S + R/ R /L — দিব্যজ্যোতি বরা অনুবাদ — তপন মহন্ত

S + R/ R /L — দিব্যজ্যোতি বরা অনুবাদ — তপন মহন্ত

শেয়ার করুন


[লেখক পরিচিতি:- দিব্যজ্যোতি বরা—জন্ম যোরহাটে ১৯৮০ সালে। ২০০০ সালে কটন কলেজ থেকে স্নাতক। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর। বর্তমানে একটি মহাবিদ্যালয়ে প্রবক্তা হিসেবে কর্মরত। কমসংখ্যক গল্প লিখেও পাঠক সমাজে প্রশংসিত। এই গল্পটির ইংরেজি অনুবাদও প্রকাশিত হয়ছে Muse India পত্রিকায়। তবে বাংলা অনুবাদে মূল অসমিয়া গল্পটিকেই অনুসরণ করা হয়েছে। লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থ–ব’লা বেদুইন।]


“… আর এক সময়ে আমি তাকে পেয়ে গেলাম। প্রকাণ্ড একটা বটগাছের নীচে বসেছিল সে। যেন আমি আসব বলে সে জানত… আর সে আমাকে বলে, ‘আপনি আমার এই অবস্থাকে কীভাবে বর্ণনা করবেন? আপনি কি পারবেন?’
আমি বলি, ‘পারব, কিন্তু এর জন্য আমাকে আমার গল্পটি আবার নতুন করে লিখতে হবে।’”


আমি কে ছিলাম? আমি সীতা। লাঙলের হলরেখায় পেয়ে জনক আমাকে লালন-পালন করে বড়ো করেছিল। নিশ্চয়ই কোনও কুমারী মা সামাজিক অপবাদের ভয়ে আমাকে ক্ষেতে ফেলে গিয়েছিল। আমার নিজস্ব অস্তিত্বের কোনও পরিচয় ছিল না। আদরে-যত্নে বড়ো হলাম, কিন্তু আমার অস্তিত্বহীন অবস্থাটা কী যে ভয়ংকর! এই অবস্থা আমাকে কাঁকড়ার মতো খুবলে খুবলে খাচ্ছিল। নিজের প্রকৃত পরিচয় জানতে না পেরে আমি ক্রমশ বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। রাজভোগ আমার কাছে প্রহসন বলে মনে হয়েছিল। এই অবস্থায় আমার দত্তক পিতা আমার বিয়ের জন্য ‘স্বয়ম্বর সভা’-র আয়োজন করেন।

রাম এলেন স্বয়ম্বরে। প্রথম দর্শনেই আমার হৃদয়ে এক ভূমিকম্প হল। কী ছিল সেই দূর্বাদলশ্যাম সুন্দর শরীরে, পূর্ণিমার চাঁদের মতো সৌন্দর্য-শরীরে; প্রশান্ত গভীর দু-চোখে কী এমন এক সন্মোহনী শক্তি ছিল যে আমার হৃদয়ের চারপাশের সমস্ত দেয়াল ভেঙে পড়ে এবং আমি আর আমার নিজের মধ্যে ছিলাম না। আমার মনে এক অদ্ভুত ভাবনা আসে—ধনুকে গুণ লাগাতে না পারলেও আমি পিতার বচন ছিন্ন করে রামকেই ভজনা করব। আর প্রথমবারের মতো আমার নিজের ভাগ্যের প্রতি একটু আস্থা জন্মাল। আমি নির্লজ্জের মতো ভাবতে থাকি—দরিদ্রের হাতে কুবেরের ঐশ্বর্য আসার মতো নিয়তি রামকে আমার সাথে মিলিয়ে দিয়েছে…কী ধরনের ভাবনা ছিল সেগুলো!

আমি রামের সাথে অযোধ্যায় চলে এলাম। কিন্তু সেখানে এসে হতাশ হলাম। প্রজাবৎসল রাম, পিতৃমাতৃ-পরায়ণ রাম, পুরুষোত্তম রাম—এই অভিধাগুলোর বৃহৎ ছায়াময় ব্যক্তিত্বের নীচে আমার অস্তিত্বের পরিচয়ই বা কী ছিল? রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ হিসেবে আমার ওপর অগণিত দায়িত্ব ছিল। সেখানে প্রেম-প্রণয়ের সময় কোথায়? তবু, আকুল হৃদয়ে সেই রাতের প্রতীক্ষায় থাকি যখন সমস্ত প্রদীপ নিভে আসে, রাজবাড়ির প্রধান ফটকটা বন্ধ হয়ে যায় এবং রাজমহলের কোলাহল নিমজ্জিত হয় রাতের শান্ত নিস্তব্ধতায়।

উনি আসেন।

‘জানকী…’ হঠাৎ করেই অপেক্ষা ও আকুলতার মধুমাখা মুহূর্তগুলো থেমে যায়। জানকী—রাজা জনক কন্যা, এই শব্দটি আমাকে কুশের পবিত্র ঘাসের কাঁটার মতো বিদ্ধ করে। আমি হাসতে চেষ্টা করি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি বলে যান তাঁর সন্মুখে আসা সমস্যাবলীর কথা—তাঁর অমাত্যদের দূর্নীতি, রাজপরিবারে ক্ষমতা দখলের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কৈকেয়ীর প্রতি পিতা রাজা দশরথের মোহান্ধ প্রেম, আনুগত্য। মাঝে মাঝে তিনি জিজ্ঞেস করেন—‘তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?’ এক অস্বস্তিকর উদ্বেগ আমাকে দমিয়ে রাখে। কিন্তু একটু হাসি বা মিষ্টি শব্দ দিয়ে ক্ষোভকে আড়াল করে রেখে আমি তাঁর দু’বাহুর মাঝে নিজেকে সমর্পণ করি।

সেই সময় তাঁর ছিল প্রচণ্ড যৌনক্ষুধা। আমার মনে হচ্ছিল যেন একটা ক্ষুধার্ত সিংহ একটি হরিণীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এমন নয় যে আমার মাঝে কোনও কামনা-বাসনা ছিল না, কিন্তু দৈহিক খেলার অবসানের পর এক হাহাকার শূন্যতা আমাকে গ্রাস করে ফেলত। সবাই বলেন যে বনবাসের আদেশকে মেনে নেওয়াটা রামের নৈতিক জীবনের অন্যতম উচ্চবিন্দু। কিন্তু বনবাসের খবর বর্ণনা করে উনি আমাকে বললেন—‘হে সর্বাঙ্গসুন্দরী, তোমার মোহ ত্যাগ করলাম। বিশাল নিতম্ব, সরস জঘন, রামকদলীর মতো সুকুমার ঊরু, গোপনীয় দেহসৌষ্ঠবের সমস্ত মায়া ত্যাগ করে জীবন্মৃত হয়েছি।’ বজ্রপাতসম এই দুঃসংবাদের পরেও আমার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির ঢেউ খেলে যায়। আমি একজন স্ত্রী, কাঙ্খিত, তৃপ্তিদাত্রী… বনবাসে আমাকে তাঁর সঙ্গী করতে বিনম্র অনুরোধ করলাম এবং এক কথায় উনি রাজি হলেন।

কিন্তু কী এক আশ্চর্য, আনন্দ আর ক্লেশ-যন্ত্রণা একসাথে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল বনবাসে!

বনবাসিনী হয়ে আমি কিন্তু এক অন্য রামকে আবিষ্কার করি। অযোধ্যায় রাজ্য-রাজনীতি তাঁকে ভীষণ ভাবে ব্যস্ত করে রেখেছিল। এখন সে সকল প্রকার চিন্তা থেকে প্রায় মুক্ত হল। মন্দাকিনী নদীর কূলে একদিন আমরা বসেছিলাম। নদীর জলে এক আশ্চর্য নীলাভ বর্ণ ফুটে উঠেছিল। কয়েক জোড়া বনহংস নদীর মাঝে জলকেলি করছিল। নাগেশ্বর, চাঁপাফুলের গন্ধ বাতাসে ভেসে এসে বুক ভরিয়ে দিচ্ছিল। আমার মন শান্ত ও শীতল হয়ে পড়েছিল।

হঠাৎ যেন আমি রামের ডাক শুনলাম—‘সীতা’।

আমি তাঁর দিকে ফিরে তাকালাম। কোনোদিন না দেখা মানুষের মতো সে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল… আর তাঁর দু’চোখে আমি অভিনব বিদ্যুৎ খেলে যেতে দেখলাম। যেন মেঘের কালো ঘাগরাকে মুক্ত করে আলোর নদী বয়ে এল, সোনালি-রূপালি অর্বুদ মাছ খলবল করতে থাকল।

‘কী দেখছেন?’
‘তোমাকে।’
‘এই শরীর আপনার কাছে আর অপরিচিত, অগম্য নেই।’
‘আমি যে তোমাকে পুনরাবিষ্কার করেছি এই মূহুর্তে তুমি তা নিশ্চয় অনুভব করছ।’ তারপর তিনি স্বগতোক্তির সুরে বলেন, ‘তোমার দিকে আমি ভালো করে তাকিয়েই দেখিনি। জীবনটা যেন জন্মান্ধের মতো পেরিয়ে যাচ্ছিল।’

সেই দিনগুলো ছিল আমার জীবনের মধুরতম সময়। মৃগয়া, ফলমূল সংগ্রহ, অরণ্যবাসীর সুরক্ষার মতো কাজে ব্যস্ত থাকে লক্ষণ। নদীর পারে, গাছের ছায়ায় আমরা বসে থাকি বহুক্ষণ। অনেক সময় কোনও শব্দ বিনিময় না করেও অতিবাহিত হয়ে যায় প্রহরগুলো। অথচ এই নীরবতায়ও আমি এক অনন্য মাদকতা খুঁজে পেয়েছিলাম। আমি রোমাঞ্চিত হয়ে পড়েছিলাম। মনে মনে ভাবি, আমি যেন রামকে বুঝতে সক্ষম হয়েছি… সে আমার শরীর ও মনকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছিলেন। আগের মতো দামাল, বর্বর ছিলেন না। তাঁর স্পর্শ যেন এক কালো ভ্রমরের মতো আর আমি আমার সুবাস স্বেচ্ছায় ছিটিয়ে দিয়েছি।

বনবাসের সমস্ত সময়টা একসাথে কাটালে রামের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী বাঁক নিত জানি না। কিন্তু তখন আমি যতটা সুখী ছিলাম তেমন সুখী আমি আর কখনও হতে পারলাম না।

রাবণ আমাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমার সরলরৈখিক জীবনের আপাতত ইতি পরে। আমি এক জটিল আবর্তনীতে পা দিই আর আমার জীবনও হয়ে পড়ে চাঞ্চল্যকর, বিভ্রান্ত ও আমার পক্ষেই দুর্জ্ঞেয়।
রাবণের শরীরে আমি একজন উন্মাদ দুরন্ত প্রেমিকের সমস্ত গুণ দেখতে পেয়েছি। আমার জন্য তাঁর পত্নী-পরিজনদের প্রায় ত্যাগ করার মতো অবস্থা হয়েছিল। শুভাকাঙ্ক্ষীদের সমস্ত উপদেশ এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন। রামের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যন্ত্রণা আমার মধ্যে অহরহ ছিল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে হাজার বিবেক দংশনের মাঝেও এক বিমল তৃপ্তিতে আমার মন ভরে গিয়েছিল। রাবণের দু’চোখে আমি অন্ধ প্রেমের দেখা পেয়েছিলাম। সে আমার কাছে এলে আমি তাঁর প্রতি নিষ্ঠুরতম ব্যবহারটা করতাম। কিন্তু মনে মনে আমি তাঁর দুর্বার ভালবাসার প্রতি শ্রদ্ধা না জানিয়ে থাকতে পারিনি। এটাও আশ্চর্যজনক যে তিনি আমাকে কোনোদিনও কটু কথা বলেননি বা আমার প্রতি জোর-জবরদস্তি বা খারাপ ব্যবহার করেননি। আমি তাঁর আচরণে মুগ্ধ না হয়ে পারিনি।

আস্তে আস্তে রামের আশা আমি প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। মাসের পর মাস পেরিয়ে গেল। তাঁর কোনও খবর-বার্তা আমি পাইনি। আমারও স্খলন আরম্ভ হয়েছিল। রাবণের প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। তাঁর ব্যাকুল দুই বাহুর মাঝে নিজেকে ধরা দিতে আমি প্রায় প্রস্তুতই হয়েছিলাম, এমন সময় রণভেরীর বিকট শব্দে সমস্ত লংকা কেঁপে উঠল। নিজের খোঁড়া গর্ত থেকে আমি যেন উঠে এলাম। ছিঃ। আমি কী করতে গিয়েছিলাম? যে সময়ে সুদীর্ঘ দিন অর্ধাহারে অনাহারে বনে-জঙ্গলে এক রাজপুরুষ লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়িয়ে আমার মতো একজন সামান্য নারীর জন্য জীবন ত্যাগ করার মতো অবস্থায় পৌঁছেছিলেন, আমি তখন মজে ছিলাম এক পরপুরুষের চিন্তায়! আমার অনুশোচনার সীমা রইল না।

যুদ্ধ আরম্ভ হল। রাবণের বাহিনী যুদ্ধে পরাজিত হচ্ছিল। মাসের পর মাস ধরে চলা এই যুদ্ধে রাবণের আত্মীয়-স্বজনেরা মরে শেষ হতে চলল। রামেরও কয়েক লক্ষ সৈন্য নিহত হল। এই সব খবর আমার কাছে পৌঁছেছে। কিন্তু রাবণকে অনেক দিন হয়ে গেল দেখিনি। রামের প্রতি আমার অনুরাগ পুনরায় জাগ্রত হয়ে উঠছিল, সেখানে রাবণের অস্তিত্ব সাগর তীরে পরিত্যক্ত একটা পাথরের মতো ঢাকা পড়ে গিয়েছিল… এমনই সময়ে একদিন রাবণ আমার কাছে এলেন। তিনি শুকিয়ে কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর চোখের চারদিকে ভ্রমরের মতো কালো বলয়। তাঁর মুখ দিয়ে অস্ফুটে কিছু শব্দ বেরিয়ে এল।

তিনি থমকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

‘শীঘ্রই তোমার প্রতীক্ষার অবসান হবে, সীতা… কে জানে, আগামীকাল তোমার দেখা আর পাবো কি না?’
‘তাহলে আমাকে ছেড়ে দিচ্ছ না কেন? কেন নিজের মরণ নিজে ডেকে আনছ?’
‘আমার অহংকার! পুরুষের গর্ব, একজন রাজার গর্ব, একজন প্রেমিকের গর্ব… তুমি কী বুঝবে?’
একটি খঞ্জর যেন আমার বুকের মাঝে ঢুকে যায়। সন্মোহিত আমি বলে উঠি, ‘তুমি কী চাও? দেখি, এদিকে এসো।’
যুগপৎ বিস্ময়ে সে ভ্যাবাচেকা খায়। তারপর এক-পা দু-পা করে কাছে আসে।
আমি তাঁর সমস্ত মুখমণ্ডল চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করি—
‘তুমি আরও কী চাও?’
‘…আর কিছুই চাই না।’
এর দু-দিন পর রামের হাতে রাবণ নিহত হন।

এক বর্ষণমুখর রাতে আমি রামের কাছে এলাম। রামের কক্ষে আর কাউকে দেখলাম না। বুঝলাম রাম নিভৃতে আমার সঙ্গ পেতে চায়। আমার ইচ্ছে হল আমি ছুটে গিয়ে রামের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ি আর ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠি, কিন্তু রামের মুখের দিকে চোখ পড়ার সাথে সাথে আমার শরীর দিয়ে হিমবাহের স্রোত বয়ে যায়। কী ভাবলেশহীন ছিল রামের মুখ!
‘বসো।’
আমি বসে পড়লাম। তিনি আমার দিকে এগিয়ে আসেন। একটি ধারালো তরবারির মতো সেই চাহনি যেন আমাকে কুপিয়ে কাটার জন্য ধেয়ে আসছে।
‘রাবণের সাথে তোমার কী কী হয়েছিল?’
আমি ভয়ঙ্করভাবে চমকে উঠি। এক অজানা আতঙ্কে আমার হৃদয় ঠান্ডা হয়ে যায়। আমার জিহ্বায় কেউ যেন পেরেক পুঁতে দেয়। আমি হতভম্ব হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি।

তিনি আমার আরও কাছে আসেন। রাম এখন কী করবেন? আমাকে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলবেন নাকি? ডান হাতের মধ্যমা আঙুল দিয়ে সে আমার গাল স্পর্শ করেন।
‘পাকা বেলফলের মতো লোভনীয় এই শরীরকে না ছুঁয়ে রাবণ কি ক্ষান্ত ছিল? এই শরীর…’—তাঁর দীর্ঘ নিশ্বাস আমার গালে লাগে—‘… রাবণের অগম্য ছিল কি?’

…আর প্রথমবারের মতো আমার মুখ দিয়ে কথা বেরোয়—‘চন্দ্র-সূর্য থেকে শুরু করে সমস্ত দেবতাদের সাক্ষী রেখে বলি, রাবণের সাথে আমার শারীরিক সম্পর্ক হয়নি। রাবণ আমাকে ভালোবাসত—সে দস্যু ছিল না যে আমার সর্বস্ব হরণ করবে। প্রেমে তাঁর শ্রদ্ধা ছিল বলেই আমি বেঁচে ছিলাম।’

আমার নিজের কথাই যেন আমার নিজের কাছে নির্মম ও অচেনা লাগল! রামের মুখ গিরগিটির মতো রং বদলাচ্ছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি রামের মুখের দিকে সোজা তাকিয়ে থাকার সাহস করতে পারলাম।

অনেকটা সময় কেটে গেল। বৃষ্টির শব্দ ক্রমশ বেড়ে যেতে থাকে… এক সময় রাম বলেন—‘ঠিক আছে। আমি তোমাকে বিশ্বাস করলাম। তোমাকে আমি গ্রহণ করলাম।’

এরপর অনেক দিন পেরিয়ে গেল। ইতিমধ্যে আমরা অযোধ্যায় ফিরে এসেছি, কিন্তু সেই রাতের কথা আমি ভুলতে পারছিলাম না। আমার মনে কেন এমন অনুভূতি এল যেন আমি রামকে প্রতারিত করেছি যদিও আমার কথা একেবার মিথ্যাও তো ছিল না। রাবণ আমাকে উপযাচক হয়ে কোনোদিন স্পর্শ করেনি; আমিই বিদায়বেলায় তাঁকে চুম্বনে ভরিয়ে দিয়েছিলাম। রাবণের সাথে সেই শেষ সাক্ষাৎ এখনও আমার বুকে অভিশাপের মতো গেঁথে আছে। আমি আমার সাথে অহরহ রাবণের সেই চোখজোড়া, রাবণের কণ্ঠস্বর, তাঁর অন্ধ অনুরাগ বয়ে নিয়ে বেড়াতাম… আর প্রতিদিন কেন যেন আমার সন্দেহ গাঢ় হয়ে উঠছিল যে রামও সুখী নয়। ভেতরে ভেতরে কিছু যেন তাঁকে খুবলে খুবলে খাচ্ছিল। কিন্তু এই কথা আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করার সাহস করতে পারিনি। রাতের বেলায় শারীরিক ঘনিষ্ঠতার সময় হঠাৎ তিনি থমকে যান, তাঁর স্পর্শও যেন ইতস্তত, বিলম্বিত। তাঁর ভারাক্রান্ত নিশ্বাস আমার হৃদয়কে পুড়িয়ে ফেলতে চায়।

একদিন আমি একটি স্বপ্ন দেখি। আকাশীরথে চড়ে আমি রাবণের সাথে কোথাও যাচ্ছি। মেঘের মধ্যে কখনও কখনও আমাদের যান ঢুকে যায় আর আমি চিৎকার করে রাবণকে শক্ত করে ধরে থাকি। রাবণ হাসে। হঠাৎ উল্কার মতো কিছু একটা ভয়ংকর শব্দে আমাদের যানটির কাছে পড়ে যানটিকে দু-টুকরো করে ফেলে। আমি নীচে পড়ে যাচ্ছি আর আতঙ্কে চিৎকার করছি—‘রাবণ, বাঁচাও, বাঁচাও।’

ধড়মড়িয়ে আমি জেগে উঠে রামের দিকে তাকাই। আমার দিকে পিঠ দিয়ে রাম ঘুমিয়ে আছেন। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি।

এই স্বপ্ন দেখার কয়েকদিন পর থেকে রাম অন্তঃপুরে বেশ দেরি করে আসা আরম্ভ করেন। তাঁর অপেক্ষায় থেকে থেকে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। সকালে যখন জেগে উঠতাম তখন সে শয়নকক্ষ ত্যাগ করে চলে গেছেন। আসলে সে শয়নকক্ষে এসেছেন কি না সেটাও আমি বুঝতে পারিনি। এভাবে দশটা দিন কেটে গেল।

কিন্তু একদিন আমি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হলাম। রাতের চতুর্থ প্রহর পার হল। আমি শয্যায় বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর রাম এলেন। আমরা দুজনেই একে অপরকে দেখে চমকে উঠলাম। এই দশ দিনে তাঁর চেহারা ভয়ানকভাবে বদলে গেছে। তাঁর মুখশ্রী ম্লান হয়ে গেছে, চোখেও আগের মতো জ্যোতি ছিল না।

‘তুমি এত রাত পর্যন্ত জেগে আছো?’
‘আপনি কী চান?’ সেই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারিনি যে আমি রাবণকে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নটিরই পুনরাবৃত্তি করেছি। তিনি হতবাক হয়ে গেলেন।
‘আপনাকে শুনতে হবে। আজ আমি নিজেকে আর আপনাকে এই লুকোচুরির খেলা থেকে মুক্ত করতে চাই।’
তিনি আমার চোখের দিকে তাকালেন এবং তারপরে আমাদের মধ্যে হঠাৎ যেন একটি অদৃশ্য বোঝাপড়া আরম্ভ হল। তিনি ধীরে ধীরে আমার পাশে বসে বলেন—‘বলো’।
আমি বলতে শুরু করলাম।

সতেরো দিন পর লক্ষ্মণ আমাকে এই জায়গায় নিয়ে এল। মধ্যাহ্নের সূর্য তখন অগ্নিবলয়ের রূপ ধারণ করেছে। সব গুল্মলতা-বৃক্ষ নিথর হয়ে আছে। যমুনার তীরে আমরা আমাদের রথ থামিয়ে নৌকায় নদী পার হলাম। আমাদের জন্য সারথি সুমন্ত রথে অপেক্ষা করতে থাকে।

আমাকে একটা গাছের নীচে বসিয়ে লক্ষ্মণ বলে—‘মহারাজ আপনাকে নির্বাসনের আদেশ দিয়েছেন।’
আমার দু-চোখ দিয়ে দু-ফোঁটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে নামে।
‘কিন্তু এখনও উপায় আছে…’, কেন জানি সেই মুহূর্তে লক্ষ্মণের কণ্ঠের আওয়াজ অচেনা মনে হল! দক্ষিণ দিকে ইশারা করে সে আমাকে বলে—‘ঐ যে ঘন জঙ্গল দেখছেন, সেখান থেকে পাঁচশো ক্রোশ গেলেই আমার মামার অধীনস্থ রাজ্য… আমরা সেখানে যেতে পারি।’
সীমাহীন বিস্ময়ে আমার দু-চোখ যেন বিস্ফারিত হতে চায়।
‘আমি বুঝতে পারছি না।’
“দাদা বলেছিলেন—‘লঙ্কার যুদ্ধের আমিই মূল নায়ক। যুদ্ধ-শিরোমণি, মহাবীর ইত্যাদি নানা উপাধিতে আমাকে অলংকৃত করা হল, কিন্তু আমি কি শুধু সেটাই চেয়েছিলাম। সেগুলো তো আমার পরম অভীপ্সিত বস্তু ছিল না। আমি চেয়েছিলাম…’”
লক্ষ্মণ থেমে গেল আর এই প্রথমবার আমার চোখের দিকে তাকাল—‘আমি একজন নারীর প্রেম চেয়েছিলাম।’
আমার মনে হল যেন আমার শরীরে বাজ পড়েছে। ‘আমি প্রথম দর্শনেই সেই নারীর প্রেমে পড়েছিলাম। প্রায়শই বলা হয়—স্ত্রী জাতির মোহে পুরুষেরা জল-ধরাতল-রসাতল কিছুই গণ্য করে না। আমারও তেমনটাই হয়েছিল। কিন্তু সেই স্ত্রীকে লাভ করল অন্য একজন। ভেতরে ভেতরে আমি উন্মাদ হয়ে গেলাম কিন্তু আমার হৃদয় থেকে সেই নারীর ছবিকে তিলমাত্র মুছতে পারলাম না।’
‘থামো, থামো! এই ধরনের কথা বলবে না।’ আমি আর্তনাদ করে উঠলাম।
লক্ষ্মণ আমার আরও কাছে আসে।
‘অন্তত এখন তো তুমি আমার হতে পার। মন্দোদরী যেভাবে বিভীষণকে, তারা যেভাবে সুগ্রীবকে গ্রহণ করেছিল, সেভাবে তুমিও আমাকে গ্রহণ করো, সীতা। আমি তোমাকে জগতের সমস্ত সুখ এনে দেব। দাদার মতো আমি তোমাকে সন্দেহ করি না। তোমার চলা-ফেরায় আমি কোনো বাধানিষেধ আরোপ করব না… আমার স্ত্রী হও, সীতা।’

আমার চোখের সামনের পৃথিবীটা হঠাৎ চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করে। আমার ভেতরের ও বাইরের সমস্ত দৃশ্য একাকার হয়ে যায়। আমার দু-চোখের সামনে ঘন অন্ধকার নেমে আসে। যখন আমার জ্ঞান ফিরে আসে তখন প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে। আমি মাটিতে শুয়ে ছিলাম। লক্ষ্মণ আমাকে অশ্বত্থের পাতা দিয়ে বাতাস করছিল। তার উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি আমার দু-চোখের ভ্রূকুটিতে ফিরে যায়।

…হঠাৎ যেন আমার হৃদয়ের একটি অজানা দরজা খুলে গেল। অতীতের নানান খণ্ডিত চিত্র হুড়মুড় করে আমার মনে ভিড় করে… একান্ত অনুগত ভাই লক্ষ্মণ, বনবাসের সময় সদা সতর্ক, সদা জাগ্রত লক্ষণ, দুর্গম অরণ্য থেকে খুঁজে পেতে আমার জন্য সুগন্ধি ফুল, ফলমূল নিয়ে আসা লক্ষ্মণ, সলজ্জ, নম্র, মিতভাষী লক্ষ্মণ, বনবাসের আদেশ শুনে দশরথ-কৈকেয়ীকে শাস্তি দিতে উদ্যত লক্ষ্মণ… লক্ষ্মণ কেন ঊর্মিলাকে ত্যাগ করে বনবাসে আমাদের সঙ্গী হয়েছিল? আমার জন্যে? অথচ সেই সুদীর্ঘ সময়ে এমন একটি দিনের কথা আমার মনে পড়ে না যেদিন আমি লক্ষ্মণের কাছ থেকে কোনও ইঙ্গিত পেয়েছি। রাম কি এ বিষয়ে কিছু জানতেন? আমার নিজের চিন্তার কুণ্ডলীতে আমি পাক খেয়ে খেয়ে জড়িয়ে যাচ্ছিলাম।
আমি দু-চোখ খুললাম। স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল লক্ষণ।

‘তুমি কী চাও? রাবণকে ও রামকে জিজ্ঞেস করা একই প্রশ্নের আমি পুনরাবৃত্তি করি? তুমি যা চাইছ সেটা তো এখন আর সম্ভব নয়।’

আমি ভেবেছিলাম সে আবার আমাকে তার স্ত্রী হতে বলবে অথবা আমার সঙ্গসুখ কামনা করবে।

কিন্তু লক্ষ্মণ তখন বলে—‘আমি বিচার চাই।’

সীতা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। আমি বুঝলাম সীতার গল্প শেষ হয়ে গেছে কিন্তু সীতার গল্পের শেষ বাক্যটি আমার মনে অমোঘ মন্ত্রের মতো ক্রিয়া করে। ন্যায় চেয়ে আসলে লক্ষ্মণ কী বোঝাতে চেয়েছিল? কার কাছে লক্ষ্মণ ন্যায় বিচার চেয়েছিল? সীতার আমাকে এই গল্পটি বলার প্রতীকী অর্থ কী? আমি ‘রামায়ণ’ রচনা করেছিলাম আমার মতাদর্শ তথা দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কিন্তু আজ আমার চরিত্রেরা তাদের পৃথক দৃষ্টিকোণ থেকে কথা বলছে। রামের চরিত্র, আদর্শবাদ আর তাঁর প্রজা-বাৎসল্যের স্বভাবকে মহিমান্বিত করে দেখানোর জন্য, আমি অন্যান্য চরিত্রগুলোকে গৌণ করে রেখেছিলাম। কিন্তু আজ অন্য চরিত্রগুলো মাথা উঁচু করেছে, তাঁদের কণ্ঠস্বর উদাত্ত হয়ে পূর্বের ধারণাগুলোকে প্রত্যাহ্বান জানিয়েছে; একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে।
আমি নিজের চিন্তায় এতটাই ডুবে গিয়েছিলাম যে সীতার কণ্ঠ আমাকে ভীষণ ভাবে চমকে দিল। সীতা বলে—‘এখন আপনিই আমাকে ধর্ম সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারেন। আমাকে পথ দেখান।’

আমি বললাম—‘এখন তোমার সামনে দুটি পথই খোলা আছে। একটা আমি নির্ধারণ করে দেওয়া পথ—তোমার বনবাস। অন্যটি—লক্ষ্মণের অনুগমন করা। আমি আমার গল্পটি আবার লিখব আর সেখানে দুটো উপসংহারই থাকবে। তুমি কী চাও?’

… আমি সীতার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।

(গল্পে S = সীতা (Sita), R2 = রাবণ/রাম (Ravana/Ram), L = লক্ষ্মণ (Laxman), এবং ‘/’ চিহ্নটি কয়েকটি বিকল্পের ইঙ্গিত দেয়।)

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২