মানুষ ও পোকার গল্প বা সাধন ও বুঝদার জামাই – অর্ণব রায়
শালোর দুনিয়ায় মানুষ নাই খো। ব্যাবাক পুকা সব।
সাধনের জাং-এর ওপর দিয়ে একখানা গুবরে পোকার মতো দেখতে, কিন্তু বড়ো সাইজ, খুরখুর করে হেঁটে যাচ্ছিল। কোথায় যাবে কে জানে। সাধন ওটার দিকে চোখ গেঁথে ছিল। লুঙ্গি প্রায় কুঁচকি অবধি তোলা। জাং উদোম। তবুও পোকার পায়ের খুরখুর চলা টের পাচ্ছিল না। শেষে হাঁটুতক এসে সে পোকা খাদের মুখে কোনদিকে যাবে ঠিক করতে পারে না। এদিক ওদিক শুঁড় হাওয়ায় কিলবিল করে ও বিপদের গন্ধ শোঁকে। বাঁ হাতের দু আঙুলের টোকায় সাধন পোকার হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে ও উপরের কথাটি বলে।
খেলার মাঠ যেখানে শেষ হচ্ছে আর ধানের খেত শুরু হচ্ছে, সেরকম একটা জায়গায় ওরা আলের ওপর বসেছিল। প্রায় ওদের পাছার তলা থেকেই গোড়ালি সমান কচি কচি ধানের গাছ আর সেসব গাছের তলায় তলায় কুলকুল ছিলছিলে জল। মাথার ওপর হা হা খোলা আকাশে সূর্য রাধুবাবুর ইটভাটার চুল্লির পানা জ্বলছে। কাল সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে। হাওয়া ভ্যাপসা। জোলো। গুমোট গরম। পেছনদিকে যেদিকেই তাকাও ধু ধু করছে খেত। এরকম ভরসকালে চারপাশ মানুষজনে ভরে থাকার কথা। ধানের খেতে খেতে চাষি আর লেবার মিলে টুকটাক কাজ সারবে সারাদিন। স্প্রে দেবে। গাছে পোকা এল কি না দেখবে। শ্যালো চালিয়ে জল দেবে। জল বেড়ে গেলে আল অল্প কেটে সে জল বের করে দেবে। তা নিয়ে পাশের খেতের সাথে ঝগড়া কাজিয়া করবে। এরকম হাজারটা কাজ। ওদিকে খেলার মাঠে গরু বাছুর চরবে। চরতে চরতে মুখ তুলে দেখে নেবে ধানখেতে মুখ-টুখ দেবার সুবিধে আছে কি না। একগোছা ছেলেপিলে, যাদের ইস্কুল-টিস্কুল কিচ্ছু নেই, বা সুয্যি ঠিকঠাক গরম খেতে না খেতে মাঠপাড়ের পেরাইমারি ইস্কুলে সে পাট চুকিয়ে চলে এসেছে যারা, তারা হয়তো একটা বল নিয়ে পিটছে। বা হয়তো এমনিই ছুটোছুটি করছে। কিংবা গরুবাছুরগুলোর পেছনে লাগছে। মাঠের এককোণায় দাঁড়িয়ে ওদের মা-ঠাকুমারা ওদের বাড়িতে খেতে ডাকছে। তাদের সরু সরু গলার আওয়াজ মাঠের এপাশ থেকে ওপাশ ছড়িয়ে যাচ্ছে। ওরাও তেমনি গলা ভাসিয়ে দিয়ে জবাব দিচ্ছে, ‘আসতিছিইইই…’। কিন্তু যাচ্ছে না। এইসব চলবে। তা না, যেদিকে তাকাও খাঁ খাঁ করছে। একটা জনমনিষ্যি নেই! যেন কোনো রাক্ষস এসেছিল রাতের বেলা, সব মানুষজনকে এক মুঠোয় ধরে গপ করে খেয়ে ফেলেছে। খালি পুলিশের গাড়ি হুমহাম করে টাউন জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর একটা মানুষের আধখানা ছায়াকেও বেওয়ারিশ ঘুরে বেড়াতে দেখলে নেমে এসে বেদম ক্যালাচ্ছে। মাঝে মাঝে ওদের কলোনিতেও ঢুকে আসছে। বা যাচ্ছে টাউনের আশেপাশে এরকম আরও যত কলোনি আছে সেগুলোতে। মানুষেরা ওদের দেখলেই মেঠো ইঁদুরের পারা সুট করে ঘরের ভেতরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে আর জানলা দরজার ফাঁক দিয়ে জুলজুল করে দেখছে। আর যে সব ধেড়ে–কচি–নেংটি তখনও কলপাড়ে কি মোড়ের মাথার শিরীষ গাছের তলায় খুচরো খাচরা থেকে যাচ্ছে, তাদের একেবারে শুয়োরতাড়া করে ঘরে ঢোকাচ্ছে।
আরে বাপু, মানুষ আর কত ঘরের মধ্যে থাকবে! হরতাল না হরতাল, তা আর কতদিন চলে? মাস গড়িয়ে যেতে চলল। কামকাজ বন্ধ। ব্যাবসাপাতি গঙ্গার জলে। ঘরে চাল নাই। আনাজপাতি নাই। তেল নুন মশলা সব শেষ। সবচেয়ে বড়ো কথা, পয়সা নাই। গরিব মানুষের ঘরে কয়দিন বসে খাবার পয়সা থাকে হে? পেট জ্বললে মাথাও জ্বলছে। আর মুখ দিয়ে গলগল করে কালো ধোঁয়া আর লাল আগুন বেরিয়ে আসছে। টুক কথাতে ঝগড়া বেঁধে যাচ্ছে। সে ঝগড়া চড়ছে। চিঁ চিঁ করে নেমেও যাচ্ছে। আবার সব চুপচাপ। যে যার পড়ে আছে তেলচিটে বিছানায়। জোয়ান ছেলে ছোকরারা আর উড়ু উড়ু মেয়েরা মোবাইল খোঁচাচ্ছে। কী আর করবে! ঘর কি একটা সারাদিন পড়ে থাকার জায়গা হল! সারাদিন পড়ে থাকার জায়গা গঙ্গার ধার। সদরঘাট। টাউনের রাস্তা। হাজারটা মোড়ে হাজারটা চায়ের দোকান। ঠেক। ম্যাকেঞ্জি মাঠ। বা টাউনের ধারে ধারে এত এত মাঠ, আমবাগান, ইটের ভাটা আছে, সেগুলোর কোথাও একটা গাছতলা কি ছায়া ছায়া দেখে সাইড হয়ে গেলেই তো হল। ঘর হল রাত বাড়লে টলতে টলতে হাতড়ে হাতড়ে ফেরার জায়গা। কোনওমতে দুটি মুখে গুঁজে বিছানায় কেলিয়ে পড়ার জায়গা। সেখানে সারাদিন এতগুলো লোক, যে যার কাজে না গিয়ে, বাবাটা টেলারিং এর দোকান কি হোটেলের কাজে না গিয়ে, জোয়ান ছেলে লোকের টোটো নিয়ে সকাল সকাল না বেরিয়ে, মা-টা লোকের বাড়ি বাসন মাজতে না গিয়ে সারাদিন ওই ঘুপচি ঘরে মধ্যে মাথা ঠোকাঠুকি করে থাকলে কারোর মনমেজাজ ঠিক থাকে আর? তার ওপর বাচ্চাদের চ্যাঁ-ভ্যাঁ, বারবার বাড়ি থেকে পালিয়ে বাইরে খেলতে যাওয়ার চেষ্টা, মা গুলোর ওদেরকে হাতের ডানা ধরে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে ফিরিয়ে আনা আর পেটানো, ওদের চিল চিৎকার—সব মিলে গোটা পাড়া উনুনে বসানো গরম জলের হাঁড়ির ওপরের ঢাকনার মতো টগবগ করে। সব পাড়ায় গলিতে টাউনে এক অবস্থা। কোথায় যাবে মানুষ?
আর পুলিশ মারছিলোও বাপু! পুলিশ যত না মারে, দেড়া মারে সিভিক গুলায়। হাতের নাগালে পেলেই হল। সে যে দশরথ একবার একটু বেরিয়েছিল। বেশি না, এই ম্যাকেঞ্জিমোড়ের দিকেই গেছিল ঘুরতে-ফিরতে। আর যাবে কোথায়! কেন বেরিয়েছ, কী কাজ—এসব কোনও কথাই নাই। গদাগদ লাঠির বাড়ি। দশরথ পাছায় আর গুল্লার হাড়ে কালসিটে নিয়ে ফিরে এল। কিন্তু কাঁহাতক আর বাড়ি বসে থাকা যায়! ছেলেপিলে দুদিনেই পুলিশের সাথে কুমির-ডাঙা খেলতে শিখে যায়। এখন দেদার ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশের গাড়ির ছায়াটা হুই রাস্তার শেষ মাথায় দেখা গেলেই টুক করে গুটিপোকার পারা নাই হয়ে যাচ্ছে। পুলিশের বাবার সাধ্যি কি খুঁজে বের করে!
পোকাটাকে ফেলে দিয়ে সাধন খানিক দম ধরে বসে থাকে। অল্প অল্প দোলে। দুই চোখ দুইবার দুইবার চারবার বন্ধ করে, খোলে। হাতের মুঠো পাকায়। আবার টানটান করে খোলে। এখনও চারপাশের দুলুনিটা থামেনি। ঘাড় কাত করে রাখলে ঘাড় কাত হয়েই থাকছে। কতক্ষণ যে আছে, ঘাড় মাথা টনটনিয়ে না উঠলে টের পাওয়া যাচ্ছে না। তার মানে এখুনি উঠতে গেলে দুনিয়া তো টলছেই, হুড়মুড়িয়ে ধ্বসেও যেতে পারে। চোখের ওপর আঁধার নেমে আসতে পারে। এদিকে পেটের ভেতর চনচনিয়ে ক্ষিধে লাফাচ্ছে। বাড়িতে মা-টা ভাত-টাত রেঁধেছে কিনা কে জানে। বাড়ি-মা-ভাত এই তিন সোজা রেখা মিলতেই সেই তিনকোণের মাঝখানে একখানা বৌ আর দুইখানা বাচ্চার মুখ কেঁপে কেঁপে ভুস করে ভেসে ওঠে। সাধনের গলা দিয়ে টকজল উঠে আসে। সাধন ভ্যাঁচ্ করে কেঁদে ফেলে।
সাধনকে বেমক্কা কেঁদে ফেলতে দেখে আর যে দুজন, না না দুজন কোথায়, দশরথও তো আছে, তো আর তিনজন, যুগী, গনেশ আর ওই দশরথ, ‘কী হল বে’ ‘কী হল বে’ করে ওর দিকে ছুটে আসতে যায়। কিন্তু, একে তো দু হাত দূরেই বসে থাকলে ঠিক ‘ছুটে আসা’ যায় না, তার ওপর পাশে পড়ে থাকা কাঁচের বোতলগুলো আর এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্ল্যাস্টিকের পাউচগুলো ইতিমধ্যেই ওদের স্পষ্ট চলাফেরা আর ভাবনাচিন্তার ক্ষমতাকে গিলে বসে আছে। ওরা খানিক হামাগুড়ি দেয়। সাধন ঠিক কোনদিক থেকে ডুকরে উঠল ঠাহর করতে না পেরে গনেশ উলটো দিকে চলতে শুরু করে। আলের আঠালো কাদায় হাত পিছলে যুগী মুখ থুবড়ে পড়ে ধানখেতের জলের মধ্যে ও ওঠার জন্য হাত পা ছুঁড়ে শোলমাছটার মতো ছটফট করতে থাকে। বা হয়তো এর উলটোটা হয়। যুগী উদমাই যেদিক পানে চোখ যায় হামা টানতে শুরু করে আর গনেশ কাদায় পড়ে শোলমাছ হয়। কে জানে! তবে এটা ঠিক, দশরথই সাধনকে ঠিকঠাক আওতার মধ্যে পায় আর কী করবে বুঝতে না পেরে সাধনের পিঠের ওপর থাবড়া দিতে থাকে। বোধ করি, কয়দিন আগের পায়ের হাড়ের ওপর ঠং করে আছড়ে পড়া সিভিক পুলিশের প্ল্যাস্টিকের শক্ত লাঠির বাড়ি কনকনানি ব্যাথা দশরথকে হাজার নেশার মধ্যেও টনকো রাখে আজকাল।
নরেশের ঠেকের পাউচের নেশার ঘোরে সাধনের পিঠের ওপর থাবড়াগুলো বোধহয় একটু বেশিই জোরে দিয়ে ফেলেছিল দশরথ। সাধনের কান্নাকাটি চটপট থেমে যায়। পেট উদোম করে স্যান্ডোগেঞ্জি তুলে চোখ মোছে। ফোঁ ফোঁ করে নাক টানে। হ্যা খ্যা করে থুতু ফেলে। এদিক ওদিক পড়ে থাকা বোতলগুলোকে তুলে আকাশপানে হাঁ করে একটা একটা করে সেই হাঁ মুখের ওপর উলটে দেয়। যদি এক আধ ফোঁটা থেকে গিয়ে থাকে। নেই। কোনওদিনই থাকে না। বোতলগুলোকে পাশে রাখে সাধন। নরেশকে ফেরত দিলে পাঁচ টাকা বোতলপিছু পাওয়া যাবে। লুঙ্গির ভাঁজে বিড়ি হাতড়াতে হাতড়াতে মুখটাকে ভেচকে বলে, এই দুনিয়ায় আমার কেউ নাই রে ভাই, কেউ নাই।
বাংলা ভাষা আর তার যাবতীয় অভিধানে ‘আমার কেউ নাই’-এর যা-ই মানে থেকে থাকুক না কেন, সাধন যদি বলে ‘আমার কেউ নাই’, তার সোজাসরল মানে হল ইদানীং কয়েকদিন ওর হাতে নগদ টাকাপয়সা কিছু নাই। মাঠের ধারের কান্ট্রি বা তিন পাত্তির ঠেকে কেউ কারোর না। কান্ট্রিটা তবু দু-চার দিন ‘ভাই রে’ ‘বন্ধু রে’ বলে চালানো গেলেও, তিনপাত্তি কি ফিরকির বোর্ডে বাকিতে কারবার করতে গেলে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। সাধনের ‘আমার কেউ নাই’-এর মানে ও নাগাড়ে কয়েকদিন বোর্ডের ধারে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে শুধু দেখেই গেছে। একটা হাতও খেলতে পারেনি। তাসগুলো, রুইতন হরতন ইস্কাবন ওকে কাঁচা মেয়েমানুষের মতো, একভাঁড় টাটকা কান্ট্রির মতো দুই হাত বাড়িয়ে ডাকছে, কিন্তু ও যেতে পারছে না। ওর চোখের সামনে আনতাবড়ি খেলোয়াড়গুলো বুড়বকের মতো তাস ফেলছে আর হু হু করে পয়সা হারছে। সাধন নিজের আঙুল কামড়ে কামড়ে কড়া ফেলে দিচ্ছে। যেন ওরই পয়সা হারছে। মনে হচ্ছে শালাদেরকে কাদায় মুখ ঠুসে পা দিয়ে ঠাসে। গায়ের মধ্যে চিড়বিড়োনো রাগ পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিজলির বেগে ছুটোছুটি করছে। সে রাগ ঠান্ডা করতে যে নরেশের কান্ট্রির ঠেকে যাবে, তারও উপায় নেই। দুনিয়ায় কোথাও কি পয়সা ছাড়া কিছু নাই? নরেশ বা নরেশের বৌ, যেই ঠেকে থাক, সাধনকে বাকিতে দেওয়া দূরে থাক, আগে পয়সা না দেখিয়ে মাল শব্দটা মুখ থেকে বের করলেই হুড়কো নিয়ে কুকুরতাড়া করে তাড়বে।
তাহলে আর কী করার থাকে? নরেশের ভাটির আশেপাশে বেড়াল হ’য়ে ঘুরঘুর করতে হয়। চোখ রাখতে হয়, কে কখন ডানহাতে বোতল বা পাউচ আর বাঁ হাতে থার্মোকলের বাটিতে শুয়োরের মাংসের ঝাল কিংবা ছোলামটর মাখার চাট নিয়ে বেরিয়ে মাঠের দিকে যাচ্ছে। ওই তো সোনাটিকুরি কলোনির বলরাম, আরে ওই যে কাঁধে করে শান-মেশিন নিয়ে বঁটি-দা-চাকু-ছুরি ধার করে বেড়ায় না, সেই চাক্কু বলরাম, বেরিয়ে এল। বাঁ হাতে বোতল ট্যাংল্যাং করছে, ডানহাতে থার্মোকলের বাটিতে মাংসের ঝাল। গত সপ্তাহেই ওর ছেলেটা ফিরল না কাজের থেকে? বিহার না ঝাড়খণ্ড কোথায় গেছিল কাজে। গেছিল লেবার হয়ে, বছর দুই ঘুরতে না ঘুরতে শোনা যাচ্ছে মিস্তিরি হয়ে গেছে। হেডমিস্তিরির সাথে নাকি খুব খাতির। বলরাম মালের সাথে মাংসের চাট খাবে না তো কি সাধন খাবে? সাধন টিকটিকির চোখ গেড়ে রাখে। বোতল আধখানা নেমে এলে গুটি গুটি বলরামের পাশটিতে গিয়ে উবু হয়ে বসে। তাড়া খেলে ঝট করে উঠে পড়বে। আস্কারা পেলে থেবড়ে বসবে। দু-পাঁচটা পাঁচপেঁচি এপাশ-ওপাশ খেজুর করার পর বলরামের বড়ো ছেলের দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে লেবার থেকে মিস্তিরি হয়ে যাওয়ার আশ্চর্য কিসসাটি বলরামকেই শোনায়। এরপর ওকে একছুটে গিয়ে নরেশের ঠেক থেকে একখানা প্ল্যাস্টিকের গেলাস নিয়ে আসা ছাড়া আর কোনও পরিশ্রম করতে হয় না। নরেশের বা নরেশের বৌ-এর বাঁকা হাসি চোখটিপুনি ইত্যাদি দেখার সময় সাধনেরও নেই, আমাদেরও নেই।
সে এক দিন ছিল। খড়খড়ির খালে তেড়চা করে হাতজাল ফেলতে না ফেলতে এক বাজার মাছ উঠে আসত। ছেলেপিলে ইস্কুলের ব্যাগে একখান করে গামছা নিয়ে যেত। ফেরার পথে বা টাইমের আগেই ইস্কুলের ভাঙা জানলা গলে পালিয়ে হাফপ্যান্ট ভিজিয়ে বা উদোম হয়েই খালে নেমে পড়ত। গলা ডুবিয়ে জলের পেটের ভেতর হাতড়াত। যতক্ষণ গোটা গা সাদা সাদা আঁশ আঁশ না হয়ে যায়। উঠে আসত মহলা-পুঁটি-ট্যাংরা-বাটা-বাঁশপাতা মাছ পুঁটলি ভরে নিয়ে। রাতে বাড়িতে ঝালঝাল করে পেঁয়াজ-ফোড়ন দিয়ে সাঁতলে, বাপ ক্যারিব্যাগে করে মাঠের ধারেও নিয়ে যেত মালের সাথে চাট, বাড়ির লোকেরও দেখতে না দেখতে এক সানকি ভাত হাপুস-হুপুস করে উঠে যেত। সে এক দিন ছিল। মাঠের ধারে কেউ বোতল নিয়ে বসেছে, উই দূর দিয়ে হেঁটে গেলে ডেকে এনে বসিয়ে হাতে গেলাস ধরিয়ে দিত। এখন শালা পাশে বসে গায়ে ঘষা দিলেও সরে বসে, চেনা দিতে চায় না। কাজেই হাতে নগদ না থাকলে, কার ছেলে বিহার থেকে মিস্তিরি হয়ে ফিরল, কে এই বাজারেও একটা ফালি জমির দালালি লড়িয়ে দিয়ে সাব-হিস্যারও সাব-হিস্যা কিছু টাটকা নোট পকেটে পুরল, কে কাকে সরকারের বাড়ি তৈরির টাকা পাইয়ে দিল—সাধনকে এইসব কোনাখামচির সব খবর রাখতে হয়। কিন্তু তাতেই কি আর সবদিন নেশা জোটে রে ভাই? দিনকাল ভালো থাকতেই লোকে দাঁতে ছুঁচো কামড়ানো মুখ করে ঘুরে বেড়ায়। দেশ-দুনিয়ার হালচাল দেখে চোখের পাতা গুটিয়ে কপালে চড়ে যায়। টেনে টেনে নামানো যায় না। বেলা বারোটার এদিকে গরিব মানুষ বাজারে ঢুকতে গেলে গোটা গায়ে ফোস্কা পড়ে। মুদির দোকান, চালের দোকান সব থেকে আগুনের হল্কা বেরিয়ে আসছে। গরিব মানুষের মাথা আর পেছন, দুইয়ের কাপড়ই গেছে। সে ঢাকবে কী? তার মধ্যে এল এই রোগ। দূরে থাকো দূরে থাকো। মুখে শালা তিনফেরতা কাপড় জড়াও। আরে কোমড়ে জড়ানোর ত্যানা নেই, মুখে গামছা বাঁধো! সাধনকে প্রায়ই শুকনো মুখে ঘরে ফিরতে হয়।
মা শালী আজকাল বহুত সেয়ানা হয়ে গেছে। গাল দিয়ে পাড়া মাত করে দাও বা পাতকোর পাড়ে উঠে ‘জান দিয়ে দুবো’ ‘জান দিয়ে দুবো’ বলে হড়কাও—কিছুতেই একটা নয়া পয়সা খিঁচে বের করা যায় না বুড়ির থেকে! শালী আজকাল ওর কথা কানের পাশেও নেয় না। নিজের মনে ঘরের কামকাজ করে যেতে থাকে। হাত ধরে টানাটানি করলে বা টেম্পারের মাথায় কাঁধ ধরে জোরে ধাক্কা দিলে, টলে গিয়ে পড়ে যাবার মতো হয়, কিন্তু পড়ে না। বেশি কিছু করতে সাহসও পায় না সাধন। সেই সেবার নেশাটা একটু বেশি চড়ে গেল, তাওয়ের মাথায় কোমরে একটা লাথ, না না জোরে কোথায়, আস্তেই তো, মেরে দিয়েছিল। তা সে চেঁচিয়ে ভেঁচিয়ে পাড়ার লোক ঘরের মধ্যে জড়ো করে খিটকাল ব্যাপার। হালদারপাড়ার ঘরে ঘরে কাজিয়া মারপিট হবে না, পাড়ার লোকে হপ্তায় অন্তত দুবার কোনও না কোনও বাড়ির লাফড়া মেটাতে জড়ো হবে না এবং নিজেরাই জড়িয়ে পড়বে না—তাহলে আর হালদারপাড়াকে হালদারপাড়া ডেকে লাভ কী! ইন্দিরাপল্লী, রামমোহনপল্লী এসব নামে ডাকলেই হয়। পাড়ার লোকটোককে কোনওদিন বাঁ পায়ের কড়ে আঙুল দিয়েও পোঁছে না সাধন। কিন্তু ওই যে সান্টু হালদারের ছোটো ছেলেটা, জেলের বাচ্চা জলে না গিয়ে কলেজে গেল, পাস দিল, এখন ভ্যাবা হয়ে আছে, না পেল চাকরি না তুলতে পারল জাল, এখন পাড়ার মধ্যে একখানা কেলাবের মতো কী তুলে বসল। তাতে আবার টাউনের বড়ো বড়ো ঘরের ছেলেছোকরা এমনকি কয়েকটা মেয়েও আসে। কী সব গুজুর গুজুর হা হা হি হি করে। আবার পাড়ার যত খুচরো-খাচরা বাচ্চা আছে, সেগুলোকে ধরেপেড়ে সকাল সন্ধে পড়াতে বসায় ওই কেলাবঘরে। সেগুলোকে আবার পুজোয়, শীতে জামাকাপড়ও দেয়। সাধনের ছেলেমেয়ে দুটোও গতবছর পেয়েছে। সাধন পায়ে পায়ে ওদের কাছে গেছিল, যদি কিছু পাওয়া যায়। ওরা ভাগিয়ে দিল। তো সেই ছোঁড়া আর তার টাউনের দলবলও সেদিন এসে জুটে গেছিল। একে তো সাধন লাথিটা মেরে মনে মনে কেঁচো হয়ে গেছিল, মাকে লাথি মারা, যে-সে ব্যাপার না, কিন্তু মালের ঘোরে আবার মন মনের মত উস্কাচ্ছিল, ‘বেশ করেছি, শালী পইসা দিবি না, মারবে না তো কী করবে’, সব মিলিয়ে মাথাটা ভোম হয়ে গেছিল। তার মধ্যে পাড়ার লোকে আর ওই ছোঁড়া তার দলবল নিয়ে যা মুখে আসছিল তাই বলে গাল পাড়ছিল ওকে। সবটা সাধনের কানেও যাচ্ছিল না। ওরই মধ্যে কিছু বেমক্কা খিস্তি কান দিয়ে ওর নরম মগজে গেঁথে গিয়ে থাকবে। বা হয়তো ভুলভাল শুনেছিল কিছু। আর, সে নয় সে নয়, নরেশের ঠেকের পাউচগুলোই উবু হয়ে বসে থাকা থেকে উঠে গিয়ে ওদের কাউকে একটা দুটো ধাক্কা মেরে থাকবে। ফলাফল হিসেবে, সরল ভাষায়, পাড়ার লোক, সান্টুদার ছেলে, তার দলবল, ফ্রিতে মজা দেখতে আসা কিছু চলন্ত লোক—সব মিলে সাধনকে বেশ আচ্ছা করে বানায়। সে মারের তৎপরতা ও শৃঙ্খলা দেখবার মতো ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত ওর মা-ই মাঝখানে পড়ে ওকে বের করে নিয়ে আসে। টিউকল থেকে জলটল এনে দেয়। লোকজনকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে হাতজোড় করে বিদায় করে। সাধন এরপর একটুও বাড়াবাড়ি করলে সঙ্গে সঙ্গে ওদের খবর দেবে, সে-কথাও বলে। বৌটা তখন এই সংসারে একখানা পায়ের দু-একখানা আঙুলমাত্র ঠেকিয়ে পুরোদমে ডানা ঝাপটাচ্ছিল। সে সাধনের মা-কে লাথি মারা থেকে ঘরের সামনে পড়ে পড়ে পাবলিকের মার খাওয়া—সবটাই টকিজ হলে সাতটা-দশটার শো দেখার মতো মনে মনে চটপটি খেতে খেতে দেখে। মারধোর শেষ হওয়ার আগেই শাশুড়ির এই ঝাপটে পড়ে থামিয়ে দেওয়াতে, সিনেমা হলে লোডশেডিং হওয়ার মতো মুখ করে, লোকজনের সাথেই কোন্ ফাঁকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এর কয়েকদিনের মধ্যেই সে মাগী প্রথম বারের মতো ডানা মেলে ফুড়ুৎ হয়।
বোনটার যতোদিন বিয়ে হয়নি, মা-টার প্রাণে তবু খানিক দয়ামায়া ছিল। দুজনে মিলে মাস্টারপাড়ার তিন-চারটে বাড়ির কাজ ধরেছিল। এদিক-ওদিক পালটাপালটি করে মা-মেয়েতে ভালোই চালাচ্ছিল। আর সাধনও কি পয়সা কামাত না? ওর কি এককালে একটা গোটা ভ্যান নিজের নামে ছিল না? ও কি দিনের পর দিন রাত থাকতে উঠে গিয়ে গঙ্গার ধারে সদরঘাটের যেখানে মাঝিরা সারারাত ধরা মাছ এনে ধপাধপ ফেলত, সেখানে গিয়ে হত্যে দেয়নি? ঘাটওয়ালার সাথে মাঝিদের সাথে চেঁচামেচি দরদাম ঝগড়াঝাঁটি করেনি? অন্য মাছওয়ালাদের মতো বাজারের মাছের আড়ত থেকে মাছ তুলত না। যাতে দুটো পয়সা বাঁচে। সেই মাছ ভ্যানে করে টাউনের পাড়ায় পাড়ায় বেলা দুপুর পর্যন্ত ‘মাছ লিবেন, মা-আ-আ-আ-ছ’ করে গলা ফাটিয়ে ফেরি করেনি? তখন ত ওর বৌটাও ডানা ঝাপটানো শুরু করেনি। না কি করেছিল, সাধন খেয়াল পায়নি? কে জানে। আর, খারাপ টাইম কি মানুষের আসে না? সেই টাইম ভালো করার জন্য পুরুষ মানুষ কী করবে? লটারি কাটবে না? তিনপাত্তির বোর্ড বুকে জড়িয়ে ঝুলে পড়বে না? টাইম ঠিক চললে সাধনকে ভ্যান বেচতে হয়? ভ্যান গেছে গেছে, যে সাইকেলে করে তারপর মাছ নিয়ে বেরোচ্ছিল, টাইম ঠিক চললে ভরা বাজারের মধ্যে গণপতি-ফলওয়ালা কয়টা টাকার জন্য কলার ধরে কেড়ে নিয়ে যেতে পারে? আজ সাধনকে মাথায় করে প্লাস্টিকের গামলায় কয়খানা চুনোমাছ, এই টুকু টুকু ঘিনি ঘিনি চিংড়ি নিয়ে বেচতে বেরোতে হয়?
আর মাছের কারবার কি কম ফৈজতের কাজ! এ তো আর ভ্যানে করে সবজি কি ফল বেচা নয় যে দিন ফুটে লতায় পাতায় বেলা হলে পর বাবুর মতো হেলতে দুলতে তুলসিবাড়ির পাইকারি বাজারে গেলেও চলে। সেখানে যাবার পথে অমরের চা-এর দোকানে খানিক চা লেড়ো নিয়ে গুলতানি প্যাঁদালেও চলে। তারপর পাইকারি বাজার থেকে সবজি তুলে বা ফুলতলার ফল মার্কেট থেকে ফল তুলে ধুয়ে মুছে ঝকঝকে করে পাড়ায় পাড়ায় ভ্যান ঠেলে ঠেলে বেচো। টাকা নাও, মাল খরদ্দারের ব্যাগে ভরে দাও। দুপুরের আগে ভ্যান খালি। ঝাড়া হাত-পা। আজকাল টাউনবাজারে বাবু-ভাইয়াদের সংসার সামলে, শুধু নিজের নয় বৌ-এর চাকরি সামলে সকাল সকাল বাজার যাবার টাইম কোথায়! তাদের সবকিছু ঘরের দুয়ারে চাই। পেয়েও যাচ্ছে। দোতলা তিনতলা চারতলা সব ফ্ল্যাটবাড়ির গ্রিল দেওয়া বারান্দা থেকে দড়ি দিয়ে সরসর করে ব্যাগ নামিয়ে দিচ্ছে। আলু-মুলো-বেগুন-পটল সব সাঁ সাঁ করে স্বর্গপানে উঠে যাচ্ছে। সেই ব্যাগেই টাকা নেমে আসছে। সবজিওয়ালাও সেই টাকা পকেটে পুরে বগল বাজাতে বাজাতে মালের ঠেকে জুয়ার ঠেকে গিয়ে সেঁটে যাচ্ছে। মাছওয়ালাকে শুধু পেটের খোঁদল ভরাতে গেলে টাউনের রাস্তা গলি থেকে একটা একটা করে দানা হাতের নখ দিয়ে খুঁটে তুলতে হয়। বাড়ির সামনে মাছওয়ালাকে দেখলেই বাবু-ভাইয়াদের ভেতরে যেন তাদের বাপ-পিতেমো জেগে ওঠেন। সেই বাপ-পিতেমো, যারা সেই সাদাকালো সিনেমার যুগে সকালে উঠে একহাতে বাজারের থলে আর এক হাতে ধুতি কি লুঙ্গি সামলে বাজারে যেতেন। আর বাজারে মাছওয়ালার সামনে উবু হয়ে বসে একটা একটা করে মাছ দু আঙুলে টিপে টিপে পাল্লায় তুলতে দিতেন। তারপর মাছওয়ালার সাথে ওজনে মারা, পাল্লার সততা ও শেষপর্যন্ত দাম নিয়ে দীর্ঘ কচলাকচলি করতেন। মাছওয়ালার বংশপরিচয় বা দুনিয়ায় সঠিক কাঁটাওয়ালা চাবুক ও সেই চাবুক চালানোর মতো সঠিক লোকের একান্ত অভাবের কথাও দুই বাজারু একান্তে দেখা হলে বলতেন। হায়, সুভাষবাবু যে কোথায় গেলেন!
এই বাবু-ভাইয়ারাও মাছওয়ালা দেখলেই সেরকম লাফিয়ে পড়েন। এদের সুবিধেও আছে। সমস্ত ব্যাপারটা হচ্ছে তারই বাড়ির সামনে। তারই আওতার মধ্যে। কোনও গলিতে এক বাড়িতে মাছ কিনলে আরও দু-বাড়ি থেকে লোক হামলে আসে। কী মাছ, কত দাম, টাটকা না বাসি, কোথায় ধরা, দেশি না চালানি। আর বাবুরা যেমন-তেমন, আসল ডেঞ্জার বৌদিগুলান। ম্যাক্সি পরে বুকে ওড়না ফেলে যা ক্যাচাল করতে পারে রে ভাই! যেন মাছওয়ালা তার থেকে তার বর আর বাচ্চাসমেত সাধের ছোট্ট সংসারখানাই ঠকিয়ে নিয়ে চলে যাবে। যদি বা কামড়াকামড়ি করে দরদাম ঠিক হল, এবার সে মাছ কুটে দিতে হবে। সেসব দিন কি আর আছে, যখন কর্তা হাতে করে তিনকিলো ওজনের কাতলা ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরল আর গিন্নি আহ্লাদে একগাল হেসে ইয়াব্বড়ো আঁশবঁটি নিয়ে কলতলায় সে মাছ কুটতে বসল! এখন কত্তা এমন কাণ্ড করলে গিন্নি আগে আঁশবঁটি নিয়ে কত্তার ঘাড়ের চামড়া চেঁছে ফেলবে। অবশ্য যদি বাড়িতে আঁশবঁটি থাকে, তবেই। তবে গিন্নিদের জিভ আছে যদিও। এখন মাছওয়ালাকে সঙ্গে করে একখানা প্ল্যাস্টিকের বস্তা রাখতে হয়। বাবুদের বাড়ির দুয়ারে সেই বস্তা পেতে মাছখানাকে কুটতে হয়। মাছ কুটতে কুটতে পাড়ার বেড়াল, যেগুলো চারপাশে মিউ মিউ করে ঘুরঘুর করে, সেগুলোকে ছেই ছেই করে তাড়াতে হয়। কেন-না এখন চারিদিকে পরিস্কার-পরিস্কার বাতিক। আর বাবুদের নিজেদের বাড়ির সামনেটা তকতকে চাই। বাকি দুনিয়া চুলোয় যাক। বেড়াল, একখানা বেখেয়ালে ফেলে দেওয়া কানকো মুখে করে কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে আর মাছওয়ালার দোষ হবে। বাবুদের বাড়ির সামনে একখানা মাছের আঁশ পড়ে থাকলে পরের দিন সে মাছওয়ালার গুষ্টি উদ্ধার হবে। তাই এখন শুধু মাছ বেচলে হবে না রে দাদা, লোকের দুয়ারে ঝাঁটা মারার কাজও করতে হবে।
দুবেলা দুটো ভাত, দু-ঢোঁক কান্ট্রি আর দু চাকতি বোর্ড খেলার জন্য অত দিগদারি পোষায়? বোনটার বিয়ে দিয়ে মা-টাও দু হাতে ঘোড়ার গু মাখিয়ে বসে গেল। দু-পয়সা চাইতে যাও, কাঁই কাঁই করে পাড়া মাথায় করবে। ‘তুর বুনের বিহাতে অতগুলান টাকা চলি গেল। এখনও নাদু পালের দুকানে দু’হাজার টাকা পেবে। রাস্তায় ডেকে গাল পাড়তিছে। বচ্ছর ঘুইরতে চলল, এখনও পাইসা শুধা হলনি। এত্ত বড়ো বড়োভাই হয়্যা কী দিয়াছিস বুনের বিহাতে? কুন কামে লেগালছিস? এখুন বুড়ি মা-র কাছ থ্যেকে নিশা করার পইসা চাহাছু, তুর শরম লাগে না রে?’
সাধন এক-পা এগুলে দু-পা পিছোয়। পরে আবার টাইম মতো এগুলেই হবে। পইসা তো দিবেই। সকালে না হলে বিকালে দিবে। না দিয়ে যাবে কোথায়? বাবা মরলে কম টাকা পেয়েছিল নাকি বুড়ি। পঞ্চায়েতের নাইটগার্ড বলে কথা। কিন্তু সে-কথা পরে। আপাতত এই দুই-পা তিন-পা পেছুতে পেছুতেও সাধন খেয়াল না করে পারে না, যতই মন পুড়ে আংরা হয়ে যাক, যতই গা নিশপিশ করুক, যতোই জিভ চুলবুলোক—সাধনের বৌ-এর নামে সাধনের মা-র মুখ থেকে একটাও বাক্যি বেরোয় না। সাধনের মুখ থেকে বেরোনোর কথা তো বাদই দিলাম। হুঁ হুঁ বাওয়া, এর নাম পুলিশের ভয়। পাছায় দু-ডাণ্ডা যে খেয়েছে, তার মুতের রং খাঁকি বেরোবে। আর ডাণ্ডা খাওয়ারই বা কী দরকার। গরিব মানুষের পুলিশের মুখ দেখলেই বুকের খাঁচা চুপসে আসে। গোটা শরীর-মন-ঘরবাড়ি-বালবাচ্চা নিয়ে কেঁচোর পারা মাটিতে সেঁধিয়ে যাবার ইচ্ছা হয়। সাধন কি আর এসব জানে না? আর সেই সাধনের ডানা-ঝাপটানো হাঁটায়-চলায়-কথাবলায়-ঘাড় মটকে তাকানোয় লালনীল ফুলঝুড়ি ওড়ানো বৌ, চায়না, আরে বাপ মা-র দেওয়া নাম রে বাপু, চায়না হালদার, সে কী না বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতে কাজে ঢুকল এক্কেবারে থানার মেজোবাবুর ঘরে! আর কী যে যাদু করল, অমন বাঘপারা মেজোবাবু আর তার ঘাড়ছাঁটা চুলের বৌ, সব চায়না ছাড়া চোখে অন্ধকার দেখে। এমনকি ওদের বাচ্চাটা অবধি সাধনের বৌটাকে দেখে ‘তায়না’ ‘তায়না’ করে ছুটে আসে। তা অমন মেজোবাবু যার তাঁবে, সে শুধু সাপের কেন, মানুষেরও পাঁচ-ছয়-দশ যত ইচ্ছে পা দেখবে। আর দেখলও। প্রথমে থানারই ফুরনের ড্রাইভার বিনোদ। ঘাড়চাঁছা লাল চুল। ঝিল্লিম ঝিল্লিম গেঞ্জি। টাইট জিনস। ব্যাস্। নাই নাই, একদিন নাই, দুদিন নাই, সাতদিন নাই। বাপের বাড়ি, মামার বাড়ি, মাসির বাড়ি, সব ফোনাফুনি খোঁজ-তল্লাশ সারা। বাচ্চাগুলান কেঁদে-কঁকিয়ে একসা। তখন ওরা আরও কচি। কিছুই বোঝে না। সাধন কয়দিন খুব এপাশ-ওপাশ করে মাঠের ধারে পাউচ পাকড়ে ধপাস হয়ে গেল। সাধনের মা-ই কোত্থেকে খবর নিয়ে এল, পাখি উড়েছে। তা-ও আশেপাশে না, সোজা দিল্লি। কোত্থেকে খবর আনল কে জানে। সে খবর যখন সাধনকে মাটি থেকে কলার ধরে তুলে কানের কাছে চিল্লিয়ে শোনানো হল, সাধন চোখ মেলে শুনে আবার চোখ বুজে শুয়ে পড়ল। সেই যে চোখ বুজল, চায়নার ব্যাপারে আর চোখ খুলে বা চোখ তুলে তাকায়নি।
মায়ের চোখ বন্ধ হতে আরও কয়েকটা দিন আর কিছু ঘটনা লেগেছিল। সেই প্রথম দফায় প্রায় একমাস বাইরে কাটিয়ে চায়না ফিরে এল। বাড়ি ঢোকা থেকে চালচলন কথাবার্তা সব যেন, এই তো সকালে বাবুদের বাড়ি কাজে গেছিলাম, সেখান থেকে দুপুরে না এসে একেবারে বিকেলের কাজ সেরে রাতে এলাম। বাবুর বাড়ি কিছু লোক এসে গেছিল তো, তাই একবেলা আটকে দিল। সাধনের মা অত সহজে এইসব রঙ্গ দেখে ভোলে না। সে কুলোপানা চক্কর দিয়ে তেড়ে তেড়ে যায়। হালদারপাড়ায় কখনও এরকম হয়নি যে ঘরের বৌ পেটের বাচ্চাদের ফেলে নাং করতে গেছে—এই মতের সমর্থনে এক দীর্ঘ ইতিহাসও মুখে মুখে বলে। এই পর্বে চায়না তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ও ফণা তোলে। বোধহয় এতক্ষণ ঘরের ভেতরে নিজের জিনিসপত্তর-মাল-তবিল সব ঠিকঠাক আছে না হাওয়া হয়ে গেছে, সেসব হিসেব মিলিয়ে মিলিয়ে দেখছিল। বেরিয়ে এসে প্রথমেই চায়না সাধনের মা-র পাড়ার যাবতীয় মেয়ে-বৌ-এর সততার খতিয়ানের দাবি নস্যাৎ করে ও পরপর সন-তারিখ সমেত বেশ কিছু গৃহত্যাগ ও প্রত্যাবর্তনের নজির দেয়। তার গলার জোরও কিছু কম ছিল না। এতে করে লড়াইটা আর ঠিক দ্বিমুখী থাকে না। কারণ যে দর্শক ও শ্রোতামণ্ডলী এই লড়াইয়ের আঁচ পোয়াতে জমা হয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকেরই নিজের বা ঘরের লোকের নাম এই হাটের মধ্যে আছড়ে পড়ে ও তাদের এক ঝটকায় দর্শক থেকে প্রত্যক্ষ কুশীলব করে তোলে। ফলে তারা ও তাদের পরিবার নিজ নিজ কোঁচা সামলে আখড়ায় নেমে পড়ে। অনেকে আবার বর্তমান পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে তাদের পরিবারের বহুপূর্বে যত্নে পুঁতে ফেলা কঙ্কালকে মাটি থেকে তুলে নাচানোর চেষ্টা হচ্ছে দেখে সাধনের মাকে দোষারোপ ও গালিগালাজ করতে থাকে। বেয়াক্কেলে মেয়েমানুষ। ঘরের কেচ্ছা ঘরে রাখতে পারে না। বৌটা কোথায় গেছিল না গেছিল, ঠিকঠাক করে জিজ্ঞেস কর আগে। তা না, চিল্লে পাড়া মাত করছে। এদিকে পুরোনো রসের মজা হাঁড়ি খুলে যাওয়াতে আরও বিস্তর মাছি ভনভন করতে থাকে। সব মিলিয়ে সাধনদের বাড়ির বাইরে ও ভেতরে মিলিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তাকে স্বচ্ছন্দে আমরা মাৎস্যন্যায় বলতে পারতাম, কিন্তু এখানে একে অপরকে সম্পূর্ণ গিলে ফেলবার পুরোদস্তুর চেষ্টা থাকলেও, যেহেতু সব মাছের সাইজ সমান, কেউই কাউকে খেয়ে উঠতে পারছিল না। উদ্ভুত পরিবেশকে বরং আমরা হাইব্রিড মাগুরের পুকুরে একমুঠো খাবার ছড়ানোর সাথে তুলনা করে ফেলতে পারি। আর ধন্যি মানি চায়নাকে। ‘সাত জার্মান জগাই একা’! এতগুলো লোকের সাথে কী ফাইটটাই দিল! পরে পাড়ার মেয়ে বৌ-রা নাক কুঁচকে, যেন কুকুরের গুয়ে পা পড়ে গেছে, এরকম মুখ করে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, ‘বাপরে কি ত্যাজ ম্যায়ার!’ তো এমনিই তেজ আগাগোড়া বজায় রেখে সকলের মুখের ওপর ‘যা কর্যালছি বেশ কর্যালছি’ ও ‘সবকটাকে দেখে লুব’ ছুঁড়ে দিয়ে দুমদুম করে ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। দুর্ভাগ্য এটাই যে সাধন এতবড়ো সিনিমাটির কিছুই দেখতে পায়নি। তার হুঁশে আসতে এখনও পাক্কা দেড়দিন।
‘যা কর্যালছি বেশ কর্যালছি’-টা ওর বিশ্বাস হলেও ‘সবকটাকে দেখে লুব’-টা যে চায়নার ফাঁকা বুলি ছিল না, সেটা বোঝা যায় যখন ঠিক দুইদিন বাদেই থানা থেকে লোক এসে সাধন আর ওর মাকে ডেকে নিয়ে যায়। না তুলে নিয়ে যায় না। থানার পিওন-টিওন কিছু হবে, এসে ওদের দুজনকে বিকেলের মধ্যে গিয়ে থানায় দেখা করে আসতে বলে। হিসেব মতো সাধন তখন আধাদিন বা একবেলা মাত্র হুঁশে এসেছে। দুনিয়া তখনও বাচ্চার দোলনা। দুলছে, থামছে, আবার দুলছে। থানার বারান্দায় উবু হয়ে বসে সাধন আর সাধনের মা বিস্তারিত জানতে পারে কীভাবে এতদিন তারা মা-ছেলে মিলে ঘরের বৌ চায়নার ওপর নানারকম অত্যাচার করেছে। নেহাত চায়নার মতো খরগোশতুল্য নিরীহ মেয়ে বলে এতদিন তাদের সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করেছে। শেষে থাকতে না পেরে আর তাদের সংসারেরই সুসার হবে বলে বাইরে কাজের খোঁজে যায় ও বিশেষ সুবিধে করতে না পেরে ফিরে আসে। তা নিয়ে এত হাঙ্গামার কী আছে! একটা কথা কানের ভেতর গরম লোহার শিকের মতো ঢুকিয়ে নাও, এই যাওয়া ও ফিরে আসা বা অন্য কোনও বিষয় নিয়ে ভবিষ্যতে চায়নাকে একটি কথাও শুনতে হলে তাদের মা-ছেলেকে থানায় উঠিয়ে এনে যথাযথ আদর-আপ্যায়ন করা হবে। তারা কি কথাটা বুঝতে পেরেছে? সাধন আর সাধনের মা মস্ত করে ঘাড় নাড়ে। পুরো কাহিনিতে বিনোদ নামের কোনও শব্দের ভনভনাটিটুকুও ওঠে না। আর এই কাহিনিতে এতই মশগুল হয়ে পড়ে ওরা যে সে ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করতেও সেরেফ ভুলে যায়।
এরপর আর কী, চায়না ছিল মাঝির বিটি, মাছওয়ালার বৌ, হল পুলিসের বিটি আর কারোরই বৌ না। দাঁড়ের পাখি আর দাঁড়ে পা-টি রেখে ডানা ঝটপটায় না। বরং কখন দাঁড়ে এসে বসে, কখন উড়ে যায়, কেউ পাত্তা পায় না। বাচ্চাগুলান ঠাকুমার কাছে থাকে ও ঠাকুমাকে সামনে পেলেই ‘কত্তা পাইসা দে’ ‘কত্তা পাইসা দে’ করে চিলুবিলু করে। পয়সাটি হাতে পাওয়ামাত্র হাওয়া হয়ে যায় এবং ক্ষিধে বা পরবর্তী প্রয়োজন উপস্থিত না হলে তাদের টিকিটি দেখতে পাওয়া যায় না। সাধনের মা-র চোখ বুজতে বুজতেও বোজে না। সে বুড়ি মাঝে মাঝে গলা তুলে ও গলা নামিয়ে বিলাপ ও শাপশাপান্ত করে। এই গলা তোলা ও নামানোটা স্বাভাবিকভাবেই চায়নার ঘরে থাকা ও না থাকার ওপর নির্ভর করে। সাধনের গায়ের গরম কোনওদিনই ঠিকমতো ছিল না। এখন তো বেবাক নিভে গেছে। চায়না যখন থাকে বাচ্চাদুটোকে নিয়ে খাটের ওপর ঘুমায়। সাধন রাতে বাড়ি ফিরলে মেঝেতে শোয়। ঘুমের মধ্যে গড়াতে গড়াতে সাধন বেড়াল বাচ্চার মতো খাটের তলে, ওই যেখানে রাজ্যের পুঁটলি-পোঁটলা, দু-চারটে বাসন ভাঙাচোরা জিনিসপত্তর ঝুল মেখে, ধুলো মেখে পড়ে আছে, তার মধ্যে, ওই ঘুপচি অন্ধকারের মধ্যে আরও সেঁধিয়ে যেতে চায়। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে উঠে বাইরে যায়। ঝোপের ধারে মুতে আবার ফিরে আসে। খাটের পাশে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে গিয়ে জল খায়। বাইরে বেরিয়ে বিড়ি ধরায়। শুধু খাটের ওপরে উঠে যেতে পারে না। নিজের বিয়ে করা বৌকে যে সাধন সেই প্রথম বারের থেকে একবারও তার এই ঘর ছেড়ে চলে যাওয়া আবার ফিরে আসা নিয়ে একটি কথাও কখনও জিজ্ঞেস করেনি, তার পেছনে কি শুধু পুলিশের ভয় না কি অন্য কোনও জুজু তার মেরুদণ্ডের তলার দিক থেকে গুঁড়ি মেরে উঠে এসেছে, আমরা জানি না। সত্যি বলতে কি, মেয়ে-মদ্দর কপাটের আড়ালে দড়ি টানাটানি বিষয়ে আমাদের অজ্ঞতা পাতিয়ার ভাটার পাহাড়ের মতো উঁচু মাটির ঢিপিটার মতোই আকাশছোঁয়া এবং অনড়। আমরা এটুকুই দেখেছি, বৌ-বাচ্চার কথা কখনও-সখনও ভেসে উঠলে এবং তাদের মুখগুলোকে ভাসানোর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে নরেশের ঠেকের কান্ট্রি পেটের ভেতর মজুত থাকলে এবং অন্য পুরুষ মানুষের তাদের ঘরের মেয়েমানুষের সাথে সম্পর্কের কথা মনে পড়ে গেলে, সাধন কখনও-সখনও ভ্যাঁচ্ করে কেঁদে ফেলে।
অনেকটা সময় নিয়ে, চারপাশে প্রচুর ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ ছড়িয়ে শেষমেশ সাধন উঠে দাঁড়ায়। দুবার টাল খায়। হ্যাঁচোর-প্যাঁচোর করে বাতাস ধরে। খাড়াও হয়ে যায় ঠিকঠিক। সাদা চোখে দুনিয়াটাকে একটু সাব্যস্ত করে নিতে চায়। ওই যে ওই দূরে যতদূর দেখা যায়, সবুজ ধানের খেত লহ লহ করতেছে। যেন সবুজ একখানা বিশাল তিরপল পাতা। গোটা দিগন্ত জুড়ে কার বিয়ে লেগেছে কে জানে! কে এসে বসবে ওর অপর? চারপাশে একটাও মনিষ্যি নাই। মাটিতে তাকিয়ে দেখো, পোকামাকড়-সাপ-ব্যাং-কেঁচো-কেন্নো সব দিব্যি ঘরের বাইরে চলেফিরে বেড়াচ্ছে। মাঠে সাদা-লাল-পাটকিলে সব গরু, ইয়া ইয়া কালো কালো মোষ দিব্যি চরে বেড়াচ্ছে। পেছনে পাঁচনবাড়ি লাঠিসোটা নিয়ে হৈ হৈ হ্যাট্ হ্যাট্ করার কেউ নেই বলে বেবাক গিয়ে লোকের ধানখেতে মুখ দিচ্ছে। মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকাও। রোদে আর নীলে চোখ পুড়ে না গেলে দেখতে পাবে ঝাঁকে ঝাঁকে পায়রা, টিয়া, শালিখ, চড়ুই, বুলবুলি, আরও উঁচুতে চোখ ছুঁড়ে দিতে পারলে মেঠোচিল, মেছোচিল, গেছোচিল আর দু-চারটে বাজ, বিলকুল সব উড়ে বেড়াচ্ছে। কেউ তো ওদের ডানা ধরে আটকাচ্ছে না বাপু! কেউ তো ওদের পেছনে রুল উঁচিয়ে তাড়ছে না, ‘মাস্ক পরো’ ‘ঘরে থাকো’ ‘হাত ধোও’ বলে। কই ওদের তো কিছু হয় না। ওদের তো ওদের, মানুষেরই বা কার কী হচ্ছে? কই চোখের সামনে তো একটা লোককেও মরতে বা নিদেন বিছানা নিতেও দেখা যাচ্ছে না। সব বুড়ো হাবড়া দিব্যি খক্খক্ করে কাশছে, খ্যা থু করে এখানে ওখানে থুতু ফেলছে, হাঁফ টানছে আর বাড়ির লোকগুলোর হাড়মাস জ্বালিয়ে খাচ্ছে। মরবার লক্ষণমাত্র নেই। আর দেখা তো দেখা, এই যে মোবাইলে দেশ-দুনিয়ায় হ্যালো হয় আজকাল, পাড়ার একটা কারোর কাছে একটাও ফোন এসেছে, হ্যাঁগা, হামার শরীল লরম লাগতিছে, কি হামি বেমার হয়ে গেসনু, হামার শাউড়ি মরিং গেলছে! কিছুর মধ্যে কিছু নাই, সব বন্ধ! চাল কেনার পইসা নেই, মাল কেনার পইসা নেই, কেবল হাত-পা-পেটের মধ্যে নিয়ে ঘরের ভেতর সেঁধিয়ে থাকো। আর বাড়ির লোক কয়টার মুখের দিকে মরা চোখে ভুলভুল করে তাকাও দিনভর।
দিন দুয়েক আগে গোটা দশেক জোয়ান ছেলে মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস, মাথায় মশারির টুপি পরে এসে প্লাস্টিকে করে চাল ডাল আলু বাড়ি বাড়ি দিয়ে গেল। ছবি টবিও তুলল চালডাল দেওয়ার। সাধন পায়ে পায়ে ওদের কাছে গিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। ওকে ঘেঁষ দিতে দেখে ছেলেগুলো ছিটকে যায়। হাত পা ছুঁড়ে বলে ওঠে, কাছে না, কাছে না, দূরে যাও। এত কাছে আসছ কেন?
আ মোলো যা, এ তো মহা ফৈজত! কাছে না গেলে সাধন ওর কথা বলবে কেমন করে? পারলে ও তো ছেলেগুলোর কানের ভেতর সেঁধিয়ে যায়। কিন্তু উপায় নাই। কী দিন আলে রে ফেনি, মাইনসসে মাইনসকে পাশে ঘেঁষতে দেয়নি। সাধন দূর থেকেই একটু গলা তুলে বলে, হ্যাঁ গা, তুমরা নগদ পইসাকড়ি কিছু দিয়্যা যাও না কেনে!
—কেন? নগদ পয়সা দিয়ে কী হবে? এই তো চাল ডাল আলু তেল সব দিয়ে গেলাম। ওতেই এখন চালাও। দেখছ না, সবকিছু বন্ধ। কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছে না। পয়সা দিয়ে কিনবেই বা কী?
ভিড় ভিড়ের মতো জমা হয়েই ছিল। একথোকা মৌমাছির মতো এই ছেলেগুলোর সাথে সাথে ঘুরছিল। ঠেললে সরে যাচ্ছিল, আবার ঘন হয়ে ঘিরে আসছিল। ওই মৌমাছিদের মধ্যেই কেউ মোক্ষম সময়ে মোক্ষম হুলটি ফোটানোর সুযোগ ছাড়তে যায় না। ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা আওয়াজ বোঁ করে ওঠে, কেনে, কান্ট্রি খাবে!
মৌমাছির চাকে পাটকাঠির খোঁচা পড়ার মতো ভিড়টা বোঁ-ও-ও করে ওঠে। সাধন বাদে বাকিরা অবশ্য দেখেছিল, লোকগুলো খ্যা খ্যা করে হাসছে।
মাঠের ধারধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সাধন কলোনিতে ঢোকার মুখটায় চলে আসে। ক্ষিধেটা এবার ভালোরকম মালুম দিচ্ছে। পেটের মধ্যে যেন দশটা কুকুরের ঝগড়া লেগেছে। সাধন তড়বড় করে ঘরের দিকে পা চালায়। পায়ের সাথে সাধনের মাথাও চলতে থাকে। নিজেই নিজেকে শোনাতে শোনাতে হাঁটে, আজ যদি বাড়ি গিয়ে ভাত না পাই, মা শালীকে মেরেই দুবো। বলে বটে, কিন্তু জোর পায় না। জোর পাবার জন্য আবার বলে। বারবার বলে।
কিন্তু বারবার বলে লাভটা কী হয়! ভগমানের তৈরি এই দুনিয়ায় দিক দশটা, কিন্তু মানুষের চোখ মাত্র দুটো। হাতও দুটো। দুটো মাত্র পা। এক দিক দেখবে, আর এক দিক থেকে বোলতার ঝাঁক এসে পেছনে হুল ফোটাবে। দুহাতে দুনিয়াকে ঠেকাবে, দুনিয়া তোমাকে দশহাতে মারবে। তুমি দুপায়ে পালাবে, সে তোমাকে হাজার পায়ে পেছন থেকে ছুটে এসে খপ করে ধরবে আর গপ করে খাবে। বাড়ি ঢুকে সাধন দেখে চায়না রান্নাঘরের বাইরেটায় বসে বঁটি পেতে একখান এঁচোড় কুটছে। ভুল করে অন্যের বাড়িতে ঢুকে পড়েছে মনে করে সাধন বেরিয়ে চলে এসেছিল প্রায়। ঝাড়া দু-মিনিট দাঁড়িয়ে, খাবি খেয়ে, চোখ ফেড়ে দেখে টেখেও ঠিক পেত্যয় হয় না। সেই কবে চায়না এ বাড়িতে বে হয়ে এল, তখন মাঝেসাঝে এরকম দৃশ্য দেখা যেত বটে। তার ওপর এঁচোড়! বাস রে! দুনিয়াটা কি স্বর্গ-টর্গ হয়ে গেল না কি রে! না কি সাধন এখনও নেশা করে মাঠের ধারেই পড়ে আছে? তাই হবে। নয়তো রান্নাঘর থেকে মাছভাজার গন্ধ আসছে, মা রান্না করতে করতে চায়নাকে এটা ওটা এগিয়ে দিতে বলছে, চায়নাও বাধ্য মেয়ের মতো কথা শুনে টুকটাক হাতে হাতে কাজ করছে, এ কি এই পচায় ধরা দুনিয়ায় সম্ভব?
সম্ভব। খুবই সম্ভব। এই দুনিয়াবন্ধের বাজারে বাড়িতে বছর না ঘোরা নতুন জামাই মেয়ে নিয়ে এলে বিলকুল সম্ভব। তার ওপর সে জামাই যদি একখানা আট-নশো ওজনের মিরকা মাছ, নিজেদের গাছের একখানা আস্ত এঁচোড়, মায় সেসব রান্না করার জন্য সরষের তেল নুন মশলাও সঙ্গে করে নিয়ে আসে, এই দুনিয়ায়, এমনকি তাদের উঠোনেও আস্ত পরি নাচবে নাকি! নতুন জামাই বুঝদার বটে। আর তার বুঝদারি তো সেই বিয়ের দিনই বোঝা গেছিল। টাউনের এমাথা থেকে ওমাথা বিয়ে। ছেলের বাড়ি থেকে বরযাত্রী এসেছিল এক ম্যাটাডর বোঝাই। তা তারা একটু বাংলা ফাংলা খেয়ে বাওয়ালি তো করবেই! আর বিয়েগণ্ডায় খাওয়া-দাওয়া আদর-আপ্যায়ন নিয়ে ক্যাচাকেচি হবে, এটাও স্বাভাবিক। কত বিয়েতে তো হাতাহাতি, রক্তারক্তি, বিয়ে ভাঙাভাঙি পর্যন্ত হয়ে যায়। কিন্তু এই জামাইয়ের ধাতই আলাদা। নিজে তো খটখটে শুকনো ছিলই, যতক্ষণ না বিয়ে করতে বসছে, গোটা বরযাত্রীর দলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেরাল। আর নজর করে গেল, কেউ কোথাও একটুও বেচাল করছে কিনা। হালদারপাড়ার বিয়েশাদিতে এ এক নতুন ব্যাপার বটে।
তবে আজকের বুঝদারিটা জামাইয়ের না কি সাধনের মা আর বোনের কথায় কথায় ‘হ্যালো’ করে সংসারের ফুটোফাটার ব্যাপারে তথ্য এদিক-ওদিক করার, সাধন জানে না। জেনেই বা কী হবে! সাধন দেখল, আজ মুখনাড়া, ঝাঁটা ছোঁড়াছুঁড়ি, খিস্তি খেউড় বাদ দিয়েই ভরপেট ভাত জুটবে। শুধু ভাত! মিরকা মাছ আছে, পেঁয়াজ দিয়ে এঁচোড়ের তরকারি আছে। বোধহয় ডালও আছে। সাধনের মুখের ভেতর জল কাটে। ও সেই জলে ডুবে যাবে মনে হয়।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, সে বুঝদার জামাই, ওর, আর চায়নারও বটে, ঘরে খাটের ওপর চুপটি করে বসে আছে। আর চোখ দিয়ে ওকেই মাপছে। সাধনের চট করে মনে পড়ে না, ও শালার জামাই কি কাজ করে। তবে জামাইয়ের একভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকার সামনে পড়ে ওর মনে হয়, শালো যে কাজই করুক, এই দুর্দিনের বাজারেও তার সে কাজ যায়নি। দু-বেলা দু-মুঠো ভালো করে জুটে যাচ্ছে তা-ই নয়, মুঠো উপচে তার শ্বশুরবাড়ির রান্নাঘরেও ছড়িয়ে পড়ছে। আর সাধনের কাজকারবার মুরোদের কথা তো গোটা টাউন জানে। আপনারাও জানলেন একটু আগে। জামাই ত জানবেই। বিশেষ করে ঘরে জোয়ান বড়ো শালা থাকতে যে জামাইকে শ্বশুর বাড়িতে মাছ নিয়ে যেতে হলে সে মাছ রান্নার তেল নুন মশলাপাতিও জুটিয়ে নিয়ে যেতে হয়, সে জামাই শুধু তাকানো কেন, পা থেকে জুতো খুলে দু-ঘা মারলেও তা বোধহয় ন্যায্যই হয়।
জামাইয়ের অমন রাহু চোখে তাকানোর সামনে একটু কেঁচো কেঁচো ভাব করে সাধন। তারপরই গা ঝাড়া দিয়ে, মনে মনে ধুঃশ্লা বলে জামাইয়ের দিকে একখানা মাইডিয়ার হাতনাড়া দেয়। যেন, আরে কতক্ষণ? বোসো বোসো। আমি চট করে স্নানটা সেরে আসি। সাথে দেয় সেরা বুঝদারের মতো একখানা হাসি। দিয়ে সত্যি সত্যি খড়খড়ির খালে স্নান করতে চলে যায়।
দুপুরে আজ জোরদার খাওয়া হবে। খাওয়ার পর বোনকে রেখে জামাই চলে যাবার জেদ ধরবে। মা ঘ্যানঘ্যান করবে থেকে যাওয়ার জন্য। জামাই থাকবে না। থাকলে বোনটাকে নিয়ে দুপুরবেলা মা-র ঘরে দোর দেবে। মা এসে বসবে রান্নাঘরের সামনেটায়। একগলা জলে দাঁড়িয়ে সাধন হিসেব করে, যদি চলে যায়, তাহলে এগিয়ে দেবার নাম করে বড়ো রাস্তার মোড়ে, যদি থেকে যায়, দুপুরের ঘুমটুম মেরে ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির একমাত্র না ফাটা কাপডিসে চা খেয়ে বাড়ির পেছন দিকে বিড়িটিড়ি খেতে যাবার সময়—এই দুই টাইম। এই দুই টাইমেই জামাইকে ধরতে হবে। চারখানা কান্ট্রি পাউচের দাম, বোনের সাথে বিয়ে হয়েছে আটমাস বোধহয়, তা এই আটমাসের নতুন জামাই, আর এই দুর্দিনেও যে চাকরি যায়নি, তার একখানা আন্দাজ মতো মাইনে—এই তিন রেখাকে সমান তিনটে বিন্দুতে মিলিয়ে জামাইয়ের কাছ থেকে কত চাওয়া যায়, তার হিসেব কষতে থাকে সাধন। আহা, অমন বুঝদার জামাই, মানুষের মতন মানুষ একখান, সে ওকে এই কয়টা টাকা দেবে না?
সাধন ঝুপ ঝুপ করে পরপর তিনখানা ডুব দিয়ে ফেলে।