কাঞ্চনজঙ্ঘার আলো – এণাক্ষী রায়
অসমের ট্রেনগুলো শহরকে বাইপাস করে এদিক দিয়ে চলে যায় ঘটাং ঘটাং করে। আগে অবশ্য কুউউ করে করে যেত আকাশ পর্যন্ত লম্বা ধোঁয়া উঠিয়ে। এখন ডিজেল ইঞ্জিন। বিশুর মা এখনও সেই ট্রেনের ধোঁয়া ওঠার কিসসা বলে যায় নাতি-নাতনিদের। কুউউ টার বদলে ভোঁওও শব্দ ওঠে এখন। তবু নাতি-নাতনিদের বলেন
-ওই কু ঝিক ঝিক যাবার নাগিসে দেখি যা।
হাত নাড়ে নিজে।
উত্তরে কাঞ্চনজঙ্ঘা লালচে হয়ে এলে যে ট্রেনটা যায়, সেইটা দেখে মনে হয় ওই যে পাহাড়টা কালো হয়ে যাবে এখনই, ভুস করে মিশে যাবে আকাশে তার আগেই ট্রেনটা যেন ধরে ফেলতে চায় ওই লাল হয়ে যাওয়া পাহাড়টাকে। বিকেলের ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বেশি করে হাত নাড়ে বিশুর মা। ট্রেনগুলো রাস্তা পার হতে হতে দুপাশে দাঁড়িয়ে যায় গাড়িগুলো। এপারে বিশুর চা সিগারেটের দোকানে নেমে দাঁড়ায় দিদিমণি, মাস্টারমশাইরা। চা খায়, পান খায়। সিগারেটও মন্দ বিক্রি হয় না। এদিকটায় ধু-ধু মাঠের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া সোজা একটা রাস্তার দুপাশে ধানি জমি। ছোট ছোট নয়ানজুলি। লেভেল ক্রসিংয়ের জন্যই দিনে কয়েকবার চা-পান-সিগারেট বিক্রি। লেভেল ক্রসিংয়ের ওই পারে বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা বাংলা মদের দোকান। সেখানেও ভিড় হয় জবরদস্ত। বিশুর মার মনে গর্ব হয়। বিশুর দোকানে যারা আসে সবাই ভদ্রলোক। রেল লাইনের ওপারে ওই মদের দোকানে কিন্তু ভিড় হয় রিক্সাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, দিনমজুরদের। বড় জোর দু একজন ড্রাইভার ঢুকে পড়ে কখনও-সখনও।
টাউন থেকে সব মাস্টার দিদিমণিরা এদিকে চাকরি করতে আসে দল বেঁধে। বাইকে আসে কেউ কেউ। বেশিরভাগই মাসকাবারি গাড়ি ভাড়া করে সাত-আটজন মিলে। এদিক দিয়ে যাবার সময় লেভেল ক্রসিংয়ে পড়লে চা-টা খেয়ে একটু হাত-পা ছাড়িয়ে নেয়। আর কতরকম আলোচনা তাদের। বিশু আবার তাল দিয়ে দিয়ে কথা কয় অত পড়ালিখা লোকদের সাথে। কয়েকটা বেঞ্চ রোজ ঝাড়পোছ করে পেতে রাখে বিশু। চা না খেলেও বসে কেউ কেউ। বসুক না বসুক ট্রেন আসতে দেরি করলে সবাই রাগ করে। মালগাড়িগুলোর টাইমের কোনো ঠিক থাকে না। তখন ডেইলি প্যাসেঞ্জাররা ওভার ব্রিজ করার কথা বলে। এই দৃশ্য দেখছে বিশুর মা বরাবরই। আবার এদের মধ্যে কেউ বিশুর দোকানের বেঞ্চে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে থাকে বিভোর হয়ে। ঘটাং ঘটাং করে গাড়ি চলে গেলেও খেয়াল করে না। শরৎ কালে নয়ানজুলিগুলোয় শাপলা ফুলে ভরে গেলে সে এক অন্য দৃশ্য। মাছরাঙা পাখিরা বসে থাকে ইলেকট্রিক তারে। মাঝে মাঝে ঝুপ করে জলে গিয়ে পড়ে। তাদের বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে সঙ্গীকে ডাকে। ওইটুকুনি পাখির কী গলার জোর! ট্রিট্রিট্রিইইইইইইইইইইই
মাঝে মাঝে একদল পাখিবাবু আসে। ওরা চা খায় ধীরেসুস্থে। ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলে চারদিকের। বিশুর মার কুঁচকে যাওয়া মুখের ছবি তোলে কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে ঠিকরে আসা আলোয়। নয়ানজুলির পারে ওৎ পেতে বসে থাকে ওরা মাছরাঙা পাখিটির মতো। কখন কী পোকামাকড়, পাখিটাখি পেয়ে যায়। বিশুর মার তো মাছরাঙা বাদে সব পাখিকে একই লাগে। ওরা বলে বিদেশি পাখি আসে এই ঝিলে। এই আসা-যাওয়ার ফাঁকেও কেউ কেউ আসে। লেভেল ক্রসিং না পড়লেও বসে যায় বিশুর দোকানে। মাগনায় কাগজ পড়ে। মুদিকে নিয়ে কথা কাটাকাটি করে। মুদিও নাকি বিশুর মতো চা বেচত। শুনে অব্দি ভুকভুকায় হাসি পায় বিশুর মার। হুই রে তিস্তাবুড়ি। দেখে যা কেনে। এলায় চাওয়লাও পরধানমন্ত্রী হইবার নাগিসে। বিশুর মা মনে মনে রাজীবগান্ধীর টুকটুকে মুখখানা ভাবে। ডাগর বয়সে এই হাত দিয়া ছুঁইছিল উঁয়াকে। ফমে আসে সব। হেলিকপ্তার করে নামিছিল এসকোরসে। আজাপুত্তুরের নাখান। কী ঢক! আর কীবা হাসিখান! পরান জুড়ায় গেসিল। আস্তায় গাড়ি দাঁড় করায় দিসিল ওদের দেখি। কিস্যু শোনে নাই। কারো কাথা শুনে নাই। হাত খান ছুঁইসিল বিশুর মায়ের। ওরে কয় পরধানমন্ত্রী। ত মুই ঘুঁটে কুড়াইনিও আনি হইবার পারি! খুক খুক করে হাসে বিশুর মা। নিজেকে রানির বেশে মোদির পাশে চিন্তা করে হাসে। তার ফর্সা মুখে অবেলার রোদ ঠিকরায়। বাকি মেয়ে মানুষরা এই কথা শুনে ঢলে পড়ে এ ওর গায়ে। পঞ্চাশেই কুঁকড়ে যাওয়া মুখে আঁচল চাপা দেয় বিশুর মা। সরল্যার মা বলে,
– নাম কহিছু মুদি, তয় চাওয়ালা হয় কেনং করি!
খুবই ভাবনার কথা মুদি কী করে চাওয়ালা হয়! সবাই মিলে অনেক যুক্তি তর্কের পর বিশুর মা পাকা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়।
আগত লিশ্চয় মুদির দোকান সিল, তার লগে পিছৎ চাও বেচিবার ধরিসিল শ্যালায়। অই লইগ্যাই মুদি নামখান রয়া গেসে।
হাজার হোক বিশুর মা ওদের থেকে বেশি জানে। সে ঘরের কোণে বসে থেকে বা ক্ষেতিবাড়ি করে সময় কাটায় না। দোকানে বসে, সেখানে সব মাস্টার দিদিমণিদের আনাগোনা। কত আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়। অনেক কিছু জানা যায়, বিশুর মা বাইরের দেশ-বিদেশের খবর একটু বেশি জানবে এটাই স্বাভাবিক। সকলেই একবাক্যে মেনে নেয় তার যুক্তি।
বিশু টাউনে মাল আনতে গেলে বিশুর মা দোকানে বসে। কোনোকিছুর নাম পড়তে পারে না। ছবি দেখে দেখে জিনিস বিক্রি করে। ছবি দেখে দেখে টাকা পয়সার লেনদেন করে। এদিকে সবাই প্রায় চেনা-জানা কাষ্টমার হয়ে যায়। তারা বিশুর মা দোকানে থাকলে প্যাকেটে হাত দিয়ে দেখায়, ওইটা দাও, এইটা দাও করে। দাম সব মুখস্ত বিশুর মার। টাকার ছবিগুলাও মুখস্ত। জিনিস দিয়ে দাম গুনে নেয় সে। এই ছবি চিনতে চিনতে সব কিছুই ছবির মতো দেখার অভ্যেস তার। এই দোকান, বাসা, ট্রেন, সিগন্যাল, ওই শাপলা পাতায় শিশির অব্দি তার মনে ছবির পর ছবি হয়ে যায়। ছবি হয়ে যায় মানুষের মুখ। খবরের কাগজের মুখগুলো আর রোজ দেখা মানুষের মুখ সব ছবি। ছবি ওই তিস্তাবুড়ি। আর তার ধরল্যা বুইড়াও। ওই কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর চলেফিরে বেড়ানো সমস্ত রোদ, মেঘ আলো অন্ধকার সবটাই নানারকমের ছবি। ছবির থেকে বেরিয়ে এসে একেকটা দৃশ্য যেন জ্যান্ত হয়ে যায়, আবার ঢুকে যায় ছবির মধ্যে। বিশুর মার কোনো নাম নাই। বিশু হওয়ার আগে যে নামে ডাকত বিশুর বাপ, তারও আগে নিজের বাপ মায়ে, সেইসবও ছবি হয়ে গেছে। এখন গেরাম দেবতার থান ঘিরে যে সব কিসসা ঘোরে ফেরে। তার পাশে যে বটগাছটা দাঁড়িয়ে থাকে, তার মতনই মনে হয় নিজের গল্প। ঝুড়ি নামে, ঝুড়ি মোটা হয়, তার পর ঝুড়িই সত্য। আসল কাণ্ডের খবর কে রাখে। বিশুর মা তাই বিশুর মা হয়ে যায়। আর কোনো নাম থাকে না। পরিচয় থাকে না।
বিশুর দোকান চলে রমরমিয়ে। আসামের দিকে ট্রেন বাড়ে, কোন দক্ষিণ ভারত থেকেও আসে ট্রেন। কলকাতার ট্রেন আসে। ট্রেন বাড়লেই বিশুর দোকান বাড়ে। তলে তলে ওভার ব্রিজের দরখাস্তও নাকি যায়। সে সব বিশুর মার জানার কথা না। সে শুধু দেখে জরিপের লোক আসে, জরিপ করে মাটি। পর পর কয়েকদিন এই সব চলে, তারপর আবার যে কে সেই। বিশুর দোকানের মতোই ক্রসিংয়ের ওইপাশে বাংলা মদের দোকানটাও চলে রমরম করে। ওরাই খবর দেয় একদিন ক্রসিংয়ের তলা দিয়ে রাস্তা হবে। আন্ডার পাস। গাড়িগুলোকে আর দাঁড়াতে হবে না লেভেল ক্রসিংয়ে। আন্ডার পাসের কাজ শুরু হলে সারাদিনই হইহই। বিক্রিবাটা বেড়ে যায় বিশুর। বাংলা মদের দোকানটায় অবশ্য বিক্রি বাড়ে দ্বিগুণ। তাতে কিছু আসে-যায় না বিশুর বা বিশুর মায়ের। এক মাস্টারমশাই আসেন ময়নাগুড়ি কলেজের। তিনি বলেন, বুজলা বিশু! কেউ দুধ বেচে মদ খায়। কেউ মদ বেচে দুধ খায়। সামনে মদ থাকলেই যে মদ খাবে, তার কোনো মানে নাই।
-হ কাথাখান ঠিকঅই। বিশুর মা মাথা নাড়ে।
দোকানের সামনে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি চলে, লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যায়। এ কয়দিনে দু’ পয়সা জমাতে পারে বিশু। এইসব মাটি খোঁড়াখুঁড়ি শেষ হয়ে পাতাল রাজ্যের ভিতর দিয়ে পথ প্রায় শেষ হতে হতেই দুর্গাপূজা আসে-যায়। এই ফাঁকে দোকানটাকে পাকা করে ফেলে ওরা । কয়েকটা লাল-সবুজ চেয়ারও কিনে ফেলে। নয়ানজুলিগুলোয় লাল- সাদা শাপলায় ভরে যায়। কালীপূজা শেষ হতে হতে বাতাসে বেশ শীত-শীত ভাব এসে পড়ে। আন্ডার পাস খুলে যাবে আর ক’দিনের মধ্যে, শোনা যায় লোকমুখে।
বিশুর মা, নাতি-নাতনিদের ডংধরা ঠাকুরের গল্প বলে। ডংধরা হলো গিয়া শিব ঠাকুর। একঅই ঠাকুর, কত্ত নাম, ক! তিস্তাবুড়ির কিসসা বলে যায় বিশুর মায়ে। তার কোনো চিন্তা নাই। ওই পাতাল পথ খুলে গেলে বিশুর কী আসে যায়! তার বাধা খদ্দের। ওই যে দিদিমণি মাস্টারমশাইরা এসে বসে, তারা বলে বিশুর দোকানে একটু না জিরোলে তাদের ভাত হজম হয় না। আরো মন দিয়ে চা বানায় বিশু। কার চায়ে চিনি বেশি, কার কম! কে রঙ চা খাবে চিনি ছাড়া! আর কে বা চিনি দিয়ে রঙ চা খায়। সব মুখস্ত বিশুর। কে একশ বিশ জর্দা খায়! কার গোপাল জর্দা ছাড়া চলবে না জানে বিশু। নতুন দিদিমণিরা মিষ্টি পান খেতে চায়, বলে বিশুদা মিষ্টি পান দিবা একটা। সবটাই জানা। খুব সম্মান দেয় ওরা বিশুকে।
আন্ডার পাস খুলে গেলে দেখা যায় ট্রেনগুলো ট্রেনের মতো চলে যাচ্ছে যেন আরও দ্রুত। লেভেল ক্রসিংয়ে সিগন্যাল পড়ে আগের নিয়মেই। তবু কোনো গাড়ি থামে না। নিচ দিয়ে সোজা চলে যায় হুশ করে। কেউ কেউ যাবার সময় হাত নাড়ে। যেমন বিশুর মায়ে হাত নাড়ে ট্রেন দেখে।
সৌগত আসে, কলেজে পড়ায়, ওর বউ এই লাইনেই কোনো স্কুলের দিদিমণি, বউকে বাইকের পিছনে বসিয়ে নিয়ে আসে মাঝে মধ্যে। বিশুকে তুই তোকারি করে। বিশুও কী বলবে ভেবে পেত না প্রথম প্রথম। ওকে দেখলেই মনে পড়ে যেত সোনাউল্লা ইস্কুল। নীল প্যান্ট সাদা জামা পরে এতটা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেত রোজ। সৌগতর সঙ্গে একই ক্লাশে পড়ত নাইন অব্দি। তারপর ফেল করল বিশু, ওরা এগিয়ে গেল এক ক্লাস। প্রথম প্রথম মুখ তুলে না তাকিয়েই চা সিগারেট এগিয়ে দিত। একদিন ফাঁকা দোকানে এসে পড়ে সৌগত, শুধু সে আর সৌগত। কীভাবে অন্য দিকে মুখ ফেরাবে বিশু! ও কাঞ্চনজঙ্ঘাটার দিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে, গোল্ডফ্লেক ছোট এক প্যাকেট এগিয়ে দেয়। সৌগত বলে,
-কী রে! আমাকে চিনতে পারিস না তুই!
– হ্যাঁ আপনি, মানে তুমি সোনাউল্লায় পড়তা না!
– আপনি! তুমি! তখন তো তুই বলতিস! স্কুলের বন্ধু আমরা।
– হ্যাঁ অই আর কী! আমি তুই বললে লোকে কী ভাববে! তুই কলেজের প্রফেসার আর আমি চায়ের দোকানি।
– কী ভাববে! একসাথে পড়তাম। তাই-ই ভাববে। ভালো আছিস!
– হ্যাঁ এমনিতে ভালোই। এই আন্ডার পাস না কী হইল তারপর ব্যবসা চলে না। চেনা গাড়িগুলা হুশ করি বাইরায় যায়।
– হ্যাঁ সময় বাঁচে অনেক। আগে তো মালগাড়ি গেলে আধা ঘন্টা দাঁড়াতে হতো।
– যারা যারা বলছিল আন্ডার পাস হলেও আমার দোকানের চা না হলে তাদের চলবে না, তারাও হুশ করে বাইরায় যায়। হাত নাড়ে আবার।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিশু। কারো পৌষমাস, কারো সর্বনাশ!
বাংলামদের দোকানটা রমরমায় চলে আরো। ওদের খরিদ্দার কমে না।
ট্রেন গেলে আর হাত নাড়ে না বিশুর মা। ছোটবেলার শুনে আসা কিসসা বলে নাতি-নাতনিদের। কেউ না শুনলে একাই বলে যায়।
-ওই তিস্তা বুড়ি হইল গিয়া ধল্যা বুইড়ার বনুশ। বুঝিলা!
রেগে যায় বিশু। আজকাল মাথা ওর গরম থাকে সবসময়।
এলায় ধল্যা বুইড়া তিস্তাবুড়ির বর কেনং করি হয় বুঝিবার না পাও। তুমরায় কিসসা কন। ইটা হলো গিয়া বেবাক কিসসা। সইত্ত কাথা না হয়।
সইত্ত কী কন দেহি বাউ! তর দুকানে লুক কম আসিবার ধরিসে অইটা হল গিয়া তর সইত্ত। মোর সইত্ত অইটা না হয়। কিসসায় সইত্ত আসে অই মাটির নাখান।
– কী বা কন! বুঝিবার না পারিম।
– ধর ক্যানে, মাস্টারে কয় পিরথিমীর তিন ভাগৎ জল। এক ভাগৎ ডাঙ্গা। এলায় জলের তলাৎ? তলাৎ কী আসে! ডাঙ্গা নাই! তাইলে কী হয়! ডাঙ্গা খান সইত্ত? না জলখান!
– কী বা কন! মাতাখান আউলাবার ধরিসে। এইল্যা তো ভাবি নাই।
– তাইলে ক’ ধল্যা বুইড়ার বনুশ যদি তিস্তাবুড়ি, তয় বেটাখান কায়! করলা হইল গিয়া বেটা। ওর বিটি হইল দুলালী।
– হ আর মোদের কুয়াখান নাতির
ঘরের পুতি। হেঁ হেঁ।
– হাসিস ক্যান! ভাব ক্যানে! এল নাইনে ছিগনালখান পরে ঠিকঅই। লুকগুলানও খায়ে দায়ে বেবাকে কামে আসে-যায়। তুর দুকানে আসে না। ক্যান! উমরার মাটিৎ পালটায় গেসে। সব শ্যালা সীতার নাখান পাতাল পরবেশ করিবার ধরিসে। তুর দুকান এলায় মাতার উপর উঠি গেসে। এইটা হইল তর সইত্ত।
বিশ্বজিৎ ক্লাশ টেন পাস। শহরের ইস্কুলে লেখাপড়া করা। তাও সে এসব ভাবতে পারে না। তার মায়ে মন দিয়ে কিসসা শোনে গাওবুড়ার। ধরলা নদী নাকি তিস্তার বর। এইরকমই ভাবে ওরা। নদীতে নদীতে সম্পর্ক পাতায়। এদিকে সম্পর্ক ছিঁড়ে যায় মানুষে মানুষে। সেই হুঁশ নাই। মা টা একটু কেমন আছে, টের পায় বিশু। পাগলা আছে একটুখানি। সরল্যার মা নয়ানজুলি থেকে শাপলার ডাঁটি তোলে, ফুল শুদ্ধু শাপলার ডাঁটি নিয়ে বসে রাস্তার ধারে, গাড়ি থামিয়ে কেনে কেউ কেউ। শাপলা ডাঁটির ঘণ্ট চিংড়ি মাছ দিয়ে খেতে খুব ভালো লাগে। ফুলটাও ফেলা যায় না, শাপলা ফুলের বড়া একটু চালের গুঁড়ো আর ময়দা মিশিয়ে মচমচে করে কেমন করে ভেজে খাওয়া যায়, সেটাও শিখিয়ে দেয় গ্রাহকদের। বিনা মুলধনের ব্যবসা করে সে। বিশুর মাকেও বলে
-তুই ওই ধারটায় গিয়া বস কেনে। উদিকের গাড়িগুলা এইপাশে আসি কেনে না।
ছেলের ব্যবসা মন্দা যায়। আর কোনো পথ পায় না বিশুর মা। সরল্যার মার সাথে একটা সমঝোতা করেই ফেলে। সরল্যার মার উল্টাপাশে বসবে বিশুর মা, তাও যখন যখন সরল্যার মায়ে বাড়ি যাবে সেই সময়টাই বসবে। সরল্যার মা-র বাসা আরও একটু দূরে। সকালের দিকটা বসবে সে। বিশুর মা বসবে দুপুরের পর। সকাল সকাল সরল্যার মার সঙ্গে শাপলা তুলতে যায় বিশুর মা। বেশ জার লাগে জলে নেমে। হালকা কুয়াশাময় একটা হাওয়া দেয়। সূর্যটা উঠতে উঠতেও যেন আরও একটু ঘুমানোর তোড়জোড় করে। যত রাজ্যের ফড়িং, মৌমাছি জাগতে থাকে গুনগুন করে। পটাপট শাপলার ডাঁটি ছেড়ে সরল্যার মা। বিশুর মার হাতের কাছে একটা লাল শাপলাফুল পুরোপুরি পাপড়ি মেলেছে, তার পাশেই গায়ে গা ঠেকিয়ে দোল খাচ্ছে সাদা রঙের আরেকটি আধফোটা শাপলাফুল। বেশ হাওয়া দিচ্ছে হেমন্তের। একটা ফড়িং ভোঁভোঁ করে পাক খাচ্ছে ওপরে। সূর্যটা যেন এই দৃশ্য দেখার জন্যই আরেকটু ওপরে উঠে যায় আর সরে যায় কুয়াশার পরত। ঠিক ফুল দুটোর পেছনে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে হালকা কমলা কাঞ্চনজঙ্ঘা। দৃশ্যগুলো ছবি হয়ে দোল খায় বিশুর মার চোখে। কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে প্রতিফলিত আলো এসে বিশুর মার ফর্সা মুখের বলিরেখাগুলোকে স্পষ্ট করে দেয়। এই অপার্থিব আলোর নিচে ঘুঁটে কুড়ুনি থেকে রানি হয়ে যায় বিশুর মা। তার বাড়ানো হাত একটু একটু করে আদর করে দিতে থাকে শাপলাফুলগুলোকে। আদরটা ছড়িয়ে ছড়িয়ে যায় সমস্ত ছবিটায়। ফড়িংটা পরাগ মিলনে ব্যস্ত হয়ে পরে। পুরো ছবিটার মধ্যে ঢুকে পরে বিশুর মা। পায়ে কিসের কামড় খায়, জ্বালা ধরে, পরোয়া করে না। তার বিভোর চোখে তখন ঝকঝক করে কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়ার দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো শাপলাফুলের দোল খাওয়া। এই দৃশ্যের ভেতরে স্থির হয়ে যায় বিশুর মা। ছবির মধ্যে আরেকটা ছবি হয়ে হারিয়ে যায় হেমন্তের বাতাসে।পায়ের জ্বালাটা বাড়তে বাড়তে মাথায় উঠে আসে, ছবি হয়ে যেতে যেতে মনে পড়ে বিশুর বাপটা যেন কবেকার কোন ছবির ভেতরে তাকে ডাকত শাপলা বলে। আবার একবার নীল রঙের শাপলা হয়ে যায় সে।
অসাধারণ লেখনী