অচেনা মানুষ – কৃষাণু নস্কর

অচেনা মানুষ – কৃষাণু নস্কর

শেয়ার করুন

উল্টোদিকের বাসস্টপে তখনো থিকথিকে ভিড়, খয়েরি আর হলুদ রঙের ঝরাপাতা রাস্তার দুধার ছেয়েগেছে, দোকানের বেঁকা-ট্যারা প্লাস্টিকের ঢাকনা বেয়ে চুঁইয়ে পড়ছে বৃষ্টির জমা জল আর শার্সিগুলোজলের ঝাপটায় ঝাপসা হয়ে এসেছে।

মিনিট দশেক হয়ে এলো, অটোর লাইন কিছুতেই আর সামনের দিকে এগোচ্ছেনা, লাইনটা এবার পেঁচিয়ে পেঁচিয়েজিলিপির আকার ধারণ করেছে, আরও কিছুক্ষণ যেতেই কেমন জানি ইতস্তত হয়ে পড়ছি।একটানা পাঁচ দিনের দাবদাহের পর এই বৃষ্টিশাপে বর না বরে শাপ ঠিক বুঝতে পারছি না; পিছনে তাকিয়ে দেখি লাইনএবার মেট্রোর পেভমেন্টেরমুখ পর্যন্ত চলে গেছে।

ওদিকে বাসস্টপের ভিড় সময়ের সাথে এমনই বেড়ে চলেছে যে পিছনের ফলের দোকানগুলি আর দেখা যাচ্ছে না। এমন সময়, হুটোপুটি করে দু-চারজন ডিভাইডার দিয়ে লাফ মেরে রাস্তার উল্টোদিকে চলে গেল। এখন বাসের জন্য দৌড়ে বাস না পেয়ে যদি ফিরে আসতে হয়; তো আবার সাপ লুডো খেলার মতন সেই শূন্য থেকেই সুরু করতে হবে, এই ভেবে আমি আর এগোলামনা।

দেখতে দেখতে আধা ঘণ্টা হয়ে এলো, এতক্ষণে পা চালালে যে কখন পৌঁছে যেতাম, অযথা থমকে দাঁড়িয়ে থেকে আর লাভ নেই, এই ভেবে হুট করে বেরিয়ে গেলাম লাইন থেকে।

বইমেলার মাঠে এবছর একটা অপরূপ তেলরঙা ছবি দেখেছিলাম, একটা ট্রাম আর তার সাথে এক পথিক হেঁটে চলেছে বর্ষাসিক্ত কলকাতার রাস্তা দিয়ে।সেই ছবিতে ফুটে ওঠা রোমান্টিসিজম সর্বদা ভাবিয়েছে আমায়, যদি ওই পথিক আমি হতাম একদিন এই শহরে যদি ওভাবেই হেঁটে বেড়াতে পারতাম। সেই ছবি আর আমার রোজনামচার মধ্যে আজকে অনেক ফারাক। সেই ছবিটাই সিগনালের মুখের বাঁধাইয়ের দোকানে দেখছি আর কেন জানিছবিটা কেমন পানসেপানসে লাগছে।

আর একটু এগিয়েই বাঁ দেখি কতগুলো রিক্সা জটলা করে আছে,

আচ্ছা তোমরা কি কেউ মুচিপাড়া যাবে,

একে অপরের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইলো যেন কোনও এক অচিন জায়গার নাম করলাম, সটান না করে দিল দুজন, একজন বললো যেতে গেলে একশো টাকা দিতে লাগবে।

যদিও তখন পকেট আমার সায় দিচ্ছে; তবু মন আর পারমিট করলো না। আমি যৎপরোনাস্তি একটু রাগ আর গোঁ ধরে এগিয়ে চললাম।

আচমকা একটা রিক্সা সামনের গলি থেকে হুট করে বেরিয়ে খুব জোরে ব্রেক কষলো সামনে;

সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করি, এই যাবে নাকি!

কোথায় যাবেন বাবু?

মুচিপাড়ার মোর, তোমরাতো আবার রাজার কুমার জিজ্ঞাসা করে আর লাভইবা কি!

না না যাবো বসুন;

তা কত দিতে হবে শুনি;

অনেকটা রাস্তা তো তার উপর ঝড় বৃষ্টির সময়;তা পঞ্চাশ টাকা দেবেন।

আচ্ছা চলো তো আগে,

ভালোই হলো এরম এক হাবাগোবা রিক্সায়ালা কলকাতা শহরে প্রায় বিরল তার উপর এরম বিপদের সময়, হবে ভাবে কিছুতেই বুঝতে দিলাম না যে কিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে আমি এসেছি।

আচ্ছা আচ্ছা চলতো আগে, মনে মনে ভাবলাম যদিও রিকশাটা একটু ভাঙ্গাচোরা,তবু নিচে নেমে দশটা টাকা একে আমি মন খুশি করে বেশি দেব।

ক্যাচ কোচ করে কিছুটা এগোতেই হটাত যেন কেন মনে হলো, এই লোকটাতো ঠিক রিক্সায়ালা নয়।যে ভাবে সেকথা বলছে, সেভাবে সাধারণত কলকাতা শহরে কোনও রিকশাচালকবলে না।

দাদা আপনার তো অনেকটাই খরচা হয়ে গেলো,অনেকটা পথ তো দাদা তাই ভাড়াটাও একটু বেশি…

তা আমি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করি,কেন তুমি এরাস্তায় আসোনা?

না আমি করুণাময়ী টালিগঞ্জ রুটেই রোজ খাটি এদিকে প্যাসেঞ্জার অত হয়না মাঝেমধ্যে একটা দুটো ওই প্রেমিক প্রেমিকা নতুবা এই ঝড়-বৃষ্টির সময় ভাগ্যক্রমে আপনার মতন দু-একজন প্যাসেঞ্জার জুটে যায়।

আমি তন্ময়ের সাথে ওর বলার ভঙ্গি, মার্জিত আচরণ, পরিপাটি পোশাক দেখি;

আমার কিছু একটা হয়তো বুঝতে গণ্ডগোল হচ্ছে।

তা তুমি কতদিন রিক্সা চালাচ্ছ ভাই?

এই লাইনে বেশিদিন নয়, এই ধরুন বছর খানেক হয়ে এলো,

এর আগে কি করতে

মুরগির পোল্ট্রি ছিল, দোকানে দোকানে মুরগি সাপ্লাই করতাম; বারুইপুর, সোনারপুর, রাজপুর এসব জায়গায় আমাদের অনেক বাঁধা খরিদ্দার ছিল।

তাহলে সেসব ছেড়েছুড়ে দিয়ে এখন রিক্সা চালাচ্ছ যে!

সে অনেক লম্বা কাহিনি বাবু,ভগবানের মার দুনিয়ার বার…তাঁতি বেশ তাঁত বুনে খাচ্ছিলাম কী যে ফেরে পড়লাম, দুটো টাকার লোভ হলো তো ব্যাস সব ওলটপালট হয়ে গেল। এত বছরের তিলে তিলে গড়ে তোলা সাজানো বাগান এক ঝটকায় তছনছ হয়ে গেল।

আজ এইযে যাহোক করে দুবেলা দুটো খাচ্ছি এটুকুই আর বাকি সব গেছে,

চুরি করিনি চোর হয়েছি, ছিনতাই করিনি ছিনতাইবাজ হয়েছি, প্রতারণা করিনি প্রতারক হয়েছি।

সিরিডি শ্মশান মোড়ের লাল বাতিটা জ্বল জ্বল করে তাকিয়ে আছে আমার চোখে।

প্যাডেলে ওর আলতো করে রাখা পা দুটো আর হাত দুটো জোর করে চিপে আছে ব্রেকে।

আমরা বাবু ভালই ছিলাম, সুখে ছিলাম,

আস্তে আস্তে, জমি গেল ব্যবসা গেল ঘর ছাড়া হলাম,

তোমার পরিবারের সবাই কোথায় এখন

বউ থাকে তার বাপের বাড়ি আর ছেলে এক হোস্টেলে, যেখানে ও বাইক মেরামতির কাজ শিখছে।

ওই হোস্টেলের এখানের একটা শাখায় আমি রোজ খাওয়া দাওয়া করি

আর ওইখানেই আমি কলকাতায় এসে কিছুদিন ছিলাম

সে তো বুঝলাম তবে এতো কি করে ঘটলো,

প্যাডেলে পা দিয়ে জোরে ধাক্কা দিল হাত দুটো আলগা হয়ে এলো।সিগনালপেরিয়ে আর একটু দুরে গেলেই জিজ্ঞাসা করি

তা কি হয়েছে বললেনা যে!

বাবু ওইযে মানি মার্কেট, দু তিনটে মানি মার্কেট কোম্পানির হয়ে কাজ করতাম, সব দোকানে দোকানে মুরগি সাপ্লাই দিতাম সেই সূত্রে বাজারে আমার এক পরিচিতি হয়ে এসেছিল, বাজারে আমি দোকানিদের কাছ থেকে ডেলি কালেকশান করতাম, কমিশনের টাকায় দুটো ছেলে রেখেছিলাম, সবে একটু দাঁড়াতে শুরু হয়েছে কিনা, একে একে কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে গেল

খবরে কাগজে তো কত কিছু পড়লাম তবু ফিরে আর কিছু পেলাম না; বরঞ্চ যা ছিল আগের তা চলে গেল। দেশের জমি জমা, টু হুইলার, হাঁড়ি কলসি, সংসারের সব সব, যাই ছিল সব বিক্রি করে দিয়েছি আর ওই মাটির ভগবানগুলো সব গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছি।

সারাটা সংসারের চল্লিশটা বছর গঙ্গায় ভেসে গেল, কখনো কোনদিন একটা টাকাও চুরি করিনি, বিনা পরিশ্রমে উপার্জন করিনি, দু-চারজন মাতব্বর এসে কী যে বোঝালো!সেবার যখন কোম্পানির লোকেরা আমাদের গ্রামের অনুষ্ঠান করে, নেতাদের কে ছিলনা সেইঅনুষ্ঠানে!পঞ্চায়েত থেকে জেলার, এমনকি কলকাতার নেতারাও গিয়েছিল।

আজ আর কিছু রইলো না কিচ্ছু না।

উল্টোদিকে মুখ করে গামছা দিয়ে যে ঘামটা মুছছিলো, তাতে মনে হয় ওর চোখের জলও মিশে যাচ্ছিলো।

গ্রামের লোকেরা এখন আমায় জোচ্চোর বলে, আমার সব ভিটেমাটি সম্পত্তি বিক্রির পয়সায় সাত লাখের মধ্যে চার লাখ টাকা দিতে পেরেছি, আর ভেবেছি এই রিক্সা টেনে যেটুকু রোজগার করব সবটাই দিয়ে দেব, তাতে দশ বছর লাগুক কি বিশ,একদিন সব টাকা আমি শোধ ঠিক করবই।

নিজের সাথে নিজের এ কি লড়াই আমি দেখছি, এই সমাজেব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে ওঠা ভুঁইফোড় সংস্থাগুলি শত চেষ্টাতেওএসব মানুষের সর্বস্বছিনিয়েও সততা শুষে নিতে পারেনি।

দাদা আমাকে বাড়ির সবাই বলে বাড়ির লোকেদের বিশ দিয়ে গলায় দড়ি দেব আবার ভাবি জীবন যখন দিতে পারিনা তবে নেবার অধিকারও আমার নেই। ওটা ভগবানের হাতেই ছেড়ে দিয়েছি তারা যদি না খেতে পেয়ে মরে তো মরুক।

আচ্ছা তুমি এখন কোথায় থাকো আর কোথায়ই বা খাওয়া দাওয়া করো;

এই টালিগঞ্জেরইএকএনজিও সংস্থায়; এইযে কতোগুলি বই দিয়েছে দেখুন; এই-বলে হ্যান্ডেলে ঝোলানো প্লাস্টিকের বাগটা আমায় দিলো, এই বইগুলো সময় পেলে আমি পড়ি; বেশ ভালোই লাগে।

দুতিনটে বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখি, বইগুলি মূলত খ্রিস্টের জীবন দর্শন আরতার বাণীর উপর।আর একটা বই বাইবেলেরই সংক্ষিপ্ত বাংলায় অনুবাদ। বইগুলি আমি গুছিয়ে প্লাস্টিকে মুড়ে রাখি।

আচ্ছা দাদা এই দেখুন কথা বলতে বলতে আপনার মুচিপাড়া এসে গেছে।

বুক পকেট থেকে পাঁচটা দশ টাকার নোট বার করে হাতে দিয়ে বলি; ভালো থেকো।

বাঁ দিকের তেলেভাজার দোকানে সবে মাত্র বেসনে ডুবিয়ে নরম বেগুনগুলো গরম তেলে ছাড়ছে, একটু এগিয়ে মোটর ছোলা বাদাম নিয়ে ঠায় দাড়িয়ে এক মধ্যবয়স্ক লোক, আর একটু এগিয়ে দেখি ফুটপাতের এককোণে সারাদিনে বিক্রি না হওয়া খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন গুলো গোছাচ্ছে দুটো ইতস্তত হাত। ফুল মালা নিয়ে বসে আছে একটি অল্পবয়সী মেয়ে,চোখ দুটোতার জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে আমার চোখে। দুটো পেঁপে, কিছু ঢেঁড়স, বিন, কড়াই আরখুচরো সবজি নিয়ে বসে আছে একটা বাচ্চা ছেলে।

এদের মুখগুলো কেন জানিনা একইরকম দেখতে লাগছে, ওই রিকশাওয়ালাটার মতন।ঝড় হয়েছে এক ঘণ্টা হয়েএসেছে, এখানে বিদ্যুৎ নেই। সব কটা দোকানেই একটা একটা মোমবাতি জ্বলছে।আমি এই যে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি এখান থেকে নাকি কোনও এক প্রাচীন সময়ে, গঙ্গা প্রবাহিত হত।এই স্থান পবিত্র, আজ মোমবাতি জ্বলছে সারি সারি,চারিদিকে একটা একটা করে হাজারো মোমবাতি।তখনও আমার অজান্তেই আমার বাম হাতের মধ্যে বিগত দশটা মিনিট ধরে শক্ত মুঠো করে রাখা আছেকয়েকটাচকচকে হাজার টাকার নোট।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২