গোলাপপাস আতরদান মারফতি – পাপড়ি রহমান

গোলাপপাস আতরদান মারফতি – পাপড়ি রহমান

শেয়ার করুন


নিউ মার্কেটের ২নং গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে ছোটো সওদাগর খাকি প্যান্টের পাছায় বার কয়েক হাত ঘষে। তার এই হাত ঘষাঘষি পকেটমারদের রুজি-রোজগারে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে নয়। বরং বলা চলে পাছায় হাত ঘষে সে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে চায়। টাকা যদি জীবনের সবকিছু হয় তাহলে মানিব্যাগটা ছোটো সওদাগরের অস্তিত্ব। কিছুণ পর পর এই অস্তিত্বে হাত ঘষে ছোটো সওদাগর যেন আশ্বস্ত থাকতে চায়।

আজ ছোটো সওদাগরের মানিব্যাগের স্ফীতি কতটা? আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার মতো করে মানিব্যাগও যদি ফুলে উঠত! কিন্তু এই অসম্ভব চিন্তা কোনোদিন সম্ভবপর হওয়ার কথা নয়। সম্ভব হবেও না।

কিন্তু মনে মনে তো এমন ভাবতে দোষ নাই। তাই ছোটো সওদাগর এমন ভাবে। স্বস্তি এখানেই যে, মনের ভাবনা কেউ জানতে পারে না।

ছোটো সওদাগরের সঙ্গে তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী গুলমোহর। এই সুবাদে মানিব্যাগটা ফুলে কলাগাছ না হোক ডাঁটাগাছ অন্তত হতে পারত! কিন্তু এমন অদ্ভুতুড়ে ঘটনা কস্মিন্‌কালেও ঘটে নাই। আজও ঘটল না। সুন্দরী স্ত্রী সঙ্গে করে মার্কেটে ঢুকামাত্রই মানিব্যাগ ফুলতে শুরু করা—আহা এমন যদি হত! শালার পুরুষমানুষ যে এতে কেমনতর ডগমগা খুশি হত ভাবা যায় না। অথচ দেখা যায় উলটোটাই ঘটে। মানিব্যাগের মানি দ্রুত ফুরিয়ে যেতে থাকে।

এবং সুন্দরী স্ত্রীর বেলায়ও একই কথা খাটে। দিনে দিনে সুন্দর কমে ম্লান হতে থাকা।

আর টাকাও এমন জিনিস-খরচ হতে হতে মানিব্যাগ চিমসানো চামচিকা টাইপ হয়ে ওঠা। অবশ্য এ মুহূর্তে ছোটো সওদাগরের দশা ওরকম চিমসানো না হলেও কাছাকাছি তো বটেই।

স্ত্রী ভাগ্য বলে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে ছোটো সওদাগর ভাগ্যবান। অর্থাৎ স্ত্রী ভাগ্যে সে সূর্য দশাতেই বহাল আছে। স্ত্রী গুলমোহরের রূপ আর গুণের পাল্লা সমানে সমানে। এমন স্ত্রী পাশে নিয়ে হাঁটলে ৩০ ইঞ্চির সিনাও ৪০ ইঞ্চির মতো দেখায়। ফলে গুলোমোহরকে পাশে নিয়ে হাঁটাও বিপজ্জনক। লোকজন ৩০-৪০ ইঞ্চি সিনার ঘেরাটোপে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এবং এই যুগলের দিকে ঘন-ঘন দৃষ্টিপাত ঘটে।

গুলমোহরের রূপ-গুণ সমান-সমান। তার শৌখিনতাও রূপ-গুণের সমান-সমান। বিস্তর ঠেলাঠেলি করেও এই শৌখিনতা ভাগানো যায় নাই। ছোটো সওদাগর মাঝেসাঝে রসিকতা করে বলে–‘শখদার রমণী-’
জবাবে গুলমহর কিছু না বললেও তার সিনার স্ফীতি চোখে পড়ে যায়।

মানিব্যাগের স্ফীতি পরখ করার জন্য ঘন-ঘন পাছায় হাত দেয়া, এর সঙ্গে শখদার রমণীর হাউসের ভূমিকা যে সোনায় সোহাগা তা বলা বাহুল্য। কেরানিগিরির জীবনে পেটমোটা মানিব্যাগ ছোটো সওদাগর দুঃস্বপ্নেও দ্যাখে না। তবে চামচিকার মতো সামান্য স্ফীতি তার ব্যাগের আছে। যদিও এই স্ফীতি থাকা বা না থাকা সমান কথা। এবং আজ, এই মুহূর্তে ছোটো সওদাগর চিন্তিত বটে। 

গুলমোহর মাস দুয়েক আগে কি এক ছাতা-মাতা দেখে গেছে। এ নিয়ে তার প্যানপ্যানানির অন্ত নাই। ছোটো সওদাগর মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে প্রকাশ করে নাই। সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর কাছে মানসম্মান রাখাও তার বিবেচনার ভেতরই পড়ে। ফলে মানিব্যাগ মোটা-তাজা কি না তা নিয়ে ভেবেও আর লাভ নাই।

ছোটো সওদাগর আর গুলমোহর বেগম এখন নিউমার্কেটের ভেতর। নিয়ন ছিটকানো বড়োসড়ো একটা দোকানে এই যুগল ঢুকে পড়েছে। সাদা আলোর নীচে দণ্ডায়মান এই নব-দম্পতি। আর বাইরের সাইন বোর্ডে ঝুলছে-‘মুরাদিবাদী ফুলদান শোভা।’যার ভেতর লাল-সবুজ বিজলি বাতি জলের তাড়নায় চলাচল করছে।

মাস দুয়েক আগে দেখে যাওয়া ‘মুরাদিবাদী ফুলদান শোভা’র পেছনের কাহিনি জোবেদা খাতুনের।

গুলমোহরের শাশুড়ি জোবেদা খাতুনের শখ যত নষ্টের গোড়া। নিম্ন আয়ের কেরানির বউয়ের শখ একেবারে মেঘ ফুঁড়ে গেছে। মেঘ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসমানের গায়ে ঠেকেছে। যার নজির গুলমোহরের চোখ এড়াতে পারে নাই।

জোবেদা খাতুনের শখ উঁকি-ঝুঁকি মেরে এখন চুপচাপ পড়ে আছে নড়বড়ে এক শো-কেসের ভেতর। শো-কেসের দুই পাল্লায় আড়াই খানা ভাঙা কাঁচ। অবশ্য এই ভাঙাচোরাতে কাচগর্বী শো-কেসের কিছু যায় আসে নাই।

গুলমোহর আড়াইখানা ভাঙা কাচের দুইখানার ভেতরই হাত গলিয়েছে। তারপর বের করে এনেছে জোবেদা খাতুনের শখ—মধ্যম সাইজের জোড়াভাঙা ফুলদান আর একটা গোলাপপাস।

দীর্ঘদিন ব্যবহারে যাদের আসল চেহারা উধাও হয়েছে। জেল্লা হারিয়ে এদের আগপাশ-তলায় সবুজ সবুজ প্রলেপ পড়েছে। যেন কোনো জলের তলায় ডুবন্ত নৌকা। জলের স্পর্শে শ্যাওলার স্তর পড়া। গুলমোহর হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে না দেখতেই জোবেদা খাতুন হা হা করে ছুটে এসেছে—‘ও বউ থুয়া দেও। থুয়া দেও। এইডা আমার হাউসের ধন-যার দাম আমার কাছে লাখ ট্যাকা।’ 

শাশুড়ির অবস্থা দেখে গুলমোহরের টাসকি লাগা অবস্থা। জোবেদা খাতুনের ছোটোলোকি আচরণে সে একেবারে হতভম্ব। জোবেদা খাতুন প্রায় চিলের মতো ছোঁ মেরে জিনিস দুইখান হাতিয়ে নিয়েছে।

জোবেদা খাতুনের ফুলদান ও গোলাপপাস জোড়হীন। এই জোড়হীনতার রহস্য গুলমোহর ভেদ করেছে। জোবেদা খাতুনও তো স্ব-সংসারে অস্বচ্ছলই বলা চলে। যার একদিক ঢাকলে অন্যদিক উদাম হয়ে যায়। ফলে তারও অনেক সখ-সাধকে ধামাচাপা দিয়ে চলতে হয়েছে।

ধামচাপা দিয়ে চলতে চলতেই এদের আর জোড় মেলানো হয় নাই।

‘মুরাদিবাদী খুশবুঘরে’ দুইখান ফুলদান পাশাপাশিই শোয়ানো ছিল। গোলাপপাসও তাই। এবং জোবেদা খাতুনের নজর পড়েছিল দুই জোড়ার দিকে। দুইকুল রাখতে গিয়ে তাকে জোড় ভেঙে কিনতে হয়েছিল। অবশ্য এই জোড়ভাঙা নিয়ে দোকানদারও মূলামূলি কম করে নাই!

‘আফা জুড়া ভাইঙ্গা বেচন যাইব না। জুড়া ভাঙলে কেডায় কিনবো একডা একডা?’

‘কিন্তুক আমার তো দুইখান পদই চাই।’

‘তাইলে আফা এই দুই জুড়াই দিয়া দেই।’

‘না না সেইডা পারুম না। দুইজুড়া কিনন যাইব না।’

‘দেহেনেরও তো শুভা-শুভ লাগে না কি কইন? আসল মুরাদিবাদী মাল।’

দোকানদারের শত ফুঁসলানোতেও কাজ হয় নাই।

জোবেদা খাতুন এই দুই বস্তু থেকে একটা করে বাদ রেখেই কিনেছিল। এক সঙ্গে দুই জোড়া শখ মোটানো তার কাছে সোনার পাথর বাটির মতোই।

গুলমোহর দিলে চোট খেয়েছে–‘এইডা কিমুনতর কথা! কুনু জিনিস-পত্রে হাত দিলেই হেয় চিলের লাহান উইড়া আসে!’
গুলমোহর আরো খেয়াল করেছে আসল জেল্লা হারালেও মিলাদ-মাহফিলে জোবেদা খাতুনের শখের কদর বেড়ে যায়। গোলাপপাস তো জোর কদরে চলে। মাঝে মাঝে ফুলদানও হাওলাত হয়ে যায়। ধপধপা সাদা ফরাসের মাঝখানে শ্যাওলাধরা মুরাদিবাদী ফুলদান। ফুলদানে লালটুকটুকে মোরগঝুঁটি ফুল। সঙ্গে দুই-চারটা হাসনা হেনার ডাঁটা কুণ্ঠিতভাবে সৌরভ বিলায়।

একটা ফুলদানে ঠেকা কাজ চলে-কিন্তু একটা গোলাপপাসে কেমনে কি হয়? হঠাৎ বৃষ্টির ফোঁটায় কিছু মানুষ সুবাসিত হলেও কিছু মানুষ তো চাতকের মতো তাকিয়ে থাকে। গোলাপপাস ফের ভরে না নিলে আর ছিঁটানো যায় না।

ইয়ানবী সালাম ওয়ালাইকা-পড়তে পড়তে কিছু মানুষ গোলাপজলের স্পর্শের আশায় আনমনা হয় এবং তারা তৃষিত থাকে।

০২.

গুলমোহরের মন রাখতে ছোটো সওদাগরকে বেশ কিছু টাকা দণ্ডি দিতে হল। নিয়ন আলোর নীচে আরও বেশি উজ্জ্বলতর হীরার টুকরার মতো শখ এড়ানো গেল না। গুলমোহর লাগাতার দুনোমুনো করেছে–কী কিনবে সে? একজোড়া ফুলদান আর একজোড়া গোলাপপাস? পরনেই মনে পড়েছে ছোটো সওদাগরের মানিব্যাগের স্ফীতি আসলে কতটা? গুলমোহর যেটুকু জানে তাতে বড়ো বেশি সুবিধার কিছু নয়। তাহলে কী করা যায়? দুইজোড়া শখ কেনার মতো টাকা তাদের নাই। তাহলে কি সে জোবেদা খাতুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে? জোড় ভেঙে একটা একটা কিনবে? এবং তাই কিনল গুলমোহর। শুধু  জোড় ভেঙে নয় জোড় অদল-বদল করে কিনল। ফুলদান এখন প্রায় ঘরে ঘরেই দেখা যায়। ফলে গুলমোহর ফুলদান বাতিল করে পরিবর্তে কিনল একখানা আতরদান। যার চারপাশে ধাতব লতা-পাতা আর মাঝখানে তাজমহলের মতো গম্বুজ। গম্বুজের মুখটা একপাশে আটকানো। ঢাকনা খুলে অনায়াসে কিছু তুলা ভেতরে রাখা যায়। পাশে ছোটমোট আতরের শিশিটাও। ফুলদান বাতিল করার পেছনে গুলমোহরের আরো কিছু যুক্তি ছিল—‘ফুলের লগে মৌলুদ শরিফের মাইনে কি?’

মাইনে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে আতর আর গোলাপজলের আছে।

গুলমোহর অবশ্য আরেকটা দ্বিধায় ভেতরেও হাবুডুবু খেয়েছে—‘গোলাপজলের মাইনে কি?’

মৌলুদ শরিফে বেবাকেই গোলাপজল ঢালতেছে—কারো কুনু খেদ আপে নাই। মৌলুদ শরিফে যেটা দেয় তাতে ‘জল’ লাগল কেমনে? ‘জল’ বাদ দিয়া কি ‘পানি’ লাগসই হইত না? অবশ্য গুলমোহর কিছুণ পরই এই ভাবনা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে—‘সুগন্ধি দিয়া হইল আসল কায়কারবার। এইখানে জল হইলেই কী? আর পানি হইলেই কী? বেবাকে তো সুঘ্রাণ নিয়াই ভাবতেছে। জল-পানির বিবাদে দেহি কেউ নাই।’

০৩.

গোলাপপাস আর আতরদান কিনে সোনাদিয়ায় ফিরে গেল গুলমোহর। জোবেদা খাতুনের দুই পুরানা দানের সাথে সাজিয়ে রাখল নড়বড়ে শো-কেসে। এবং গুলমোহরের কদর বাড়ল। মৌলুদ শরিফে তার গোলাপপাস আর আতরদানের ঘনঘন ডাক পড়তে লাগল। গুলমোহরে মনে প্রশান্তি—‘জোবেদা খাতুনের গুমর তাইলে ভাঙনো গেছে!ডেনাভাঙা প্রজাপতির মতো দুইখান পুরানো বস্তু নিয়া কিমুনতর আ-দেখলাপনা!’

জোবেদা খাতুনের ফুলদান আর গোলাপপাস তখনও হাওলাত হয় কিন্তু নতুন গোলাপপাসের পাশে তাদের ঠিক খাটে না। দেখে জোবেদা খাতুনের চু জলে ভরে ওঠে। তার যৌবনকালে এই দুই বস্তু নিয়া কাড়াকাড়ির অন্ত ছিল না! এরাও হেই সমুয় রূপ আর রোশনায়ে ঝলমলাই ছিল!

গুলমোহরের এই দুই বস্তু আমদানির পর-পরই কিনা সোনাদিয়ায় মানুষ মরার ধুম লেগে গেল! সেয়ান-বুড়া সমানতালে ধপাধপ মরতে লাগল। আজ এই বাড়ির আক্কাস মিয়া তো কাল ওই বাড়ির জুলেখা বেগম। মৌলুদ শরিফের পর মৌলুদ শরিফ। আর মৌলুদ শরিফে অবধারিতভাবে গুলমোহরের গোলাপপাস আর আতরদান। ঝকঝকে গোলাপপাস ভরা গোলাপজলে। আর গুলমোহরের মনে ধান্ধা-গোলাপজল নিয়া কারোরই মাথায় কিরা কিলবিলায় না দেহি! জল বাদ দিয়া পানি হইলেও করত নাকি?

গুলমোহরের মনে জল আর পানির খেলা চলে ওদিকে সোনাদিয়া গ্রামে মানুষ মরে ধূ ধূ হয়ে যেতে থাকে। জোবেদা খাতুন দুই একবার আতরদানটা হাতে নিয়ে দেখেছে—‘আমাগো আমলে এমুন পদ আছিল না! আর এমুন কারুকার্য্য!’
এই দুঃখ জোবেদা খাতুনকে কাবু করে কিনা বুঝা যায় না। কিন্তু অল্প কয়েকদিনের মাঝেই তার মৃত্যু হয়।

জোবেদা খাতুনের মৃত্যু পরবর্তী মৌলুদ শরিফে গুলমোহরের কেনা গোলাপপাস কাজে লাগে। আর তাতে গোলাপজল ঢালতে ঢালতে গুলমোহরের মুখে এক ধরনের তৃপ্তি দেখা যায়। এমনকি তার ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে বাঁকা হাসি ঝুলে থাকে।
আতরদানের ঢাকনা খুলে তুলা আর ছোটমোট আতরের শিশি রাখতে রাখতে গুলমোহর কি যেন ভাবে! 

আতরের শিশিটা ফের তুলে নিয়ে নাকের কাছে ধরে লম্বা শ্বাস টানে-‘ইস! এই আতরের ঘেরানাটা দেহি মারাত্মক কড়া!’

০৪.
মিরাজ সওদাগরের ঝলমলা ড্রয়িংরুমের আভিজাত্য বাড়িয়েছে একটা গোলাপপাস ও একটা আতরদান। ছোটো সওদাগরের নাতি মিরাজ সওদাগর এই দুই বস্তুকে অ্যানটিক পিস হিসেবে শো-কেসে যত্ন করে রেখে দিয়েছে…।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২