ভারতের নাস্তিক নিরীশ্বর ঐতিহ্য – অমিতাভ ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

ভারতে এখন হিন্দু পুনরুত্থানের চেষ্টা চলছে । ধর্মের পুনরুত্থান পৃথিবীর কোথাও ভালো কাজে লাগে না । আফগানিস্তানের তালিবানরা তার প্রমাণ । ধর্মীয় পুনরুত্থান হলে পিছিয়ে যাওয়া অনিবার্য । বলা হচ্ছে ভারত অধ্যাত্মবাদের দেশ, ধর্মের দেশ । সেটা সকলে বেশ খাচ্ছে । পালে হাওয়া আছে তাই ধর্মরক্ষার নিরাপদ আন্দোলনে অনেকেই নাম লিখিয়েছেন । সেই সুযোগে ছড়ি ঘোরাচ্ছে ধর্মের কারবারিরা ।

হ্যাঁ ভারতে অধ্যাত্মবাদ ছিল, ধর্মচিন্তা ছিল । শুধু ভারতে কেন, গোটা পৃথিবীতেই ছিল । দ্বন্দ্বতত্ত্ব বলে সমস্ত চিন্তাই একমুখী হয় না । অধ্যাত্মবাদ, ঈশ্বরবাদ থাকলে তার সঙ্গে সংশয় (মানে ঈশ্বরে সংশয়), নাস্তিক্যবাদ (মানে ঈশ্বরকে অস্বীকার)ও থাকবেই । গোটা পৃথিবীতে এঁরাও ছিল, হয়তো খুব ক্ষীণ হয়েই ছিল, কিন্তু ছিল । ভারতে কিন্ত ক্ষীণ নয়, খুব স্পষ্ট শক্তিশালী একটা সংশয়ী, নাস্তিক, না-ধার্মিক ধারা ছিল । এঁদের উপস্থিতি প্রাচীন ভারতের ধর্মগ্রন্থগুলোতেও এত প্রবল যে একে শুধু একটা ধারা না বলে ঐতিহ্যই বলা উচিত্‌ । হ্যাঁ ভারতের একটা স্পষ্ট শক্তিশালী নাস্তিক, নিরীশ্বরবাদী, না-ধার্মিক ঐতিহ্য সেই প্রাচীন কাল থেকেই আছে । যদিও নাস্তিক বলতে ভারতীয় দর্শনে বোঝায় পরলোকে অবিশ্বাসী (যেমন চার্বাক) অথবা বেদে অবিশ্বাসীদের (যেমন বৌদ্ধ, জৈন) । আমরা এখানে নাস্তিক বলতে ঈশ্বর, ধর্ম, পরলোক, পুনর্জন্ম, যাগযজ্ঞ, ব্রাহ্মণদের দানধ্যানে সংশয়ী ও অস্বীকারকারীদের কথাই বলব ।

হিন্দুধর্ম মানেই বেদ । অনেকেই মনে করেন ‘ব্যাদে সব আছে’ । আছে তো । সবচেয়ে প্রাচীন ঋগ্‌বেদেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রবল সংশয় আছে । ঋগ্‌বেদের দশম মণ্ডলের ১২৯ নম্বর স্তোত্রটি নাসদীয় সূক্ত নামে পরিচিত । জগত্‌ সৃষ্টির কারণ নিয়ে আলোচনা চলেছে ঐ স্তোত্রটিতে । সেখানে পরিষ্কার বলা আছে জগত্‌সৃষ্টির কারণ কেউ জানে না । স্তোত্রের ৭টি শ্লোকের ৬ নম্বর শ্লোকটি হলো:

কেই বা প্রকৃত জানে? কেই বা বর্ণনা করিবে? কোথা হইতে জন্মিল? কোথা হইতে নানা সৃষ্টি হইল? দেবতারা এই সমস্ত নানা সৃষ্টির পর হইয়াছেন। কোথা হইতে যে হইল, তাহা কেই বা জানে? (রমেশচন্দ্র দত্তর অনুবাদ)

অর্থাৎ দেবতারা এই জগত্‌ সৃষ্টি করেন নি । তাঁরাও এই সৃষ্টির কারণ জানেন না কারণ জগত্‌ সৃষ্টি হওয়ার পরে দেবতাদের সৃষ্টি হয়েছিল ।

ঐ শ্লোকের একটি পদ্য অনুবাদ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত করেছিলেন । সেখানে তিনি লিখেছিলেন ‘সৃষ্টদেবতা অর্বাচীন’ (নতুন, প্রাচীনের উলটো) । মানে, দেবতা নিজেই সৃষ্ট, তিনি স্রষ্টা নন । সৃষ্টির দায় না থাকলে দেবতার থাকা আর না-থাকায় কোনো ফারাক হয় না ।

আঠেরোটা মুখ্য উপনিষদ । সেগুলোও কোনো একজনের লেখা নয় । নানান লোকের নানান মত তাতে প্রতিফলিত । প্রথমে আসা যাক শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (১।২) । জগত্‌কারণ হিসেবে ছটা মতের কথা বলা হচ্ছে । কাল (সময়), স্বভাব, নিয়তি, যদৃচ্ছা (রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন: যেদিকে গতি, অনিয়ম, ইংরিজিতে অ্যাক্সিডেন্ট), ভূতানি এবং পুরুষ (ঈশ্বর) । মানে ঈশ্বর ছাড়াও সৃষ্টির আরও পাঁচটি কারণ নিয়ে মতবাদ এ দেশে প্রাচীন কালে চালু ছিল । সেটা এই শ্লোক প্রমাণ করে ।

(ভূতানি : : ভারতীয় দর্শনে ভূত মানে পদার্থ । আগুন, জল, মাটি, হাওয়া আর শূন্য (আকাশ বা ব্যোম) । যাঁরা মনে করেন দেবতা বা ঈশ্বর নন প্রাণ সৃষ্টি হয় এই পাঁচটি প্রাকৃতিক উপাদানের থেকে (যেমনভাবে গুড় থেকে মদ তৈরি হয়) আর মৃত্যুর পর শরীর আবার এই পাঁচটি পদার্থে মিশে যায় (মানে শরীর ছাড়া চেতনা, আত্মা ইত্যাদি থাকে না । মানে পরলোক, পুনর্জন্মে দাঁড়ি) তাঁরা হলেন পঞ্চভূতবাদী । যাঁরা মনে করেন শুধু প্রথম চারটিই উপাদানই এমন ঘটায় তাঁরা চতুর্ভূতবাদী (যেমন চার্বাক) )

আর একটি প্রাচীন উপনিষদ: ‘কঠ উপনিষদ’এর গল্পটি এইরকম: বাজশ্রবস-এর ছেলে উশন্‌ । উশন্‌ সমস্ত পার্থিব জিনিস দেবতাদের দান করছিলেন (সম্ভবত দেবতাদের আশীর্বাদ পাওয়ার আশায়) । তাঁর অল্পবয়িসি ছেলে নচিকেতা দেখল যে বাবা যে গরুগুলো দান করছেন সেগুলো বুড়ো, নিষ্প্রাণ । সেগুলোর দুধ দেওয়ার ক্ষমতা নেই । নচিকেতা তার বাবাকে বারবার জিগেস করছিল, ‘বাবা আমিও তো তোমার সম্পত্তি । আমাকে কোন দেবতাকে দান করবে?’ তখন উশন খানিক বিরক্ত হয়েই বলে ওঠেন ‘তোমায় আমি মৃত্যুকে দান করলাম ।’ যম হলেন মৃত্যুর দেবতা । নচিকেতা তখন জীবন্তই যমালয়ে পৌঁছলেন । যম তখন যমালয়ে ছিলেন না । নচিকেতা তিন রাত কিছু না খেয়েই তাঁর জন্যে অপক্ষা করতে লাগলেন । যম ফিরে নচিকেতা-কে দেখে লজ্জিত হলেন । তাঁর অতিথি । অতিথি অনাহারে ছিলেন । যম তখন নচিকেতা-কে তিনটি বর দিতে চাইলেন । প্রথম বর চেয়ে নচিকেতা বললেন, সে যেন তার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারে । দ্বিতীয় বরে নচিকেতা জানতে চাইল কীভাবে মানুষ স্বর্গে যেতে পারে । যম তখন নচিকেতা-কে সেই যজ্ঞের পদ্ধতি নিয়ম বললেন যা করলে মানুষ স্বর্গে যেতে পারে । সেই যজ্ঞর নাম হলো নচিকেত অগ্নি । তৃতীয় বরে নচিকেতা জানতে চাইল মানুষের মৃত্যুর পরে তার কী হয় । যম কিছু টালবাহানার পরে তার জবাব দিলেন । সেইটিই এই উপনিষদের মূল উপজীব্য । এমন ভাববাদী গল্পর মধ্যেও নচিকেতা কিন্তু জানতে চান (১। ২০), ‘অনেকে বলেন মৃতরা আছেন, অনেকে বলেন মৃতরা নেই, আমাকে সত্যিটা বলুন’ । মৃতরা নেই মানে, মৃত্যুর পরে আর আত্মার অস্তিত্ব নেই । পরলোক নেই, পুনর্জন্ম নেই । মানে সংশয়ীদের অস্তিত্বের প্রমাণ । অনেকেই তার মানে তখনও এসবে বিশ্বাস করতেন না ।

এবার আসা যাক ছান্দোগ্য উপনিষদের উদ্দালক-শ্বেতকেতু উপাখ্যানে (অধ্যায় ৬) । অরুণের পুত্র বলে তাঁর পুরো নাম উদ্দালক আরুণি । দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় মনে করতেন, গ্রীসের থালেস নন, ছান্দোগ্য উপনিষদে বর্ণিত উদ্দালকই পৃথিবীর প্রথম বৈজ্ঞানিক । রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর মতে তিনি আদি বস্তুবাদীদের একজন । কেন এমন ধারণা? কী করেছিলেন উদ্দালক?

উদ্দালক আরুণির ছেলে শ্বেতকেতুকে বারো বছর বয়েসে গুরুগৃহে পাঠানো হলো শিক্ষালাভ করার জন্যে । বারো বছর শিক্ষালাভ করে শ্বেতকেতু বাড়ি ফিরলেন । ছেলের মধ্যে একটু বিদ্যালাভের অহঙ্কার ছিল মনে করে উদ্দালক তাঁকে কিছু প্রশ্ন করলেন । ছেলে সেসবের জবাব দিতে পারলেন না এবং জানালেন গুরুগৃহে তাঁকে এগুলো শেখানো হয় নি । উদ্দালক ছেলেকে শিক্ষা দিতে আরম্ভ করলেন । উদ্দালক জানালেন, অন্নই হলো মন । একথা শ্বেতকেতু বুঝতে পারলেন না । উদ্দালক তখন তাঁকে বললেন পনেরোদিন শুধু জল খেয়ে থেকে তাঁর কাছে আসতে । শুধু জল খেয়ে পনেরোদিন থেকে শ্বেতকেতু ষোলোদিনের দিন বাবার কাছে এলেন । উদ্দালক তখন ছেলেকে বেদ আবৃত্তি করতে বললেন । না খেয়ে কাহিল শ্বেতকেতু এত বছরের চর্চা করা বেদের কিছুই মনে করতে পারলেন না । উদ্দালক তখন তাঁকে অন্নগ্রহণ করে তাঁর কাছে আবার আসতে বললেন । শ্বেতকেতু তাই করলেন । উদ্দালক আবার বেদ আবৃত্তি করতে বললেন । শ্বেতকেতুর তখন সবই মনে পড়ল । উদ্দালক তাঁকে বোঝালেন অন্নই হলো মন । উদ্দালকের বক্তব্য হলো, মন মানে ব্রহ্ম, পরমব্রহ্ম, শরীর অতিরিক্ত চেতনা কিছুই নয় । আদি অনন্ত অক্ষয় প্রাণ বলে কিছু নেই । মন আসলে শরীরেরই অংশ । খাবার না খেলে যেমন শরীর কাহিল হয় । মনও তাই হয় ।

এরপর উদ্দালক শ্বেতকেতুকে বটগাছের একটি ফল দিয়ে সেটিকে ভাঙতে বললেন । ভাঙতে ভাঙতে শ্বেতকেতু আর চোখে সেই ফলের বীজের কোনো অংশ দেখতে পেলেন না । উদ্দালক তখন বললেন তুমি যা দেখতে পাচ্ছ না তার ভেতরেই সবকিছুর সূক্ষ্ম সার (ইংরিজিতে subtle essence) রয়েছে । ‘তুমিও তাই’ (তত্‌ ত্বম অসি =‌ তত্ত্বমসি) । এবার তিনি ছেলেকে এক কলসী জলে খানিক নুন গুলতে বললেন । শ্বেতকেতু তাই করলেন । নুন জলে গুলে গেলে উদ্দালক ছেলেকে কলসির ওপর থেকে একটু, মাঝখান থেকে একটু আর নীচ থেকে একটু জল খেতে বললেন । শ্বেতকেতু তাই করলেন । তখন উদ্দালক ছেলেকে জিগেস করলেন জলের স্বাদ কেমন । ছেলে বললেন, নোনতা ।। উদ্দালক বললেন, নুন দেখা যাচ্ছে না কিন্তু নুন সর্বত্রই আছে । সেইটি হলো সূক্ষ্ম সার । ‘তুমিও তাই’ (তত্ত্বমসি) । সূক্ষ্ম সার যে সংস্কৃত শব্দর অনুবাদ তা হলো অণিমা । রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সম্প্রতি প্রমাণ করেছেন অণু থেকেই অণিমা, উদ্দালক এখানে সূক্ষ্ম সার অর্থে পরমাণুর কথা বলেছিলেন । উদ্দালকের এই ধারণাই পরে বৈশেষিক দর্শনের কণাদের হাতে পরমাণুবাদের রূপগ্রহণ করেছিল । এই তত্ত্বমসি মানে ‘তুমিও তাই’-কে ভাববাদীরা নিজেদের মতো করে নানানভাবে ব্যাখ্যা করেছেন । ‘তুমিও তাই’ মানে তুমিই ব্রহ্ম ইত্যাদি ইত্যাদি । রামকৃষ্ণবাবু এইসব মত খণ্ডন করে দেখিয়েছেন উদ্দালক আরুণি একেবারেই পরমাণুবাদের কথাই বলেছেন । মানে উপনিষদ শুধু ঈশ্বরপ্রাপ্তি আর ব্রহ্মচর্চা নয়, সেখানে পরিষ্কার পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ আর সিদ্ধান্তর কথা আছে । উপনিষদের ব্রহ্মবাদ যদি আমাদের ঐতিহ্য হয়, তবে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণও আমাদের ঐতিহ্য । তবে এই দুই ঐতিহ্যর সম্পর্ক জল-অচল । দুই ঐতিহ্য কখনোই মেলে না । জোর করে যত চেষ্টাই করা হোক না কেন তারা দু-মেরুতে থাকবেই । কেউ চাইলে যে কোনো একটাকেই বাছতে হবে । ধর্ম আর বিজ্ঞানের সমন্বয় হয় নি, হয় না, হবে না, দাঁড়ি । ধর্মর সঙ্গে সংগ্রাম করেই বিজ্ঞান এগোয় । দুটোর ভিত্তি সম্পূর্ণ বিপরীত । ধর্মর মূল দাবি, অন্ধ আনুগত্য । বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত প্রশ্ন ও অনুসন্ধিত্‌সার ওপর । অবশ্য গণতান্ত্রিক দেশ । আপনি চাইলে চব্বিশ ঘণ্টা অষ্টপ্রহর বিজ্ঞানের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে ধর্মতে জীবনের সার খুঁজতেই পারেন । বিজ্ঞানের যেখানে শেষ, দর্শনের সেখানে শুরু — জাতীয় প্রলাপ বকতেই পারেন । ভাবের ঘরে চুরি নিয়ে পেনাল কোডে কিছু বলা নেই ।

প্রসঙ্গত বলে রাখি প্রাচীন ভারতের দার্শনিকরা পরমাণুর একটা ধারণা করেছিলেন মাত্র । তার মানে কিন্তু এই নয় যে তাঁরা বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরমাণুর সম্বন্ধে জানতেন । উদ্দালক আর কণাদের পরমাণুবাদে আধুনিক বিজ্ঞান খুঁজতে যাবেন না । সেটা হবে চরম বোকামি । পরমাণু সম্পর্কে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আধুনিক কালে ইউরোপ থেকেই এসেছে ।

ছান্দোগ্য উপনিষদের প্রণেতাদের অন্নকে মূল ধরার একটা প্রবণতা ছিল । ছান্দোগ্য উপনিষদ হলো সামবৈদিক । সেখানে উদগীথ শব্দকে সিলেবেলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে উদ্‌, গী আর থ-এর মাধ্যমে । ছান্দোগ্য উপনিষদকার এর মতে থ-এর অর্থ খাদ্য, অর্থাৎ এই জগত্‌ খাদ্যর ওপর স্থিত (১।৩।৬) । ব্রহ্ম, পরম ব্রহ্ম, হিরণ্ময় পুরুষ নয় — জগত স্থিত খাদ্যর ওপর । এর থেকে বড় বস্তুবাদী কথা কী হতে পারে ।

মৈত্রায়ণী উপনিষদে (৭।৮) একটি শ্লোকে স্বর্গপ্রার্থীরা কাদের সঙ্গে মিশবেন না তাঁদের একটা তালিকা আছে । যে ব্রাহ্মণেরা যাঁদের যজ্ঞের অধিকার নেই তাঁদের যজ্ঞ পরিচালনা করেন, শূদ্রর শিষ্য, যে শূদ্র পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করেন, অভিনেতা, নর্তক, সৈন্য, রাজকর্মচারীদের সঙ্গে বেদবিরোধীদের উল্লেখ এই তালিকায় আছে । বোঝা যায় বেদবিরোধীরা তখন ধর্মধ্বজাধারীদের যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ ছিল ।

তিনি ছিলেন বুদ্ধর কিছু আগের মানুষ । মানুষের চুলের কম্বল পরতেন বলে তাঁর নাম কেসকম্বল, অজিত কেসকম্বল । রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁকে অভিহিত করেন মুক্তমনা দার্শনিক হিসেবে । রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর মতে তিনি ভারতের একজন আদি বস্তুবাদী । প্রাচীন ভারতের দর্শন জগতে অজিত কেসকম্বল ও তাঁর মত অতি গুরুত্বপূর্ণ । অজিত কেসকম্বল বলেছিলেন:

‘দান-ধ্যান . . . যজ্ঞ নেই (=বেকার), সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের ফল = বিপাক নয়। ইহলোক-পরলোক নয়, মাতা-পিতা-দেবতা নেই। সত্যলোকে পৌঁছে যাওয়া এমন কোনো সত্যারূঢ় শ্রমণ-ব্রাহ্মণ নেই, যিনি স্বয়ং ইহলোক-পরলোককে জ্ঞাত হয়ে, মানুষকে বোঝাতে পারেন। মনুষ্য চতুর্ভূতের সৃষ্টি। মৃত্যুর পর (দৈহিক) পৃথিবী পৃথিবীতেই বিলীন হয়। . . . অনল অনলে . . . জল জলে . . . বায়ু বায়ুতেই লয় প্রাপ্ত হয়। ইন্দ্রিয় আকাশে গমন করে । মৃত ব্যক্তিকে খাটে করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। চিতায় অগ্নিসংযোগ পর্যন্ত তার অস্তিত্ব দৃষ্টিগোচর হয়; তারপর অস্থিসমূহ ক্রমশ ক্ষুদ্র ও ধূসরবর্ণ হয়ে আসে, অবশেষে চিতাভস্ম ব্যতীত আর কিছুই থাকে না। দান করার পরামর্শ মূর্খের উপদেশ, যিনি আস্তিক্যবাদের কথা বলেন তিনি তুচ্ছ ও মিথ্যা কথা বলেন। মূর্খ-বিদ্বান সকলেই বিনষ্ট হয়, বিচ্ছিন্ন হয়, মৃত্যুর পর আর কিছু থাকে না ।’ (রাহুল সাংকৃত্যায়নের অনুবাদ)

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ধর্মের পীঠস্থান নামে পরিচিত আমাদের দেশে এমন কথা প্রচার করা হতো । ঈশ্বর, পরলোক, অজর-অমর আত্মা, পুনর্জন্ম সবকিছুকেই পরিষ্কার অস্বীকার করা হয়েছে ।

‘কামসূত্র’ লেখককেও দেখা যায় নাস্তিক মত খন্ডনের চেষ্টা করতে । সেই নাস্তিকদের বক্তব্য সেখানে যা আছে তা হলো:

১। ধর্ম আচরণ করবে না ১।২।২৫
২। যেহেতু তার ফল ভবিষ্যতে পাওয়া যায় । ১।২।২৬
৩। যেহেতু (তা) অনিশ্চিতও । ১।২।২৭
৪। কোন্‌ বুদ্ধিমান লোক হাতের জিনিস পরের হাতে দেয় [এখানে সম্ভবত ব্রাহ্মণদের দান করার কথা বলা হচ্ছে ] । ১।২।২৮
৫। আগামীকাল ময়ূর পাওয়ার চেয়ে আজকের পায়রা পাওয়া ভালো । ১।২।২৯
৬। অনিশ্চিত (=সন্দেহজনক) সোনার টাকার চেয়ে নিশ্চিত (=আসল) রূপোর টাকা অনেক ভালো । ১।২।৩০
(রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর অনুবাদ)

বাঙলা কথা হলো, পরলোকের সোনার টাকা বলে কিছু নেই, ইহলোকের রূপোর টাকাতেই কাজ চালাও ।

রামায়ণ এবং মহাভারত-এও বস্তুবাদী মতের উপস্থিতি । রামায়ণ-এ জাবালি বনবাস থেকে রামকে নিবৃত্ত করতে লোকায়তিক মত মানে বস্তুবাদী মত বর্ণনা করেন । সেখানেও সেই দেহবিহীন আত্মা থাকতে পারে না । যজ্ঞে কোনো ফল দেয় না । শ্রাদ্ধ করে কোনো লাভ নেই ইত্যাদি কথা উঠে আসে ।

মহাভারত-এও নাস্তিক শব্দটি অনেকবার ব্যবহৃত হয়েছে এবং তাঁরা যে পাপী এবং তাঁদের কঠিন শাস্তি দেওয়া উচিত সে-কথাও আসে । অন্যান্য কুকর্মকারীদের সঙ্গেই নাস্তিকদের নিন্দা করা হয় । মহাভারত-এর ‘শান্তিপর্ব’-র মোক্ষধর্ম পর্বাধ্যায়ে সমসাময়িক দার্শনিক মতগুলির কথা আসে । প্রসঙ্গত বলে রাখি রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সম্প্রতি প্রমাণ করেছেন শান্তিপর্বর শান্তির অর্থ কিন্তু যুদ্ধর পর শান্তি যাকে ইংরিজিতে পিস বলে তা নয় । শান্তিপর্বর শান্তি হলো ইংরিজি ট্রানকুইলিটি । জ্ঞাতিহত্যার গ্লানিতে বিব্রত যুধিষ্ঠিরের মনের শান্তি ফেরাতেই ভীষ্ম শরশয্যা থেকেই তাঁকে নানা জ্ঞান দেন । এই শান্তিপর্বর মোক্ষধর্ম পর্বাধ্যায়ে জনক-পঞ্চশিখ সংবাদে সাতটি শ্লোকে নাস্তিক মতের কথা আছে । তার মধ্যে সাত নম্বরটি বেশ আগ্রহজনক:

“শুক্র থেকেই (মানুষের জন্ম), ঘি খেয়ে হজম হলে দেহেই শুক্র জন্মায় (তার মধ্যেই মানুষ নিহিত থাকে) — যেমন বটের বীজ (যার মধ্যে পুরো বটগাছ নিহিত থাকে) । জন্ম, স্মৃতি — এ সবই চুম্বক, সূর্যকান্তমণি ও আগুনের জল খাওয়ার মতো । (অর্থাৎ শুক্র-র মতো জড়বস্তু থেকেও প্রাণের উদ্ভব সম্ভব; তার দৃষ্টান্ত: জড় চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ করতে পারে, সূর্যকান্তমণি থেকেও তাপ বেরোয়, আগুনও জল শুষে নিতে পারে ) ।”

মহাপ্রাণ বা পরমব্রহ্ম থেকে জীবের আত্মার চেতনার উত্‌পত্তি—এই ধারণাকে একেবারে সমূলে খণ্ডন করে এখানে বস্তু থেকেই প্রাণের উত্‌পত্তি হয়েছে তা প্রমাণের চেষ্টা হয়েছে ।

মহাকাব্য তো দেখা হলো । এবার পুরাণে আসি । বিষ্ণুপুরাণ, পদ্মপুরাণ, ইত্যাদি অনেককটা পুরাণেও নাস্তিক বেদবিরোধী মতের পরিচয় পাওয়া যায় । তার মধ্যে পদ্মপুরাণের গল্পটি বেশ । দেবতাদের গুরু বৃহস্পতি আর অসুরদের শুক্র । শুক্র একবার মায়াবলে অদৃশ্য হয়েছিলেন । সেই সুযোগে শুক্রর রূপ ধরে গিয়ে বৃহস্পতি অসুরদের বেদবিরোধী নানা উপদেশ দ্যান এবং ধর্মভ্রষ্ট করেন । বৃহস্পতি কী বলেছিলেন একটু দ্যাখা যাক:

‘. . . ঐহিক স্বার্থপর নীচজনেরাই যজ্ঞ ও শ্রাদ্ধকার্যের প্রবর্তক । . . .বৈদিক পক্ষাবলম্বী অন্য যেসকল দেবর্ষি আছেন; তাঁহারাও হিংসাবহুল, ক্রর, মাংসাশী ও নিত্য পাপকারী, এতদ্বিন্ন দেব ও ব্রাহ্মণরাও মদ্যপায়ী -এও মাংসাশী । সুতরাং ইহাদের অবলম্বিত ধর্ম্ম দ্বারা কে কিরূপে স্বর্গ বা মোক্ষ লাভ করিবে? শ্রুতি[বেদ]স্মৃতি[ধর্মশাস্ত্র]বিহিত যেসকল যজ্ঞাদি ও শ্রাদ্ধাদি কর্ম্ম আছে, তাহাতে অপবর্গ (=মোক্ষ)লাভ নাই । এ সম্পর্কে প্রবাদ শুনা যায় যে যজ্ঞে পশু মারিয়ে রুধির কর্দ্দম প্রস্তুত করিয়া যদি স্বর্গে যাওয়া যায়, তবে নরকে যাইবে কে? যদি একজন ভোজন করিলে অন্যের তৃপ্তি হয় তবে প্রবাসী ব্যক্তিকে শ্রাদ্ধ তাহার কি অপর খাদ্য আহরণ করিতে হয় না ।’

এরপর দেবতাদের একটি কেচ্ছাকাহিনী বর্ণনা করে বলা হয়:

“সুতরাং দেখ, এ ধর্ম্ম কিপ্রকার ও জগতে এইরূপ এবং অন্যরূপ অনেক পাপকর কার্য্য দেখা যায় । ধর্ম্ম, যেখানে এইপ্রকার, সেখানে আর পরমার্থ কী?”

এইরকম গল্পর মূল শিক্ষা হলো নাস্তিক মত মানলে তোমাকেও অসুরদের মতো হেরে যেতে হবে, ধ্বংস হতে হবে । কিন্তু সেটা বলতে গিয়ে পুরাণকার আসলে তখন চালু নাস্তিক মতটাকে প্রায় পুরোটাই বিবৃত করেছেন ।

এবার চার্বাকদের কথায় আসা যাক । চার্বাক কিন্তু আসলে এক দার্শনিক মতের নাম । পুরোপুরি নাস্তিক, বস্তুবাদী একটি মত । আট শতাব্দী থেকে বারো শতাব্দী পর্যন্ত দর্শনের জগতে এঁদের বিরাট দাপট ছিল । নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে তাঁদের একাধিক সূত্রগ্রন্থও ছিল । কিন্তু সেগুলির কিছুই পাওয়া যায় না (ব্রাহ্মণ্যধর্মর চক্রান্তেই সম্ভবত তাঁদের পুঁথিগুলি পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে) । তাই চার্বাকদের মত সংগ্রহ করতে হয় তাঁদের বিরোধীদের লেখা থেকে । ভারতীয় দর্শনের নিয়ম ছিল নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে হলে অন্যের মত আগে খণ্ডন করতে হয় । জৈন, বৌদ্ধ, নৈয়ায়িক, বেদান্তিন সব ধারার দার্শনিকরাই চার্বাকমত খণ্ডন করেছেন । সেখান থেকেই চার্বাকদের মতের কথা জানা যায় । গ্রীসের দার্শনিকদের মতোই চার্বাকদের সূত্রগুলি পুনর্গঠনের চেষ্টা চলছে । দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী, মামোরু নামাই, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এই কাজটি চালিয়েছেন । সেই পথ ধরেই রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য বর্তমানে চার্বাকসূত্র পুনর্গঠনের কাজে অনেকটাই এগিয়েছেন । তাঁর দীর্ঘ পরিশ্রমী বিজ্ঞানসম্মত গবেষণায় বর্তমানে চার্বাকসূত্রগুলির একটা পরিষ্কার রূপ পাওয়া গেছে ।

আসুন দ্যাখা যাক জগত্‌, আত্মা, পরলোক, যাগযজ্ঞ নিয়ে চার্বাকদের মত কী ছিল: :

“সুতরাং এখন আমরা তত্ত্ব (=বস্তুজগতের স্বরূপ) ব্যাখ্যা করব ।

তত্ত্বগুলি (হলো) মাটি, জল, আগুন আর বাতাস । [কোনো দেহঅতিরিক্ত পরম চেতনা নেই । বস্তু থেকেই প্রাণের সৃষ্টি হয় ।]

তাদের মিলিত (রূপের) নাম শরীর, ইন্দ্রিয় ও বিষয় ।

সেগুলি থেকে চৈতন্য (দ্যাখা দেয়) । [প্রাণ দ্যাখা দেয়]

বিজ্ঞান (চেতনা) হলো কিণ্ব (মদ তৈরির উপাদান, যেমন ভাত, গুড়) ইত্যাদি থেকে মদশক্তি (নেশা ধরানোর ক্ষমতা)-র মতো ।

চেতনাসমেত শরীরই পুরুষ (=আত্মা) ।

কায়া (শরীর) থেকেই (চেতনা আসে) । [অর্থাৎ আগে শরীর, পরে আত্মা]

শরীর থাকলে তবেই (চেতনা ইত্যাদি থাকে) । [শরীর ছাড়া আত্মা থাকে না । মানে বিদেহী কিছু নেই]

জীব (আত্মা) গুলি জলের বুদ্‌বুদের মতো ।

জন্মবৈচিত্র্যর বিভিন্নতার কারণেই জগৎও বিচিত্র ।

ময়ূরচন্দ্রক (ময়ূরপুচ্ছর ভেতরের চিহ্ন)-এর মতো ।

প্রতক্ষ্যই প্রমাণ ।

প্রমাণের অগৌণতার কারণেই তার (অনুমানের) থেকে অর্থনিশ্চয় দুর্লভ (=সর্বদা নিশ্চিত লক্ষ্যে পৌঁছনো যায় না) । [রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন প্রতক্ষ্য ছাড়াও চার্বাকরা প্রত্যক্ষসিদ্ধ অনুমান মানতেন । কিন্তু যা প্রতক্ষ্য নয় তার অনুমান মানতেন না, যেমন ঈশ্বর বা আপ্তবাক্য]

পরলোক অসিদ্ধ — প্রমাণের অভাবে ।

পরলোকবাসী (পরলোকের বাসিন্দা অর্থাৎ আত্মা) না-থাকায় পরলোকের অভাব (=পরলোক নেই)

পরলোকবাসী চৈতন্য দেহহীন (হয়) — সেই কারণে (সেটি অগ্রাহ্য) ।

অন্য দেশ, অন্য কাল বা অন্য অবস্থাই পরলোক ।

(পূর্ব-)জন্মর স্মৃতি অসিদ্ধ । এক গ্রাম থেকে আসা সকলের স্মৃতিও (এক রকম হয়) ।

ধর্ম (আচরণ) করা ঠিক নয় ।

তার (ধর্মর) উপদেশে বিশ্বাস করা উচিত নয় ।”

এছাড়াও বেশকিছু লোকগাথা বা আভাণক যেগুলো মুখে মুখে চলত ও বিভিন্ন গ্রন্থে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল সেগুলি থেকেও চার্বাকদের মত জানা যায় বলে অনেকে মনে করেন । সায়ণ-মাধব, চোদ্দো শতকের একজন বৈদান্তিন, তাঁর গ্রন্থ সর্ব-দর্শন-সংগ্রহ-এ খণ্ডন করার জন্যে চার্বাকমত হিসেবে যেসব শ্লোক তুলে ধরেছেন সেগুলি হলো এই লোকগাথাগুলি:

‘স্বর্গ নেই, অপবর্গ (=মোক্ষ) নেই বা পারলৌকিক আত্মাও নেই । বর্ণ-আশ্রম ইত্যাদি ক্রিয়াও কোনো ফল দেয় না ।।

‘অগ্নিহোত্র, তিন বেদ, ত্রিদণ্ড (সন্ন্যাসীর উপকরণ), ছাই দিয়ে গা ঢাকা — বুদ্ধি ও পৌরুষহীনদের (এই) জীবিকা ধাতা (=ঈশ্বর)-র তৈরি ।।

‘জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে নিহত যদি স্বর্গে যাবে, যজমান কেন তার নিজের বাবাকে হত্যা করে না? [তিনিও তাহলে নির্ঘাত স্বর্গে যেতেন] ।।

‘মৃত জীবদের শ্রাদ্ধ করলে যদি (সেটি তাঁদের) তৃপ্তির কারণ হয়, তবে নিভে-যাওয়া প্রদীপেও তেল দিলে তার শিখা বড় হয়ে যাবে ।।

‘ইহজগত্‌ ছেড়ে যে প্রাণীরা চলে গেছেন, তাঁদের পাথেয় (=পিণ্ড) কল্পনা করা বৃথা, কারণ গৃহস্থের করা শ্রাদ্ধে (তাহলে) পথেই পথিকের তৃপ্তি হতো [তাহলে পাথেয় হিসেবে চাল-চিঁড়ে বয়ে নিয়ে যাওয়ার দরকার হতো না]।।

‘দান করলে যদি স্বর্গবাসী ব্যক্তির তৃপ্তি হতো, তবে প্রাসাদের ওপরে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের (খাবার) কেন এখানেই (মাটিতেই) দেওয়া হয় না?

‘যতদিন বাঁচবে, সুখে বাঁচবে; ধার করেও ঘি খাবে । ছাই-হয়ে-যাওয়া দেহ আবার কোথায় বা, (কোথা থেকে) ফিরে আসে?

‘দেহ থেকে বেরিয়ে যদি কেউ পরলোকে যায়, বন্ধুর প্রতি স্নেহে প্রচণ্ড আকুল হয়ে কেন সে বারবার (ইহলোকে ফিরে) আসে না?

‘ব্রাহ্মণদের বাঁচার উপায় হিসেবেই মৃতদের এই প্রেতকার্য (=শ্রাদ্ধ-অনুষ্ঠান)-র বিধান দেওয়া হয়েছে । এ ছাড়া (এর মধ্যে) আর কিছু নেই ।।

‘তিন বেদের কর্তা (=রচয়িতা) — ভণ্ড, ধূর্ত আর নিশাচর (রাক্ষস) ।

‘জর্ফরী-তুর্ফরী’ [ঋগ্‌বেদ, ১০।১০৬।৬] পণ্ডিতদের বচন বলে পরিচিত (যদিও শব্দগুলি একেবারেই আবোল-তাবোল) ।।

‘(অশ্বমেধ যজ্ঞে যজমানের) স্ত্রী ঘোড়ার লিঙ্গ ধরবেন — এমন বলা হয়েছে । তেমনি ভণ্ডরা অন্য জিনিসও ধরতে বলে । রাক্ষসরাই বলে [যজ্ঞে] মাংস খাওয়ার কথা ।’ (রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর অনুবাদ) ।

তবে আধুনিক গবেষকরা ঐসব আভাণকগুলির সবকটাকেই চার্বাকদের শ্লোক বলে মনে করেন না । সেগুলি জৈন বৌদ্ধদেরও হতে পারে ।

তবে এখানে ব্রাহ্মণদের পরিষ্কার ভণ্ড, ধূর্ত, নিশাচর, কাপুরুষ মাংসখেকো, প্রতারক বলা হয়েছে । যজ্ঞের মন্ত্রকে বলা হয়েছে আবোল-তাবোল । হ্যাঁ, আমাদের ভারতেই ।

ব্রাহ্মণ্যধর্মর ভিত নাড়িয়ে দেওয়া কথা বললে কি বৈদিকরা ছেড়ে কথা বলবেন । তবে বৈদিক পাণ্ডারা অনেক বেশি ধুরন্ধর ছিলেন । তাঁরা লেগে পড়লেন চার্বাকদের মূলগ্রন্থগুলি হাপিস করার কাজে কিন্তু নিজেদের লেখাতেই যে খণ্ডনের জন্যে তাঁরা চার্বাকদের কিছু কথা উদ্ধৃত করে বসে আছেন সেটা সম্ভবত খেয়াল ছিল না । সেই সূত্রগুলো থেকেই চার্বাকদের মত পুনর্গঠন করা হচ্ছে । কিন্তু সমস্যা আছে । বিরোধীরা খণ্ডনের জন্যে প্রায়সই চার্বাক মতকে বিকৃত করেছেন । তাঁদের ইহসুখবাদী প্রমাণ করতে চেয়েছেন । ধার করে ঘি খাওয়া মানে “ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেত্‌” শ্লোকটি সেইরকমই একটি বিকৃতি বলে সম্প্রতি রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য প্রমাণ করেছেন । মূলে শ্লোকটি ছিল:

যাবজ্‌ জীবেত্‌ সুখং জীবেন‌ নাস্তি মৃত্যোর্‌ অগোচরঃ।‌
ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ ।।

যতদিন বাঁচবে, সুখে বাঁচবে; কিছুই মৃত্যুর অগোচর নয় ।
ছাই-হয়ে-যাওয়া দেহ কোথায় (বা কোথা থেকে) আবার ফিরে আসে?

সায়ণ-মাধব তাঁর বইতে চার্বাকদের হেয় প্রতিপন্ন করতে শ্লোকটি করে দ্যান:

যাবজ্‌ জীবেত্‌ সুখং জীবদ্‌ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেত্‌
ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ ।।

যতদিন বাঁচবে, সুখে বাঁচবে; ধার করে ঘি খাবে ।
ছাই-হয়ে-যাওয়া দেহ কোথায় (বা কোথা থেকে) আবার ফিরে আসে?

এইরকম বিকৃতির উদাহরণ আরও অনেক আছে । সত্যিই বদমায়েসি কত রকমের হয়!

নাস্তিকতা বা নিরীশ্বরবাদ শুধু উত্তর ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল না । তা ছড়িয়ে পড়েছিল দক্ষিণেও । দুটি তামিল এপিক, “মণিমেকলাই” ও “নীলকেসী”-তে যথাক্রমে লোকায়ত ও ভূতবাদী নামের দুটি আলাদা ঘরানার বস্তুবাদী মতের কথা পাওয়া যায় । তাঁরাও বিশ্বাস করতেন প্রাকৃতিক উপাদান (ভূত) থেকেই প্রাণের সৃষ্টি হয় ।

এগুলো ছাড়াও নাস্তিকতার এরকম বহু নমুনা বেদ, বেদাঙ্গ, উপনিষদে আছে । মোদ্দা কথা ভারত যেমন একদিকে ভক্তির পীঠস্থান, বিশ্বাসীদের দেশ তেমনি আবার সংশয়ী, নাস্তিক আর বস্তুবাদীদের মাতৃভূমি সেই প্রাচীন কাল থেকে । দুটো বিপরীত সমান্তরাল (অর্থাৎ কখনোই মিলবে না) ধারা বয়ে গেছে প্রাচীন কাল থেকে । শাসন শোষণের সুবিধের জন্যে ধর্ম সবসময়তেই রাজারাজড়াদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছে ।

একদিকে আমাদের ঐতিহ্য, ব্রহ্ম সৎ না অসত্‌, এক না অনেক, চিত্‌ না অচিত্‌ সে নিয়ে তুমুল তক্ক বিতক্ক, জগত্‌ মায়া বা শূন্য কিনা সে নিয়ে বিবাদ-বিসংবাদ, তাল ঢিপ করিয়া পড়ে না পড়িয়া ঢিপ করে তা নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ ।

আবার অন্যদিকে ভারতেই প্রথম শূন্য আবিষ্কার হয়েছিল, তুলো থেকে সুতো তৈরি হয়েছিল, আহ্নিক গতির ধারণার জন্ম হয়েছিল । সম সময়ের তুলনায় ভারতের চিকিত্‌সাশাস্ত্র বেশ উন্নত ছিল । চরক ও সুশ্রুত সংহিতা তার প্রমাণ । (মনে রাখবেন আমি কিন্তু বলেছি তখনকার তুলনায় চিকিত্‌সা বিজ্ঞান অনেক উন্নত ছিল, তার মানে তা এখনকার তুলনায় বেশি উন্নত ছিল না) । বৈদিক ভারতের জ্যামিতির উত্‌স শুল্বসূত্র । সেই জ্যামিতিতে কোণের কোনো ধারণা ছিল না । শুধু বাহু-জ্যামিতির মাধ্যমেই ভারতীয় পিথাগোরাসের সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছিল ।

মজা হচ্ছে দেশের ঐতিহ্য নিয়ে গর্বিত হতে গেলে যে কোনো একটিই বেছে নিতে হবে কারণ দুটি পরস্পরবিরোধী । আমি ঐ দ্বিতীয় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে গর্বিত ।

গ্রন্থসূচি

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য । চার্বাকচর্চা । ন্যাশনাল বুক এজেন্সি । ২০১৭ ।

রাহুল সাংকৃত্যায়ন । দর্শন দিগ্‌দর্শন (দ্বিতীয় খণ্ড) । চিরায়ত । ২০০৮ ।

Bhattacharya, Ramkrishna. More Studies on the Cārvāka/ Lokāyata. New Castle Upon Tyne: Cambridge Scholars Publishing 2020.

Bhattacharya, Ramkrishna. Uddalaka: A Materialist among the Upanisadic Sages, Indian Skeptic, Vol. 12 No. 8, 1999, pp. 7-9.

Bhattacharya, Ramkrishna. More Studies on the Cārvāka/ Lokāyata. New Castle Upon Tyne: Cambridge Scholars Publishing 2020.

Olivelle, Patrick (Ed. and Trans.). The Early Upanisads. New York: Oxford University Press, 1998.

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *