দেশভাগ থেকে করোনাকাল, ভারতবর্ষ হেঁটেই চলে – দীপক সাহা

দেশভাগ থেকে করোনাকাল, ভারতবর্ষ হেঁটেই চলে – দীপক সাহা

শেয়ার করুন

নদিয়ার করিমপুর থেকে মুর্শিদাবাদের ডোমকল যাওয়ার পথ সভ্যতার অত্যাচারে মৃতপ্রায় খড়ে নদীর উপর অস্থায়ী বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে যেতে হয়। দূরত্ব প্রায় ২৩ কিলোমিটার। দিন কয়েক আগে এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় রাজ্য সড়কের দু’পাশে চার-পাঁচটি ছোটো টেন্ট চোখে পড়ল। একটা টেন্টের কাছাকাছি পৌঁছতেই ফেস্টুনে বাংলা হরফে বড়ো বড়ো করে লেখা, ‘চলো যাই কেরালা’। সঙ্গে যোগাযোগকারীর নাম ও মোবাইল নম্বর। অর্থাৎ এরা কেরালায় শ্রমিক সরবরাহ করেন। প্রতিদিন সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে কেরালাগামী বাস ছাড়ছে রাতে এবং বাসভর্তি আমার রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিক চলেছে অন্ন সংস্থানের আশায় ভিনরাজ্যে। করোনাকাল প্রায় দেড় বছর অতিক্রান্ত। দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মানচিত্রের অনেক সমীকরণের বদল হয়েছে কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের দুঃখ, দুর্দশার দিনপঞ্জির কোনো পরিবর্তন হয়নি।

তেলেঙ্গানা থেকে বীজাপুর প্রায় দেড়শো কিলোমিটার পথ। আর মাত্র চৌদ্দ কিলোমিটার অতিক্রম করতে পারলেই পৌঁছে যেত নিজের ছোট্ট কুটিরে। কিন্তু তা আর হল কই! দীর্ঘ পথ হাঁটার শ্রমে পরিশ্রান্ত দ্বাদশী জামলো মাকদাম আর পারল না। এগারো জনের একটি লঙ্কাখেতে কাজ করা দলের সঙ্গে মাকদম তার বাড়ির পথে হাঁটা লাগিয়েছিল। কিন্তু বাড়ি ফেরার সাধ মিটল না। খাবার নেই, জল নেই, পুলিশের নজর এড়িয়ে বনবাদাড় পেরিয়েও ঘরে পৌঁছোনোর আগেই তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল।

লক্ষ, অযুত, নিযুত, কোটি কোটি মানুষ চলেছে। চলেছে বছরের পর বছর। অভুক্ত, খয়াটে চেহারা, কোটরে চোখ, দড়ি-পাকানো হাত-পা, নোংরা পোশাক, শুকনো বুক, কোঁচকানো চামড়া নিয়ে চলেছে। কারা এরা? এই কোটি কোটি মানুষেরা একটি দেশের মানুষ। দেশটার নাম ভারতবর্ষ। রাজপথে হাঁটছে। রেল লাইন বরাবর হাঁটছে। বাস স্ট্যান্ড, রেল স্টেশনে জমায়েতে হাজির হচ্ছে। পুলিশের লাঠির গুঁতো খাচ্ছে। উৎখাত হচ্ছে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে। পথেই ঘর। পথেই যাপন। পথেই মৃত্যু।

শুধুমাত্র বিশ্বাসকে সম্বল করে পথ থেকে পথান্তরে চলেছে। কারণ বিশ্বাস ছাড়া তাদের কিচ্ছু সম্বল নেই। অবিশ্বাস করার শক্তিও নেই, সাধ্যও নেই। তারা বিশ্বাস করে ভিনরাজ্যে গেলে মেয়ের বিয়ে হবে, বাবার অসুখ সারবে, জমি ফিরে পাবে, ফসল ভালো হবে। বিশ্বাস করে ভিনরাজ্যে গেলে পাকা ঢালাই হবে ঘরের খড়ের চাল, জুটবে হাঁড়ির চাল, মায়ের ওষুধ, মেয়ের মিড-ডে-মিলে আধখানা ডিম, ছেলের কলেজ যাওয়া। এইসব ছোটো ছোটো স্বপ্নগুলোকে বুকের পাঁজরে আগলে তারা প্রিয় পরিবার, প্রিয় গ্রাম ছেড়ে পাড়ি দেয় দূর থেকে দূরান্তে, ভিনরাজ্যে, ভিনদেশে।

দেশভাগ থেকে করোনাকাল ভারতবর্ষ হেঁটেই চলেছে। সময় বদলায় কিন্তু মানুষগুলো এক থাকে। ১৯৪৭, ১৯৭১-এর পর আবার সেই মর্মান্তিক হাঁটার দৃশ্য। ৭৪ বছর ধরে ক্ষতবিক্ষত রক্তঝরা শীর্ণ অথচ দৃঢ় পায়ে হাঁটছে পরিযায়ী শ্রমিকদের ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম, ভারতবর্ষের পথে পথে। শুধু ‘নেই’ থেকে ‘আছে’-র দিকে পথচলা। ওদের ‘নেই’ বলেই আছে ভোট, আছে সরকার ও সরকার দখলের লড়াই। ওদের ‘নেই’ বলেই ওরা হাঁটে ব্রিগেডে, দিল্লির রাজপথে, যন্তরমন্তরে, বান্দ্রাতে, আনন্দবিহারে। আবার করোনা ও প্রশাসনের সাঁড়াশি আক্রমণে তারা সেই পথ ধরেই হেঁটেই চলেছে। ভবিষ্যতেও এই ক্ষয়াটে ও রুগ্ন মানুষেরা হেঁটেই যাবে। তাদের অনন্ত যাত্রার গন্তব্যস্থল কৃষ্ণগহ্বর।

দেশবাসী কৃষক লং মার্চের পর এবার দেখল শ্রমিক লং মার্চ। মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে লক ডাউন ঘোষণা হতেই কর্মচ্যুত হয়ে এক প্রকার বাধ্য হয়েই অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক মাইলের পর মাইল দিনে সূর্য, রাতে চাঁদ-তারাদের সাক্ষী রেখে দু’পায়ের উপর ভরসা করে পথে বেরিয়ে পড়ে। ঘরে ফেরার আশায়। অভুক্ত অবস্থায় পরিশ্রান্ত শরীরে অদম্য মনোবলকে পুঁজি করে প্রিয় সন্তানের মুখটা মনে করে আবার কিছুটা পথ পাড়ি। পথে পুলিশের নজর এড়িয়ে চুপিচুপি পা ফেলা। কিন্তু জামলো মাকদামের মতো অনেকেরই আর ঘরে ফেরা হয়নি। পথেই চিরঘুমে ঢলে পড়েছে।

রাজ্যে রাজ্যে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের হা-হুতাশ রাষ্ট্রের কানে পৌঁছোতে অনেক দিন পেরিয়ে যায়। কারণ ছিন্নমূল শ্রমিকরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলতে পারে না। তারা সংঘবদ্ধ হতে শেখেনি। কোনওরকমে মাথা গুঁজে ঘামরক্তঝরা শ্রমের বিনিময়ে এরা পরের দিনের সূর্য দেখার অপেক্ষায় থাকে। সুরাটে, বান্দ্রা স্টেশনে, আনন্দমার্গে পরিযায়ী শ্রমিক জমায়েতে পুলিশি লাঠি চালায়। রাজনীতির বাজার সরগরম হয়। কিন্তু তাদের ঘরে ফেরা আর হয় না।

সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর পরিশ্রান্ত শরীরে তারা গাদাগাদা করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিনরাত গুজরান করে। সোশ্যাল ডিসট্যানসিং তাদের কাছে অর্থহীন। পানীয় জলই জোটে না, আবার সাবান-জল দিয়ে বারে বারে হাত ধোয়া! গা ঘিনঘিনে বারোয়ারি ল্যাট্রিন ব্যবহার করে। কলে কারখানায় বিষাক্ত পরিবেশে নাকমুখ খোলা অবস্থায় কাজ করে চলে ১২ ঘণ্টা ধরে। মাস্ক পড়া তাদের কাছে বিলাসিতা। সরকার মনে করছে পরিযায়ী শ্রমিকরা করোনার ঢিবি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলেই সমূহ বিপদ। কারণ সাম্যবাদী করোনা ভাইরাস শ্রেণিবৈষম্যের লক্ষ্মণরেখা তোয়াক্কা করে না। ফলে মৃত্যুভয় গ্রাস করেছিল সর্বস্তরে। সেজন্যই মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে কোনো সময়-সুযোগ না দিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকসহ সমস্ত ভারতবাসীকে ঘরবন্দি করার ফরমান জারি হয়। পরিযায়ী শ্রমিকরা সরকারের গলার কাঁটা।

লক ডাউনের দেড়মাস অতিক্রম করার পর সরকার নড়েচড়ে বসেছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরাতে। কেন্দ্র না রাজ্য কোন্ সরকার কত শতাংশ ট্রেন ভাড়া দেবে তা নিয়েও অনেক টালবাহানা। পরিযায়ী শ্রমিকদের চরম দুর্দশাকে পুঁজি করে এই সুযোগে রাজনৈতিক দলগুলোও ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছিল। কয়েক কোটি পরিযায়ী শ্রমিক অর্ধাহারে, অনাহারে, সহায়সম্বলহীন অবস্থায় রাতের খোলা আকাশের নীচে, দিশেহারা হয়ে পাগলের মতো পথে পথে ছুটে বেড়াচ্ছে। হাপিত্যেশ করে অপেক্ষা করছে কখন মহামান্য সরকার করুণার বারি বর্ষণ করে তাদের ঘরে ফেরার ব্যবস্থা করবে। অনিশ্চিত বিদেশ বিভুঁইয়ে আর মন টিকছে না। নিজঘর সব মানুষের কাছেই অতি প্রিয়। পরিযায়ী শ্রমিকরা নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে আসলে তাদের উপযুক্ত স্বাস্থ্য ও অন্যান্য পরিসেবা দেওয়ার দায়িত্ব রাজ্য ও কেন্দ্র উভয় সরকারের। একই সঙ্গে খেয়াল রাখা ভীষণ জরুরি ছিল যাতে পরিযায়ী শ্রমিকদের থেকে সংক্রমণ সমাজের অন্য অংশে না ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকরা রাজ্যে ফিরে আসলে তারা একপ্রকার একঘরে হয়ে রইল। অভিযোগ, সমাজচ্যুত অবস্থায় তারা কোভিড হোমে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছিল।

অন্তঃরাজ্য ভ্রাম্যমাণ শ্রমিকরা ভারতের অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করার অন্যতম প্রধান কান্ডারি। দেশের অর্থনীতি সভ্যতার পিলসুজ। তাদেরকে সহজেই আমরা গালভরা শব্দ ‘পরিযায়ী’ তকমা জুড়ে দিই। কিন্তু চরম দুর্ভাগ্য ভিন্ রাজ্যে বা বিদেশে থাকার জন্য রেশন, স্বাস্থ্যবীমাসহ অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা যোজনার বিষয়গুলো থেকে তারা বঞ্চিত। শুধুমাত্র ভোটের সময় তারা কিছুটা জামাই আদর পায়।

কেরল ছাড়া অন্য রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার করুণ ছবি প্রায় একইরকম। কেরল সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের অভিহিত করে ‘অতিথি শ্রমিক’ বলে। উল্লেখ্য কেরলে ‘কেরল মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কারস ওয়েলফেয়ার স্কিম ২০১০ যোজনা’-য় নথিভুক্ত পরিযায়ী শ্রমিক বেশ কিছু সুবিধা পায়। যেসব সুবিধাগুলি কেরলের শ্রমিকরা পায়, পরিযায়ীরাও সেগুলি পায়। যখন বিভিন্ন রাজ্য থেকে পরিযায়ী শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে দেশে ফেরার চেষ্টা করছে, কেরল সরকার আটকে-পড়া শ্রমিকদের ৪৬০৩টি আশ্রয়ে প্রায় ১,৪৪,১৪৫ জন ভিনরাজ্যের ‘অতিথি শ্রমিক’-কে আশ্রয় দিয়েছিল।

মারণ করোনাসুর আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল, পরিযায়ী শ্রমিকদের মৌলিক মানবাধিকারকে অবজ্ঞা করা, তাদের বাস্তব সমস্যার প্রতি অন্ধ থাকা, তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা, কীভাবে সংকটকালে গোটা দেশকে চরম বিপর্যয়ে ফেলতে পারে। আশা করব করোনা পরবর্তী অধ্যায়ে আর্থসামাজিক নতুন সমীকরণে গোঁজামিল দিয়ে আপৎকালীন সমাধান নয় বরং শ্রেণিবৈচিত্র্যেপূর্ণ ভারতবর্ষ প্রকৃত অর্থে সকলের আপনঘর হয়ে উঠবে। নাহলে রাস্তার দু’পাশ ‘চলো যাই কেরালা’ পোস্টারে ছেয়ে যাবে।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২