স্মরণ – রুখসানা কাজল

স্মরণ – রুখসানা কাজল

শেয়ার করুন

আমি তোমার পায়ের কাছে বসে ছিলাম। স্বচ্ছ মশারি, তার ওপারে হালকা হলুদ দেয়াল । ডিম আলোয় ফ্যাটফ্যাট করছে শিল্পী শাহাবুদ্দীনের আঁকা স্বাধীনতা ছবির ডুপ্লিকেট কপি। বিবর্ণ অসুখী রাতে, দোলচেয়ারে বসে বসে টেবিল ল্যাম্প থেকে ছিটকে পড়া আলোতে ওই কাঁদুনে হলুদ ওয়াল দেখে ভাবতাম শিল্পী ভ্যান গঘ কী খেয়ে এই হলুদ রঙকে প্রিয় রং হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন !

কোনো হলুদ জলের নদীর ধারে, আ-দিগন্ত বিছানো সূর্যমুখী ক্ষেতের আল ছুঁয়ে হলুদ রঙা কোনো বাড়িতে সকাল দুপুর রাতে বিষণ্ণতা গা মোচড়াচ্ছে ভাবতেই খারাপ লাগত আমার । বিশেষ করে সেই সব নিশুতি রাতগুলোতে। তোমার মতো না ভালোবাসার মানুষের হলুদ অসুখের জন্যে সেই রাত জাগা। ঘড়ি দেখে ওষুধ খাওয়ানো, মাথা ধুইয়ে মুছে দেওয়া, ওয়াশরুমে আনা নেওয়া, বমি পরিষ্কার করা। আহ্‌ বিষণ্ণতা, তোমার ভালো নাম বুঝি হলুদিয়া ছারখার ! নিপতনে পূর্ণগ্রাস!

ঈশ্বর আমাকে অঢেল মাটি দিয়ে বানিয়েছেন । আমার বিরক্তি নেই, ঘৃণা নেই। আমি ক্লান্তিতেও অপরাজিত। অনুরোধে সিগ্রেট ধরিয়ে দিচ্ছি, তুমি ইচ্ছে করে ধোঁয়া ছাড়ছ আমার নাকমুখ ছড়িয়ে। সিগ্রেটে আমার অনাস্থা নেই কোনো কালেই। তবু ধূমপান আমার আসে না। শত সাবধানে সিগ্রেট টানলেও ঠোঁট ফুলে ঢোল হয়ে যায়, জ্বলে পোড়ে।মুখের ভেতর কটকট তেতো কষটা টেস্ট লেগে থাকে বহুক্ষণ ধরে।

অথচ দামী সিগ্রেটের এই সুগন্ধ, মনে পড়িয়ে দেয় আমাদের বাগানের ডোবা জুড়ে বর্ষায় ফোটা কেয়াফুলের কথা। অক্ষত ফুল পাওয়া খুব কষ্টকর ছিল। কাদামাটি আর পোকা আক্রান্ত হয়ে থাকত বিনম্র সুন্দর সাদা ফুলগুলো। কেয়া খুব নরম ফুল জানো তো ! যদিও কাঁটার সৈন্যরা দুর্দান্ত মুখরা। মাঝে মাঝে আবার ফুলের থোড়ে সাপ পেঁচিয়ে থাকত। আমাদের শব্দ শুনলেই গা ঢিলা দিয়ে মাথা উঁচিয়ে দু-ফলা জিভ দেখাতো লকলক করে। ধোঁয়া ছাড়ার আগ মুহূর্তে তোমার মুখটা ঠিক ওরকম হয়ে যেত।তুমি হিসিয়ে উঠতে একপেশে শ্লেষে, মরে যাচ্ছি, আমি মরে যাচ্ছি। তুমি বেঁচে থাকবে ! দিব্যি বেঁচে থাকবে তুমি ! কেন কেন?

তোমার নখ ভয়াবহ রকমভাবে গেঁথে যেত আমার হাতের মাংসে, পিঠে, গলায় কখনো কখনো নরম দু’বুকে। জোর ধাক্কা দিয়ে সরে যেতাম। তোমার হলুদ শরীরটা সদ্য বিছানো বাটিক চাদরে কুণ্ডলী পাকিয়ে ককিয়ে উঠত। মুহূর্তে মহাত্মা চোখে শতজন্মের আকুলতা খেলিয়ে তুমি নেতিয়ে পড়তে উঃ আঃ করে। জাস্ট ভান। অসুখটা মনোবিকারের পর্যায়ে চলে গেছিল। কিম্বা অসুখটার নামই ছিলো মনোবিকার।

সিক্স ডোর আলমারিতে হেলান দিয়ে আমি করুণা ঝেড়ে ফেলে দেখতাম, তুমি যখন শুয়ে শুয়ে সিগ্রেট খাও, কায়দা করে ধোঁয়া উড়াও তোমাকে ফিলিপিনের জঙ্গলে পাওয়া, ছাগল খেয়ে শুয়ে থাকা শ্লথ তৃপ্ত হলুদ চক্রের অজগরের ছবির মতো লাগে। আমি শশীবালা সাপুড়িয়ার মতো নিজেকে রক্ষা করে বীণ বাজাতাম, চৌরাসিয়া শুনবে ? ইকোস অফ এটার্নিটি ? চালিয়ে দিই ?

তোমার খিন্ন শুকনো হাত, দুধ সাদা কালো স্ট্রাইপের পাজামার নিচে বেরিয়ে থাকা দুটো ফর্সা ল্যাকপেকে পা আমাকে কখনোই আকর্ষণ করেনি। না মায়া, না ভালোবাসায়, না যৌনতায়। অথচ অসুখ করলেই আমি দক্ষ নার্সের মতো তোমার সেবা করেছি। কখনো কখনো অকাম্য যৌনতাও মেনে নিয়েছি সুতীব্র বিবমিষা চেপে রেখে। তখন কেবলই মনে হত নির্বিষ এক হলুদ সাপ অনুত্তাপ নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে পেঁচিয়ে ধরছে আমার প্রাণপাখি। সঙ্গমে আনন্দ কই? কই বেমিশাল উত্তেজনা ?

বার বার তাই নেউলের বুদ্ধিতে প্যাঁচ খুলে বেরিয়ে এসেছি। তবুও রাত গভিরে অসম্ভব শব্দহীনতায় বনেদী সেগুনকাঠের আলমারির গোপন ড্রয়ারের তাকে, লুকিয়ে রাখা হার্ড ড্রিংকে কুচো বরফ মিশিয়ে তোমার মুখে তুলে দিয়েছি। ড্রিংক নয়, আমি বোতলগুলোর নিপুণ সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে ভাবতাম, আহা এগুলোতে সুবাসিত সেন্ট ভরে কেউ আমাকে গিফট করে না কেনো ! রাতে বদ্ধ বেডরুমে শরীরের শেষ সুতোটা খুলে ফেলে সেন্ট বৃষ্টি ছড়িয়ে, “আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশী” নাচতে, গল্পের বই পড়তে, গান শুনতে, অযথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়তে, কি যে আনন্দের ছিল আমার !

দু’রুমের মাঝখানের দরোজাটা কিছুতেই বন্ধ করতে দিতে না তুমি, মরে যাচ্ছি, আমি মরে যাচ্ছি। তুমি ঘুমুচ্ছ ? উঃ কি মানুষ তুমি !

অথচ ডাক্তার ভাইয়া তোমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো, ফিজিক্যাল ডিস্টেন্স মাস্ট। অন্যকে অসুখ ছড়িয়ে দেওয়া কোনো ভালো মানুষের কাজ নয়। মাঝে মাঝে দরোজা তবু খুলতেই হতো। তুমি হলুদ শরীরে সম্পুর্ণ উদোম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপতে। রাগ, হিংসা, যৌনতার ক্রূর কাঁপন। তোমার মাথার পেছনে, ওয়াল জুড়ে শিল্পাচার্য জয়নুলে্র আঁকা সুফলা সবল সাঁওতাল রমণী, তার পাশে মন মাটি জলপ্রিয় মরমী শিল্পী সুলতানের অমিত শক্তিশালী কর্মরত নারীপুরুষের ছবি।

আমার ভেতর ঝলকে উঠত অনম সাহস। ঈশ্বরীর মত দূরত্ব চোখে তাকিয়ে দেখতাম, মারণ অসুখ নমিত করতে পারেনি তোমার আশ্চর্য সুন্দর পুরুষ অঙ্গটিকে। ভিখারীর মতো মুখ উঁচিয়ে চেয়ে আছে।দরিদ্র, লালাতুর, খুনি চেহারায় জ্বলন্ত ঈর্ষায় মাখামাখি হয়ে উদ্ধত লালাভ যৌনামুখীন। অমানুষী হাহাকার ছড়িয়ে স্ফীত জ্বলছে, কাঁপছে, মরে যাচ্ছি আমি মরে যাচ্ছি, তুমি গান শুনছ ? এত আনন্দ তোমার ! বন্ধুরাই তবে সবকিছু !

বন্ধুত্ব এক অপার বন্ধন। আমি বন্ধুদের জন্যে জান লড়িয়ে দিতে পারি। তবু ফুল্লপত্র ধূপ সুগন্ধীপূর্ণ দরোজাটা খোলা রাখি। জানি তো বন্ধুতা, সেও এক সম্পর্ক মাত্র। কখনো ঢেউয়ের মতো উঠে নামে, কখনো ভালবাসা, স্নেহ, মায়ায় পূর্ণ কলসের মত আজীবন স্থির থাকে। যে বন্ধুরা নিঃশব্দে চলে যায়, আমি বুঝে নিই মন মরে গেছে তাদের। যেন আমরণ ফাংগাস খেয়ে ফেলছে আমার থোকা জবার গাছ, লাল রঙ্গনের কচিপাতা, আস্তে আস্তে বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে অমরাবতীর ফুলফোটা সবুজ কোল। তবুও ওদের জন্যে মায়া বেঁধে রাখি।

শুধু বন্ধুতার মুখোশে যারা তস্কর, তাদের জন্যে হাসি তুলে রাখি। হাসিটা নিকেলের। আমার হাসি দেখে তারা বুঝে নেয়, আমি চিনে নিয়েছি তাদের ! বুঝে গেছি তাদের ঈর্ষার পারদটা। চেয়ে চেয়ে দেখি বান্ধবীরা চলে যায় ছলক ঝলক অলোক আলোর টানে। এই ভাঙ্গা-গড়া খুব এনজয় করি। জানি তো আমার সম্পর্কে কাঁদুনি নেই। নেই আঠাও। আমি এক একলা গ্রহচারী। কিম্বা একলা কোনো নদী। যে চাইবে ছুঁয়ে থাকতে, সে থাকবে চিরদিন।

ঠিক এইখানে জানো ত হলুদ,আমি মিলে যাই জীবনের সাথে। এরা সুস্থ, তুমি অসুস্থ ছিলে। শরীরের সাথে তোমার মন শীর্ণ বিশীর্ণ নদীর মত শুষে যাচ্ছিল ক্ষীণতায়, ক্ষুদ্রতায়, ভয়ে, না বাঁচার অমোঘ আতঙ্কে। তুমি তো জানতেই মৃত্যু মানে চিরবিচ্ছেদ। আর কখনো দেখা হবে না এই আকাশ মাটি , ফুল জল, পাখি ও মানুষ, গুন্ঠিত নারীর শরীর। তোমার জিমঘর, দেশি বিদেশি গল্পপ্রবন্ধ কবিতার বই, দামি লাইটার, পাঞ্জাবীর চেন, কাফ বোতাম, জোড়া জোড়া দামি শার্ট প্যান্ট, এলিগ্যান্ট সু, শীত সন্ধ্যায় পরার জন্যে ব্র্যান্ড স্যুট টাই, অসংখ্য পর্ণগ্রাফি। তুমি বাঁচতে চেয়েছিলে। আমার ক্ষমারা তাই নেমে আসে সাদা মেঘের মত। তোমার জন্যে ক্ষমা।

আষাঢ়স্য প্রথম দিন। তোমার মৃত্যু হয়েছিলো এমন ঘনঘোর বর্ষায়। তিনটে কদমফুল সবুজ পায়ে জড়াজড়ি করে হাসছিলো স্ফটিক স্বচ্ছ ভ্লাসে। দীর্ঘ ক্লান্ত আঙুলে তুমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে নিচ্ছিলে ফুলগুলো। তোমার শেষ নিঃশ্বাসে ছিল বৃষ্টি করুণ গন্ধ।

চারুকলার কদমগাছে ঝেঁপে ধরেছে কদম। কাউকে দিয়ে কিছু পেড়ে নেবো আজ। এবারের গোঁয়ার জ্যৈষ্ঠ হঠাৎ হঠাৎ কদিনের জন্যে ধরা পড়ে গেছিল বৃষ্টি, মেঘ আর দমকা ঝড়ের হাতে। এবার ক্ষেপে উঠেছে। শেষ জ্যৈষ্ঠর বিকেলে ঝুমে নেমেছিল বৃষ্টি। নাগরিক রঙ ভেসে গিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল নগরের সাদাসিধে মুখ। অনার্স পড়ুয়া দুটি তরুণী রং চায়ে বৃষ্টি জল মিশিয়ে অমৃত করে হাসছিল। আমি হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরি। আমার আঙ্গুলের নখ থেকে ঝরে পড়ে ক্ষমা। আমি বৃষ্টিজলে ক্ষমা ভাসাই। তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম হলুদ মানুষ।


[ চিত্রাঙ্কন মৌমিতা ভট্টাচার্য্য ]

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২