বর্ষশেষের কলকাতা : কলকাতার ক্রিকেট (পর্ব ৭) – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

বর্ষশেষের কলকাতা : কলকাতার ক্রিকেট (পর্ব ৭) – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

সপ্তম পর্ব 

১৯২০ এর দশক ভারত তথা বাংলার ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘ভদ্রলোক’ সমাজের শিক্ষিতদের কাছে ক্রিকেট গ্রহণ করা ও ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে কতকগুলি কারণ ছিল। বোরিয়া মজুমদারের মতে, ক্রিকেট ছিল শিক্ষিত ভদ্রলোকদের কাছে অহিংস পদ্ধতিতে ব্রিটিশরাজের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা। সেই সময়ে যখন মূলত ১৮৫৭ সালের পরবর্তী সময় সশস্ত্র আন্দোলনকে আর ছড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না। তাছাড়া ১৮৫০-৭০ এর সময়ে শরীরচর্চা জাতীয় দেশি খেলাগুলিকে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ মার খাওয়ায় ক্রিকেট ও ফুটবলের মতো ইউরোপীয় খেলাগুলির প্রতি নজর দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও গত্যন্তর ছিল না। এই কারণে বাঙালি ভদ্রলোক সমাজ-মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে দেশি রাজাদের।

এখানেই ভারতের অন্য অংশের সাথে বাংলার ক্রিকেটের পার্থক্য যে মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক সমাজ সরাসরি এখানে যুক্ত ছিল খেলাটির সঙ্গে খেলোয়াড় এবং সংগঠক হিসেবে এবং তাদের সহায়তায় ছিল নাটোর, কোচবিহার, ময়মনসিংহের জমিদার, সামন্ত-দেশীয় রাজন্যবর্গ। যেখানে অন্যত্র খেলাটির মূল সংগঠনে নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্যবসায়ী বা দেশীয় রাজাদের। বম্বের প্রথম যুগের খেলোয়াড়দের মধ্যে পাভ্রী, কাঙ্গা ভাইয়েরা, বাপাসোলা, ওয়ার্ডেন এরা সবাই পারসি। আবার উত্তর পশ্চিম ভারতের দেশীয় রাজপরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন রণজি, দলীপ, পাতিয়ালা পিতা-পুত্র। কিন্তু বাংলার প্রথম যুগের খেলোয়াড়রা মুলত ভদ্রলোক সমাজের। রাজপরিবার থেকে খেলোয়াড় এলেও তাঁরা খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলেন না।

ক্রিকেট ক্লাবগুলিতে এই ভদ্রলোকদের নিয়ন্ত্রণ ছিল এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সামন্তরা। ভুললে চলবে না যে জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ডে এই দুই গোষ্ঠীর যৌথ উদ্যোগই চলত। যদিও এর মূল কাণ্ডারি ছিলেন ভদ্রলোকরা এবং এটাও সত্য যে সামন্তরা খুব একটা ব্রিটিশ-বিরোধী ছিল না। কিন্তু ক্রীড়াক্ষেত্রে এমনটা খুব একটা দেখা যায়নি।এদেরি যৌথ উদ্যোগে ক্রীড়াক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ প্রবেশ করে। ব্রিটিশ শিক্ষা (যা মূলত ইংল্যান্ডের পাবলিক স্কুল-এর কাঠামো অনুসারে তৈরি) ব্যবস্থাই তৈরি করেছিল ভদ্রলোক সমাজকে। যারা ক্রীড়াক্ষেত্রে ‘ভিক্টোরীয় মতাদর্শ’-এর “খেলোয়াড়ি মনোবৃত্তির” ভারতীয়করণ করায়। এই মডেল ব্রিটিশ কলোনিগুলির সর্বত্র দেখা যায়, যদিও ভিন্ন ভিন্ন চেহারায়। তাছাড়া প্রশাসনের কোনও ইচ্ছা ছিল না যে তাঁরা স্কুল-কলেজে ক্রীড়া চর্চার উদ্যোগকে বন্ধ করে দেবে।

এই ব্যাপারটি একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। প্রথমত, একটি বিষয় মনে রাখতে হবে – ভারতে আভ্যন্তরীণ সংস্কারের ক্ষেত্রে ১৮১৫ থেকে ১৮৫৭ অবধি ব্রিটিশ দৃষ্টিভঙ্গি যা ছিল তা ১৮৫৭ পরবর্তী যুগে ছিল না। একথা ব্রিটিশ সরকার মহারানীর ঘোষণাপত্র দ্বারা (১৮৫৮) উল্লেখ করেই দিয়েছিলেন। ফলে স্কুল কলেজে ক্রীড়া ব্যবস্থা চালু রাখা বা বন্ধ করার কোনওটাই ব্রিটিশদের হাতে ছিল কিনা বা তাঁরা করতে চাইত কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

দ্বিতীয়ত, পার্থ চ্যাটার্জী তার ‘The nation and it’s fragment’ (colonial and post colonial histories)(oup,1995) গ্রন্থে দেখিয়েছেন এই একই বিষয় যে ‘From the 1820s to the 1870s, was the period of “social reform”, when a colonial enlightenment was beginning to “modernize” the customs and institutions of traditional society and the political spirits was still very much that of collaboration with the colonial regime, nationalist had still not emerged.’(P-5).

উপরন্তু বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন যেমন দেখিয়েছিলেন একটি কল্পিত সমাজ যা একটি পূর্ণাঙ্গ আকার ধারণ করে সেই সব প্রতিষ্ঠান দ্বারা যাকে তিনি, মানে বেনেডিক্ট বলেছেন “Printed capitalism” তা পার্থ চ্যাটার্জী মেনে নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ‘কাদের কল্পনা’ (প্রথম চ্যাপ্টারের নাম)। এখানে পার্থবাবু দেখাচ্ছেন যে উপনিবেশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদ তাদের নিজস্ব ‘ডোমেইন’ তৈরি করে ‘সভেরেন্টি’এর ক্ষেত্রে। এবং এটি তৈরি হয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে যুদ্ধ হওয়ার আগে। এটি করতে গিয়ে দুটো ভাগে তাঁরা জগতকে ভাগ করেন — (১) বস্তুগত, (২) আত্মগত। বস্তুগত জগতে অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাঁরা পাশ্চাত্যের আধিপত্য মেনে নেয় তাকে অনুসরণ ও অনুকরণ করে। আত্মগত জগত ছিল ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি যেখানে ১৮৭০-এর আগের সংস্কার তাঁরা পছন্দ করেনি।ফলে স্কুল কলেজের সরকারি শিক্ষার পাশাপাশি ক্রীড়াচর্চা চলছিল।

কিন্তু এখানে মনে রাখতে হবে যে যেমন পার্থবাবু দেখাচ্ছেন তেমনটা হলে দেশীয় ক্লাব বা প্রতিষ্ঠানগুলি পাশ্চাত্য আধিপত্য স্বীকার করে চলত। কিন্তু সর্বত্র তা হয়নি। এখানে পাশ্চাত্য আধিপত্যকে মেনে ক্রীড়াচর্চা হয়েছে কিন্তু তার প্রধান ক্ষেত্র হয়েছে সেইসব প্রতিষ্ঠান যা আসলে আত্মগত ক্ষেত্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ শিক্ষালয় (স্কুল কলেজ) ও ক্লাব (সংস্কৃতি ও ক্রীড়াচর্চা) গুলির মাধ্যমে। এর কারণ হল ঔপনিবেশিক নীতির প্রয়োগ ও তার প্রতিরোধ সর্বত্র এক নয়; দ্বিতীয়ত, রামচন্দ্র গুহ-র মতে, কোনও সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব ক্রীড়াজগতের সবকিছুকে ‘একচ্ছত্র’ ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না।

যাই হোক, এই সামগ্রিক ‘Discourse’ টিই আসলে বম্বের থেকে বাংলার ক্রিকেট চরিত্রকে পৃথক করে দেয়।

সবশেষে সামান্য কিছু কথা — ভিক্টোরীয় যুগের নীতি হল উদারনীতি। যা বহু ক্ষেত্রে বিরাট প্রগতিশীল ভূমিকা নিয়েছে। কিন্তু তার সাথে সাথে আর একটি ব্যাপারও আছে, আর তা হল, এর নিয়মানুবর্তিতা। যা কঠোরভাবে মেনে চলত ইয়র্কশায়ার ক্রিকেট দল (যেমন লাঞ্চের আগে চার না মারা, কোনও রকমের উচ্ছ্বাস প্রকাশ না করা)। যে মানুষটিকে এই যুগের ক্রিকেটের প্রতীক হিসেবে দেখা হয় সেই ডাবলু জি গ্রেস কিন্তু কোনওভাবেই এই আদর্শ খুব একটা মেনে চলেছেন বলে জানা যায় না। আসলে ১৮৭০ এর পর থেকেই রাজনীতিতে ভিক্টোরীয় যুগের অবসান হয়েছিল কিন্তু সামাজিকভাবে তা অটুট ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত। ভারতে শিক্ষিত সমাজ যারা মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে ‘তৈরি’ করেছিল তাঁরা এই নীতিগুলি কঠোরভাবে মেনে চলতেন। এরা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। যদিও সবাই যে আবার এই মানসিকতার সমর্থক তা বলা ভুল।

১৯১১ সালে মোহনবাগান ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্ট-কে ২-১ গোলে হারিয়ে দেয়। এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে এই ঘটনা তৎকালীন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে বিরাটভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং অনেকেই মনে করেন যে আসলে এই ঘটনা বাংলার ক্রিকেট খেলাকে জনমানস থেকে অনেকটা সরিয়ে দিয়েছিল। তবে এমনটা যে সত্যি হয়েছিল, তা মনে করার কোনও বাস্তব কারণ নেই। সেই সময় বহু খেলোয়াড় একই সঙ্গে ফুটবল এবং ক্রিকেট দুটোই খেলতেন এবং প্রকৃতপক্ষে জনমানসে দুটোই সমান প্রভাব ফেলত। এই সময় থেকে বাঙালি খেলোয়াড়রা নিয়মিত প্রথম শ্রেণির ম্যাচে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। ১৯১৭-১৮ সাল নাগাদ কোচবিহারের মহারাজার দলে বিধু মুখার্জী, মনি দাস, সুধন্য বোস, প্রকাশ ঘোষ, প্রতুল ব্যানার্জী এবং শৈলজা রায়-কে খেলতে দেখা যায়। কুমার হিতেন্দ্রনারায়ণও সেই দলে ছিলেন। এছাড়া মহারাজ কুমার ভিক্টর বা জিতেন্দ্রনারায়ণও খেলেছিলেন। এঁদের মধ্যে মনি দাস ফুটবলও খেলতেন। ১৯১১ সালে ভারতের ইংল্যান্ড সফরে নির্বাচিত হয়েও যাননি কালাপানি পেরোতে হবে বলে। কয়েক বছর পরে প্রফুল্ল মুখার্জীও খেলেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে সারা পৃথিবী জুড়ে ক্রিকেট খেলা বন্ধ হয়ে গেলেও ভারতে তা বন্ধ হয়নি। এই সময় ভারতে ৮ খানা প্রথম শ্রেণির ম্যাচ হয়েছিল। আর ঠিক এই সময়তেই বাংলায় প্রথম শ্রেণির খেলায় বাঙালিরা অংশ নেওয়া শুরু করেন। এবং ভারতীয়দের ক্রিকেট মাঠে কিছু অনন্য নজির গড়া শুরু হয়। এই সময়েই সি কে নাইডু প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা শুরু করেন। বাংলাতেও এই সময়ে বেশ কিছু বড়ো মাপের ভারতীয় এবং ব্রিটিশ খেলোয়াড়দের আগমন ঘটে। তারা অনেকেই উন্নত মানের খেলোয়াড় ছিলেন এবং ইংল্যান্ডে নিয়মিত প্রথম শ্রেণির খেলায় তারা ভালো খেলতেন।

১৯২২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়দের একটি দল ভারতে আসে। তাঁরা ৯টি ফুটবল ও দুটি ক্রিকেট ম্যাচ খেলেন। এর মধ্যে ১৪ই জানুয়ারি প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে ম্যাচটি ড্র হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয় দলটি অর্থাৎ ক্রিস্টোফার কন্টিজেন্ট ১০৮/৪ তোলার পরে প্রেসিডেন্সি ৭৪/৫ তুলতে ম্যাচের সময় শেষ হয়ে যায়।

১৫ জানুয়ারি আজকের মোহনবাগান মাঠে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে বাবু মহারাজের ৫১ (বর্তমান দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড় কেশব মহারাজের পূর্বপুরুষ) ও বিলি সুব্বানের ২২ তাঁদের ১০০/৬ (ডিক্লেয়ার্ড) তুলতে সাহায্য করে। জবাবে মনি দাস (অপরাজিত ১০২) ও গোষ্ঠ পাল (অপরাজিত ৬৪) মোহনবাগান কে ২২৯/২ অবধি নিয়ে যায়। খবরে প্রকাশ, পরের সপ্তাহে বালিগঞ্জ ম্যাচে খেলবার জন্য বাবু মহারাজ ও বিলি সুব্বান-কে ডেকেছিল মোহনবাগান। যদি খেলে থাকেন তাঁরা তাহলে বলতেই হবে, এঁরাই মোহনবাগানে খেলা প্রথম বিদেশি।

১৯২৬-২৭ সালে ভারতে প্রথম MCC সরকারি সফরে এল। মূলত CCC এর উদ্যোগেই এটাও সম্ভব হয়েছিল। দলটির ১৮ জন সদস্যের (১৭ জন, ভারতের পাটিয়ালার মহারাজা MCC এই দেশে এলে দলের হয়ে কিছু ম্যাচ খেলেন) ১০ জনই ছিলেন টেস্ট ক্রিকেটার।

এঁদের মধ্যে লেল্যান্ড ৪১টি, বব ওয়াট ৪০টি, মরিস্টেট ৩৯টি ও চিচেস্টার-কনস্টেবল ২৪টি টেস্ট খেলেন। এছাড়াও ছিলেন টেস্টে প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ানের স্বীকৃতি পাওয়া অ্যান্ডি স্যান্ডহ্যাম, তিনিও ১৪টি টেস্ট খেলেন।

এই সফরে অ্যান্ডি স্যান্ডহ্যাম ১৭৫৬ রান করেন প্রথম শ্রেণির খেলায়, বব ওয়াট ১৭৪৭, জে এইচ পার্সন ১২৮৯ ও মরিস্টেট ১১৯৩ রান করেন। মরিসটেট ১১৬টি উইকেটও নেন। এছাড়া জর্জ গিয়ারী ৮১, অ্যাস্টিল ৭১, বয়েস ৫৬, মার্কার ৪২ ও বব ওয়াট ৩২টি উইকেট নেন।

দলের অধিনায়ক ছিলেন আর্থার গিলিগ্যান। ১৮৯৪ সালে জন্মানো আর্থার গিলিগ্যান ১৭ বছর বয়সে ডালউইচ কলেজের হয়ে খেলা শুরু করেন। কেমব্রিজের ব্লু পান, সারের হয়ে প্রথম শ্রেণির কেরিয়ার শুরু করেন, পরে সাসেক্স এ চলে যান ও তাঁদের সেকেন্ড ইলেভেন দলের হয়ে মাইনর কাউন্টি খেলে ৪ ম্যাচে ১৮ উইকেট পান।

প্রথম শ্রেণির খেলায় হার্ড হিটার টেলএন্ডার হিসেবে ৯১৪০ রান করেন ১২টা শতরান সহ, সঙ্গে ছিল ৮৬৮ উইকেট পান (সেরা ৮/২৫)।

১৯২২ সালে তিনি টেস্ট খেলতে নামেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। ১৯২৪ সালে হারবার্ট সাটফ্লিক ও মরিসটেট যে টেস্টে ডেবিউ করেন সেই টেস্টে গিলিগ্যান মাত্র ৭ রানে ৬ উইকেট নেন। গিলিগ্যান গোটা কেরিয়ারে ১১ টেস্টে ৩৬ উইকেট পান।

১৯২৬-২৭ মরশুমে এমসিসির দল নিয়ে ভারতে আসেন ও সফর শেষে ভারতকে ICC মেম্বার করার প্রস্তাব দেন, তাঁর সুপারিশ-এর জন্যই BCCI চালু হয় ও ভারত ICC-র পূর্ণ সদস্য হয়।

অল্পবয়সে তিনি ব্রিটিশ ফ্যাসিস্ট দলের সদস্য হন এবং সম্ভবত অস্ট্রেলিয়া ফ্যাসিস্ট দলেরও প্রতিষ্ঠাতা হন। যদিও দুটোই ১৯২৬ সালে উঠে যায়।

১৯২৬ সালের ২২ ডিসেম্বর, কলকাতায় সিঁথির মাঠ (সম্ভবত, পাইকপাড়ার বেঙ্গল জিমখানা মাঠ) ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হল। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান্স অফ বেঙ্গল নামে একটি দল মুখোমুখি হল এম সি সি-র। অ্যান্ডি স্যান্ডহ্যামের অপরাজিত ১১২ এমসিসিকে পৌঁছিয়ে দিল ২২২/২। গ্যারি ফোর্ড কেবল ১০০ রানে ২ উইকেট নিলেন। জবাবে মাত্র ১০৩ রানে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান্স অফ বেঙ্গল অল আউট। তবে, হাবু মিত্র ২৯ করেন। যার মধ্যে মরিসটেটকে চারটি ছক্কা মেরেছিলেন। ইনিই সেই হাবু মিত্র যিনি ১৯২০ সালের আই এফ এ শিল্ডের সেমি ফাইনালে কুমারটুলির হয়ে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে গোল করে কুমারটুলিকে জিতিয়ে দেন।

যাই হোক, মরিসটেট ৪৬ রানে ৫ উইকেট নেন। গিয়ারি ২৩ রানে ৩ টি ও অ্যাস্টিল ২৩ রানে ২ উইকেট নেন।

এরপর ২৬, ২৮ ও ২৯ তারিখে তিনদিনের প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলা হয় ইয়োরোপীয়ান অফ দ্যা ইস্ট ও এমসিসির মধ্যে।

ইয়োরোপীয়ান অফ দ্যা ইস্ট গীয়ারি (৪/৪৪)-র বিধ্বংসী বোলিংয়ের সামনে ১৪৬ করে। মাদ্রাজের সি পি জনস্টন (তখন কলকাতায়) ৩৫ ও আলেকজান্ডার হোসি (বাংলার প্রথম রঞ্জি অধিনায়ক) ৩৩ করায় এই রানটা ওঠে। জবাবে এমসিসি ৩২৬ তোলে। স্যান্ডহ্যাম আবার ১১২, অ্যাস্টিল ৫১ করেন। সেই ফ্রাঙ্ক ট্যারান্ট ৭৫ রানে ৬ উইকেট পান। জবাবে ইয়োরোপীয়ান অফ দ্যা ইস্ট ১২৫ রানেই শেষ। গাইজ ৪৯ করেন। বয়েস ৫২ রানে ৭ উইকেট নেন।

৩১ ডিসেম্বর শুরু হয় দ্বিতীয় বেসরকারি টেস্ট। প্রথম বেসরকারি টেস্ট ভারত ড্র করেছিল বোম্বেতে। তার আগে হিন্দু ও অবশিষ্ট দলের হয়ে দেড় ঘণ্টায় দেড়শো করেন সি কে নাইডু। প্রথম বেসরকারি টেস্টে সেঞ্চুরি করেন প্রফেসর বি ভি দেওধার।

ইডেনে এত বড়ো ম্যাচ এর আগে হয়নি। ইডেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মানচিত্রে ঠাঁই পেতে চলেছিল।

আই পি এফ ক্যাম্পবেলের অধিনায়কত্বে ভারত টসে জিতে ব্যাট করতে নামল। কিন্তু মরিসটেট ৪২ রানে ৬ উইকেট নিয়ে ভারতকে মাত্র ১৪৬ রানে আটকে দিলেন। কেবল উইকেট রক্ষক ব্রুক ৪৩ ও নাইডু ২৪ করেন। কিন্তু নাজির আলি (৩/৬৯), ক্যাম্পবেল (৩/১২), মেয়ের (২/৭১) ও জামশেদজী (২/৩১) এমসিসিকে ২৩৩ এর বেশি তুলতে দিলেন না। অ্যাস্টিল ৬১, টেট ৫৮, ওয়াট ৪০ ও ব্রাউন ৩০ রান করেন।

ভারত ঘুরে দাঁড়াল। গাইজ (৯১) ও ব্রুক (৭২) প্রথম উইকেটে ১৬৬ তুলল। এটাই প্রথম শ্রেণির খেলায় ভারতের প্রথম শতরানের জুটি। কিন্তু এরপরেই ধ্বস নামে। দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষের আধঘণ্টা আগে ছিল ১৬৬/০, সেখানে তৃতীয় দিনের শুরুতে ১৮৩/৫। পরের দিকে নাজির আলি অপরাজিত ২৫ করেন। ভারত তোলে ২৬৯। টেট ৬৪ রানে ৪ উইকেট নেন, অ্যান্ডি স্যান্ডহ্যাম ৫৭ রানে ৩ উইকেট নেন।

এমসিসির লক্ষ্য ১৮২। তাঁরা ১ উইকেটে ৮৬ তুলে ফেলার পরে জামশেদজির ভেল্কি শুরু হল। ১৪০ রানের মাথায় ৬ উইকেট পড়ে গেল। ওয়াট (অপরাজিত ৯৭) ধৈর্য্য ধরে খেলে ম্যাচ বার করে নিয়ে যান।

এরপরেই গিলিগ্যানের সুপারিশে ভারতে বোর্ড গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হল।

যখন ১৯২৬ সালে BCCI তৈরির উদ্যোগ শুরু হল, তখন বোম্বেতে একটি কনফারেন্সের মাধ্যমে অস্থায়ী বোর্ড তৈরি হয়। তাতে যারা সদস্য হন–

১) বোম্বে, মাদ্রাস, সেন্ট্রাল প্রভিন্স ও পাঞ্জাবের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড।

২)করাচী পেন্টাঙ্গুলার কমিটি।

৩)ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব।

৪)রাজেন্দ্র ক্রিকেট ক্লাব,পাটিয়ালা।

৫)রোশেনারা ক্রিকেট ক্লাব, দিল্লী।

৬) কাথিয়াবাঢ় রাজ্য।

এখানে সিদ্ধান্ত হয় যে বোম্বে, বাংলা ও আসাম, মাদ্রাস ও দক্ষিণ ভারত, সেন্ট্রাল প্রভিন্স, যুক্তপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধ, বিহার ও ওড়িশা, আর্মি স্পোর্টস কন্ট্রোল বোর্ড, রাজপুতানা, সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ান স্টেটস, পাটিয়ালা, পাঞ্জাব, দিল্লি ও জেলার জন্য আলাদা বোর্ড গঠন করতে হবে।

এরই ফলে জন্ম নেয় CABA মানে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম। ইডেনে CCC এর প্যাভিলিয়নে ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২৮ সালে মিটিং হয়। মাননীয় বিচারপতি এইচ জি পিয়ারসনের সভাপতিত্বে (CCC এর তৎকালীন সভাপতি) ওই মিটিং হয়। তাতে উপস্থিত ছিলেন:

ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব:- আর বি ল্যাংডেন, এ এল হৌসি, আই পি এফ ক্যাম্পবেল, এম রবার্টসন এবং এফ এম গ্যারেট।

বালীগঞ্জ ক্রিকেট ক্লাব:- জে বি কলথার্ড এবং আর ডব্লু প্লামার।

স্পোর্টিং ইউনিয়ন:- মণীন্দ্র (বেচু) দত্তরায়।

পার্শি:- এন এন ল্যাংরানা।

মোহনবাগান:- ডি এন গুই।

গ্রিয়ার স্পোর্টিং:- এস কে সিনহা।

কুমারটুলি ইন্সিটিউট:- এস এন কর।

ডালহৌসি:- জে মে ওয়েব।

জ্যাভেরিয়ান(সেন্ট জেভিয়ারস-এর প্রাক্তন):-ডব্লু আর এফ রবিন্সন।

হাওড়া স্পোর্টিং:- বি বি ঘোষ

এরিয়ান:- কে মুখার্জী।

মহামেডান স্পোর্টিং:- সৈয়দ আহমেদ রশিদ।

ক্যালকাটা রেঞ্জার্স ক্লাব:- এন ফোর্ড।

প্রেসিডেন্সী কলেজ:- এম ভট্টাচার্য।

এরপর আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হয় যে সম্পাদক-সভাপতি উভয়েই ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব থেকে হবেন। ইউরোপীয় সদস্য হবে ৩ জন, হিন্দু ২ জন, মুসলিম- ইঙ্গ-ভারতীয়-পার্শি এবং আসাম থেকে একজন করে। সেই হিসেবে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯২৮ সালে CABA প্রথম মিটিং করে। ক্যাম্পবেল, হৌসি আর ওয়েব ইউরোপীয় সদস্য, মোহনবাগানের ডি. এন. গুই এবং টাউন ক্লাবের শৈলজা রায় হিন্দু সদস্য, রবিন্সন ইঙ্গ-ভারতীয় সদস্য হন। পার্শিদের তরফ থেকে সদস্য হন ল্যাংরানা আর আসাম থেকে ল্যাংডেন।

ভারত তথা বাংলার ক্রিকেট নতুন যুগে পা রাখে।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২