আশাকর্মী – রিনি গঙ্গোপাধ্যায়

আশাকর্মী – রিনি গঙ্গোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

সকাল থেকে এই নিয়ে প্রায় দশটা ঘর ঘোরা হয়েছে। কম বেশি প্রত্যেকটা বাড়িতেই একই কথা বলতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যোজনা, পোলিও, প্রেগনেন্ট মায়েদের নানা নির্দেশাবলী, কন্ডোম, আইপিল, কন্যাভ্রূণের জন্মের খরচ সরকারের ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্যই শর্তাবলী প্রযোজ্য। সুমিত্রার কষের পাশে ফেনা জমে উঠেছে। জল তেষ্টা পেয়েছে। খিদেও লেগেছে একটু। সেই কখন ঘর থেকে একটু চিঁড়ে লেবু দিয়ে মেখে খেয়ে বেরিয়েছে। তারপর থেকে পেটে দানাপানি নেই। তার ওপর আবার এই শীতেও রোদ এমন চড়া হয়ে উঠেছে যে গায়ে চাদর রাখা যাচ্ছে না। সুমিত্রা চাদরটা খুলে ওড়নার মতো দু কাঁধের ওপর ফেলে রাখে। বোতল থেকে বের করে জল খায়। খিদেটা যেন আরো বেশি করে জানান দিচ্ছে। এখন তো খাওয়াদাওয়ার দিকে একটু নজর দিতে হবে। যদিও মাত্র দুমাস। তবু এখন তো দুটো পেটের খাবার তাকে খেতে হবে। ভাবতেই তার গালে একটু যেন লাল আভা খেলে গেল। না কি চড়া রোদ তার কালো গালদুটোকে টকটকে করে তুলেছে ঠিক বোঝা গেল না। 

সুমিত্রার মনে হলো একটু জিরোতে পারলে ভালো হতো। এই বস্তি অঞ্চলটা পেরিয়ে একটু এগোলেই একটা বড়ো হাউসিং সোসাইটি। ওখানে এক মাসিমা,মেসোমশাই থাকেন। তাদের বাড়িতে অবশ্য সুমিত্রার দরকার থাকার কথা নয়। তবু সব বাড়িতেই সার্ভে করতে হয় বলে তাদের বাড়িতেও গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল সুমিত্রা। খুবই ভালো ওরা। বাড়িতে কেউ এলে না খাইয়ে ছাড়েন না। বারকয়েক গিয়েছে সুমিত্রা ওই বাড়িতে। প্রত্যেকবার মাসিমা কিছু না কিছু খাইয়েছেন। কখনো মিষ্টি , কখনো মুড়ি তরকারি। কিছু না থাকলে বিস্কুট। বলেন, খাও। এতো ঘুরে ঘুরে কাজ। খিদে পায় তো!

উত্তরে সুমিত্রা শুধু হেসেছে। মনে মনে ভেবেছে এমন করে অন্যের খিদে বোঝার মানুষ এখনো আছে! নয়তো কিছু কিছু বাড়িতে তো তাকে বা তার মতো কাউকে দেখলে বাড়ির ভেতরে আসতেও বলে না। দরজা থেকেই কোনোরকমে উত্তর দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। আজ এই প্রচণ্ড খিদের মুহূর্তে ওই বাড়িটার কথাই মনে এলো তাই সুমিত্রার। বস্তির অলিগলি, নোংরা পেরিয়ে হাইরাজটার সামনে দাঁড়িয়ে সুমিত্রা একটু বড়ো করে শ্বাস নিল। পেটে বাচ্চাটা আসার পর থেকেই তার একটু ফাঁকা জায়গায় হাত পা ছড়িয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ইচ্ছে করছে। একটু নরম গদিতে ঘুমোতে ইচ্ছে করছে! কিন্তু উপায় কী! সেই তো বস্তির একটি ঘর তারও গন্তব্য। শুধু ঘরটা তার বিয়ের আগে পল্টু বাঁধিয়ে দিয়েছিল। এই হাইরাজটার যে কটা ঘরে সে ঢুকতে পেরেছে দেখেছে কত বড়ো বড়ো ঘর। কত বড়ো বড়ো জানলা, রোদ,আলো হাওয়া। কেমন খোলামেলা! তাদের ঘরগুলোর মতো ঘুপচি, অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে নয়। ইসস্, যদি ওরম একটা ঘরে থাকা যেত! বেশি না, বাচ্চাটা হওয়া অবধি। ভাবতে ভাবতেই সুমিত্রা হাজির হলো মাসিমার ফ্ল্যাটটার সামনে। দরজা খোলার পর কিন্তু সুমিত্রা অবাক হলো। দরজা খুলেছে মাঝবয়সি এক মহিলা। মাথায় কাঁচা পাকা চুল। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। হ্যাঁ বলুন?

সুমিত্রা খানিক হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে মাসিমা? 

মহিলার মুখের ভাবের যেন সামান্য পরিবর্তন হয়। বলেন, উনি তো নেই। আপনার কী দরকার আমাকে বলতে পারেন। 

ও, আমি সুমিত্রা। আশাকর্মী। বাচ্চাদের পোলিও দেওয়া হবে তাই জানাতে এসেছিলাম। 

ও, আচ্ছা। কিন্তু এ বাড়িতে কোনো বাচ্চা নেই। 

সুমিত্রা বলে ওঠে, জানি। কিন্তু এ বাড়িতে মাসিমা মেসোমশাই থাকতেন? ওরা কোথায়?

মা তো মারা গেছেন। বাবা আছেন। 

ব্যাস, সুমিত্রা এবার নিজে থেকেই জুতো খুলে ঘরে ঢুকে পড়ে। মাসিমা মারা গেছেন! আমি জানি না তো! বেশ কয়েকদিন এদিকে আসা হয়নি। আসলে ওই বস্তিটাতেই আমাদের কাজ বেশি থাকে তো! মেসোমশাই কোথায়?

মহিলা সুমিত্রাকে একটি ঘরে নিয়ে যায়। মেসোমশাইয়ের সঙ্গে সুমিত্রার কথা হয়। জানা যায় ভদ্রমহিলা মেসোমশাইয়ের ছেলের বউ।  ও, আপনাকে তো কোনোদিন দেখিনি?

আমি এখানে উইক এন্ডে আসি। 

ও, আপনাদের বাচ্চা?

আমাদের কোনো ইস্যু নেই।

বাচ্চা নেই! সুমিত্রা যারপরনাই অবাক হয়। মহিলার তো বেশ ভালোই বয়স হয়েছে। এখনো বাচ্চা নেয়নি!

সুমিত্রা প্রেগনেন্ট মহিলাদের যা যা নির্দেশাবলী দিতে বলা হয়েছে সেসব আওড়ে যায়। মহিলা মন দিয়ে শোনে। 

তারপর সুমিত্রার কেমন মনে হয় এরা বোধহয় বাচ্চা নেবে না। এতো বয়স হলো! এখনো যখন নেয়নি! সুমিত্রা তখন কন্ডোম, আইপিল এসব বিনামূল্যে বিতরণের কথা বলে। মহিলা তাও শোনেন। কিন্তু কিছুই বলেননা। 

মেসোমশাইও কেমন চুপচাপ বসে থাকেন। কোনো কথা বলেন না।

সুমিত্রা শেষপর্যন্ত খাতা বার করে নাম, বয়স,ফোন নম্বর এসব লিখে নেয়। নিজের ফোন নম্বর দেয় ওদের। আপনি কখনো বাচ্চা নিতে চাইলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। কন্যাসন্তানের জন্মানোর সব খরচ সরকারের।কন্যাভ্রূণ হত্যা আটকানোর জন্য এসব করা হচ্ছে। সুমিত্রা আরো নানা কথা বলে। টাকার অঙ্ক কত জানায়। মহিলা কোনো উত্তর করেননা। কিছু খাওয়ার কথাও বলেননা। সুমিত্রা আর কি করে! বেরিয়ে আসে।

কিছুদিন পর রাতে পল্টু আর সুমিত্রার কথা হচ্ছিল। কাল তোমার ইউএসজি করানোর কথা তো?

হ্যাঁ। কালকেই তো ডেট।

ডাক্তারের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেনিও। যা বলতে বলেছি মনে আছে তো।

আরে ওসব ডাক্তারকে বলে লাভ নেই। নার্সদিদির সঙ্গে কথা বলতে হবে। 

ও, নার্স, ঠিকমতো বলতে পারবে তো?

নার্সদিদিরাই তো বলে দেয়। পাশের গলির বিকাশদার বৌকে তো নার্সদিদিই বলে ব্যবস্থা করে দিল। 

ও। পল্টু সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়। তাকে বেশ চিন্তিত দেখায়।

 পরদিন সুমিত্রা সকাল থেকে হাসপাতালে লাইন দিয়ে বসে আছে। পেচ্ছাপ চেপে এভাবে কতক্ষণ বসতে হবে কে জানে! হাসপাতালে আজ বেশ ভিড় রয়েছে।

ইতিমধ্যে সে নার্সের সঙ্গে কথা বলে এসেছে। সঙ্গীতাদি বলেছে, চিন্তা করিসনা। আমি বলে দেব।

কিন্তু পেচ্ছাপ যে আর ধরে রাখতে পারছেনা সুমিত্রা। এবার মনে হচ্ছে বেরিয়ে যাবে। কেমন হাঁসফাঁস করছে তার। সঙ্গীতাদিকে গিয়ে বারবার তাড়া দিতে থাকে সুমিত্রা। 

অবশেষে ইউএসজি শেষ করে সে সোজা বাথরুমে দৌড়োয়। পল্টু এই পুরো সময়টা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল আর একনাগাড়ে বিড়ি খাচ্ছিল। সুমিত্রা ফিরে এসে তাকে খবরটা দেয়, মেয়ে। 

পল্টু বিড়িতে একটা লম্বা টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তাহলে? এবার? 

সঙ্গীতাদি রাতে ফোন করতে বলেছে।

রাতে সঙ্গীতা জানায়, শোন, তোর মিসক্যারেজের রিপোর্ট আমি তৈরি করে দেব। ডাক্তারবাবুকে বলে রেখেছি। অ্যাবরশান হয়ে যাবে। দশ হাজার মতো লাগবে।

সুমিত্রা নিশ্চিন্ত হয়। পল্টুও। বাচ্চা আসার পর থেকেই ওদের দুজনের এই একটাই চিন্তা ছিল। মেয়ে হলে কী হবে! বড়ো করো রে, বিয়ে দাও। শুধু খরচ আর খরচ! খুব বেশি হলে কী আর করবে! তার মতো আশাকর্মী হবে! তার বেশি তো নয়। সরকার তো জন্মের সময়ের খরচটা দিয়েই খালাস। সারাজীবন টানবে কে! প্রথম বাচ্চা ছেলে হলে ভাগ্য ফিরে যাবে বলেছিল ত্রিকালদর্শী বাবা! সেটা এভাবে নষ্ট হতে দেওয়া যায় না কি!

মাস কয়েকপর সুমিত্রার ফোনে একটি অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসে। 

আমি সাউদার্ন হাইরাইজ থেকে মিসেস পোদ্দার কথা বলছি।

কে? মানে ঠিক চিনলাম না তো! সুমিত্রার গলার আওয়াজ ক্লান্ত, অসুস্থ শোনায়। 

ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠ বলে ওঠে আপনি এই হাইরাইজে যে মাসিমা মেসোমশাইয়ের বাড়িতে আসেন আমি তাঁদের ছেলের বউ বলছি। 

সুমিত্রা বিরক্ত হয়। এই সময় এই ফোন! তার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। এমনিতেই আজ চার মাস সে বিছানায় পড়ে আছে। কোনো কাজ করতে পারে না। আশাকর্মীর কাজটা তার আছে না গেছে তাও সে জানে না। অ্যাবর্শনের পর থেকে সে আর উঠতেই পারছে না। তার ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছে না। অ্যাবর্শনের সময় জরায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আসলে ডাক্তারটাই পাজি। এমন বেঁকে বসল শেষমুহূর্তে! সঙ্গীতাদি নিজে করতে গিয়ে গোলমাল করে ফেলল।

ওদিকে ফোনে নারী কণ্ঠ আবার বলে ওঠে, চিনতে পারছেন! 

হ্যাঁ, বলুন।

আপনার সঙ্গে একটু দরকার ছিল। কথা বলা যাবে?

হ্যাঁ, বলুন। সুমিত্রার গলায় বিরক্তি ঝরে পড়ে।

এভাবে না। আপনি একবার আসতে পারবেন!

না, আমার শরীর খারাপ। 

ও, কী হয়েছে? 

বাচ্চা নষ্ট হয়েছে!

সে কী? কীভাবে?

সুমিত্রা এবার একটু থমকায়। কী বলবে ভেবে পায় না।

ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠ আবার বলে ওঠে, আপনার সঙ্গে দেখা করা যায়? আপনার বাড়িতে যদি যাই!

সুমিত্রা এবার একটু ঝাঁঝিয়ে বলে ওঠে, কী দরকার বলুন।

মহিলা খুব শান্ত গলায় বলেন, আপনার সঙ্গে দেখা করে বলব। ফোন কেটে যায়।

পরদিন টিনের দরজায় ঠকঠক শুনে পল্টু দরজা খুলে দেখে এক মাঝবয়সি মহিলা দাঁড়িয়ে আছে।জিন্স পরা, চোখে চশমা, মাথায় কাঁচা পাকা চুল। সুমিত্রা আছে?

হ্যাঁ, আপনি?

ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল। একটু দরকারে এসেছি।

ও, আসুন।

সুমিত্রা বিছানায় আধশোয়া হয়ে এতক্ষণ দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার উঠে বসতে চেষ্টা করে।

মহিলা বলেন, আমি এসেছিলাম আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে। আমি একটি এনজিওর সঙ্গে যুক্ত। সেই সূত্রেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আশাকর্মী হিসেবে কন্যাভ্রূণ হত্যা বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন? বাবা- মায়েরা কতটা সচেতন? বিশেষত এই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে এই বিষয়ে সচেতনতা কতটা বলে আপনার মনে হয়? 

মহিলার কথার মাঝখানেই সুমিত্রা বলে বসে ওসব আপনাদের মতো বড়োলোকেদের বাড়িতেই বেশি হয়। আমরা তো বাচ্চাকে ভগবান মনে করি। সে ছেলে হোক আর মেয়ে হোক!

আচ্ছা, তার মানে আপনার অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত তথাকথিত শিক্ষিত পরিবারগুলোতেই এই প্রবণতা বেশি! এটা কেন বলে আপনার মনে হয়?

সে আমি জানি না। দেখুন ম্যাডাম আমি অসুস্থ। আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না। 

হ্যাঁ, তাইতো । আপনি তো কাল বললেন, আপনার বাচ্চা নষ্ট হয়েছে। আই অ্যাম সো সরি। কী করে হল এমন?

ওই পড়ে গেছিলাম।

পড়ে গেছিলেন! ওহো… কত মাসের প্রেগনেন্সি ছিল আপনার? 

সাড়ে তিন মাস।

খুবই দুঃখজনক। অ্যাবর্শন হয়েছে?

আরে ওই অ্যাবর্শন করতে গিয়েই তো… বলেই সুমিত্রা মনে মনে জিভ কাটে। না মানে…

মহিলা সুমিত্রাকে দেখেন। তার তোতলানো খেয়াল করেন। তারপর খুব কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করেন, মেয়ে ছিল? তাই!

সুমিত্রা কথা বলতে পারে না। মাথাটা নীচু হয়ে যায় আপনা থেকেই। 

আপনি না একজন আশাকর্মী। আপনি নিজেই… ছিঃ।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশের একটা দল ঘরে ঢোকে। পল্টুকে ওরা গ্রেফতার করেছে।

মহিলা বলেন, শুনুন, হসপিটালে বহুদিন ধরেই একটা রাকেট চলছে। সে খবর আমাদের কাছে আগেই ছিল। সঙ্গীতা সরকার বলে একজন নার্সকে এ ব্যাপারে আটক করা হয়েছে। আপনাকেও আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। 

সুমিত্রা হঠাৎ কেঁদে ফেলে। ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম।

 আপনি আধা সরকারি কর্মী হয়ে যে কাজ করেছেন তার কোনো ক্ষমা নেই। আপাতত আপনি পুলিশ হেফাজতে হাসপাতালে ভর্তি থাকবেন। সুস্থ হলে আদালতে পেশ করা হবে। 

সুমিত্রা হাত জোড় করে মিনতি করে। মহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে যান।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২