তালিবান: আন্তঃসাংস্কৃতিক বন্ধনহীনতার ভ্রূণ – সায়ন ভট্টাচার্য

তালিবান: আন্তঃসাংস্কৃতিক বন্ধনহীনতার ভ্রূণ – সায়ন ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

ধর্মই আফগানিস্তানের জাতিসত্তার দৃঢ়তম বন্ধন। আফগানদের প্রায় ৯৯ শতাংশই মুসলিম। এদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ সুন্নি এবং প্রায় ১৫ শতাংশ শিয়া মুসলিম। শহরগুলিতে অল্পসংখ্যক হিন্দু, শিখ, পারসিক ও ইহুদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। ১৯৬০-এর দশক থেকে অনেক আফগান ইহুদি ইসরায়েলে পাড়ি দেয়।

উপরের তথ্যটি আমার নয়–বর্তমানের বিশ্বনাগরিকদের ‘ই-মস্তিষ্ক’ উইকিপিডিয়ার। অর্থাৎ মানবতা নয়, তথ্য যাচ্ছে ধর্মই জাতির বন্ধন। বন্দুকের নল ও জনগণের বন্দিদশা এবং বিপন্ন মানবতা এই মুহূর্তে আফগান যুদ্ধের প্রাক্‌-প্রাথমিক দশা। আফগানিস্তানকে মাঝখানে রেখে, তালিবানকে ‘তুরুপ’ বানিয়ে রাজনৈতিক তাস বাঁটোয়ারা চলছে, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের মধ্যে। এমন সময় শুনছি আফগান প্রেসিডেন্টের চিফ অব স্টাফ মতিন বেকের কণ্ঠে ‘‘ভয় পাবেন না! কাবুল নিরাপদ!’’ যার দুই সপ্তাহ আগে তালেবানরা বিভিন্ন শহর দখলে নিতে শুরু করে৷ বর্তমানে কাবুল ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সব প্রাদেশিক রাজধানীই তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে৷ তালেবানরা ক্রমশ কাবুলের দিকে এগিয়ে আসায় গত কয়েকদিন ধরেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেখান থেকে তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিতে তোড়জোড় চালিয়ে আসছে৷

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল তিনমাসের মধ্যে তালিবানরা আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখলে নিতে পারে৷ এই হুমকিগুলো ঘটনার পরবর্তী সময়ে কীভাবে সামনে আসে? নাগরিক চেতনা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মধ্যে সর্বদাই অসম লড়াইয়ের পরাজয় ঘটছে গণতন্ত্রের।

আটের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল অনেক বাংলাদেশি। ঠিক সেই সময় এই স্লোগান উঠেছিল সেই দেশে। সম্প্রতি আফগানিস্তান দখল করেছে তালিবান। তার জেরে বাংলাদেশের একাংশ তালিবানকে সমর্থন করছে। এতে বাংলাদেশেও নতুন করে ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং জঙ্গি তৎপরতা মাথা চাড়া দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে শেখ হাসিনা প্রশাসন। নাট্যকর্মী ও সাংবাদিক পাভেল রহমান তালিবানের ভয়ে আফগান নাগরিকদের দেশ ছেড়ে পালানোর কাবুল বিমানবন্দরের সেই দৃশ্য বর্ণনা করে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আফগানিস্তানের কাবুল বিমানবন্দরে, একটি বিমানের ভিতরের দৃশ্য এটি। দেশ ছেড়ে জীবন বাঁচাতে পালাচ্ছে। আহা! জীবন। রাজনীতি পুরো বিশ্ব এখন বুর্জোয়াদের দখলে, পুঁজিপতিদের হাতে। রাজনীতি যখন অসুস্থ হয়, তখন দেশ ভালো থাকে না। নিজের দেশ ছেড়ে পালানোর মতো এমন দুর্ভাগ্য কারও না হোক। ক্ষমতার জন্য রাজনীতি নয়, মানুষের জন্য রাজনীতি হোক। প্রিয় বাংলাদেশ, শিক্ষা নাও; ভালো থেকো।’

আফগানিস্তানের সময়কে পরাবাস্তববাদী মনে হলেও আদপে একটা বাস্তব নৃশংস পরিস্থিতি তালিবান আক্রমণের একুশ বছরের সময়কালেই তৈরি হচ্ছিল ভিতরে ভিতরে। তাই মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুরোনো ব্যবস্থা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল এবং গত দুই দশকে যা কিছু গড়ে উঠেছিল তার ধ্বংসস্তূপ পড়ে রইল। যখন তালিবান তার লক্ষ্যের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, সেই সময়েও পশ্চিমি গোয়েন্দাবাহিনী ভবিষ্যদ্বাণী করছিল কাবুল দখল করতে তালিবানের ৩০ দিন সময় লাগবে। কিন্তু তালিবান যোদ্ধাদের কাবুলের প্রেসিডেন্টের প্রাসাদের দরজায় পৌঁছোতে ৩০ ঘণ্টারও কম সময় লাগল। তার আগেই অবশ্য প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি পালিয়ে গিয়েছিলেন। আমেরিকা অবশ্যই কঠিন পরিস্থিতি থেকে দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমেরিকাকে আবার সেই সায়গনের দিনগুলোতেই ফিরে যেতে হল। সেই কূটনীতিকদের হেলিকপ্টারে করে তুলে নিয়ে আসা, আর সমস্ত সংবেদনশীল নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলা। সন্ত্রাস ও পুঁথির মধ্যে সংঘাতটা ঠিক কোথায় লাগে? আপাতভাবে মানুষের মনে হয় একটা অন্ধ ধর্মীয় প্রাচীন বর্বরতা তালিবানদের মধ্যে কাজ করে। তাহলে তো প্রাচীন সম্পদকে আরও বেশি করে বাঁচিয়ে রাখা উচিত। কিন্তু না—আসলে সুশীল সমাজ এটা হয়তো ধারণা করতে ভুলে যায় খুব আধুনিক উপায়ে ধর্মকে শুধুমাত্র শিখণ্ডী দাঁড় করিয়ে চরমপন্থার অমানবিক ব্যবহার কৌশল তৈরি করে। তাহলে আফগানিস্তানের পরিবেশের মধ্যে কোথাও একটা অন্ধত্বের প্রতি বিশ্বাস কাজ করেছে। জন্ম যখন হয়েছে ভ্রূণ সেখানে ছিলই। সেখানে সাহিত্য সংস্কৃতির ভূমিকা সমাজে কী অবস্থায়, একবার দেখা যাক।

হাজারা সাহিত্যের পরিধি খুবই সীমিত। কেননা অনেক কবি ও কথাসাহিত্যিক মাতৃভূমি ছেড়ে বিভিন্ন দেশে অভিবাসন গ্রহণ করেছেন। তারা অভিবাসী দেশের ভাষায় কিংবা ইংরেজিতে সাহিত্যচর্চা করেন। হাজারা বংশোদ্ভূত সমকালীন কবিদের মধ্যে নরওয়েজিয়ান কবি, সাংবাদিক এবং মানবতাবাদী কর্মী কামরান মীর হাজার (জন্ম ১৯৭৬) আন্তর্জাতিক সাহিত্য মহলে সুনাম অর্জন করেছেন। তিনি কাবুল প্রেস এবং রিফিউজি ফেসের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান সম্পাদক। তিনি একাধিক কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা। তার সম্পাদনায় ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘Poems for the Hazara: A Multilingual Poetry Anthology and Collaborative Poem’ কাব্য সংকলন। এ সংকলনে ১২৫টি দেশের ১৬৮টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং সব কবিতাই ছিল হাজারাদের দুর্দশা নিয়ে রচিত। কেননা তাদের প্রগতিশীল ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে তারা বারবার গণহত্যা, দাসত্ব এবং জোরপূর্বক স্থানচ্যুতির শিকার হয়েছে।

তাহলে সরাসরি সাহিত্যকর্মীদের আপন মাতৃভূমির পরিসরে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের পাঠ করার সুযোগ তারাই পাচ্ছে যারা সমাজের বিত্তশালী অংশের সদস্য।

হাজারা বংশোদ্ভূত অভিবাসী কবিদের মধ্যে যারা সুনাম অর্জন করেছেন, তারা হলেন আলী বাবা তাজ (জন্ম ১৯৭৭), মহসীন চাঙ্গেজি (জন্ম ১৯৭৯) এবং বসির আহাং (১৯৮৪)। পাকিস্তানের অভিবাসী উর্দু কবি আলী বাবা তাজ কবিতায় নাজম শৈলী ব্যবহারের জন্য অত্যন্ত পরিচিত। সাংবাদিক ও ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র নির্মাতা শারমীন ওবায়িদ চিনোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘কবিতা হলো জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার, যা জীবন আমাকে দিয়েছে। কবিতা আমাকে সব সময় কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে এবং এটি আমার জন্য এক ধরনের সমর্থন। আমার জন্য কবিতা যদি না থাকত, তাহলে আমি হারিয়ে যেতাম। আমি কবিতার মাধ্যমে ভয়, উদ্বেগ, আশা, সুখ এবং দুঃখ প্রকাশ করি। কবিতাই আমার আশ্রয়।’ অন্যদিকে কবি, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মী বসির আহাং বর্তমানে ইতালিতে থাকেন। এছাড়া ফার্সি ভাষায় কবিতা রচনা করেন হাজারা কবি সৈয়দ আবুতালিব মোজাফ্ফরি (জন্ম ১৯৬৬)।

সমকালীন হাজারা কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে জাবেদ খাভারি (জন্ম ১৯৬৭) এবং মোহাম্মদ হুসেইন মোহাম্মদী (জন্ম ১৯৭৬) আন্তর্জাতিক সাহিত্যাঙ্গনে একটি পরিচিত নাম। বর্তমানে তারা ইরানের অভিবাসী। জাবেদ খাভারি তার লেখায় হাজারাদের জীবনের বিভিন্ন নেতিবাচক ইতিহাস তুলে ধরেন। এরই মধ্যে তার একাধিক গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। লেখালেখির স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০০৪ সালে ‘কালচারাল প্রাইজ অব আফগানিস্তান’ লাভ করেন।

সাংস্কৃতিক কর্মীরা সুশীল সমাজের সৈনিকের ভূমিকা পালন করেন। আপাতভাবে বিশ্বায়ন যে সার্বভৌম সংস্কৃতি ভেঙে দিচ্ছে তলায় তলায়—নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে বাধ্য হয়ে সরে যাওয়া আবার ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে দেশান্তর একটা দেশকে ভিতর থেকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২