যে-বছর চের্নোবিল ( পর্ব ১২ ) – কুশাণ গুপ্ত

শেয়ার করুন

১২

(শেষ পর্ব)

শীত

একাধিক সূত্র হইতে পাওয়া যায়, চের্নোবিলের নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টটি গড়িয়া উঠিয়াছিল ভ. ই. লেনিনের নামানুসারে। ইউক্রেনের প্রিপিয়েট এই নগরটি স্থাপিত হয় পার্শ্ববর্তী নদীটির নামে, সত্তরের দশকে। ইহা ছিল সাবেক সোভিয়েতের অপর আরেকটি ছিমছাম নিউক্লিয়ার-শহর। স্কুল, হাসপাতাল, পার্ক, সুইমিং পুল, ফুটবল স্টেডিয়াম― যা যা উপাদান একটি উন্নত দেশের ছোটোখাটো শহরে থাকে, সে সকল এই শহরেও ছিল। প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ এই শহরে বসবাস করিতেন।

দুর্ঘটনার পরে ২৭ এপ্রিলে যে সকল নাগরিকদের শহর হইতে স্থানান্তরিত করা হয়, সকলেই ভাবিয়াছিলেন, নিশ্চয়ই নিজ-বাসভূমিতেই একদিন তাঁহারা ফিরিবেন। কিছু মানুষ ভলান্টিয়ার হিসাবে দুর্ঘটনাস্থলে কাজ করিবেন, তাঁহারাই কিছুকাল রহিয়া যান। কিন্তু স্যাক্রোফেগাস নির্মাণ সম্পন্ন হইবার পরে কার্যত পরিত্যক্ত প্রিপিয়েট জনমানবহীন ভূতের শহর হইয়া রহিল।

এদিকে ডিসেম্বর আসিয়া গেল। শৈবা এই চার মাসে অনেকটা বাড়িয়া উঠিয়াছে। নতুন খাঁচাটিকে ভালো করিয়া সিলিং হইতে ঝুলন্ত আঁকশির সঙ্গে বাঁধা হইয়াছিল, যাহাতে কোনোমতেই পড়িয়া না যায়। সত্য এক পশু-চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি বার দুই তিনেক ভিজিট করিয়া যান। উপযুক্ত ওষুধ দেওয়ার পরে শৈবা ধীরে ধীরে কিছুটা সুস্থ ও সবল হইয়াছে। তথাপি ডানা কিছু দুর্বল। এখন সে সামান্য ডানা ঝাপটানোর প্রয়াস করে। আরেকটি দর্শনীয় বস্তু হইল শৈবার ঘাড় ঘুরাইয়া কখনও ক্যারর ক্যাট ক্যাট শব্দ, কখনও বা মিঠু মিঠু। পূর্বের টিয়া কার্যত নীরব থাকিত। কিন্তু বর্তমানের পাখিটি বড়োই আমুদে। মুহূর্তেই নানান স্বরে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে সক্ষম।

সেপ্টেম্বর মাসেই সত্যমাধব সঙ্কট-উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন। ইহা বুঝিবার উপায় হইল তাঁহার গুপ্ত ডায়ারির একটি সংকেত। একটি পাতায় নানা শব্দাবলী লিখিত হইবার পরে তিনি পরের পৃষ্ঠায় একটি স্বস্তিক-চিহ্ন আঁকিতেন। মঙ্গলময় ওই চিহ্নের নীচে দুইটি অনাবশ্যক সরলরেখা এবং মধ্যস্থলে একটি বিন্দু, যাহার সম্ভাব্য অর্থ ক্রাইসিস-পিরিয়ডের পরিসমাপ্তি।

পূজার ছুটির কিছুদিন পূর্ব হইতেই সত্যের গৃহসংকটজনিত তৎপরতা বাড়িয়া যায়। একসময়ে তিনি উমাপদকে নিমাই জানা নামক যুবক সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করিতে বলেন। এ-ব্যাতীত ওই মিউনিসিপ্যালিটি ওয়ার্ডের পৌরপিতা তাঁহার পিতার অধীনে একদা কাজ করিত। তাঁহার সূত্রেও নিমাই সম্পর্কে ভরসাযোগ্য তথ্য আসে।

ইতিপূর্বের গৃহযুদ্ধ তাঁহার দম বন্ধ করিয়া ফেলিয়াছিল। বিশেষত, বিবাহ-সিদ্ধান্তে তাঁহার পক্ষে পরিবারের কেউই ছিল না। মৈত্রেয়ীর বিবাহ অপেক্ষা গৃহযুদ্ধের আশু অবসানই হয়তো অবশ্যকর্তব্য হইয়া উঠিয়াছিল। এই সম্পর্কে সহকর্মী উমাপদ তাঁহার দৃঢ় অবস্থান জানান। উমাপদর বক্তব্যের সারমর্ম ছিল এইরূপ: কন্যার মঙ্গলার্থে কন্যার পিতা অপেক্ষা তাহার নিজের মতামত সর্বাগ্রে গ্রহণীয়। দ্বিতীয়ত, চিরকালীন বিবাহ-প্রথায় সত্যমাধব অগ্রণী ও ব্যতিক্রমী ভূমিকা লইয়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পথ-প্রদর্শক হইয়া উঠুন।

তথাপি, অসবর্ণ বিবাহ লইয়া সত্যমাধবের চিত্ত দ্বিধান্বিত ছিল। পূর্বেই উল্লিখিত, শীতলবাবু ওরফে শীতল মুখোপাধ্যায়ের মতামত-সম্পর্কে সত্যর আস্থা, যে কোনো কারণেই হোক, কিছু বেশি মাত্রায় ছিল। একদিন শীতলবাবুর নিকট টিচার্স রুমের এককোণে সত্য ব্যক্তিগত সমস্যা পাড়িলেন। শীতল বাবু প্রসঙ্গটি শুনিয়াই নিজস্ব সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করিলেন। তিনি প্রথমেই যে প্রসঙ্গের অবতারণা করিলেন তাহা হইল, এইরূপ: পরোক্ষ সিদ্ধান্ত ও প্রত্যক্ষ সিদ্ধান্ত এই দুইতে মূলগত ফারাক রহিয়াছে। যেমন, শীতলবাবু স্বচক্ষে মার্ক্স, রামকৃষ্ণ ও গান্ধি কাউকেই দেখেন নাই। তথাপি তিনি রামকৃষ্ণের প্রতি অনুগত। ইহা হইল পরোক্ষ সিদ্ধান্ত। ইহা না হইয়া যদি মার্ক্সের পক্ষপাতী হইতেন তথাপি তিনি রবিবারে মাংস খাইতেন, সংসার একইভাবে চলিত। কিন্তু প্রত্যক্ষ সিদ্ধান্ত ভাবনা চিন্তা করিয়া লইতে হয়। ইহাতে দৈনন্দিন জীবনের ভালো মন্দ জড়াইয়া রহিয়াছে। অতঃপর শীতল বলিলেন,

―বিশেষত, এই মেয়ের বিয়ের বিষয়ে কয়েকটা ভাইটাল পয়েন্ট দেখতেই হয়। প্রথমে দেখা উচিত পাত্রের চরিত্র কীরকম। মানে ওই নেশাভাং ও অন্যান্য ভাইসেস আছে কিনা।

একটু থামিয়া, তিনি পুনরায় বলিলেন, দ্বিতীয়ত, লায়াবিলিটি কী কী আছে।

―লায়াবিলিটি বলতে?

―ধরুন, অবিবাহিত বোন বা দিদি, বেকার ভাই। এইসব।

ইহার পরে শীতলবাবুর কণ্ঠস্বর আরও নামিয়া গেল। আশেপাশে তাকাইয়া বলিলেন,

দেখুন, নিজের বেলায় একটা নীতি নেব আর আপনাকে অন্য পরামর্শ দেব, আপনি জানেন, এসব হিপোক্রিসি আমার ধাতে নেই।

―সে জানি বলেই তো আপনার অ্যাডভাইস আমি গুরুত্ব দিই―সত্য বলিলেন।

–তবে শুনুন। আপনি জানেন, বড়ো মেয়ের ক্ষেত্রে আমি মেয়ের পছন্দেই ভিন-জাতে বিয়ে দিই। মনের মধ্যে একটা খুঁতখুতুনি কাজ করত। কিন্তু, আপনাকে কী বলব, জামাই প্রায় প্রতি সপ্তাহে এসে খোঁজখবর নেয়। শুনলে আশ্চর্য হবেন, প্রায়শই বাজার করে দেয়… এছাড়াও এটা ওটা।

―বলেন কী?

―এছাড়া একটা কথা। লোকে এগ্রি করবে না। হিন্দুধর্মের এই অল ইনক্লিউসিভ ব্যাপারটা কেবল ক্যাপিটালিজমের সঙ্গেই তুলনীয়। এসব শাস্ত্রের অনুমোদনপ্রাপ্ত। আমি মন্ত্র পড়িয়েই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি।

―অল ইনক্লিউসিভ ব্যাপারটা বুঝলাম না।

―হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট এক হিন্দুকে অপর হিন্দুর সঙ্গে বিয়ে করতে অনুমতি দিচ্ছে কি শুধু? এই আইনের বৈধতা কি এমনি এমনি? তাছাড়া, আসল কথাটা বলি, শীতলবাবু সামান্য থামিলেন।

―আসল কথাটা হল, হিন্দু ধর্ম ক্রমাগত অন্যকে ইনক্লিউড করে বেড়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের কায়স্থ পশ্চিমবঙ্গের ব্রাহ্মণের নিকটবর্তী, জেনেটিক্যালি, কালচারালি। কিন্তু ইউপির বামুন ছেলের চেয়ে আমি এমনকি বাঙালি মাহিষ‍্যে কন্যা পাত্রস্থ করার পক্ষপাতী।

সত্যমাধব মন দিয়া শীতলবাবুর যুক্তিবিন্যাস শুনিতেছিলেন। অকস্মাৎ শীতলবাবু বলিলেন, যাই হোক, লায়াবিলিটি কী কী আছে?

―ছেলেটির তো মা, বাবা, ভাই, বোন কেউ নেই।

―তাহলে তো জিরো লায়াবিলিটি। চমৎকার! দেরি না করে লাগিয়ে দিন।

ইহার পরেই শীতলবাবু বলেন, আপনার বড়ো মেয়েটিকে বা নাতিকে দেখতে পান? দেখতে পেলেও ফি বছরে কতবার? আমাদের যা বয়স, বিপদ, আপদ, রোগ, জ্বালা, হাতের সামনে একটা নিকটাত্মীয়… এমন সুযোগ সহজে হাতছাড়া করতে নেই।

শীতলবাবুর সঙ্গে আলোচনার পরে সত্যর দ্বিধা কাটিয়া যায়। ইহার অনতিপরেই তিনি এক সন্ধ্যায় নিজ কন্যাদের কক্ষে উঁকি মারিয়া গলায় মৃদু খাঁকারি তোলেন। অতঃপর আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলেন, মৈত্রেয়ী, অপালা, একবার আমার ঘরে আসিস। দরকারি কথা আছে।

কিছুদিন যাবৎ গৃহে পিতা ও কন্যাদের বাক্যালাপ প্রায় স্থগিত ছিল। এমনকি স্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তাও প্রয়োজনের অতিরিক্ত হইত না। কিছুটা যুদ্ধকালীন থমথমে ভাব উভয় পক্ষেই অল্পবিস্তর অস্বস্তি আনিয়া দিয়াছিল।

মৈত্রেয়ী ও অপালা ঢুকিতেই সত্য বলিলেন, যে কারণে ডাকলাম… একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

ইহার পরেই বলিলেন, নিমাইয়ের সঙ্গে মৈত্রেয়ীর বিয়ে দেব। আশা করি তোদের আপত্তি নেই।

শেষ ও অতিরিক্ত বাক্যটি বলিবার অনতিবিলম্বে অপালা, বাবা, বলিয়া ডাকিয়া উঠিল। এই ডাক শৈশব ও কৈশোরের, সত্যর অতি পরিচিত, তিনি অল্প হাসিবার প্রয়াস করিলেন। কিন্তু অপালা আসিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরিল। মৈত্রেয়ী অতঃপর আসিয়া তাহাকে প্রণাম করিল।

কিছুদিন পরেই পাকা কথা হইল। নিমাইয়ের কোনোরকম দাবিদাওয়া নাই। বিয়ের তারিখ আগামী বৎসরের ফাল্গুনে স্থির হইয়াছে।

সেপ্টেম্বরে অপর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটিয়াছিল। বিষয়টি এইরূপ: মাঝে মধ্যেই সত্য নবম ক এর ক্লাসে পড়াইতে গিয়া তৃতীয় বেঞ্চের নির্ধারিত স্থানে একটি ছেলেকে খুঁজিতেন। ক্লাসে এদিক ওদিক তাকাইয়াও সেই মুখটি দেখিতে পাইতেন না। ছেলেটির ঝাঁকড়া চুল ও বলিষ্ঠ স্বাস্থ্য ছিল, মনে পড়িত। একদিন ক্লাসে বলিয়াই ফেলিলেন, হ্যাঁ রে, ওই ছেলেটাকে দেখতে পাচ্ছি না।

―কে স্যার? জনৈক ছাত্র বলিল।

―এখানটায় বসত, তিনি বেঞ্চ দেখাইলেন।

সহসা ন্যাড়া মাথার একটি ছেলে দাঁড়াইল, আপনি কি টোটনের কথা বলছেন স্যার?

―নামটা তো জানি না। অনেকদিন দেখিনি।

―এন আর এস হসপিটালে ভর্তি আছে স্যার।

শুনিয়াই সত্যর বুক কেমন ধড়ফড় করিতে লাগিল। পরের দিন আবার ক্লাসে টোটন পাঙ্গাসের মুখ মনে আসিল। তিনি ন্যাড়া মাথার ছেলেটিকে দাঁড় করাইলেন, শুধাইলেন―

তোর নাম কী?

―আবিদুর হোসেন, স্যার।

―ওই টোটন… এখন কেমন আছে জানিস কিছু?

―আমি গত সপ্তাহে দেখা করতে গিয়েছিলাম। একটা অপারেশন হয়েছে। একটু দুর্বল আছে স্যার।

―টোটনের হাসপাতালের ওয়ার্ড আর বেড নম্বর দিতে পারবি?

ছেলেটি গড়গড় করিয়া ওয়ার্ড ও বেড নম্বর বলিয়া দিল।

সেই সপ্তাহেই রবিবার সত্যমাধব খড়গপুর হইতে বেলা বারোটা নাগাদ হাওড়া লোক্যাল ধরিয়া পরে শিয়ালদাগামী বাস ধরিলেন। এনআরএস হাসপাতালে নির্ধারিত ওয়ার্ডে ভিজিটিং আওয়ার্সে পৌঁছাইলেন। গেটে রক্ষী কার্ড দেখিতে চাহিয়া আটকাইলে অনুনয় বিনয় শুরু করিলেন। শেষে সাড়ে চার ঘণ্টা ব্যয়ে বহুদূর হইতে জার্নি করিয়া আসিয়াছেন শুনিয়া রক্ষীর মন কিছুটা গলিল।

দোতলার ওয়ার্ডে ঢুকিয়া বেড অবধি পৌঁছাইয়া সামান্য খুঁজিয়াই দেখিলেন সেই শ্যামলাবর্ণ কিশোর বেডে বসিয়া আছে। কিছুটা ওজন কমিয়াছে, দেখিয়াই মনে হইল। বেডের নিকট একজন টুলে এক মধ্যবয়সি মানুষ বসিয়া আছেন। অনতিদূরে আরেক ভদ্রলোক। তিনি নিকটে আসিতেই দুই ভদ্রলোক, সপ্রশ্ন, চাহিলেন।

কিন্তু, সবিস্ময়ে সেই কিশোর বলিল, স্যার!

তিনি বলিলেন, আমি টোটনের মাস্টারমশায়।

যিনি টুলে বসিয়াছিলেন তিনি উঠিয়া দাঁড়াইয়া মুহূর্তেই নমস্কার করিলেন, বলিলেন, আমার নাম মৃগেন পাঙ্গাস। আমি টোটনের বাবা। পাশের ব্যক্তিকে বলিলেন, ও টোটনের মামা।

তারপর বলিলেন, স্যার, আপনি কি এখন বাড়ির থেকে এলেন?

সত্য খানিক অস্বস্তি সহ বলিলেন, না, একটা কাজেই কলকাতা এসেছিলাম… ভাবলাম ছেলেটা অনেকদিন স্কুলে আসেনি… একটু দেখা করে যাই।

সত্য কিছু ফল কিনিয়াছিলেন। সেগুলি এগাইয়া দিলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করিলেন, এখন টোটন কেমন আছে, শরীর ও চিকিৎসাবিষয়ক কিছু কথা হইল। টোটনের একটি ছোটো অস্ত্রোপচার হইয়াছিল। কিন্তু সে প্রায় সুস্থ। হয়তো পরের সপ্তাহেই সে হাসপাতাল হইতে বাড়ি যাইতে পারিবে।

একটু নিকটে পৌঁছাইয়া সত্য টোটনের মাথায় আলতো করিয়া হাত বুলাইলেন, বলিলেন, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ফের বাবা।

ফিরিবার পূর্বে সত্য একবার টোটনের দিকে তাকাইলেন। চৌদ্দ বছরের কিশোরের দুই চোখে যাহা লাগিয়া ছিল তাহা বিস্ময়, নাকি কৃতজ্ঞতা, তাহা তিনি বুঝিতে পারিলেন না।

টোটনের পিতা তাহাকে হাসপাতালের গেট অবধি সঙ্গ দিয়া কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিলেন।

হাওড়া স্টেশনে বিকালের একটি ট্রেন সত্য মিস করিলেন। পরবর্তী ট্রেনটি খড়গপুর লোকাল। সময়ে ছাড়িলেও মাঝখানে লাইনে ফল্ট হইল। লেট করিয়া ট্রেনটি রাত সাড়ে দশটা নাগাদ খড়গপুরে আসিয়া দাঁড়াইল।

সত্য ট্রেন হইতে নামিলেন। এখন দুইটি উপায়। যদি শহরগামী পরের ট্রেন আসিয়া পড়ে তাহলে স্টেশন হইতে রিকশা লইয়া বাড়ি ফেরা। কেন-না বাস এখন পাওয়া যাইবে না। অন্যথায় ট্যাক্সি খুঁজিতে হইবে।

প্ল্যাটফর্মে নামিয়া তিনি ইতিউতি দেখিতেছিলেন। হাঁটিতে হাঁটিতে অকস্মাৎ ওভারব্রিজের নিকট সামান্য আলোয় এক বৃদ্ধের হাতছানি চোখে পড়িল। নিকটে গিয়া সত্য চমকাইয়া উঠিলেন। আসান বাবা?

তাপ্পি মারা রঙিন কাপড়। বিবর্ণ ও ধুলামলিন। সাদা দাড়ি। সঙ্গে একটি ঝোলা। লক্ষণীয় কৃশকায় এক বৃদ্ধ। কাতর দৃষ্টিতে বৃদ্ধ তাঁহার দিকে হাত তুলিয়া আছেন।

―আসান বাবা!–একটু ঝুঁকিয়া সত্য বলিলেন।

কিন্তু, বৃদ্ধের মুখে তেমন ভাবান্তর হইল না। শুধু হাতটা সামান্য নড়িয়া ঈষৎ নমস্কারের ভঙ্গিতে নড়িল।

সত্য ব্যাগ হইতে কেক বাহির করিলেন। কেকটি হাওড়া স্টেশনে কিনিয়াছিলেন। কিন্তু খাওয়া হয় নাই।

বাড়ানো কেকটি কাঁপা হাতে বৃদ্ধ পীর গ্রহণ করিলেন। সত্য এখনও নিশ্চিন্ত হইতে পারেন নাই। আট বৎসর আগে একবারই আসানবাবার সাক্ষাৎ পাইয়াছিলেন। কিন্তু সেই ঔজ্জ্বল‍্য এই মুখ হইতে অন্তর্হিত। যদিও অবয়বে খানিক মিল।

জলের বোতল ব্যাগ হইতে বাহির করিয়া পুনরায় ঝুঁকিয়া বোতলখানি পীরের দিকে বাড়াইয়া দিলেন সত্য। কাঁপা হাতে বৃদ্ধ পীর গ্রহণ করিলেন।

এবার পীরের উদ্দেশে সামান্য জোরে সত্য বলিলেন, আপনি কি মুস্কিল আসান ফকির? আট বছর আগে পাঁচখুরিতে ছিলেন? কুঁদরি উকিলকে চেনেন?

পীর, নিরুত্তর, তাকাইয়া রহিলেন। শুধু ঠোঁট দুটি বিড়বিড় করিতে লাগিল।

অকস্মাৎ, প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষারত কিছু মানুষের হুড়াহুড়ি লাগিল। পাশের প্ল্যাটফর্ম দিয়া উদ্দিষ্ট লোকাল ঢুকিতেছে। সত্যকেও সংলাপ অসম্পূর্ণ রাখিয়া দৌড়াইতে হইল।

মাঝে মধ্যেই রাতের খড়গপুর স্টেশনের ওভারব্রিজের নিকটে বসিয়া থাকা‌ নিঃসঙ্গ পীরের কথা মনে পড়িত। ওই পীর আসান ফকির কিনা সেই বিষয়ে যদিও সত্য স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারেন নাই।

ইহার পরে পূজা অতিক্রান্ত হইল। কালীপূজা আসিল। এই বৎসর পিতামহী শৈবালিনীর শতবর্ষের আয়োজন হইয়াছিল। শৈবালিনীর সঠিক জন্মদিন জানা ছিল না, কিন্তু তিনি কালীপূজার দিন জন্মাইয়াছিলেন। সুতরাং, কালীপূজার দিনটিকে জন্মদিন হিসাবে পরিবারে মনে রাখা হইত। মন্দিরের কিছু সংস্কার ও নতুন করিয়া রং করা হইয়াছিল। অপালা ও মৈত্রেয়ী মিলিয়া একশোটি প্রদীপ সযত্নে জ্বালাইল।

স্কুলে আসিয়া সত্য একটি প্রস্তাব রাখেন। শৈবালিনী দেবী শতবর্ষ নামে একটি পদক তিনি নবম শ্রেণীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপককে প্রদান করিতে চান। ইহা লইয়া স্কুলে আলোচনা হইবার সময় বিদেশ ভুঁইয়া অনুরোধ করেন, ইতিহাস ও ভূগোল মিলাইয়া ‘ইন্ডিয়া এন্ড হার পিপল’ গ্রূপে সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপককে মেডেলটি প্রদান করিতে। সত্য রাজি হইয়া যান।

কীরূপে হাসু পরের বৎসর শৈবালিনী দেবী শতবর্ষ পদক পাইয়াছিল তাহা এক্ষণে লিখিতেছি:

ডিসেম্বর মাসে সত্যমাধব সাইকেলে করিয়া ফিরিতেছিলেন। নবম শ্রেণীর বাৎসরিক পরীক্ষার ইতিহাস খাতার কিছু পরিমাণ তাঁহার কাঁধের ব্যাগে ছিল। ভার কমাইবার জন্য বাকি বান্ডিল সাইকেলের ক্যারিয়ারে বাঁধিয়া লইয়াছিলেন।

অকস্মাৎ, সাইক্লিং করিতে করিতে রাসময়রার চকের নিকটে আসিয়া সত্যমাধবের প্রস্রাবের বেগ তীব্র হইল। বস্তুত কিছু আগে হইতেই প্রস্রাব পাইতেছিল। এই অঞ্চল জনবহুল। আশেপাশে রাস্তার ধারে কাজ সারিবার উপযোগী নির্জনতা নাই। অগত্যা রাসময়রার চকের মিষ্টির দোকানে আসিয়া সাইকেলটি দাঁড় করাইয়া তিনি দোকানিকে বলিলেন, একটু বাথরুম যাব।

দোকানি বংশপরম্পরায় সত্যকে চিনিতেন। তিনি সত্যকে দোকানের টয়লেটটি দেখাইলেন।

অতি সঙ্কীর্ণ টয়লেটটিতে কোনোমতে জলবিয়োগ করিয়া সত্য দোকানিকে ধন্যবাদপূর্বক বাহিরে আসিতেই চক্ষু স্থির হইয়া গেল। সাইকেলের ক্যারিয়ার হইতে একটি গরু খাতার বান্ডিল মুখে লইয়া টানিতেছে। দ্রুত দৌড়াইয়া গরুটিকে তাড়াইবার উপক্রম করিতে গরুটি বিন্দুমাত্র বিচলিত হইল না। সত্য আপ্রাণ বান্ডিল চাপিয়া ধরিলেন, দেখিলেন, বান্ডিল হইতে গরুটি একটি খাতা টানিয়া লইতেছে। অগত্যা সত্য খাতার ওই অংশ ধরিয়া টানিলেন। খাতাটির একাংশ ছিঁড়িয়া গেল। গরুটি তাহা গলাধঃকরণ করিতে করিতে প্রস্থান করিল। বাকি খাতা সামলাইয়া ক্যারিয়ারে রাখিয়া সত্য বাড়ি ফিরিলেন।

বাড়ি আসিয়া খাতা পরীক্ষা করিয়া সত্যর চক্ষু চড়কগাছ হইয়া গেল। খাতাটি লম্বালম্বি দ্বিধাবিভক্ত, একাংশ গরু হজম করিয়াছে। বাকি অংশ সত্যর হাতে। উপরের অংশে চন্দ্র নামটি পড়া যাইতেছে। রোল নম্বরের অংশটি ছেঁড়া। ভিতরে পাতা উল্টাইয়া দেখিলেন অবজেক্টিভ প্রশ্নের অংশে চারটি উত্তর পড়া যাইতেছে। বাকি অংশের উত্তরের একাংশ পড়া যাইতেছে, যাহা হইতে কুড়ি নম্বরের মূল্যায়ন কার্যত অসম্ভব।

সাবজেক্টিভ উত্তরে আরও সমস্যা। অধিকাংশ উত্তর হইতে কিছু বোঝা যায় না। একটি প্রশ্নে ঐতিহাসিক রোমিলা থাপারের মতে, কিন্তু তাহার পরের বাক্যাংশ পড়া যাইতেছে না। তিনি ছাত্রদের রোলশিট দেখিয়া ছাত্রের নাম সনাক্ত করিলেন, চন্দ্রহাস দাস মাল।

সকল খাতা দেখিবার পরে চন্দ্রহাসের খাতার মূল্যায়ন কীভাবে করিবেন, এই বিষয়ে সত্যর দ্বিধা ছিল। কিন্তু, বিষয়টি তিনি পাঁচকান করিতে চান নাই। অতঃপর ডিসেম্বরেই খোঁজ লইয়া জানিলেন ভূগোলের খাতা দেখিয়াছেন বিদেশ ভুঁইয়া। একথা সেকথার পরে সত্য বলিলেন, বিদেশ, ক্লাস নাইনে ভূগোলের খাতা দেখলে?

―হ্যাঁ, আজই শেষ করলাম।

―নম্বর কেমন উঠেছে?

―একজনই লেটার পাবে। বাকি দু চারজন একটু কম। বাকি সব অ্যাভারেজ।

―ভূগোলে লেটার! বলো কী! আচ্ছা, নম্বরশীটটা একটু দেখি।

বস্তুত, সত্যমাধবের অভিপ্রায় এইরূপ ছিল, কোনোমতে চন্দ্রহাস দাস মালের ভূগোলের নম্বর দেখিয়া সেই মত একটা মার্কিং করা। এই বিষয়ে অন্য কোনো বিষয়ের তুলনায় ইন্ডিয়া এন্ড হার পিপল গ্রূপের সঙ্গী বিষয়টিই নির্বাচনের উপযুক্ত, এই ভাবনাই মাথায় আসিয়াছিল।

―দাঁড়ান। একটা খাতা দেখাই আপনাকে, এই বলিয়া বিদেশ খাতার বান্ডিল খুলিলেন।

খাতা দেখিয়া সত্যবাবু চমকাইয়া উঠিলেন। চন্দ্রহাস দাস মাল। রোল নং ২৯।

―সত্যি বলতে কী এরকম মৌলিক খাতা লাস্ট দশ বছরে দেখিনি। একদম মৌলিক উত্তর। ম্যাপগুলো এঁকেছে একবার দেখুন! আপনাকে বলছি, এই ছোকরা অনেকদূর যাবে।

ইহার পরে একটু থামিয়া বলিলেন, সেভেন্টি ফোর দিয়েছি। সেভেন্টি প্লাস এই একজনই। এর পরের মার্কস সিক্সটি এইট।

সত্য খাতাটি দেখিলেন। সত্যিই ম্যাপের পরে ম্যাপ এবং প্রয়োজনীয় লেজেন্ড শেড দেওয়া, একদম অন্য ধাঁচের খাতা।

সত্যমাধব ইতিহাসে হায়েস্ট মার্কস দিয়াছিলেন সিক্সটি ফাইভ। অগত্যা, চন্দ্রহাস দাস মাল বেনিফিট অফ ডাউটে যুগ্মভাবে সিক্সটি ফাইভ পাইল। ফলত, ইন্ডিয়া এন্ড হার পিপল গ্রূপে সর্বোচ্চ নম্বরের দাবিদার হইয়া প্রথম মেডেলের দাবীদার হাসুই হইল।

শীত ভালোই পড়িয়াছিল। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের এক ভোরে লেপমুড়ি দিয়া সত্য ঘুমাইতেছিলেন। তিনি একটি স্বপ্নের ভিতর মগ্ন ছিলেন। এক শূন্য প্রান্তরে বসিয়া আছেন এক বৃদ্ধ, কাঁপা কাঁপা ঠোঁট দুটি নড়িতেছে। দূরে উড়িতেছে কিছু পাখি। সত্য বৃদ্ধের দিকে তাকাইয়া আছেন। কিন্তু বৃদ্ধের দৃষ্টি কোনো এক অনির্দিষ্ট শূন্যতার দিকে। সত্য তাঁহাকে ডাকিবার প্রচেষ্টা করিতেছেন, কিন্তু কথা বলিতে সত্যও অক্ষম। অকস্মাৎ পেছন হইতে কেউ ডাকিতেছে তাঁহার ডাকনাম ধরিয়া, সত্য ফিরিয়া দেখিতে পাইলেন, পিতামহী হাতছানি দিয়া ডাকিতেছেন বারবার।

ঘুম ভাঙিয়া গেল। দেখিলেন সামনে দাঁড়াইয়া আছে অপালা। তিনি ওঠামাত্র অপালা বলিয়া উঠিল, কখন থেকে তোমাকে ডাকছি বাবা। আজ এত দেরি হয়ে গেল তোমার। মর্নিং ওয়াকে যাবে না?

সত্য ঘড়ির দিকে দেখিলেন, তাই তো। এহে। আজ দেরি করে ফেললাম রে।

অপালা বলিল, বাবা তোমার মনে নেই নিশ্চয়। আজ কত তারিখ?

—কেন বল তো?

—আজ ২৮ শে ডিসেম্বর। তোমার জন্মদিন।

সত্য মৃদু হাসিলেন। এই বৎসরও ব্যতিক্রম নয়, অপালাই প্রতিবার তাঁহার জন্মদিন স্মরণ করাইয়া দেয়। দেখিতে দেখিতে পঞ্চান্ন পূর্ণ হইয়া গেল?

একদিন লুপ্ত কালের অবান্তর আখ্যানের ওপর পড়িয়া যাইবে সময়ের পলিস্তর। ততদিনে ভাঙিয়া বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইবে অনেকের সাধের সোনালি সোভিয়েত-ভূখণ্ড। দুই জার্মানি কালক্রমে মিশিয়া যাইবে একদিন। বামফ্রন্ট-যুগেরও অবসান হইবে কোনো একদিন। সেদিনের আখ্যানের প্রৌঢ়রা কেউ কেউ পৌঁছাইবেন বার্ধক্যে, প্রয়াত হইবেন অনেকেই, সে-কালীন কিশোরদের চুলে মিশিবে সময়ের রুপালি গুঁড়া।

ততদিনে দক্ষিণবঙ্গের এই জিলাও ভাগ হইয়া যাইবে। এই শহরও পালটাইয়া যাইবে কালের নিয়মে। শহরের রাস্তায় রিকশার পরিবর্তে চোখে পড়িবে অটো; ধোঁয়ায়, ভিড়ে, চিৎকারে ঢাকা পড়িবে চিরাচরিত রাস্তাগুলি। পুরাতন সিনেমা হলগুলি নিশ্চিহ্ন হইয়া এই শহরেও উঠিবে শপিং মল ও ফ্লাইওভার। একদা মানবহীন গোপ টিলায় তৈরি হইবে রিসর্ট ও পার্ক। জঙ্গল লুপ্ত করিয়া চতুর্দিকে আরও প্রসারিত হইবে শহর। কাঁসাইয়ের প্রান্তরগুলি ঢাকিয়া যাইবে নতুন নতুন কনস্ট্রাকশনে, পালবাড়ির মাঠ হারাইবে স্বকীয় নির্জনতা। ক্রমেই শহর হইতে নির্বাসিত হইবে পাখিকুল। তথাপি অজস্র ক্ষতচিহ্ন বুকে লইয়া পাহাড় হইতে সমতল অবধি বহিয়া যাইবে অক্লান্ত কাঁসাই।

কিন্তু সেইদিন পরিত্যক্ত চের্নোবিলে ফিরিবে আশ্বস্ত প্রকৃতি ও মানবরহিত নির্জনতা―ফিরিবে অরণ্যের পতঙ্গকুল, সরীসৃপ, শ্বাপদ ও পাখি।

সমাপ্ত

কৃতজ্ঞতা: শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য, মৃন্ময় হোতা, কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়, সোমনাথ রায়, সুমন দে, প্রতিভা সরকার ও আপনপাঠ

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২