবে প্রতিবাদের একমাত্র ভাষা – কিন্তু নিবারণ বাবু তেমনটা হল কোথায়? আজও ঘুমে- জাগরণে দেখি আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য, তন্দ্রার ভেতরে আকাশ বাতাস অনুরণিত হয় ধর্ষিতার মায়ের কাতর আর্তিতে, রক্তলোলুপ মানুষের দল আমার চেতনার চেনা কেতনপুরকে অচেনা করে তুলছে। বরং সু-বোধববর্জিত কবি-শিল্পীকূলের কাছে আমার চাওয়া একটাই আমার মৃত্যুর পর তোমরা আমাকে কংশের জলে ভাসিয়ে দিও, আমাকে তোমরা কাঠের আগুনে পুড়িয়ে ফেলো না,কিংবা মাটি খুঁড়ে কবর দিও না বিস্মৃতির বনানীতে; বর্জ্যপদার্থের মতো আমি চাই না মাটিতে মিশে যেতে। ভাসিয়ে দিও আমায় কংসের জলরাশিতে, যাতে উচ্ছল জলস্রোত আমাকে পৌঁছে দেয় অনাবিষ্কৃত, অনাম্নী কোনো এক দেশে যেখানে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির, বা অনুগ্রহের বিনিময়ে কবি তাঁর হাতের কলমকে পণ্য হয়ে উঠতে দেন না… নিবারাণ বাবু,আজও কি তুমি সেই রুশ উপকথার সারল্যে ভরা শিশুটাকে খোঁজো? তুমিও কি আজও চোখে হারাও তাকে নীরেন বাবুর মত? ভীড়ের মাঝে তাকে দেখতে না পেলে আজও কি ব্যাকুল হয়ে ওঠো, নিবারাণ বাবু? আজও কি তোমার হৃদয় আকুল হয়ে ওঠে নীরেন বাবুর শঙ্কায় যে, স্তাবকের দল তাকে হয়ত পার্বত্য কোনো গোপন গুহায় লুকিয়ে রেখেছে ? ভয় পেও না, সেই শঙ্কা আজ বোধহয় তোমাকে মুক্তি দিয়ে, আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে ভিন্ন কোন হৃদয়ে যে কি না আজও স্বপ্ন দেখে বা দেখায়, নিবারাণ বাবু; নির্জন কোনো চরাচরে অথবা নদীর ধারে, কিংবা কোনো রাষ্ট্রীয় বটবৃক্ষের সুরক্ষিত উদ্দালোকে সেই শিশুটি ঘুমিয়ে পড়েছে…ঘুম পাড়ানো হয়েছে তাকে। গুয়েতামেলার কবি ও বিপ্লবী ওতো রেনে কাস্তিওর-র Apolitical Intellectuals কবিতাটি তোমার নিশ্চিত পড়া, নিবারণ বাবু। হয়ত আত্মগ্লানির দ্বারা তাড়িত হয়ে আজ হয়ত কবিতাটির ঠাঁই হয়েছে তোমার “অ-পাঠ্য”-এর তালিকায়। তাই এই খোলা চিঠি শেষ করব সেই অ-পাঠ্য হয়ে ওঠা কবিতার ভাবানুবাদ দিয়েই…

রাজনীতি-উদাসীন বুদ্ধিজীবিদের প্রতি কোন একদিন রাজনীতি-উদাসীন স্বদেশের বুদ্ধিজীবিদের কৈফিয়েত তলব করবেন সরল-সোজা মানুষের দল।। তাঁদের কছে জানতে চাইবে তাঁরা কি করছিলেন যখন স্বদেশ একটু-একটু করে শুকিয়ে গেল ছোট্ট এবং একাকী আগুনের মত।। একটা কথাও কেউ জানতে চাইবেন না তাঁদের বেশ-ভুষা সম্পর্কে মধ্যাহ্নের আহারের পর দিবানিদ্রা সম্পর্কে একটা কথাও কেউ জানতে চাইবেন না, তাঁদের “নাস্তিত্বের ধারণা”র বন্ধ্যা লড়াইয়ের বিষয়ে কারুর ঠেকা নেই তাঁদের আর্থ বৈদগ্ধ্য কতটা জানার। তাঁদের প্রশ্ন করা হবে না গ্রীসদেশীয় পুরাণ নিয়ে অথবা আত্মগ্লানির বিষয়ে, যখন তাঁদেরই একজন মরতে শুরু করবেন কাপুরুষোচিত মৃত্যু।। তাঁদের প্রশ্ন করা হবে না নিরর্থক ন্যায্যতা প্রদানের অপপ্রয়াস নিয়ে, সতত অসত্যের প্রতিচ্ছায়ায় ভূমিষ্ঠ তাঁরা।। কোন একদিন সরল-সোজা মানুষের দল আসবে।। সেই সমস্ত মানুষেরা যাদের ঐ রাজনীতি-উদাসীন বুদ্ধিজীবিদের কাব্যে, নাট্যে, গ্রন্থে কভু ঠাঁই হয়নি তবু নিত্য যুগিয়ে গেছে তাঁদের পাউরুটি আর দুধ, তাঁদের ডিম থেকে ডিমের আমলেট যারা নিত্য চালিয়েছে তাঁদের যন্ত্রচালিত শকট যারা পেলেছে তাঁদের কুকুর, করেছে তাঁদের বাগান আর খেটেছে তাঁদেরই জন্য তারা কৈফিয়েত চাইবে।। “তোমরা কি করেছিলে যেদিন নির্ধন মানুষের জীবনের যত ছিল সুকোমলতা ক্রমান্বয়ে নিঃশেষিত হল?” হতভাগ্য এই স্বদেশের রাজনীতি-উদাসীন বুদ্ধিজীবিদের সেদিন আর দেওয়ার মত কোন উত্তরই থাকবে না।। সেদিন নৈঃশব্দের শকুন কুড়ে-কুড়ে খাবে তাঁদের পাকস্থলি।। তোমাদের চেতনার দৈন্য তোমাদেরই বিবেককে করবে দুর্নিবার করাঘাত।। লজ্জায় মূক হয়ে রইবে তোমরা মুখ।। তোমার বিশ্বস্ত- গুণমুগ্ধ

তোমার বিশ্বস্ত- গুণমুগ্ধ

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২