নির্জন স্বজনে… – পিয়াল রায়

নির্জন স্বজনে… – পিয়াল রায়

শেয়ার করুন

” বারে-বারে একটি সুর এসে যেন বাজে
হৃদয়ের মধ্যে নিঃশব্দচরণে নেমে আসে
ছিন্নবিচ্ছিন্ন বিস্মৃত দিনের কাহিনী “

কখনো কখনো এমন দিন আসে, চতুর্দিকে যেন ফুটে ওঠে বিষাদের ছায়া। প্রভাতের ফুল ম্লানমুখে পড়ে থাকে কঠোর মৃত্তিকার কোলে।সুখের সমস্ত সুর নস্যাৎ করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বেয়াদপ পাগলামী।ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে কোনো সর্বনাশের ইঙ্গিত নিয়ে। কবরের ঠান্ডা হাওয়ায় ভরে যায় ঘরের আনাচকানাচ।সময়ের প্রেম তীক্ষ্ণ দাঁত বসায় প্রেমের সময়ে। বুকের আগুন পুড়িয়ে মারতে চায় প্রাণোচ্ছল আদিম সুরটিকে।

“কত রাত গিয়েছে এমন
বয়েছে রে বসন্তের বায়,
পূবের জানালা দিয়ে ধীরে
চাঁদের আলো পড়েছে ওর গায়!

কত রাত গিয়েছে এমন
দূর হতে বাজিত রে বাঁশি
সুরগুলি কেঁদে কেঁদে ফিরে
বিছানার কাছে কাছে আসি।”

এভাবে কেন যে আপনি আমায় ধ্বংস করে রেখে গেলেন। কেনই বা এলেন কেনই বা চলে গেলেন? আপনার বৃহৎ কর্মজগৎ আপনাকে টেনে নিয়ে গেল। ভুলিয়ে দিল দুদিনের সেই মত্ত খেলাঘর। বোকা আমি, আমার সবটুকু তুলে দিয়েছিলাম আপনার হাতে। হৃদয়ের অপেক্ষা তখনো বুঝিনি। না চাইতেই দুহাত ভরে দিয়েছিলেন শ্বেতপদ্মের রাজকীয় জৌলুস। দেখুন, আজ সেসবই ফিরে এসেছে রক্তাক্ত , ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের শীর্ণ রূপ নিয়ে।পিতার আদরিনী ভুলে গেছে আনন্দময় জীবনের অনাবিল স্রোত। বাজার সরকার বাবার সময় তো ছিল না কচি মেয়েকে কোলে নিয়ে ভালোবাসার চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেওয়ার। তাই বোধহয় আপনার হাতে তুলে দিলেন সে অভাব পূর্ণ করতে। আর তুলে দিয়েই চলে গেলেন অন্যত্র। তাঁর সকাতর পিতৃহৃদয় হয়তো বুঝেছিল কন্যার আগামী অসহায়তা। তিনি নিজ চোখে দেখতে চাননি তা। দেশের দশের প্রগতিকামী এমন পরিবারের সকলের কানে পুরাতন হয়ে বাজলো পিতার আদরের মাতঙ্গিনী নাম। বহু পুরাতন, বহু ব্যবহারদীর্ণ সে নাম বিবাহের প্রয়োজনে উপড়ে ফেলে নতুন বেনারসির ছোঁয়ায় ঝলমলে হয়ে উঠলো কাদম্বরী। আপনার সোহাগিনী। জীবন উদযাপনে প্রাণের আরাম এনে দিলেন নিগূঢ় ভালোবাসায়। হায়, তবু যেদিন পাথর গড়িয়ে গেল ঢালে,ঘর্ষণে ঘর্ষণে পাথর ভাঙার শব্দটুকুও পেলেন না আপনি। আপনার কৃপার অপেক্ষায় আজীবন উপোসী থেকে গেল আপনারই সোহাগিনী।

আমি খুব বোকা। আমি আমাকে নিয়ে জীবনের এই রঙ্গ, রসিকতা বুঝিনি। বিষণ্ণ বিকেলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আজ বুঝতে পারি, ঢেউ আসে আসলে ফিরে যাবার জন্যই। নিষ্পাপ বালিকার মতো সেই ঢেউ চিরজন্মের করে পেতে চেয়েছিলাম। যে গান জীবন বারেবারে শুনিয়েছে লক্ষকোটি প্রানের ভিতর তাকেই কিনা ভেবেছিলাম এ শুধু আমারই! বুঝতে পারিনি সে গান একেক প্রাণে একেক সুরে বাজে। সুরের লহরী তার ভাসিয়ে নেয় কাকে কোন্ অনির্দেশ্যলোকে সে হিসেব পাওয়া যায় না কোনোদিন। এখানে নুড়িগুলি একই স্রোতের টানে ভাসতে থাকে। অথচ দেখুন ফুলের বিছানায় শুয়ে একবারো বুঝিনি কৃত্রিম ফুল গায়ে সূঁচের মতো বেঁধে।

আমি তো রণভূমে টিকে থাকতেই চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম আসা যাওয়ার পথের ধারে ফুটে ওঠা কোমল ফুলগুলি দিয়ে আপনাকে সাজিয়ে তুলতে ঠিক আমার মনের মতোটি করে।ঠাকুরবাড়ির চার দেওয়ালের ভিতর বন্দি আমার কাছে আপনিই ছিলেন একমাত্র খোলা জানালা। আমার সমস্ত গুনগুনানিতে আমি স্বপ্ন দেখেছি সুন্দর এক কুটিরের, যাকে ঘিরে বড় হয়ে উঠেছে বহুবিচিত্র ও ঝলমলে বৃক্ষের সারি। প্রাসাদে আমার কিবা প্রয়োজন? আমার সমস্ত আনন্দ আয়োজন তো আপনাকে ঘিরেই। তাই কথা দিয়েছিলাম, আপনার যোগ্য হয়ে উঠবো একদিন। আপনি হবেন আমার অহংকার আর আমি আপনার বক্ষলগ্না চিরকালীন ঐশ্বর্য্য। এই এক অশান্ত জীবন আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে গেল আপনার পাশ থেকে। ছিনিয়ে নিল মন্ত্রমুগ্ধ মধুর উত্তাপ।পাহাড় চূড়ায় অকাল সূর্যাস্ত ভুলিয়ে দিল পাখিদের ঘরে ফেরার দিক।একটা ধূসর কালো যবনিকা প্রতীক্ষা করে রইলো। আর অপেক্ষা করলাম আমি, কখন সভাভঙ্গ শেষে আপনি ফিরে এসে পুনরায় তুলে নেবেন যাদুকাঠি। সাঙ্গ হবে আমাদের লুকোচুরি খেলা।

কোন্ সে কীটের প্রবেশ কুড়ে কুড়ে খেলো আমাদের? সমুদ্র এখন আমার ভেতর গর্জায়। সে গর্জনে কোনঠাসা হয়ে যায় ভিতরবাড়ির কোলাহল। একা একাই লড়ে যাই আমি। অস্ত্রহীন, নিঃসম্বল। হায়! আমার লোভ। আপনাকে চিরতরে নিজের করে পাওয়ার লোভ। নিরহংকার হতে পারলো না বলে তলিয়ে গেল স্বখাতসলিলে।

একটি তৃণপুষ্পেরও আপন অধিকারে এ পৃথিবীতে ফুটে ওঠার আত্মম্ভরিতা থাকে। আমার সেটুকুও ছিল না। বারবার তাই ভরিয়ে দিলেন অবহেলায়। অথচ কতদিন আপনার বুকে মাথা রেখে বলেছি, ‘ যত কষ্টই দিন,সব সইতে পারি আপনাকে ভালোবেসে শুধু অবহেলা দেবেন না, সে সইতে পারবো না।’ আপনিও তো তাতে সম্মত ছিলেন। তবে কী এমন হল যে, পাখি ভুলে গেল তার সযত্ন লালিত বাসা। এত প্রতিকূলতাতেও তিল তিল করে গড়ে তোলা ভালোবাসার অবয়ব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। না না, নিশ্চিহ্ন হবে কেন? সে শুধু আধখানা স্মৃতিমাত্র হয়ে রয়ে গেল। এক অসহ্য যন্ত্রণা কেবল মাথা তুলে দাঁড়ালো বিপুল সমারোহে।সকলের অগোচরে চোখ থেকে ঝরে গেল অবহেলার জল।

নিজেকে আপনার যোগ্য করে তুলতে তুলতে টের পাইনি কখন একা হয়ে গেছি। কখন আমার পাশ থেকে আপনাকে টেনে নিয়ে গেল আপনারই সরোজিনী। জ্যোতিষ্কের উজ্জ্বল বিভায় ভুলে গেলেন ঘরের নিরিহ প্রদীপখানি। আমি অপেক্ষা করলাম। কিন্তু একদিন অপেক্ষারও বয়স বাড়ে। তার ন্যুব্জ দেহ মিশে যেতে চায় মাটিতে। পুড়ে যেতে চায় চিতার আগুনে। পাপ-পুণ্যের দোহাই না মেনে এ চাওয়া পবিত্র হয়ে ওঠে আপন শক্তিতে। জননী হতে না পারা জায়া আর কতদিন স্বামীসুখ প্রত্যাশী হতে পারে?ক্লান্তিকর এ প্রশ্নও একদিন থেমে গেল। বিশ্বসংসার বুঝে নিল তার দায়িত্ব। ফেলে দেওয়া পুরোনো আসবাবের তুল্য ঠেলে ফেলে দিল একদা ছায়াঘেরা ছিমছাম আশ্রয় থেকে। হারিয়ে যেতে চাইনা বলে প্রসাধনে সেজেছি আজ। ঠিক যেমন আপনি পছন্দ করতেন তেমনটা। আজ হাওয়া প্রবল। ভেতরমহল থেকে কোনো কটূক্তি ভেসে আসছে না। আমাকে দেওয়া আপনার যাবতীয় অবহেলা চঞ্চল হাওয়ার দাপটে গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির মতো উড়ে যাচ্ছে অন্যকোনো দিকে। এখান হতে এখন পুরাতনের বিদায়। আফিমের স্বাদ এত মাতাল স্নিগ্ধতায় ভরা আগে বুঝিনি তো! আঃ চিরশান্তি! শান্তি! শান্তি! শুনতে পাচ্ছি, স্বর্ণ ঠাকুরঝি গাইছে…
” সকাতরে ঐ কাঁদিছে মানুষ শোনো শোনো পিতা”…
পিতা এসেছেন.. এবার বিদায়… আপনি এসেছেন … পায়ের ধুলোটুকু মাথায় নিতে দিন… ভালোবাসি… আপনাকে… খুউব…

আমি হেরে যেতে চাইনি। আমাকে হেরে যেতে হল শুধু আপনি আমায় জিতিয়ে দিলেন না বলে।

 

কবিতাংশ:-
হেমচন্দ্র বাগচী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেরণা :-
কবির বৌঠান : মল্লিকা সেনগুপ্ত
জীবনের ঝরাপাতা: সরলাদেবী চৌধুরানী
ঠাকুর বাড়ির অন্দর মহল : চিত্রা দেব
ঠাকুরবাড়ির আঁতুড় ঘরে: রীতা রায় মিঠু
কাদম্বরী দেবী : সুব্রত রুদ্র
রবি জীবনী : প্রশান্তকুমার পাল
বন্ধুরা, যারা নইলে এ লেখা অসম্পূর্ণ :-
শ্রদ্ধেয় অম্লান দত্ত
সুহৃদ রমিত দে
অধ্যাপক তাপস দাস (হরিশ চন্দ্র রিসার্চ ইন্সটিটিউট)
অধ্যাপক জয়দীপ ঘোষ (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়)

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২