রাক্ষস কিংবা মানবের ইতিবৃত্ত – রুমা মোদক

রাক্ষস কিংবা মানবের ইতিবৃত্ত – রুমা মোদক

শেয়ার করুন

সুবলা তেতে আছে মাছ ভাজার আগে গরম করা কড়াইয়ের মতো, গৌরীর মুখ নেই সেখানে দুফোঁটা আত্মপক্ষ সমর্থনের জল দেয়। রাস্তা ভালো নয়, বাতের ব্যথায় হাঁটা অসম্ভব, গিয়েও মন্টুর দেখা মিলে কিনা কে জানে ইত্যাদি গৌরী তাকে সঙ্গে না নেয়ার জন্য যত অজুহাতই খাড়া করছে, সুবলা নিজের গোঁ থেকে সরছে না মোটেই। বরং গৌরীর উপর নিজের সব ক্ষোভ আর রাগ এই সুযোগে উসুল করে নিচ্ছে হাড়েহাড়ে। গৌরীর মনে মনে ইচ্ছা যে কয় টাকাই উদ্ধার করা যায়, উদ্ধার করে ফিরে আসবে, অনেক হয়েছে। মন্টুকে আর তার ত্রিসীমানায় ঢুকতে নিষেধ দিয়ে আসবে সে। কিন্তু সুবলার পণ কড়া। গৌরীর অধিকার আদায়। দরকারে চিৎকার, চেঁচামেচিতে পাঁচবাড়ির লোক জমায়েত করে গৌরীকে স্ত্রীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে আসবে সে।

সুবলার সব ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি করে নিজ নিয়তির ভোগান্তির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে গৌরীর জীবনে। বলার সময় তাই সব বক্তব্যের আগেপিছে যোগ করছে এক শব্দবন্ধ, ‘আগেই কইছিলাম’, ‘আগেই কইছিলাম’…। শুরু থেকেই সুবলার তীব্র বিরোধিতা আর অসহযোগিতায় গৌরীর দ্বিতীয় বিয়ে। সুবলা নিজের দ্বিতীয় বিয়ের নাকে খত দেয়া স্মৃতির অতলে গিয়ে নানা বিপরীত বিরূপ অভিজ্ঞতা সারাদিন বয়ান করে বিভীষিকা জাগাতে চেয়েছিল গৌরীর অভিপ্রায়ে। গৌরীর বাপ ছাড়ান দিলে শুধু দুইবেলা খেতে পাওয়ার নিশ্চয়তায় গৌরীকে নিয়ে দুই নম্বর জামাই খুঁজে নিয়েছিল সুবলা। পেটে আরেকখান মেয়ে দিয়ে বছর না ঘুরতেই নিরুদ্দেশ হয়েছিল সে-ও, সুবলার সঞ্চয় চুরি করে। অনেকদিন বিশ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করেছিল সুবলা। ফিরেনি। এসব বৃত্তান্ত যখন ইনিয়ে বিনিয়ে ভোগান্তির নানা ব্যথাপুঁজে বয়ান করে সুবলা, গৌরী তখন সিদ্ধান্তে নিরুপায় স্থির, ভুল হলে ভুল। ঠিক হলে ঠিক। বছর পঁচিশ কী আর শরীরের ডাক অস্বীকার করার মতো সন্ন্যাসী-সন্ত, ঘরের আল ঘেঁষে হেঁটে যাওয়া ছোকরাদের আলগা ছোঁকছোঁক করার যন্ত্রণা না হয় হিসাবেই নিল না। মা-কে একথা মুখ ফুটে বলার মতো বেহায়া কোন্‌কালে কেউ হতে পেরেছে বলে জানে না সে।

সুবলার ধারণা গৌরী মন্টুর উপর দুর্বল। সামনে গেলেই দরদ আর প্রেমের মাখামাখিতে গলে পড়বে, যে অন্যায়টা মন্টু গৌরীর উপর চাপিয়ে দিয়ে গেছে, তার মাশুল তো আর কেবল গালিগালাজেই ফুরায় না। একেবারে সুদে আসলে উসুল করে নিয়েই ফিরবে। মোটেই ছাড়াছাড়ি নেই। গৌরীর উপর এজন্য সে ভরসা করতে পারছে না মোটেই। দায়িত্বটা নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছে। সুবলার দুই নম্বর অবশ্য প্রথম পক্ষের কাছেও ফিরে যায়নি। সুবলা খোঁজ নিয়েছিল। কিন্তু গৌরী তো নিশ্চিত তার ব্যাটা পয়লা পক্ষের ধারেই গেছে। মন্টুর চেয়ে সুবলার রাগ তাই মন্টুর পয়লা পক্ষের বউয়ের উপরেই বেশি। বেটি তাবিজ কবজ জানে, নইলে ল্যাংড়া বেটির কাছে কেনো মন্টু বারবার ছুটে ছুটে যায়? শুধু কি তাই, কম-বেশি যাই করুক, রোজগারের টাকাটাও দিয়ে আসে ল্যাংড়া বেটির হাতে। আর এই বেয়াকুফ মাইয়া গৌরী তিন বাড়ি হেঁটে কাজ করে আর রোজগারের টাকায় ব্যাটারে খাওয়ায়। তো ব্যাটার রোজগারেই যখন খাবি, গৌরীর কষ্টের টাকা চুরি করে নিয়েও যখন তোকেই দেবে তখন গৌরীরে অধিকার নিয়ে ভিটায় উঠতে দিবি না কেন?

নিজের ভাগ্যকেই দোষ দেয় সুবলা এই বেয়াক্কেল মেয়ে পেটে ধরছে বলে। নিজের পাওনা নিয়ে যার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই, শ্বশুরের ভিটায়ও যদি মর্যাদা দিয়ে না উঠায়, আবার বাচ্চা সহ বউই যদি না পালে তো ব্যাটাকে বিয়ে করল ক্যান?

সুবলার কাছে জীবনের একটাই আপদ, রাক্ষুসে ক্ষুধা। আমি তো দুইবার সাঙ্গা বইছিলাম দুইডা পেট চালাইবার লাইগ্যা, তর তো হেই চিন্তা নাই। ক্যান আপদ ঘাড়ে নেছ! গৌরী অতীত-বর্তমানের আগাপাশতলা হিসাব করে দেখে আসলে পেটের ক্ষুধা নয়, মেয়েসন্তান পেটে ধরাই আপদ হয়েছে গৌরীর জীবনে, সুবলার জীবনেও।

আহা তবে বুঝি নিজেকে আপদ ভাবার দিন মুড়িয়েছে নটে গাছটির মতো। মেয়েমানুষ নয়, পুরুষমানুষই আপদ এখন তার কাছে। অযাচিত উৎপাত থেকে আপন মাংস রক্ষার ঢাল আর জৈবিকতার প্রয়োজন। নইলে এই যে মন্টু, দ্বিতীয়বার যার গলায় মালা দিয়ে জৈবিক চাহিদাকে সামাজিক বৈধতা দিয়েছে গৌরী, নিজ থেকে না গেলে তাকে তো ঠেলেও বের করা যায় না ঘর থেকে। দুই দুইটি পরিবার জীবনে জড়িয়ে থাকলেও জীবিকা তার কাছে দায়ও নয়, দায়িত্বও নয়, বরং ইচ্ছা অনিচ্ছার ছেলেখেলা। বসিয়ে বসিয়ে দুবেলা খোরাকি যোগানো ছাড়া উপায় থাকে না গৌরীর। হাঁড়িতে চাল দেয়ার সময় ঘরে বাস করা একটা জলজ্যান্ত মানুষের উপস্থিতি তো উপেক্ষা করা যায় না।

তিনদিন আগে ম্যাডামকে টাকাটা ফেরত দেয়ার কথা। এই কথামতো ফেরত দিতে না পারা ভবিষ্যতে সাহায্য পাবার সব সম্ভাবনার দরজায় খিল দিয়েছে। গত তিনদিন ধরে গৌরী সময় নিয়েছে, আজ না কাল। আজ আর কোনো অজুহাত নেই দেখানোর মতো, খেয়াহীন নদী পাড়ি দেয়ার মুখোমুখি কখনও উদভ্রান্ত হয় না গৌরী। জীবনের খরস্রোতে কত খেয়াই পাড়ি দিয়েছে, কত অচেনা পানিপথ, তৃতীয় মেয়ে জন্ম দেয়ার অপরাধে আরও দুই মেয়ে সহ যেদিন প্রথম জামাই বিষ্ণু বাড়ির উঠান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, অতর্কিত আশ্রয় হারিয়ে সেদিনও হুঁশ হারায়নি সে। ঠান্ডা মাথায় সম্মুখের পরিস্থিতি পাড়ি দেয়ার উপায় ভেবেছে, খুঁজে বের করেছে। যুদ্ধের কৌশল জানা না থাকলেও যুদ্ধ করার মানসিক জোর তার সীমাহীন।

ম্যাডামের কাছ থেকে মাসের প্রথমে দশ হাজার টাকা চেয়ে এনেছিল গৌরী। এন জি ওর শেষ কিস্তি নির্দিষ্ট সময়ে জমা দেয়ার জন্য। আবার নিজের একমাত্র অস্থাবর সম্পদ বালাজোড়া, যক্ষের ধনের মতো এ যাবৎ আগলে রেখেছে যা, সুধীর বণিকের ঘরে বন্ধক দিয়ে টাকাটা এনেছিল ম্যাডামকে সময়মতো ফেরত দিবে বলে। আর তিনবাড়ির ছুটা বুয়ার বেতন পেয়ে সুধীর বণিককে দেবে। দিন, তারিখ, নির্ধারিত সময়ের তিন চারটি জটিল সমীকরণ মেলানোর চেষ্টায় গৌরী যখন ব্যতিব্যস্ত তখন তিনদিন আগে সকাল-সকাল বের হওয়ার মুখে গৌরী দেখে চাটাইয়ের নীচে ব্যাগে টাকাটা নেই, নেই তার দ্বিতীয় স্বামী মন্টুও।

প্রথমে নানারকম সম্ভাব্যতা নিয়ে ভাবে সে। নিজেকে থইহীন লাগে, তবু পথ খোঁজার লগি-বৈঠা শক্ত হাতে ধরে রাখে। সে কি টাকাটা অন্য কোথাও রেখেছে? মাচাঙের হাড়ির ভেতর, ম্যাডামের কাছ থেকে যে কমলা রঙের শাড়ি চেয়ে এনেছিল, সেটার নকশায় লাল গোলাপের মাঝে নকল হীরে, চুমকির চকমকি, গিঁট দিয়ে সেটার আঁচলে? ঘরের দড়িতে ঝুলানো যে শাড়িখানা কাল সারারাত আনন্দের রং বিলিয়েছে সেটার এ-মাথা ও-মাথা তন্নতন্ন করে দেখে সে।

এন জি ওর কিস্তি শেষ হয়ে গেলেই সেলাই মেশিনটা তার। ঘরে বসে জীবিকা। প্রতিদিন আঁধার ভোরে বের হবার তাড়া ফুরাবে। সে আনন্দে উড়েছে সে গত রাতেও। অথচ আজ ভোর না হতেই তার সব আনন্দ গিলে খেয়েছে অপ্রত্যাশিত উৎকণ্ঠা!

গভীর রাতে মন্টু ঘরে না ফিরাতে নিশ্চিন্ত হল নিশ্চিত নিয়তিরানীর বাড়ি গেছে সে। ঠিকানা তো দুইটাই। মতি, হরি, লিটনের মতো এ-বাড়ি ও-বাড়ি উঁকিঝুঁকি দেয়ার বাতিক নাই লোকটার।

এই কথাটা কেন জানি সুবলার গায়ে আগুন ধরায়। তার স্পষ্ট যুক্তি দুইটা। এমন বসাইয়া বসাইয়া জামাই আদর করলে অন্য ঘরে উঁকি দিব কী করতে? পাগলেও নিজের বুঝ বুঝে। আর হে তো সেয়ানা পাগল। সাথে দ্বিতীয় যুক্তিটা দিতেও বিন্দুমাত্র দেরি করে না সুবলা। এত্ত ভালা হইলে পইলা ঘরে বউ বাইচ্চা রাইখা তরে বিয়া করতে গেল ক্যান!

এটা অকাট্য। দুজনের দুইবার দেখা হত দিনে। যাবার পথে একবার আর আসবার পথে একবার। ইচ্ছাকৃত নয় আবার অনিচ্ছাকৃত কিনা এ ব্যাপারে নিশ্চিত নয় গৌরী। ম্যাডামের ফ্ল্যাটের গেইট সাতটায় খুলে আর নয়টা বাজার আগে রান্না সারতে হয় তাই গৌরী শীত-গ্রীষ্ম-বসন্ত ভোর ছয়টাতেই ঘর থেকে বের হয়। আর মন্টুর বাস ছাড়ে সকাল সাড়ে ছয়টাতে। হাইওয়ে পার হয়ে ঢাকা পৌঁছাতে ছয়-সাত ঘণ্টা। আবার ফিরতি বাসের কন্ডাকটর হয়ে আসতে আসতে সন্ধ্যা। সময়টা যেন কী করে মিলে যায়। নদীর বাঁধের উপর দিয়ে পরস্পরকে অতিক্রম করার সময় চার চোখের বিনিময়ে উঁচুতে লাল বাতি জ্বলতে থাকা মোবাইল টাওয়ারের মতো শক্তিশালী রশ্মির মতো শরীরে শরীরে চুম্বকের উত্তর-দক্ষিণের বিপরীত মেরুর আকর্ষণ ঘটে!

মন্টু টিনের ছাউনি ছেড়ে বাঁশের ঘরে চলে আসে। সেটা মেসঘর আর এটা সংসার। সেখানে বুয়া তিনবেলা নিয়মের ভাত তরকারি রাঁধে, লবণ-মরিচ কম হোক কি বেশি, খেয়ে নিতে হয়। আর এখানে একটু শুটকির ভর্তায়ও অধিকার থাকে, আরেকটু দাও বলার আধিপত্য থাকে। কাল ধনেপাতা দিয়ে রসুন ভর্তা খাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করা যায়। আরেকটা অধিকারও থাকে। যখন ইচ্ছে শরীরে উপগত হওয়ার অধিকার।

এরজন্য অবশ্য নিজেকেও অস্বীকার করেনা গৌরী।পারস্পরিকই বটে। তিন কন্যাসন্তান নিয়ে মায়ের কাছে আসা অবধি দুই চারজনের উঁকি দেয়া অব্যাহত ছিল। লুকিয়ে চাপিয়ে দুয়েকজনের সাথে বিনিময়ও হয়েছে চাওয়া-পাওয়া। কিন্তু বিয়ে করে নিলে আর লোকের পাঁচকথার তোয়াক্কা থাকে না। যদি এটাকেই পেশা করে নেয়ার ধান্দা থাকত তো অন্য কথা। পারুল, নীহার যেমন নিয়েছে। মেয়েদের দিকে তাকিয়ে গৌরী ও পথ মাড়াতে চায় না। কত বিচার সালিশ বৈঠক করেও প্রথম জামাই বিষ্ণু আর ঘরেই নিল না। কীসের রক্তের টান আর বাপের আদর, সব ভদ্রলোকের গালগপ্প। খুব বুঝা হয়েছে।মেয়েদের ভাগ্যকে এই ব্যাটাছেলেদের ইচ্ছা অনিচ্ছার খেলার মাঠ করতে চায় না সে।

মেয়েগুলোকে লেখাপড়া শিখিয়ে চাকরিতে দিতে চায় গৌরী। যেন বিয়ের পর নির্মম পুরুষগুলো নিয়মমতো অজুহাত সাজিয়ে বের করে দিলেও চোখে সরষে ফুল না দেখে। তার ইচ্ছা হয়তো সংসার করুক কিবা না করুক, একবার নয় পাঁচবার করুক। সুবলার মতো পেটের চিন্তা আর তার মতো শারীরিক চাহিদা কিংবা সামাজিকতার আতঙ্কে বাড়তি পেট লালনের চিন্তা তাদের পীড়িত না করুক। তাদের পায়ের নীচে মাটি নদীর কূলের আঠালো নরম অবিশ্বস্ত না হোক, বরং ঢাকা যাওয়ার হাইওয়ের মতো শক্ত কিন্তু মসৃণ হোক। মেয়েগুলো ইস্কুলে যায়।

নিজের প্রয়োজন ছিল বটে, স্বীকার্য সাহসে সে মানতে দ্বিধা করে না। রাত গভীর হলে, মেয়েদের নিয়ে মা সুবলা অন্য বিছানায় নষ্ট গাড়ি ঠেলে নেয়ার মতো ঘরর্ ঘরর্ নাক ডাকলে, একলা এক বিছানায় তার ঘুম আসত না। শরীর উতলা হত, বন্য স্পর্শের জন্য ছটফট করত। কত রাত না ঘুমে কেটেছে এক বছরে!

তবে মনে মনে নিজের চাহিদাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবলেও ব্যাটা কি আর সবসময় তা ভাবে? ঠিকই মালাবদলের জোরে গৌরীর ইচ্ছা অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে যখন-তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে শরীরে।

মন্টু প্রথম বউ নিয়তিরানীর কাছেও যায়, সব জেনেই নয়াহাটির ইস্কন মন্দিরে গিয়ে মালাবদল করেছে সে। আনুষ্ঠানিকতার যা কিছু, সেখানেই শেষ, কলোনিতে দুজন এসে উঠেছে খালিহাতে খালি গাঁটছড়াটা বেঁধে। রকিব মিয়ার কলোনিতে ভাড়া থাকা বিশ ঘরের মানুষ প্রথমে হা করে দেখেছে, তারপর ছি ছি করেছে। গৌরী জানে তার কিছুটা, বিয়ে সংক্রান্ত খাওয়াদাওয়া বঞ্চিত হয়ে। হোক দুইখান রসগোল্লা আর একখান নিমকি তা যে তারা পায়নি সে নগ্ন আফসোস তারা লুকাতে শিখেনি। আর কিছুটা গৌরী যে বেশ একখানা জুটিয়ে নিয়েছে সে ঈর্ষায়। আর যাই হোক, এখন তো গৌরী দুজনের রোজগারে খাওয়াদাওয়ার অনিশ্চয়তা থেকে বাঁচল। শুধু রকিব মিয়াই মাসের ভাড়া তুলতে এসে বাহবা দিয়েছে। বেশ কইরছস। না জায়েজ কাম না কইরা এক্কেবারে সাঙ্গা কইরা লইছস।

সুবলা সঙ্গ নেয়, মেয়েকে একা ছাড়তে রাজি নয় সে। পনের থেকে আজ চল্লিশ, পঁচিশ বছরের সঙ্গী এ মেয়ে।আজ ব্যাটা-বেটিরে ধরবে সে, মন্টুকে আর তার প্রথম পক্ষের স্ত্রীকে। মালাবদলের অধিকারেই যে গৌরীরও স্থাবর বসতভিটাখানায় থাকার অধিকার আছে তার ভাগ আদায় করবে। এই তার পণ।

পথে নেমে হাঁটা দেয় দুজন। রিক্সাভাড়া নিয়ে পঞ্চাশ-ষাট টাকা খরচের বিলাসিতা এখন মানায় না তাদের। কয়েক প্যাঁচ রাবারে আটকে রাখা ফোনটা বাজতে থাকে অবিরাম বিরক্তিকর রিংটোনে। পাওনাদার ম্যাডামের ফোন। আজ কাজেও যায়নি সে। ম্যাডাম হয়তো না খেয়েই কলেজে গেছে।

রাঙাগাঁওয়ে যাওয়ার একটাই রাস্তা। এবড়ো-খেবড়ো, বর্ষার নরম কাদায় গাড়ির চাকার ছাপ ফেলে যাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক গর্ত আর জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে অবিচ্ছেদ্য মাখামাখি। বাড়িটাও সে চেনে। বিয়ের পর তাকে নিয়ে একবার এসেছিল মন্টু। উঠানে খেলতে থাকা নেংটা ছেলের দল এক পলক চোখ তুলে তাকায়। নির্বিকার আবার খেলায় মগ্ন হয়ে যায়। অপেক্ষাকৃত বড়ো, একমাত্র প্যান্ট পরা ছেলেটা দৌড়ে ঘরে ঢোকে। ও মা বেডি আইছে। ঘরের ভেতর জমাট জমাট একগুঁয়ে অন্ধকার, বাইরের অবাধ আলো ডেকে নেয়ার সুযোগ না পেয়ে ফুঁসছে সেখানে। সেখানে আধভাঙা তক্তপোশে অস্পষ্ট মন্টু।

নিয়তিরানী খোঁড়াতে খোঁড়াতে বের হয় ঘর থেকে, রাস্তা পার হতে গিয়ে ট্রাকের নীচে পড়েছিল সে, পায়ের বিনিময়ে বেঁচে ফিরেছে। পুরামাস নদীর পাড়ের কচু সেদ্ধ কইরা খাইছি, পেডের অসুখে পোলাডা মরতে নিছিলো। ব্যাটা মাত্র বাড়িত আইছে চাল ডাইল মাছ লইয়া এমনেই দৌড়াইয়া আইছস! আমার পোলাপানের দুইডা ভাত খাওয়া সহ্য হয় না তর?

সুবলা কিছু বলতে দেয় না গৌরীকে। টেনে বের করে নিয়ে আসে বাড়ি থেকে। পেটের ক্ষিধার চেয়ে ভয়ংকর রাক্ষস দুনিয়াত আর কিচ্ছু নাই লো মা। যতই ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা সাজিয়ে আসুক গৌরী, সে-ও চুপ করে বের হয়ে আসে। এই বাচ্চাগুলোও তো প্রায় তার মেয়েদেরই সমবয়সি।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২