নতুন স্লোগান – নীলকমল ব্রহ্ম অনুবাদ: তপন মহন্ত

নতুন স্লোগান – নীলকমল ব্রহ্ম অনুবাদ: তপন মহন্ত

শেয়ার করুন

“বেকার ভাতা দিতে হবে” স্লোগানের জায়গায়, যা প্রাচীরের গায়ে লেখা ছিল, কেউ রাতারাতি নতুন স্লোগান লিখে দিয়েছে—“বোড়ো ভাষাকে সহযোগী সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দাও।”

অন্য যে কোনও দিনের মতোই তিনি যখন হাঁটতে বেরোন, বুড়ো দুখেশ্বর প্রাচীরের দিকে তাকিয়ে দেখেন, সেখানে নতুন কোনো স্লোগান আছে কিনা। দেওয়ালে একটি নতুন স্লোগান লেখার অনেক দিন হয়ে গেল। পুরোনো স্লোগানটি শ্যাওলায় অস্পষ্ট হয়ে গেলেও কিছুটা এখনও পড়া যায়, “নো উদয়চাল, নো রেস্ট!” “বোড়োল্যান্ড দিতে হবে,” “ছেলে হোক বা মেয়ে, দুটিই যথেষ্ট।”

সিভিল হাসপাতাল থেকে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞকে অপসারণের দাবিতে দেওয়ালের এক কোণে একটি পোস্টার ছিল। একটি পুরোনো পোস্টার—“বোড়ো পুরুষেরা দখনা না পরা কোনও বোড়ো মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে না” সরিয়ে নতুন পোস্টার “বেকারদের ভাতা দাও” লেখা হয়েছে। এই স্লোগানকে জায়গা দেওয়ার জন্যই আগের স্লোগানটি মোছা হয়েছিল।

নতুন স্লোগানটি দেখে বুড়ো দুখেশ্বর ভাবেন, তিনি হাসবেন না কাঁদবেন!

তিনি জানেন যে সেই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এখনও সিভিল হাসপাতালে কর্মরতা। দখনা না পরা মেয়েদেরও দিব্যি বিয়ে হচ্ছে। বেকাররাও আর ক্ষতিপূরণ চায়নি। যা প্রয়োজন ছিল, তা বোড়ো ভাষার স্বীকৃতি।

বুড়োটি খুব খুশি হলেন। যদিও কিছু ঘটেনি তবু তাঁর দেওয়ালের একপাশটি সাদা করা হয়েছে। অন্ততঃ কয়েক দিনের জন্য তাঁকে তার তিন মেয়ের অভিযোগ শুনতে হবে না—“এই অলস বুড়োটি বাড়ি মেরামত করে না কেন?”

কে না চায় নিজের বাড়িঘর মেরামত করতে? কিন্তু দায়িত্বটা কি কেবল বাড়ির মুরব্বির? বউ বাচ্চাদের কি কোনও দায়দায়িত্ব নেই?

একা বৃদ্ধ কীভাবে সব সামলাবেন? যদিও তাঁর অনূঢ়া তিন মেয়ে এবং একটি জোয়ান ও সবল দেহের ছেলে আছে, তবুও বুড়ো দুখেশ্বরকে হাটবাজার করতে হয়। কদাচিৎ তাঁর স্ত্রী পিঠের ব্যথায় শয্যাশায়ী হলে বুড়োকেই রাঁধতে হয়। তবে দুখেশ্বরের দেওয়ালে নতুন স্লোগান লেখা হলে বুড়োর খুব ভালো লাগে। কারণ এতে দেয়ালটি নতুন ভাবে পরিস্কার হয় আর এই স্লোগানগুলো থেকে তিনি অনেক কিছু শিখতে পারেন।

কখনও কখনও বুড়ো দুখেশ্বর ভাবেন, স্লোগানগুলি কি তাকে শিক্ষিত করার জন্য লেখা হয়েছে? হতে পারে। স্লোগানগুলি এভাবে স্মরণ করিয়ে দেয় তাঁর জীবনে সম্মুখীন হওয়া বিভিন্ন সমস্যার কথা।

বুড়ো দুখেশ্বরের অবসর নেওয়ার প্রায় পাঁচ বছর হল। তিনি বন বিভাগের একজন রেঞ্জার ছিলেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি রাজ্যের বিভিন্ন রেঞ্জ অফিসে কাটিয়েছেন। এমনকি এখনও লোকেরা বলাবলি করে, বুড়ো দুখেশ্বরের মতো আরও দু’জন রেঞ্জার থাকলে আমরা দেখতে পেতাম, কোন্ লোভী বন আধিকারিক সাহস পায় বনাঞ্চল ধ্বংস করতে!

তিনি এখন অনুশোচনা করেন, সুদীর্ঘ চাকুরি জীবনে তিনি প্রতিদিনের বাস্তবতাকে নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা করেননি।

তাঁর চাকুরিই এর জন্য দায়ী। তাঁর কাজটাই এমন ছিল যে পৃথিবীতে কী ঘটছে তা ভেবে দেখার সময়ই ছিল না।

তাঁর ভাগ্য ভালো ছিল। তাই স্ত্রীর তাগাদায় তিনি শহরের এই বাড়িটি করতে পেরেছেন, তাঁর সন্তানরা পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছে।

কিন্তু হায়! আজ অনুভব করেন যে তিনি ওদেরকে শিক্ষিত করে ভুল করেছেন। আজকের শিক্ষিত সন্তানেরা কি মা-বাবার জন্য গর্ব করে! বরং কষ্ট করে মানুষ করা ও নামী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষায় শিক্ষিত সন্তানেরা এখন তাদের বুড়ো বাবার জন্য লজ্জা পায়!

তাঁর মনে আছে কীভাবে একজন নতুন তরুণ ডিএফও তাঁকে একবার তাঁর অফিসে ডেকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, “আপনি কেন ওই ব্যবসায়ীকে সিএফটির পারমিট দেননি? এটি তাড়াতাড়ি দেওয়ার বন্দোবস্ত করুন। নইলে আপনার পেনশনের কাগজপত্র আটকে দেবো।”

চাকুরিতে যোগদানের সময় থেকে অবসর গ্রহণের আগে পর্যন্ত বুড়ো দুখেশ্বর কখনও বন বিভাগের নিয়ম-কানুনের বিরুদ্ধে যাননি, এখন নতুন ডিএফও-র আদেশ মানতে গিয়ে অবসর গ্রহণের প্রাক্কালে তাঁকে সমস্ত নিয়মগুলি ভাঙতে হয়েছে। তিনি এখন বুঝতে পারেন, যদিও নিয়মগুলির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, কিন্তু সময় পালটেছে।

অবসর গ্রহণের পর, গৃহপ্রবেশের সময় তাঁর প্রাচীরে একটি নতুন স্লোগানের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ হলে তিনি হেসে ফেলেন। এটিতে লেখা ছিল—“নৈতিক অবক্ষয় নিপাত যাক।”

তাঁর তিন মেয়ের বিয়ের বয়স অতিক্রান্ত। তবুও মা-বাবা যখন পছন্দের পাত্রদের নাম প্রস্তাব করেন তখন তারা উদাসীন থাকে।

“ওই গরীব ফরেস্টারের সাথে? তাকে বিয়ে করার চেয়ে আমি বরং আইবুড়ো থাকব।”

একথা তাঁর বড়ো মেয়ে বলে যে তিন বার পরীক্ষা দিয়েও বি.এ. পাস করতে পারেনি।

“বাবা আর মায়ের চোখে, মাস্টার আর ব্যবসায়ী ছাড়া কেউ নজরে পড়ে না! সম্ভবত তাঁরা বুঝতে পারেন না যে এই পৃথিবীতে ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ারও রয়েছে!”—এম.এ. পরীক্ষা পুরো না করা তাঁর মেজো মেয়ে একথা বলে। (সে আন্দোলনের সময় বাড়ি এসেছিল আর ফিরে যায়নি পরীক্ষা দিতে)। ছোটো মেয়ে অন্য দুজনের চেয়ে আরও বেশি মেজাজি। গান, নাচ, অনুষ্ঠান, নাটক নিয়ে ব্যস্ত সে বিয়ের কথা তুললেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলে, “তোমরা যদি আমাদের খাওয়াতে-পরাতে না পারো, তবে আমরা যখন ছোটো ছিলাম তখন কেন আমাদের মেরে ফেললে না?”

বুড়ো দুখেশ্বর অনেক কারণে দুঃখ পেয়েছেন, বোড়ো হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মেয়েরা কখনও দখনা পরে না। তিনি অবাক হয়েছিলেন যে তাঁর মেয়েরা দেয়ালে লেখা স্লোগানটি, “বোড়ো পুরুষেরা দখনা না পরা কোনও বোড়ো মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে না”-র মর্মার্থ বুঝতে পারে না। অথবা হতে পারে তারা এটি জেনেশুনেই মেনে নিতে চায় না, বুড়ো দুখেশ্বর মাঝে মাঝে ভাবেন।

বড়ো মেয়েটির পরেই ছিল তাঁর ছেলে। যে বংশবৃক্ষকে পল্লবিত রাখবে সে-ও ‘অপদার্থ’। সে নিজেকে যেকোনো ধরনের কাজ থেকে দূরে রাখে। ডিএফও তাকে ফরেস্টারের চাকুরি দিতে রাজি ছিলেন। সেই কাজে বেতন খুব কম বলে সে চাকরি নেয়নি। যদি পৃথিবীতে কোনো নির্বোধ থাকে তবে সেই নির্বোধ তাঁর সন্তানেরা। তাদের গর্ব, স্বপ্ন এবং উচ্চাকাঙ্খা দেখে তাক লেগে যায়! ছেলেটি তার মায়ের টাকা চুরি করে বিদেশি মদে গলা ভেজায়, শহরের মেয়েদের প্রলুব্ধ করে, নিজেকে ধনী পরিবারের ছেলে বলে জাহির করে আর বাড়ির খাবারের টেবিলে যখন মাছ-মাংস না থাকে তখন প্লেটগুলো ভেঙে ফেলে। সে এমন আচরণ করে যে তার কাজ করার এখনও এমন বয়স হয়নি যে সে নিজেই অর্থোপার্জন করে একটি মদের দোকান কিনতে পারবে, একটি ধনী মেয়ের স্বপ্ন দেখতে আর প্রচুর খাবার খেতে পারবে।

বুড়ো দুখেশ্বরের চোখ যখনই “বেকারদের জন্য ভাতা দাও” স্লোগানটিতে আটকে যায়, যা পূর্বের স্লোগানটির জায়গায় এসেছিল, তখন তিনি মিশ্র আবেগে আপ্লুত হন। যারা কাজ করে না তাদের কেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে? যারা পরিবারের কষ্টার্জিত টাকা ধ্বংস করে তারা ক্ষতিপূরণ পেতে শুরু করলে সবাই অলস হয়ে গিয়ে আর কাজ করতে চাইবে না।

সময় পালটেছে। মানুষের চিন্তাভাবনা এবং জীবন-যাপন পদ্ধতিরও পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের মাঝে বুড়ো দুখেশ্বরের নিজেকে মানিয়ে নেওয়া শক্ত হয়ে পড়ছিল। ত্রিশ বছর আগে কাঠের তৈরি ঘরগুলি যখন কংক্রিটের বাড়ির মুখোমুখি দাঁড়ায় তখন তারা নিজেকে যেমন বেমানান মনে করে, তেমনি তাঁর মেয়ের বিয়ে ও সামাজিক সংরক্ষণ সম্পর্কিত তাঁর মতামতও বর্তমানে অচল। তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে বুড়ো দুখেশ্বর তেমন কিছু পরিবর্তনের কথা ভাবতে পারেন না। তবুও আশা করেন সমস্ত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে। তাঁর মেয়েদের বয়স প্রতিদিন বেড়ে যাচ্ছিল। তাঁর পুত্র তখনও কোনও কাজ করতে প্রস্তুত ছিল না!

বুড়ো দুখেশ্বরের উদ্বেগের শেষ নেই। তাঁর সংসার টিকিয়ে রাখার একমাত্র সম্বল হল পেনশন। তিনি প্রায়ই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এই কথা ভেবে যে তাঁর মৃত্যুর পরে কীভাবে তাঁর পরিবার বেঁচে থাকবে! তাঁর যে তিন মেয়ে চাকরির সন্ধানে ছিল, তারা কোনোমতে টিউশনের মাইনে দিয়ে তাদের নিজেদের পোশাক-পরিচ্ছদের যোগাড় করতে পারত। কিন্তু তবু তিনি উদ্বেগ থেকে মুক্তি পেতেন না। তিনি যদি তাঁর পুত্রের মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখতেন তবে কিছুটা স্বস্তি অনুভব করতে পারতেন। সেটাও হয় না!

আজ নতুন একটি স্লোগান বুড়ো দুখেশ্বরের মনে পুনরায় আশা জাগিয়েছে। যদি বোড়োকে সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় তবে অনেক বোড়োভাষীরা সরকারি চাকুরি পেতে পারে। এমনকি ডিএফও অফিসেও। তিনি তার ছেলেমেয়েদের চাকরির জন্য ডিএফওকে অনুরোধ করতে পারবেন। কিন্তু তিনি যদি তাঁর মেয়েদের বিয়ে দিতে পারতেন তবে তিনি অনেক বেশি খুশি হতেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তার পুত্রের মতিগতির পরিবর্তন হতে পারে। যদি সেটা না-ও হয় তবে তাঁর কী! তিনি তো তখন অনেক দূরে অন্য জগতে থাকবেন!

প্রাতঃরাশের পরে বুড়ো দুখেশ্বর বাজারে বেরোলেন। ফেরার পথে তিনি শাকসবজি ও মাছ সহ পাঁচশো গ্রাম চুন এবং নীল নিয়ে ফিরলেন। তাঁর স্ত্রী খোঁচা দিয়ে বলেন, “আশ্চর্য, আজ আমার বুড়ো মানুষটির কী হয়েছে! চুনের অভাবে আমরা পান-সুপারি চিবানোর অভ্যাসটি প্রায় ছেড়ে দিতে বসেছি! আজ কেন এল আধা কেজি চুন! অবাক কাণ্ড! এত চুনে কি করবে সে?”

বুড়ো দুখেশ্বর ভাবে তাঁর পক্ষে নীরব থাকাই ভালো। বাজারে যাওয়ার সময়, কেন তিনি চুন কেনার পরিকল্পনা করেছিলেন, তা জেনে গেলে তারা এটা কোনোমতেই ভালোভাবে নেবে না। বুড়ো দুখেশ্বর কিছু করার সংকল্প নিয়েছিলেন। তিনি তা আগেভাগে প্রকাশ করার সাহস করেননি। যদি তাঁর সন্তানেরা জানতে পারে তবে তারা তাঁকে উপহাস করবে।

তবে তিনি কাজটি করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। সন্ধ্যায় বৃদ্ধকে দেখা গেল এক বালতি জলে চুন গুলতে। কিছুক্ষণ পরে তিনি বাইরে বেরিয়ে এসে প্রাচীরের কাছে দাঁড়ালেন। তিনি ভেবে নেন দেওয়ালের কোন্ অংশে তিনি চুন লাগাবেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে পুরোনো লেখা প্রায় বিবর্ণ হয়ে যাওয়া “ছেলে হোক বা মেয়ে, দু’টিই যথেষ্ট”র জায়গাতেই তিনি এটা লিখবেন…

একটা সময় ছিল যখন তিনি এই স্লোগান দেখে হাসতেন। তিনি ভাবতেন এটি রাজনীতিবিদদের জনগণকে বিভ্রান্ত করার একটি ফন্দি। তবে এখন তিনি বুঝতে পেরেছেন যে এই পরিকল্পনাগুলো জনসাধারণের কল্যাণেই। আজ তিনি নিজে লজ্জা পান যে তিনি চার সন্তানের জনক। নিজের বিব্রত অবস্থা ঢাকতে গিয়ে তিনি স্লোগানটি মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

প্রাচীরে আঁকার কাজ শেষ করার পরে তিনি নিজের কাজে নিজেই মুগ্ধ হলেন। এত সুন্দর! কে বলতে পারে যে আমি বুড়ো হয়ে গেছি? সন্ধ্যার দিকে তিনি কোথা থেকে এক টুকরো বাঁশ নিয়ে এসেছিলেন। তিনি বাঁশের প্রান্তটি চোখা করে পেন্সিলের আকারে একটি ব্রাশ তৈরি করলেন। লেখার জন্য ব্রাশটি ব্যবহার করা যায় কিনা তা দেখার সময় তিনি যখন কলেজে পড়তেন তখনকার একটি ঘটনার কথা তাঁর মনে পড়ে।

কলেজর ছাত্র থাকাকালীন, দুখেশ্বর তার বন্ধুর বোনের বিয়েতে গিয়েছিলেন। তাঁকে গেটে “হ্যাপি ওয়েডিং” লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি কেবলমাত্র একটি সাধারণ ব্রাশ দিয়ে অল্প সময়ে যা লিখতে পেরেছিলেন তা সবার নজর কেড়েছিল এবং তিনি শিল্পী হিসাবে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন, বিশেষত মেয়েদের মধ্যে। তখনই দুখেশ্বর নজরে পড়েছিলেন গ্রাম প্রধানের মেয়ে দুখুশ্রির।

শেষ পর্যন্ত তাঁরা একে অপরকে জানতে পারেন। শীঘ্রই তারা প্রেমে পড়েন আর পরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

রাতের খাবারের পরে তিনি দুখুশ্রির মুখ থেকে শুনতে পান, “বীণা, রিনা, মীনা, তোমরা কি দেখেছ যে তোমাদের বাবা কি করেছেন? তিনি এখন ঘর পরিষ্কার করবেন। আজ দেয়ালে রং লাগিয়েছেন। হতে পারে, আগামীকাল বাড়িটিও মেরামত করবেন।”

তাঁর স্ত্রী এবং কন্যারা যা বলে তাতে দুখেশ্বরের সংকল্প ভঙ্গ হয় না। তিনি রাতের খাবার শেষে শান্তভাবে ঘুমিয়ে পড়েন।

তখনও কেউই জেগে উঠেনি, তাঁর স্ত্রী কিম্বা তাঁর সন্তানরাও। এখন অবধি, মানুষেরা রাস্তায় পা রাখেনিl বুড়ো দুখেশ্বর কোনও প্রকার বাঁধা ছাড়াই স্লোগানটি লিখলেন। স্লোগান লেখার পরে, তিনি নীল ও ব্রাশ সহ বালতি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর নিজের লেখা দেখে খুব খুশি হলেন। তাঁর মন এক অসীম প্রশান্তিতে ভরে গেল। কাকের ডাকে তিনি বাস্তব জগতে ফিরে এসে তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরতে গিয়ে তিনি দেখলেন দুখুশ্রি তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন।

হাসতে হাসতে তাঁর স্ত্রী তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন: “বুড়ো, তুমি কি লিখেছ?”

বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই তিনি বললেন, নিজেই দেখে নিও!

গতকাল রাতেই তাঁর স্ত্রী দুখুশ্রি বিষয়টি জানতে চেয়েছিলেন। গত রাতে সে-ও নিশ্চয়ই সেই বিয়ের রাতের কথা মনে করেছিলেন। প্রাচীরের কাছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাঁর স্ত্রী দেখলেন, বুড়ো চমকপ্রদ একটি স্লোগান লিখেছেন ঠিক যেমনটি তিনি সেই বিয়ের রাতে লিখেছিলেন, “হ্যাপি ওয়েডিং”। তাঁর স্ত্রী অপটুভাবে পড়েন— “তিন বিবাহযোগ্য কন্যার জন্য তিন জন যোগ্য বর আবশ্যক।”



নীলকমল ব্রহ্ম (১৯৪৪-১৯৯৯): বোড়ো সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বাধিক ছোটোগল্প রচয়িতা নীলকমল ব্রহ্ম এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। এই শক্তিমান কথাকার বোড়ো সাহিত্যে সাহিত্য সম্রাট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তাঁর বাস্তবধর্মী ছোটোগল্পের চরিত্রগুলি চিন্তায় চেতনায় নতুন যুগের প্রতিনিধি। সহজ সরল গ্রাম্য মহিলা থেকে শুরু করে সুশিক্ষিত অত্যাধুনিক মহিলা, নারী শরীরের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে অতি অহংকারী মহিলা- সমাজের সব ধরনের নারীর বহুমুখী চরিত্র চিত্রণে পারদর্শী সাহিত্য সম্রাট। নারীবাদী ভাবনার নির্যাসে রচিত ‘হাগ্রা গুদুনি মই’ (গভীর অরণ্যের মৃগ) গল্প সংকলনটি তাঁর উৎকৃষ্ট শিল্পকর্মের নিদর্শন। গল্পটির বিভিন্ন চরিত্রের চিন্তা চেতনায় ফুটে উঠেছে আধুনিকতা। ‘সিরিনায় মান্দার’ (ঝরা মাদার ফুল) গল্পের নারী চরিত্র বালেঙ্গশ্রী বর্তমান সমাজের শহুরে আবহাওয়ায় প্রতিপালিত লোভী মেয়ে বৈবাহিক জীবনেও অবৈধ সম্পর্ক রেখে শেষে অনুতপ্ত হয়ে নিজেকে তুলনা করেছে ঝড়ে পড়া মাদার ফুলের সাথে। সামাজিক গল্প ছাড়াও নীলকমল ব্রহ্ম রাজনৈতিক গল্পও লিখেছেন। ‘সিলিংখার’ (নিঃশেষিত) পুস্তকের ‘বুলি’ গল্পে লেখক বোড়োদের রাজনৈতিক সংকটকে তুলে ধরেছেন। বিষয়বস্তু নির্বাচন, চরিত্র চিত্রণ, শব্দ চয়নে নীলকমল ব্রহ্ম সুদক্ষ। তাঁর গল্পে গতানুগতিক রক্ষণশীল বোড়ো সমাজের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছে এক মধ্যবিত্ত প্রগতিশীল আধুনিক বোড়ো সমাজ। শহরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে প্রাচীন মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য বোড়ো সমাজ থেকে ক্রমশ অপসৃত হয়ে এক শিক্ষিত ভোগবাদী সমাজ ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে, এই চরম সত্যটি লেখকের শক্তিশালী কলমে উঠে এসেছে। ১৯৮৬ সালে রজত কমল পুরস্কারে সম্মানিত বোড়ো চলচ্চিত্র “আলয়ারন”-এর তিনি চিত্রনাট্যকার। ড. অঞ্জলি দৈমারি এবং মি. প্রণব জ্যোতি নার্জারি অনুদিত “New Slogan”, গল্পটি “থুনস্লাই” পত্রিকার নভেম্বর, ২০১৪ সংখ্যা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন তপন মহন্ত।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২