পারফিউম: একটি প্রেমের গল্প – কৌশিক বাজারী

পারফিউম: একটি প্রেমের গল্প – কৌশিক বাজারী

শেয়ার করুন

আলো অন্ধকার মাখা একটা সন্ধে উপর থেকে নেমে এসে জমির কিছুটা উপরে ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে কিছুক্ষণ থেমে আছে যেভাবে অচেনা পথিক হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে নতুন গলিপথ চিনে নেয়, তারপর গলির বাঁকে এগিয়ে গিয়ে মিলিয়ে যায়, আর দ্রুত অন্ধকার নেমে এসে রাত হয়ে যায় ছাদের চারপাশ।

সমীরণ বিছানা থেকে উঠে ছাদের ঘর ছেড়ে বাইরে ছাদের কিনারে এসে দাঁড়ায়।

এখন মফস্‌সল শহরের মাথায় মহামারির আকাশ ঝকঝকে হয়ে থাকে। পূর্ণিমায় চাঁদের পাহাড় আর তার কালো ছাইরং ক্ষত দেখা যায় বহুকাল আগের মতো। অজস্র নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়েছে এর মধ্যে, যাদের ভুলে গিয়েছিল মানুষ। অথবা মানুষ আদৌ কোনো নক্ষত্রকে মনে রাখে কিনা জানা যায় না। চাঁদের খুব কাছে একটা ঊজ্জ্বল তারা দেখা যাচ্ছে এখন। ওটা কি বৃহস্পতি? স্থির ও উজ্জ্বল। তার নীচে, অনেক নীচে, মানুষের পৃথিবীতে পুনরায় সেই আদিম অসহায়তা ছড়িয়ে পড়ছে। দূরত্ব বাড়ছে, এতদিন ভেতরের দূরত্বের কথা ভুলে ছিল মানুষ, এখন এক মহারূপকের মতো তা সর্বজনীন হয়ে পথেঘাটে ছড়িয়ে গেল। কোনো অতিথি, আত্মীয়, বন্ধু, কোনো মানুষের আলিঙ্গন আর বিশ্বাসযোগ্য নয়। সভ্যতা এক অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে? সমীরণ এক নির্মল বাতাসের নীচে দম চেপে আকাশে তাকায় বহুদিন পর। হঠাৎ রেবতীর কথা মনে পড়ে তার। রেবতী নামে বইয়ে পড়া এক নক্ষত্রকে খোঁজে।

ছাদ থেকে নেমে এসে শ্রীতমার ঘরে উঁকি মারে। দেয়ালে আটটা দশ বাজছে একটা ঘড়িতে। ‘আমি বেরোচ্ছি একটু’। শ্রীতমা একবার চোখ তুলে ফের বই-খাতা-ফাইল-ল্যাপটপে ডুবে যায়।

সমীরণ রাস্তায় নামে। মোড়ের মাথায় গোপালের গুমটিতে একটা সিগারেট জ্বালায়। এখানে গলি শেষ হয়ে বড়ো রাস্তা শুরু। শীতের মফস্‌সল-রাস্তা আটটায় শুনশান। তাছাড়া মহামারির আতঙ্ক মানুষকে ঘরবন্দি করেছে, সে-ও কত মাস হয়ে গেল। এ-ও এক অভ্যেস। চাদর গায়ে পেঁচিয়ে সমীরণ একটা বুক ভর্তি টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। শ্রীতমা তো কিছুই জিজ্ঞেস করল না! সে কি তাকে ঘৃণা করে এখন? ঘৃণা এক বিষম বস্তু। যা নিজেকেই কুরে- কুুুরে খায়। আমার মস্তিষ্ক আমাকেই মেরে অচেতন করে ফেলে রাখে। এই চল্লিশোর্ধ্ব জীবনে (বছর পাঁচেক পর তো পঞ্চাশ হয়েই যাবে, তাই চল্লিশোর্ধ্ব বললে একটু কম কম শোনায়) আমার এখনও তেমন কেউ ঘৃণার মানুষ নেই। সমীরণ ভাবে। খুব ছোটোবেলার কিছু স্মৃতি আছে তার মনের ভেতর। ভাবলে, ঘৃণ্য সেসব জগৎ দ্রুত উঁকি দিয়ে মিলিয়ে যায় এই মধ্যবয়সে। সেটুকুই ঘৃণার অনুভূতি।

সমীরণের অলস শুয়ে থাকার মাঝে কখনও একঝলক মনে হয়—কিন্তু আমিও কি কারো কারো ঘৃণার পাত্র নই? সে জানে না, এই চিন্তাও যেহেতু মানুষের মনে স্থায়ী হতে পারে না, তাই দ্রুত ভুলে যায় সে। ঘৃণার কথা তাই তার মনে স্থায়ী হয় না কখনও।

ঘৃণার উলটোদিকে কি প্রেম? নাকি ভালোবাসা? নাকি স্নেহ? বন্ধুত্ব? আরও হালকা-গাঢ় শেডের সম্পর্ক সকল, অথবা সবগুলিই? ভাবলে আশ্চর্য লাগে! এই এতজনের বিরুদ্ধে লড়ে একা ঘৃণা, একেক জনের মস্তিষ্কে জিতে যায়। দিবারাত্র তাদের মস্তিষ্ক ঘৃণার উপনিবেশ হয়ে দাউদাউ জ্বলতে থাকে। আর মানুষটি সেই উত্তাপ নিতে নিতে জীবন পার করে দেয়। প্রেম-ভালোবাসা-স্নেহ সমস্ত দাউদাউ জ্বালিয়ে তারা একা ঘৃণাকে ভালোবসে রোগা হয়ে যেতে থাকে। সেই রোগা মানুষগুলির প্রতি হয়তো তার প্রেম জাগে, স্নেহ জাগে, কিন্তু ভয়ংকর তেজস্ক্রিয়তার কারণে সমীরণ তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারে না।

সে মনে মনে একবার শ্রীতমার মুখটা ভাবে। তার হাস্যোজ্জ্বল চোখের মণি যা প্রেমের তীব্র আকুতিতে ছোটো হয়ে বুজে আসত আর তীব্র এক আলো ঠিকরাত চারপাশে, সেই শ্রীতমাই যখন মাথায় আগুন জ্বেলে সামনে এসে দাঁড়াত, তার চোখে আর চোখ রাখা যেত না। তার গরল অসহ্য মনে হত। সমীরণ তখন মনে মনে শ্রীতমার থেকে বহুদূরে কোনো মেঠো পথে একা হেঁটে যাচ্ছে। শ্রীতমা তার আত্মাহীন শরীরের সামনে দাঁড়িয়ে বিষ ওগরাতে ওগারেতে কোনোদিন তা টেরও পেল না।

‘একটু বেরোচ্ছি’ বা ‘আর কতক্ষণ ল্যাপটপে ঘাড় গুঁজে থাকবে’ ইত্যাদি কথায় আজকাল শ্রীতমা আর কথা বলে না বিশেষ, মুখ তুলে একবার চায় মাত্র। খুবই কেজো আর উত্তাপহীন হয়ে আছে তারা। রাত্রে যেদিন শরীর ডাকে, দুজনেই কাছে আসে, অভ্যেসের মতো নগ্ন হয়, মিলিত হয়, খুব সহজ পদ্ধতিতে পরস্পর প্রবেশ করে, দশ পনেরো কুড়ি মিনিট পর নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। নারী ও পুরুষের ভেতরের সৃজন নিভে আসে। কোনো আতর, কোনো সুগন্ধ নেই সেখানে। রাত গভীর হয়ে যায় তাদের পরিত্যক্ত দাম্পত্যের উপর। অনেক উপরে, ছাদ পেরিয়ে, মেঘের ভেতর চাঁদ ওঠে বহু পুরোনো। তাদের জন্মেরও বহু আগের, আদিম জ্যোৎস্না শহুরে আকাশের বাতাবরণ ভেদ করতে না পেরে ঝুলে আছে কত বছর কে জানে।

এদিকটায় অন্ধকার বেশি, রাস্তায় মিউনিসিপ্যালিটির আলো কম। একটা বাড়ির আধখোলা জানলার আলো এসে পড়েছে রাস্তার পাশের একটা অন্ধকার ঝোপে। কিছু দূরে একটা লোহার বিদ্যুৎখুঁটি থেকে একটা হলুদ বাল্‌ব ঝুলে আছে। যেন বহুকাল আগের আলো। এরকম ভাঙা দৃশ্যের মাঝে এসে দাঁড়ালে বোঝা যায় না এটা কোন্ সাল, কোন্ যুগ? সময় ভেঙে যায়। সমীরণ একটা সবুজ, রং খুবলে যাওয়া, অনেকদিনের পুরোনো দরজার সামনে আনমনে থমকে দাঁড়ায়। পুরোনো দরজার মাথায় বিশ বছর আগের একটা অশ্বত্থচারা ডাল বাড়িয়েছে।

সমীরণ তখন সদ্য স্নাতকোত্তর শেষ করেছে। একটা দুটা বাড়ি সকাল সন্ধে পড়ায়। কলেজের বাংলা পড়া পড়াতে গিয়ে তার মাথায় বাংলা কবিতার একটা খোঁচ গেঁথে যায়। খোঁচ দিয়ে কবিতা লেখা যায় না। কিন্তু কবিতার বদরক্ত চামড়ার তলায়, খুলির অল্প উপরে জমে থাকে। যা আজীবন থেকে গিয়ে অভ্যেসের মতো হয়ে যায় কারও কারও। মাঝে মাঝে রক্তপাত হয়। আবার ভুলে যায়। কিন্তু বাংলা পড়ানো হয়তো কোনো কারণ নয়, আরও বহু আগেই তার কারণ কোথাও নিহিত ছিল, কিছু অক্ষর তাকে উসকে দেয় মাত্র। তখন অল্প বয়সে সে খাতায় লিখে ফেলত সেসব অক্ষর। এখন আর আসে না সেসব। শুধু তার মাথার ভেতর টাইম-স্পেস ভেঙে যায় মাঝেমাঝে। সে ভাঙা একটা অসময়ের ভেতর দাঁড়িয়ে নিজেকে হাতড়ায় তখন। তার সামনে সবুজ রং খুবলে যাওয়া একটা সবজে দরজা। হাতের সিগারেট ফেলে সে চাপ দেয়।

অল্প চাপ দিতেই একটা ধাতব শব্দে দরজা খুলে যায়। সামনে লম্বা স্যাঁতসেঁতে একটা অন্ধকার পথ। দুদিকে দেয়াল। বহু পুরোনো ইঁটের গাঁথুনি। সমীরণ জানে, যদিও অন্ধকারে এসব কিছুই দেখা যায় না।

অল্প এগিয়ে গেলে আলো ফুটে ওঠে ওধারে। আকাশে অন্ধকার ভারী মেঘ থেকে দু ফোঁটা শীতের জল পড়ে সমীরণের গায়ে। সে শিউরে ওঠে। সামনে, আধো অন্ধকার সিঁড়ির বাঁকে একটা কুড়ি বছর পুরোনো ডুম জ্বলছে। শেষ ধাপে সে দাঁড়িয়ে, যেন অপেক্ষায় ছিল, যেন জানত সমীরণ আসবে এই শীতের সন্ধ্যায়। একটা দমকা হিম হাওয়া এসে সমীরণের গায়ের চাদর এলোমেলো করে দেয়। সমীরণের ভেতরে কেউ তাকে অন্ধকার রহস্যের দিকে ঠেলে দেয়।

সেদিন বাড়ি ফিরে সমীরণের ডায়ারির এন্ট্রিতে লেখা হবে—
মেঘে মেঘে আকাশ ঘনালে, আমি এত ভয় পাই কেন! গতজন্মের কোনো স্মৃতি কাজ করে? গতজন্মের হলে তাকে স্মৃতি বলা যাবে? আমি জন্মান্তর মেনে নিলাম। এক জন্ম অপছন্দ হলে অন্য জন্মে যাওয়া যাবে অনায়াসে… এজন্মের মেঘ, অন্য জন্মে ছেড়ে এলাম, তার আকাশ ও নদীঘাট রেখে এলাম, যদি কোনোদিন ফিরে আসি, ঘন আকাশের নীচে, হাওড়ের জলের ভেতরে…’

তখন পাশের ঘরে শ্রীতমা ফোন ধরে ফোঁপাতে থাকে।

‘আমি আর পারছি না সুবাস! এই বদ্ধ গুমোট থেকে বেরোতে চাই। কী করব! আমাকে বলে দাও?’ সুবাস শ্রীতমার কলেজের বন্ধু। এই শহরে পুরোনো বন্ধু বলতে এই একজনই, মাথার ভেতর ঝড় উত্তাল হয়ে উঠলে যাকে ফোন করে সব বলে ফেলা যায়। সুবাস এসবে অভ্যস্ত। তার পেশাগত দক্ষতায় সে মানুষকে শান্ত করে ফেলতে পারে। শ্রীতমার সমস্যাটা সে জানে অনেকদিন যাবৎ।

মুখে বলে—ধৈর্য রাখো। সমীরণ ফিরেছে?

—হ্যাঁ, নিজের ঘরে, টেবিলে উবু হয়ে কি লিখছে ভগবান জানে…

শ্রীতমা ফোন রেখে একবার উঁকি দেয়। দেখে সমীরণ তার লেখার ভেতর বসে আছে।

—খাবে না?

—হুঁ

—আচ্ছা। টেবিলে রইল।

—হুঁ

সমীরণ ফের ডুবে যায়…

প্রবল শীত বাতাসে এলোমেলো গায়ের চাদর একবার জড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে যায়। সিঁড়ির বাঁকে তাকে অনুসরণ করে সমীরণ। কুড়ি বছর পুরোনো একটা ডুমবাতির নীচ দিয়ে সে দোতলায় উঠে আসে। টানা বারান্দায় বোগেনভেলিয়ার ঝাড় উঁকি দিচ্ছে অন্ধকারে। একটা খুব চেনা গন্ধ বাতাসে ভেসে আসছে, কীসের গন্ধ! বারান্দার শেষ মাথায় ঘরের ভেতরে সে হাতছানি দেয়। আধো অন্ধকারে ভেতরে ঢুকতেই ঝাপটা মারে সেই আতরের গন্ধ। বিশ বছর আগে রথের মেলায় কেনা এক মুসলমান ফকিরের কাছে নীল রঙের ছোট্ট কারুকাজ করা শিশি, চকিতে মনে পড়ে সেই গন্ধ। সমীরণের শরীর অবশ হয়ে আসে। মাথার ভেতরে ঝিমঝিম। জানালার বাইরে মহাকাশ থেকে আসা অন্য গ্যালাক্সির আলোয় সে দেখে বন্ধ দরজার ভেতর কিশোরী ভেনাস, তার শেষ সুতো খুলে আলনায় রাখছে। সমীরণের আলগা পাজামার ভেতর ঘুর্ণি মোচড় দিয়ে ওঠে। বহু পুরোনো এই ঝড়, সে টের পায়, সমস্ত তছনছ করতে করতে এসে পড়ছে ঘরের মেঝেতে, টেবিল শূন্যে ভাসমান, ভেনাস তার ঝড়ের উপর হাত রাখে, পাজামা খসে পড়ে, উত্থিত স্তম্ভের চুড়ায় মেঘ জমে। ভাসমান টেবিল দেয়ালে ধাক্কা খায়। মৃদু আলো আর ঝড়ের দাপটে সে দু-পা ফাঁক করে মধুকূপ মুখে তুলে দেয়। অচেতন আর চেতনের মাঝে তার উত্থিত ঝড় মুখের মধ্যে পুরে জগৎ শান্ত করে দেয় ভেনাস। দুটো সাপ, একাকার, দু’জনকে খায়। দেয়ালের ফটোফ্রেম খুলে গিয়ে শূন্যে ওড়ে, আলনার কাপড় জানলা দিয়ে মহাকাশে পালায়। সমীরণের বাতিঘর তাকে বিদ্ধ করে নীচে শুয়ে থাকে। হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা, তার টালমাটাল জাহাজ অন্ধকারে দূর বঙ্গপোসাগরে ডুবে যায়।

সমীরণ খাতা থেকে মুখ তোলে। শ্রীতমা সামনে দাঁড়িয়ে। বয়সের ভার লেগে যাওয়া ঈষৎ পৃথুল।

—তুমি কি স্বাভাবিক হতে চাও না ইচ্ছে করেই?

—কেন! আমি তো ঠিকই আছি শিতু।

—একটা বাড়িতে দুটা মানুষ, সারাদিন ক’টা কথা হয় মনে আছে? ভেবে দেখেছ কখনও?

শ্রীতমা আজ ফেটে পড়তে চায়। দীর্ঘ দীর্ঘ একাকিত্বের বিষ তাকে উন্মাদ করে তোলে। এই পাগলের ঘর ছেড়ে বহুদূর চলে যেতে চেয়েছে বহুবার। গোপনে উকিলের পরামর্শ নিয়েছে। ফের চুপ হয়ে গেছে। তবু যাবার সেই তাড়না তাকে আরও মূক, আরও স্তব্ধতার দিকে নিয়ে গেছে। কিন্তু কোথায়? সুবাসের মুখ মনে আসে তার। আবছা। তাকেও কি চেনে! কেউ কাউকে চেনে? কোথাও যেতে পারে কেউ?

—কথা হয় না কেন শিতু?

—খাবার টেবিলে রোজ দুটা মানুষ একা একা উঠে যায়! এ কেমন ঘর!

—তোমার খাওয়া হয়ে গেছে? আমার তো খিদে ছিল না। চলো বসি এখন।

সমীরণ খাবার টেবিলে এসে বসে। শ্রীতমা পাশে দাঁড়িয়ে এলোচুল গোছানোর ব্যর্থ চেষ্টার মতো মাথা ঝাঁকায়। সে কি ঘৃণা করে সমীরণকে? ভালোবাসে? প্রেম? আছে? অল্প মায়া আর তীব্র জিঘাংসা জ্বেলে সে সামনের দেয়ালে চেয়ে থাকে। সেখানে একটা ঘড়িতে কাঁটাগুলো বারোটার দিকে এগোচ্ছে। এই ঘড়িটা কে কবে কখন এই দেয়ালে এরকম একটা অড স্পেসে ঝুলিয়ে দিয়েছিল ভাবলেই শ্রীতমার রাগ হয়। এই ঘর নেওয়ার আগে থেকেই ঘড়িটা ওখানে ছিল। তারা এখানে আসার আগে কে বা কারা এর মালিক ছিল সে জানে না। ঘড়িটা খুব সাধারণ। সময় ঠিকঠাক বলে চলেছে একটা অড স্পেস থেকে।

অন্যদিন সমীরণ এই চেয়ে থাকার থেকে পালিয়ে বহুদূর কোনো রাস্তায় হাঁটে। হয়তো ছোটোবেলার কোনো রাস্তা। সাইকেলের চেন পড়ে যাওয়া দুপুর। সে ভাতের উপর ডাল মাখে। অন্যদিকে রোদ মাথায় হাতে কালি মেখে সে চেন লাগায়। মুখে গ্রাস তোলে। রোদে অল্প ঘেমে উঠে দাঁড়ায়, আর দেখে শ্রীতমা উঠে দাঁড়াচ্ছে। ঠিক তখনই রাস্তায় একটি ইস্কুল বালিকা তার দিকে চেয়ে অল্প হেসে চলে যাচ্ছে ভাঙা রাস্তা ধরে। সমীরণ ভাবে সে কি ওকে চেনে? তার নীচের ক্লাসের কেউ? শিতু উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে আছে। কি ভাবছে ও? চোখের আগুন নিভে গেছে। আজও, এখনও, একটাও কথা বলা হয়নি খেতে বসে, শিতু চলে যাচ্ছে উঠে। সমীরণ প্রাণপণ নিজেকে প্রস্তুত করে। তবু তার বাকযন্ত্র বাস্তবে ফেরে না। সুবাসের ফোন ছিল তখন? সমীরণ ভাবে। ওদের দেখা হয়? কোথায়? একান্তে? ওরা কি চেনে নিজেদের? একদিন নীল আলো জ্বলা ঘরের আধখোলা পর্দার আড়ালে সে দেখেছে ওদের। সুবাস বহুদিনের বন্ধু শ্রীতমার। হয়তো আরও দূর, সে জানে না। সে পুনরায় সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেয়, একটা গর্তে চাকা লাফিয়ে ওঠে। সে প্রাণপণ তাল সামলায়। শিতু চলে যাচ্ছে। সে পকেট হাতড়ায়। গায়ের চাদর সরিয়ে বুকপকেট খোঁজে। হ্যাঁ, এই তো, সে পেয়ে যায়।

সমীরণ বাঁ হাত বাড়িয়ে শ্রীতমার সামনে মুঠো করা হাত খুলে ধরে।

মুহূর্তে ঘর ভরে যায় তীব্র বহুকাল পূর্বের সেই আতরের গন্ধে! আলো কি নেভানো ছিল? আলো কি নিভে গেল হঠাৎ? বাস্তব মুছে যেতে থাকে অন্ধকারের ভেতর। একটা হু-হু ঠান্ডা বাতাস, এ কি বহুপূর্ব কোনো স্মৃতির সুবাস! তীব্র আতর গন্ধে অচেতন হবার আগে শ্রীতমা এক ঝলক দেখতে পায় টেবিল উড়ছে শূন্যে। দেয়ালের ঘড়িটা তার অসময় সহ ভেসে যায়। সমীরণ সাগালের ছবির মতো হাতে আতরশিশি নিয়ে মাথার উপর ভেসে আছে। জানলার বাইরে মহামারি আকাশ। ঝলমল করছে রেবতী নক্ষত্র। আরও দূরে উজ্জ্বল রঙিন মহাকাশ। আর কিছু মনে নেই তার।

(গল্পটি লেখা শেষ করে, পুনর্পাঠের পর আমার মনে পড়ে যায় ‘পারফিউম: আ স্টোরি অফ মার্ডার’ সিনেমাটির শেষ দৃশ্য। সেহেতু নামকরণে ঋণ রইল।)

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২