মণিপুরি ভাষা ও লিপি – এল বীরমঙ্গল সিংহ

মণিপুরি ভাষা ও লিপি – এল বীরমঙ্গল সিংহ

শেয়ার করুন

ভারতের ভাষাগুলো মূলত ইন্দো-আর্য, দ্রাবিড়, অস্ট্র-এশিয়াটিক ও সাইনো-টিবেট ভাষা পরিবারভুক্ত। মণিপুরি ভাষা সাইনো-টিবেট পরিবারের টিবেটো-বার্মা সাব ফ্যামিলিভুক্ত কুকি-চিন গ্রুপের ভাষা। ভারতের টিবেটো-বার্মা সাব ফ্যামিলিভুক্ত ভাষাগুলোর মধ্যে একমাত্র মণিপুরি ভাষার নিজস্ব লিপি ‘মৈতৈ ময়েক’ রয়েছে। মণিপুরি ভাষার প্রাচীন সাহিত্য এ লিপিতেই লেখা। এর মৌখিক সাহিত্য যে খ্রিস্ট জন্মের আগেই প্রচলিত ছিল তার নিদর্শন রয়েছে। মণিপুরের আদি ধর্মীয় উৎসব ‘লাই হারাওবা’-তে ঔগ্রী, থেঞ্চো ইত্যাদি যেসব গান গাওয়া হয় সেগুলো প্রাচীন মণিপুরি মৌখিক সাহিত্যের জ্বলন্ত নিদর্শন। আর লাই হারাওবা উৎসব খ্রিস্ট জন্মের আগে থেকেই প্রচলিত। তাছাড়া নুমিং কাপ্পো, পোইরোইতোন খুন্থোক, হিজন হিরাও ইত্যাদি প্রাচীন মণিপুরি পুঁথির রচনাকালও খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে বলে পণ্ডিতেরা দাবি করেন। আর অধিকাংশ মণিপুরিদের বিশ্বাস মণিপুরের প্রথম রাজা শাবাংবা ৩৩ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসার পর থেকেই নাকি ডায়েরি লেখার ঢঙে মণিপুরের রাজমালা ‘চৈথারোল কুম্বাবা’ ধারাবাহিকভাবে লেখা হয়েছে। মুশকিল হল, মণিপুরি লিপিতে লেখা প্রাচীন পুঁথিগুলোতে লেখকের নাম-ধাম ও রচনাকাল উল্লেখ থাকে না। তাই কবে থেকে মণিপুরি লিপিতে প্রাচীন পুঁথিগুলো লেখা শুরু হয়েছিল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। মণিপুরের বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ববিদ ডব্লিউ য়ুমজাও সিংহ ১৯৩৫ সালে মণিপুরের রাজা খোংতেকচার আমলের (৭৬৩-৭৭৩ খ্রিঃ) একটি তাম্রপত্র আবিষ্কার করেন। তাঁর ‘Report on the Archaeological Studies in Manipur, Bulletin No-1’-এ তাম্রপত্রটির প্রতিলিপি সহ এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। নিংথৌখংজম খেলচন্দ্র, আর কে ঝলজিৎ প্রমুখ মণিপুরের বিশিষ্ট পণ্ডিতেরা অষ্টম শতাব্দীতে মণিপুরি ভাষা লিখিত রূপ পেয়েছিল বলে স্বীকার করেন। তবে চোংথাম মণিহার সহ অনেকেই ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁদের মতে দ্বাদশ শতাব্দীতে ‘মৈতৈ ময়েক’ অর্থাৎ মণিপুরি লিপির জন্ম। এ প্রসঙ্গে সুনীতি কুমার চ্যাটার্জি তাঁর ‘Kirata-Jana-Krti’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, “The beginning of this old Manipuri literature (as in the case of Newari) may go back to 1500 years, or even 2000 years, from now. It is said that there is a copper-plate inscription, of king Khongtekcha, involving Sri Hari (i.e., Vishnu with Lakshmi) and, Siva and Devi, dating from 724 saka (=c. 790 A.D.). But that is problematical, as the king is said to have ruled the Meitheis from 763 to 773 A.D.). The late Yumjao Singh thought that the Poiration Khunthok, a Prose-work describing the settlement of some Meithei tribes, is the oldest work in Manipuri, going back to the 3rd century A.D. (page-158, 5th Edition).”

মণিপুরের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজা গরিবনিওয়াজ (১৭০৯-১৭৪৮ খ্রিঃ) সিলেট থেকে আসা শান্তদাস গোস্বামীর কাছে বৈষ্ণব ধর্মের দীক্ষা নেন। দূরদর্শী শান্তদাস গোস্বামী বুঝতে পেরেছিলেন মণিপুরি লিপিতে লেখা প্রাচীন পুঁথিগুলো চালু থাকলে প্রজাদের কখনও আদি ধর্ম ত্যাগ করে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা দেওয়া যাবে না। তাই গুরু শান্তদাসের পরামর্শে অনুগত শিষ্য রাজা গরিবনিওয়াজ মণিপুরি লিপিতে লেখা প্রাচীন পুঁথি সমূহ সংগ্রহ করে ১৭৩২ খ্রিস্টাব্দে পুড়িয়ে ফেলেছিলেন যা মণিপুরের ইতিহাসে ‘পুরাণ মৈ থাবা’ বা প্রাচীন পুঁথির বহ্ন্যুৎসব নামে উল্লেখিত। খুন্থেম কাওমচা সিংহ তাঁর ‘মণিপুর ইতিবৃত্ত’ (১৯৩৪) এবং পণ্ডিতরাজ অতোনবাপু শর্মা তাঁর ‘পাখংবা’ (১৯৫২) নামক বইয়ে এই প্রাচীন পুঁথি পোড়ানোর কথা উল্লেখ করেছেন। পুড়ে যাওয়া ১২৩টি প্রাচীন পুঁথির নামের তালিকা সেখানে উল্লেখ রয়েছে। রাজা গরিবনিওয়াজ প্রাচীন পুঁথি পুড়িয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, মণিপুরি লিপিতে লেখা সব প্রাচীন পুঁথি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ফতোয়া জারি করেন, মণিপুরি লিপিতে লেখা কোনো পুঁথি কারও কাছে পাওয়া গেলে তাকে চরম শাস্তি দেওয়া হবে। রাজদণ্ডাদেশের ভয়ে সেদিন মণিপুরি লিপিতে সাহিত্যচর্চা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে দীর্ঘকাল মণিপুরি সাহিত্যচর্চা থমকে গিয়েছিল। তাই অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম অধ্যায় পর্যন্ত এই সময়ে মণিপুরি ভাষায় তেমন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি হয়নি। তবে সেই সময়ে মণিপুরি সংস্কৃতির বিকাশ চরম শিখরে পৌঁছেছিল। এই সময়েই সৃষ্টি হয়েছিল মণিপুরি ধ্রুপদী নৃত্য রাস ও নটসংকীর্তন। এ পর্বে বাংলা লিপিতে রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত ইত্যাদি মণিপুরি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। মণিপুরি সাহিত্যকে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক এই তিনটি পর্বে ভাগ করা হয়েছে। ১৭৩২ সালে রাজা গরিবনিওয়াজ কর্তৃক প্রাচীন মণিপুরি পুঁথি পোড়ানো পর্যন্ত সময়কে মণিপুরি সাহিত্যের প্রাচীন যুগ, প্রাচীন পুঁথি পোড়ানো (১৭৩২) কাল থেকে ইঙ্গ-মণিপুর যুদ্ধ (১৮৯১ খ্রিঃ) এই সময়কে মধ্যযুগ এবং ইঙ্গ-মণিপুর যুদ্ধ (১৮৯১ খ্রিঃ) পরবর্তী কালকে আধুনিক যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মণিপুরি সাহিত্যচর্চায় প্রাচীন ‘মৈতৈ ময়েক’-এর পরিবর্তে ক্রমেই বাংলা ও অসমীয়া লিপি ব্যবহার হতে শুরু করে। ব্রিটিশের উদ্যোগে মণিপুরে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে আধুনিক শিক্ষা চালু করার সময় বাংলা লিপিতেই পঠনপাঠন শুরু করে। মণিপুরি লিপিতে ছাপার ব্যবস্থা না থাকার কারণে পাঠ্য পুস্তক ও মণিপুরি ভাষার বই বাংলা লিপিতেই ছাপতে হয়েছিল। ফলে সাধারণের মধ্যে মণিপুরি লিপির পরিবর্তে বাংলা লিপির ব্যাপক প্রচলন ঘটে। মণিপুরি লিপির চর্চা মুষ্টিমেয় কিছু পণ্ডিত ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। বিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্ন থেকেই বাংলা লিপিতে আধুনিক মণিপুরি সাহিত্যের জয়যাত্রা শুরু হয়। মণিপুরি সাহিত্যচর্চায় গুণগত পরিবর্তন ঘটে। বলা বাহুল্য বিংশ শতাব্দীর প্রথম কয়েক দশককে মণিপুরি সাহিত্যের ‘রেনেসাঁ যুগ’ বলে আখ্যায়িত করা যায়।

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে মণিপুরে আর্য সংস্কৃতি ও ভাষার আগ্রাসনে মণিপুরি ভাষা ও সংস্কৃতি যে বিপন্ন হয়ে পড়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে বৈষ্ণব ধর্মের প্রবল আগ্রাসনের মধ্যেও মণিপুরিরা নিজস্ব সংস্কৃতিকে হারিয়ে যেতে দেননি। মন্দিরে ব্রাহ্মণ পুরোহিতের মাধ্যমে দেবদেবীর পূজার্চনা করার পাশাপাশি প্রতিটি মণিপুরি ঘরে গৃহকর্তারা তাদের আদি দেবদেবী সনামহি, লেইমরেল শিদবী, অপোকপা ইত্যাদির পূজার্চনা করে গেছেন। তাদের আদি উৎসব ‘লাই হারাওবা’-কেও বাঁচিয়ে রেখেছেন। শুধু তাই নয়, রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র ভাগবতের ভাবাদর্শ ও চিরাচরিত মণিপুরি নৃত্যকে ধ্রুপদী নৃত্যে উত্তরণ ঘটিয়েছেন। আর্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে মণিপুরি সংস্কৃতির গুণগত মানের উত্তরণ ঘটলেও মণিপুরি ভাষা চক্রব্যূহের কবলে পড়ে গিয়েছিল। প্রথমেই তাকে হারাতে হয়েছিল নিজস্ব লিপি। সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মে মণিপুরি ভাষা ক্রমেই ব্রাত্য হয়ে পড়েছিল। লাই হারাওবা উৎসবেই কেবল মণিপুরি ভাষার স্থান প্রাধান্য পেয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে যখন মণিপুরে আধুনিক শিক্ষা চালু হয় তখন প্রথম দিকে মাতৃভাষা হিসেবে মণিপুরি ভাষা পড়ার সুযোগও ছিল না। কবি চাউবা, হিজম ইরাবত সিংহ প্রমুখের প্রচেষ্টায় প্রাথমিক স্তরে মণিপুরি ভাষা শিক্ষা চালু হয় এবং ১৯২৪ সালে প্রথম কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মণিপুরি ভাষায় এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসার সুযোগ পায়। পরবর্তীকালে পর্যায়ক্রমে কলিকাতা, গৌহাটি, জে এন ইউ, মণিপুর, অসম ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে মণিপুরি ভাষার পঠনপাঠন চালু হয়।

মণিপুরি ভাষায় সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি এর গুরুত্ব ও মর্যাদা বৃদ্ধির প্রচেষ্টাও চলতে থাকে। রাজন্য আমলে মণিপুরি ভাষা রাজসভার ভাষা হিসেবে প্রচলিত ছিল। রাজকার্য ও বিচার ব্যবস্থা মণিপুরি ভাষাতেই পরিচালিত হত। ১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর ভারতভুক্তির পর মণিপুর কেন্দ্রশাসিত একটি অঞ্চলে পরিণত হয়। ফলে মণিপুরবাসী মণিপুরকে পূর্ণরাজ্যের মর্যাদা প্রদানের দাবি তোলে। ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান চালু হওয়ার সময় প্রথমে ১৪টি ভারতীয় ভাষাকে সংবিধানের ৮ম তপশিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ১৪টির মধ্যে ১০টি ভাষা ইন্দো-আর্য ভাষা আর বাকি ৪টি দ্রাবিড় পরিবারভুক্ত ভাষা। টিবেটো-বার্মান ও অস্ট্র-এশিয়াটিক পরিবারের কোনো ভাষাকেই সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাই সংবিধান চালু হওয়ার দিন থেকেই মণিপুরি ভাষাকে সংবিধানের ৮ম তপশিলে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে মণিপুরি সাহিত্য পরিষদ ও অন্যান্য সাহিত্য সংস্থা সোচ্চার হয়ে ওঠে। এ দুটো দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৭২ সালে মণিপুরকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয় এবং মণিপুরি ভাষাকে ভারতের সাহিত্য অকাদেমি স্বীকৃতি দেয়। এরপর ১৯৭৩ সাল থেকে প্রতি বছর মণিপুরি ভাষার একজন লেখককে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার দিয়ে আসছে। সাহিত্য অকাদেমির অধীনে একটি মণিপুরি ভাষা উপদেষ্টা পর্ষদও রয়েছে। মণিপুরি ভাষাকে সংবিধানের ৮ম তপশিলে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে আন্দোলন ক্রমেই জোরদার হয়ে ওঠে। সাহিত্য সংস্থাগুলো ছাড়াও ছাত্র-যুব, বুদ্ধিজীবীরাও এতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ১৯৭৭ ও ১৯৮৪ সালে দু দুবার মণিপুরি ভাষাকে সংবিধানের ৮ম তপশিলে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়ে বিধানসভায় সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই দাবিতে মণিপুরে গণধর্না, অনির্দিষ্টকালের অনশন, মিটিং, মিছিল, বন্‌ধ পালিত হয়। এমনকি দিল্লির বোটক্লাবে গণধর্না, গণঅনশনও পালিত হয়। গণআন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত ১৯৯২ সালের ২০ আগস্ট পার্লামেন্টে ৭১ তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে মণিপুরি সহ কোঙ্কনি ও নেপালি ভাষাকে সংবিধানের ৮ম তপশিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাই মণিপুর সহ মণিপুরি অধ্যুষিত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এই ২০ আগস্ট দিনটিকে মণিপুরি ভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। পরবর্তীকালে ২০০৩ সালে ৯২ তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে আরও চারটি ভাষা—বোড়ো (টিবেটো-বার্মান), সাঁওতালি (অস্ট্র-এশিয়াটিক), ডোগরি এবং মৈথিলি ভাষাকেও ৮ম তপশিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখন সংবিধানের ৮ম তপশিল ভুক্ত মোট ভাষার সংখ্যা ২২টি।

মণিপুরি লিপি বা মৈতৈ ময়েক

মণিপুরিদের নিজস্ব লিপি থাকা সত্ত্বেও অন্য ভাষার লিপিতে পঠনপাঠন ও সাহিত্যচর্চাকে অনেকেই মানতে চায়নি। নিজের মণিপুরি লিপিতে আবার পঠনপাঠন ও সাহিত্যচর্চা শুরু করার জন্য তারা দাবি তোলে। তাই মণিপুর সরকার ১৯৭৩ সালে গঠন করে Meitei Mayek Advisory Committee। এই এডভাইজারি কমিটি সব দিক বিবেচনা করে সর্বসম্মতিক্রমে সরকারের কাছে ২৭ অক্ষর বিশিষ্ট মণিপুরি লিপিমালা স্বীকৃতি দেবার জন্য সুপারিশ করে। যথারীতি সরকারও সেই সুপারিশ মেনে নেয় এবং ১৯৮২-৮৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিদ্যালয় স্তরে এ লিপিতে পঠনপাঠন শুরু করা হবে বলে ঘোষণা করে। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে অনেক দেরিতে ২০০৬ সাল থেকে মণিপুরের বিদ্যালয় স্তরে মণিপুরি লিপিতে পঠনপাঠন চালু করে। ক্রমে তা বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় স্তরে পেরিয়ে বর্তমানে মণিপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে পঠনপাঠন শুরু হয়েছে। এর ফলে মণিপুরের বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে বাংলা লিপি ক্রমেই অপরিচিত হয়ে পড়েছে। তাই এখন মণিপুরে অধিকাংশ শিশুসাহিত্যের বই মণিপুরি লিপিতে ছাপা হয়। অন্য সাহিত্যের বইও বাংলা ও মণিপুরি দুটো লিপিতে ছাপা হচ্ছে। আগামী দিনে মণিপুরি সাহিত্যের সব বইপত্র তাদের নিজস্ব লিপিতেই ছাপা হবে। আগামী ২০২২ সাল থেকে মণিপুরের দৈনিক সংবাদপত্রগুলো বাংলা লিপির পরিবর্তে মণিপুরি লিপিতে ছাপা হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। সংবিধানের ৮ম তপশিলভুক্ত ভাষা হিসেবে মণিপুরি ভাষায় তার নিজস্ব লিপিতে ভারতের কারেন্সি নোটে টাকার সংখ্যা ছাপার জন্য সম্প্রতি রাজ্যসভার অধিবেশনে দাবি তুলেছেন মণিপুরের সংসদ লাইশেম্বা সানাজাওবা।

মণিপুরি ভাষা ভারতের অন্যতম একটি প্রাচীন ভাষা। যেসব ভারতীয় ভাষার অন্তত পনেরোশ বছর আগের সাহিত্যের নিদর্শন রয়েছে সেগুলোকে ধ্রুপদী ভাষা (Classical Language) হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। ২০০৪ সালে প্রথম তামিল ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে আরও পাঁচটি ভাষা—সংস্কৃত (২০০৫), তেলেগু (২০০৮), কন্নড় (২০০৮), মালয়ালম (২০১৩) ও ওড়িয়া (২০১৪)-কে ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ভারতের একটি প্রাচীন ভাষা হিসেবে মণিপুরি ভাষাকেও ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে। মণিপুর থেকে রাজ্যসভায় সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হয়ে লৈশেম্বা সানাজাওবা পার্লামেন্ট বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণী মুহূর্তে মণিপুরি ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। গত ডিসেম্বরে (০৫/১২/২০) ইম্ফলে অনুষ্ঠিত এক সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি জানান, মণিপুরি ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের প্রসঙ্গ তিনি যে রাজ্যসভায় উত্থাপন করেছিলেন তার উত্তরে কেন্দ্র সরকার ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চারটি ক্রাইটেরিয়া জ্ঞাতব্য তথ্য রাজ্য সরকারের মাধ্যমে পাঠাতে বলেছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের জানতে চাওয়া তথ্য সমূহ মণিপুর সরকার অতি শিগগিরই পাঠানোর জন্য উদ্যোগ নিয়েছে বলে সাংসদ সানাজাওবা জানিয়েছেন।

ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য দরকারি সেই চারটি ক্রাইটেরিয়া হল—

i) High Antiquity of its Texts Recorded History over a period of 1500-2000 years.

ii) A body of Ancient literature/texts which is considered a valuable Heritage by generations of speakers.

iii) The literary tradition be original and not borrowed from another speech community.

iv) The Classical Language and Literature also be a Discontinuity between the Classical Language and its later Forms or its Offshoots.

বলা বাহুল্য ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য প্রাচীন এক ভারতীয় ভাষা হিসেবে মণিপুরি ভাষা উপরোক্ত প্রায় সব ক্রাইটেরিয়াই পূরণ করে।

মণিপুরি ভাষা সাইনো-টিবেটো পরিবারভুক্ত ভাষা হলেও এর লিপি ‘মৈতৈ ময়েক’ ব্রাহ্মীলিপি থেকে উদ্ভূত। তবে মণিপুরি লিপির কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মণিপুরি বর্ণমালার মোট সংখ্যা ২৭টি। এর মধ্যে স্বরবর্ণ মাত্র ৩টি , যথা—অ, ই, উ। তবে ‘অ’ বর্ণের সঙ্গে ‍‍‌‍‌‌‌‍আ-কার, এ-কার এবং ও-কার যুক্ত করে আরও ৩টি স্বরধ্বনি লেখা হয়। আর ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা ২৪টি। মণিপুরি লিপিতে মূল বর্ণ ১৮টি। এই ১৮টি বর্ণের উচ্চারণ মানব শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে নেওয়া হয়েছে। যেমন—কোক (মাথা)-ক, সম (চুল)-স, লাই (ললাট)-ল, মীৎ(চোখ)-ম ইত্যাদি। ব্রাহ্মীলিপিতে অন্যান্য ভাষায় বর্ণ শেখার জন্য যেখানে ক, খ, গ, ঘ, ঙ এভাবে পড়তে হয়, সেখানে মণিপুরি বর্ণমালা শেখার জন্য পড়তে হয়—কোক-ক, সম-স, লাই-ল, মীৎ-ম এইভাবে। মূল ১৮টি বর্ণের সঙ্গে আরও ৯টি বর্ণ যুক্ত হয়ে মণিপুরি বর্ণমালার সংখ্যা হয়েছে ২৭টি, এই ৯টি বর্ণের উচ্চারণ এসেছে যথাক্রমে— ক>গ, স>ঝ, ল>র, প>ব, চ>জ, ত>দ, খ>ঘ, থ>ধ এবং ফ>ভ।

মূল ১৮টি বর্ণ যাদের উচ্চারণ মানব শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে নেওয়া হয়েছে
মূল ১৮টি বর্ণের সঙ্গে পরে যুক্ত ৯টি বর্ণ

এছাড়াও মণিপুরি বর্ণমালার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল কিছু বর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপ যা বাংলায় হসন্তচিহ্ন দিয়ে প্রকাশ করে থাকে যে রকম ক্, ল্, ম্, প্ ইত্যাদি ৮টি বর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপ রয়েছে। এরূপ ৮টি বর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপকে বলা হয় ‘লোনসুম ময়েক’ অর্থাৎ বর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপটি লিখতে হয়। হসন্তযুক্ত বর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপটি লিখতে হয়। বাংলা বর্ণমালায় ‘ং’ একটি বর্ণ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও মণিপুরি বর্ণমালায় এটি একটি অক্ষর চিহ্নমাত্র।

লোনসুম ময়েক বা হসন্ত বর্ণ
চৈতপ ময়েক বা অক্ষরচিহ্ন
সংখ্যাবাচক শব্দ

তথ্য ঋণ:—
১. Kirat-Jana-Krti— Suniti Kumar Chatterji
২. The History of Manipur (An Early Period)— Wahengbam Ibohal SinghSingh
৩. A History of Manipuri Literature (Part I & II)— R. K. Jhalujit
৪. A History of Manipuri LiteratureLiterature— Ch. Manihar Singh
৫. অরিবা মণিপুরী সাহিত্যগী ইতিহাস— নিংথৌখোংজম খেলচন্দ্র সিংহ
৬. মণিপুরী, ভাষা ও সাহিত্য — এ কে সেরাম (সম্পাদনা)

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২