এই দেশ অচেনা আমার – সম্বিৎ চক্রবর্তী

এই দেশ অচেনা আমার – সম্বিৎ চক্রবর্তী

শেয়ার করুন

একটা থাপ্পর খেয়ে রাস্তায় পড়ে গেলাম। আমার যা স্বভাব পড়ে গিয়েও ভাবি গালে একটা থাপ্পড়ে কেউ একেবারে মাটিতে চিৎপটাং হয়ে পড়ে?

পড়ব বলে মনটাই যেন ভিতরে ভিতরে একরকম তৈরি ছিল।

—হয়তো ধরাশায়ী হয়ে সহানুভূতি পাওয়ার মতলব।

অথবা পড়ে গিয়ে থাপ্পড়কারীর শক্তিকে একটু স্বীকৃতি, সম্মান দেওয়া; আসলে তোয়াজ করা।

‘বাবা? কী জোরেই মারতে পারো তুমি!’

কিন্তু স্বীকৃতি কাকে? যন্ত্র কি বোঝে এসব!

আসলে পড়ে যাওয়ার ছলে থাপ্পড়টাকে খানিকটা এড়িয়ে যাওয়া।

হ্যাঁ, এটাই হবে। যন্ত্রের মার বড়ো মার।

তাই পড়ে যাওয়া শুধু পড়ে যাওয়া নয়, খানিকটা পালিয়ে যাওয়াও বটে।

আজকাল নিজের ভিতরে কী হয় ভালো করে বুঝি না। তবে আজকে দোষটা আমারই ছিল। লাইন ছাড়িয়ে সত্যিই বেরিয়ে গিয়েছিলাম। 

একটা গাছ দেখেছি। রাস্তার এই দ্বিতীয় মোড়ে এসে কতদিন ভেবেছি জলের ট্যাঙ্কের পাশে ওই শিরীষগাছটার কাছে যদি যেতে পারি। দু’চোখ ভরে, আসলে সমস্ত প্রাণভরে গাছটাকে দেখব।

গাছেদের অভিসন্ধি নেই।

জানি এভাবে দেখা সম্ভব নয়। অঙ্কের হিসেবে বেঁধে দেওয়া রাস্তা আমাদের প্রত্যেকের। সামান্য এদিক ওদিক করেছ কী যন্ত্রদানবগুলো হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়াবে। নতুন সিস্টেমে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার মার খেলাম।

প্রথম যে মারটা কপালে জুটেছিল সেটা আজও ভুলিনি। কারখানা জীবনের মাস দুই হয়েছে সবে। রাস্তায় আমার ঠিক পাশের লেন দিয়ে একটা লোক যাচ্ছিল। পরে দেখেছি আমাদেরই ওয়ার্কশপের।

তো, সামান্য খুচরো আলাপ করতে গিয়েছিলাম।

কী বলব মাইরি! এখনও গায়ে কাঁটা দেয়।

হতচ্ছাড়া রোবটটা কী এক কায়দায় ওর একটা আঙুল মাথায় ছুঁইয়ে দিল আমার।

ইলেকট্রিক শক! হ্যাঁ তাই। সে অনুভূতি বোঝাতে পারব না রে বাবা। ভুলবোও না বাপের জন্মে। সারা শরীরে যে কী লাগল! তবু বেঁচেও গেলাম।

যন্ত্রগুলোর মধ্যে কত কী ভরে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

তবুও আজ আমার রাগ হল না একটুও। রোবটের বাচ্চাদের ওপর রাগ করেই বা কী হবে?

ও তো আর তোমাকে কোনও রাগে, ঘেন্নায় মারছে না।
 ওর মধ্যে ভরে দেওয়া প্রোগ্রামের কম্যান্ড তামিল করছে মাত্র।

এখন সকালে রাস্তায় বেরোলে তুমি দেখতে পাবে সারি সারি মানুষ নিঃশব্দে নিখুঁত শৃঙ্খলায় কারখানার দিকে হেঁটে চলেছে নিজের নিজের জন্য বেঁধে দেওয়া পথে।

অবশ্য রাস্তায় বেরোই-বা ক’দিন। মাঝে মধ্যে যখন বাড়িতে ফিরতে দেয় ওরা… দু-এক ঘণ্টার জন্য।

ঘরের লোকেদের একটু চোখের দেখা দেখতে দিলে নাকি আমাদের কাজের গতি আর গুণমান… আঃ কী দয়া ওদের। অঙ্কের মতো নিখুঁত।

যা বলছিলাম। মার খেয়েও রাগ হয় না। মারটা যেহেতু সিস্টেম জেনারেটেড। যাদের ওপর রাগ হওয়ার কথা তারা তো আমার রাগ, ঘেন্নার নাগালের বাইরে। তার চেয়েও বড়ো সমস্যা তারা যে ঠিক কারা সেটাই ঠিক ধরতে পারি না।

রাগ আর ঘৃণা তাই আলগা হয়ে আসে। অনুভব করি অন্যরকমের এক বিষাদ। অভাবজনিত বিধান। একটা রক্তমাংসের হাতের স্পর্শ মিস্ করছি কিছুদিন ধরে। সে স্পর্শ যদি থাপ্পড়ও হয়, তাও।

অথচ কিছুদিন আগে হলেও এমন ঘটনায় অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে করত। অথবা খুন করতে।

মৃত্যু কামনা করতাম লোকটার। কী নাম যেন?

হ্যাঁ, এম এক্স দুশো একুশ; MX221। ঠিক নাম তো নয়, ইউনিফর্মে খোদানো নম্বর।

আমার কাছে ও তাই ২২১। লোকটা নিজেকেও বোধহয় তা-ই ভাবত।

২২১-এর শেষদিনের হাবভাব আমাকে বেশ বিচলিত করেছিল। কেমন অন্যমনস্ক আর বিষণ্ন দেখাচ্ছিল ওকে। হেঁটে যেতে যেতে আমি বারদুয়েক হোঁচট খেলাম। ওর দেখি কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। রাগ-বিরক্তি নেই। সাহসটা একটু বেড়ে গেল আমার। এক জায়গায় ইচ্ছে করেই রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নিই কিছুক্ষণ। ওপাশের বড়ো বিল্ডিংটা দেখছিলাম। এমনিই।

সে মক্কেল দেখি কিছুই বলে না। খানিকটা এগিয়ে অপেক্ষা করে আমার জন্য।

আশ্চর্য! শরীরটরীর খারাপ হল না তো ওর!

না কি এটাও ওদের একটা নতুন চাল।

থাক বাবা, বেশি খুশি বা অবাক হওয়ার দরকার নেই।
এই যে সুযোগ নিচ্ছি, একারণেও মার জুটতে পারে কপালে।

আমাদের এমন কিছু নেই যা ওদের সার্ভারে উঠে যাচ্ছে না।

এখনও ভেবে পাই না কীভাবে আমরা এই নতুন জীবনে ঢুকে গেলাম হঠাৎ। আসলে আমরা কিছু করিনি। নতুন জীবনটা আমাদের গ্রাস করে নিল। আমরা টের পাইনি।

কত কত আগে থেকে কতদূর পর্যন্ত দেখে নিয়ে ছক সাজিয়েছিল ওরা?

যখন বুঝেছি ততদিনে এক একটা দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি।

সত্যিই। ওইরকম সময়ে কেউ বাইরে বেরোতে পারে ইচ্ছে মতো?

রোজ শুনি লক্ষ লক্ষ মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে। রাস্তাঘাট, হাওয়া-বাতাস, ঘরের লোকজন—সবাইকেই সন্দেহ হয়।
 
রাস্তায় বেরোতেই ভয় করে। দোকান-পাট বন্ধ। গাড়ি ঘোড়া চলে না, সমস্ত দেশটা যেন যুদ্ধের আতঙ্কে ঘরবন্দি হয়ে গেছে। চ্যানেলে চ্যানেলে মৃত্যুসংবাদ। গণচিতা আর গণকবরের দৃশ্য। মহমারীর প্রকোপ আমাদের মধ্যে ঔপনিবেশিক শাসনের আতঙ্ক নিয়ে আসে কেন? এই দেশ কি উপনিবেশ আজ!

কী মৃত্যু, কী মৃত্যু রে ভাই! প্রথম কিছুদিন অবশ্য পরিচিত বৃত্তের কেউ মারা যায়নি। চেনা-জানা কেউ মারা না-যাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুটাকে ঠিক ঠাহর করা যায় না যেন। তাই একটু নিশ্চিন্ত ছিলাম। এক হিসেবে ভালোই ছিলাম। বাড়িতে ছেলে আর বউকে বেশি বেশি সময় দিই। বসে বসে পেসেন্স খেলি। গল্পের বই পড়ি। তিনজনে মিলে তাস খেলা হয়। তখনও জানালা খুলে রাখা যেত। এ-বাড়ি ও-বাড়ির সঙ্গে কথাবার্তা হয়। জানালায় মুখ লাগিয়ে প্যাঁচাল পাড়ি আবার সতর্ক থাকি ওদের নিশ্বাসের নাগালের বাইরে যেন থাকতে পারি। অ্যাকাউন্টে বেতন ঢুকে যায়, আরামসে।

স্কুলের ছেলেমেয়েদের মুখ মনে ভেসে ওঠে। আটকাতে পারি না। অস্বস্তি হয়। আমরা বেতন পাচ্ছি ওরা শিক্ষা পাচ্ছে না। পর মুহূর্তেই ভাবি—ছোটোরা সংক্রমিত হলে সেটা আরও মারাত্মক আর ক্ষতিকর। সংক্রমণে এদের সমূহ ক্ষতির কথা চিন্তা করে ওদের শিক্ষার ক্ষতিকে উপেক্ষা করার মনের জোর পাই। বিবেক দংশন ফলে জল হয়ে ধুয়ে যায়। ছয়-ছয়টা ক্লাস করার বদলে ঘরে বসে একটানা ছুটিকে পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মতো জীবনের কুসুমিত আশীর্বাদ বলে বোধ হয়।

তবু সুজন, নুরুল, অঙ্কিতাদের মুখ ভুলতে পারি না। ওদের প্রাইভেট টিউশন নেওয়ার পয়সা নেই। স্কুলটাই সব ওদের কাছে। 

ভুবনের কথাও মনে পড়ে যায়। বোকা ভুবন ওর প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের জন্য একটা ঘর নিয়ে থাকতে শুরু করেছিল। তার স্কুলের সামনের মাঠে বা গাছতলায় ফাঁকা ফাঁকা করে ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে যাচ্ছিল সে। একার উদ্যোগে খোলা মাঠের আর খোলা মনের স্কুল সে চালিয়েছে বেশ কিছুদিন।

শুনেছিলাম কে বা কারা এসে ভুবন মণ্ডলের সেই মুক্ত বিদ্যালয় পিটিয়ে তুলে দেয়। এই দুঃসময়ে কেন সে স্কুল খুলেছে? 

ভালো করে কৈফিয়ৎ দেওয়ার আগেই গোটা কয়েক চড়-থাপ্পড় খেয়ে যায় ভুবন। ছাত্রছাত্রীদের সামনেই। কান ধরে ওঠ-বস পর্যন্ত করায় ওরা। প্রশাসনের বিরোধিতা করে সে নাকি রোগ ছড়ানোর চক্রান্ত করেছে।

তারপর সে যে কোথায় গেছে কেউ জানে না। অন্তত বাইরে বেরোনোর আর পড়ানোর সুযোগ ভুবন আমাদের থেকে বেশ কিছুদিন বেশি পেয়েছিল।

মাঝে মাঝে মাথা পর্যন্ত ঢেকে বাইরে বেরোই। দু-একটা দেকানপাটে যা পাই নিয়ে চালে আসি।

জানি সবার অবস্থা আমার মতো নয়। দিন আনি দিন খাইদের কী অবস্থা ভাবতেও ভয় করে।

তার চেয়েও বেশি ভয় পাই একথা ভেবে যে আমার নিশ্চিন্ত বেতনের চাকরিতে মানুষের কুনজর পড়বে না তো?

এরপরেই পরিচিতদের মৃত্যুসংবাদ আসতে থাকে। শরীর কাঁপে। খবরের কাগজ তখনও আসে। টিভির বেশির ভাগ চ্যানেলও বন্ধ হয়নি আজকের মতো। 

প্রথমে শয়ে শয়ে, তারপর হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর খবর। মৃত্যু আর হাহাকার দেশ জুড়ে। কী করব বুঝতে পারি না। দিনের বেলা পড়ে পড়ে ঘুমোই। রাতে দুশ্চিন্তায় জেগে উঠি।

এলাকার কয়েকজন ডাক্তার মারা গেলেন। একজন তো বিশেষ পরিচিত। মহামারী ভাইরাস বায়ুবাহিত হয়ে উঠেছে। ভোরের নির্মল প্রাণবায়ু আর সন্ধের উদাসী বাতাস বলে কিছু নেই আর। ভাইরাসেরা নিজেদের পালটে পালটে ক্রমশ অজেয় হয়ে উঠছে। আমাদের বাঁচার সবচেয়ে বড়ো উপায় চারপাশ থেকে সমূলে ছিন্ন হয়ে যাওয়া। ছিন্ন হয়ে থাকা।

এরকমই তো বলত ওরা।

মৃত্যু দেখে দেখে রোগটাকে বিশ্বাস করতে হচ্ছে। আর বিশ্বাস করতে হচ্ছে সরকারি ঘোষণাকে।

একদিন দুটো ঘোষণা করা হল চ্যানেলে চ্যানেলে।

আমাদের ঘরবাড়ির দরজা-জানালাগুলো সব বন্ধ করে রাখতে হবে। জানালাগুলো তো বটেই এবং সর্বক্ষণ। দরজাও বেশিরভাগ সময়, ভাইরাস এমনই ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। 

শুধু তাই নয়। এই মারণ ভাইরাস ছড়াচ্ছে প্রতিবেশি শত্রুদেশগুলো। দ্বিতীয় ঘোষণাটা শুনেই রক্ত গরম হয়ে ওঠে। শুধু আমার নয়, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, সকলেরই। তখনও পর্যন্ত নেট চালু থাকার ফলে বা ফোনে যেটুকু যোগাযোগ করা যেত তার ভিত্তিতে বলছি।

বহু মানুষের বহু কষ্ট, বহু ত্যাগ স্বীকার কারে দেশ স্বাধীন হয়েছে। সে স্বাধীনতা কি আবার হারানো যায় ?

সত্যি সত্যিই ইচ্ছে করে একটা অটোমেটিক রাইফেল পেলেই মাঠে নেমে পড়ি। আমাকে যদি নেয়, এই মুহূর্তেই যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে প্রস্তুত আমি। মরি মরব, কয়েকটা শত্রুকে তো নিকেষ করতে পারব। 

কিন্তু সেরকম কোনও ডাক আসে না দেশের তরফে। যুদ্ধের ধরনধারণ রীতিনীতি বদলে যাচ্ছে। ওরা ব্যায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার চালাতে চাইছে। এ মুহূর্তে আমাদের কর্তব্য, ঘরে নিজেদের আটকে রাখা। 

দেশের স্বার্থে এক হওয়ার অর্থ এখন নিজের নিজের মতো একা হওয়া।

সব সামলে ওঠার পর দেখিয়ে দেব আমরাও মার দিতে জানি।

আমার মধ্যে মাঝে মাঝে যে সন্দেহের খচখচানি হচ্ছে না তা নয়। কিন্তু এসব তো শুধু প্রশাসন বলছে না। বলছে সরকারি সংস্থার বড়ো বড়ো সব বিজ্ঞানীরা।

ক’দিন বাদেই প্রলয়ের সঙ্গে মোবাইলে কথা হচ্ছিল।

“আমরা কোন্ দিকে যাচ্ছি বল তো প্রলয়?”

প্রলয় খ্যাঁক করে ওঠে, “কোন্ দিকে আবার? বসে বসে বেতন পাচ্ছ আবার সরকারকে দোষ দাও। সত্যিই মাইরি। কিছু বলার নেই।”

“এত লেকচার দিচ্ছিস প্রলয়? এ মাসের স্যালারির মেসেজ ঢুকেছে তোর?”

প্রলয় একটু চুপ করে থাকে। এরপর বলে, “ঠিক খেয়াল করিনি। আমাদের কোম্পানি না জানিয়ে কিছু করে না বস্। বেতন নিয়ে ভয় পাচ্ছিস কেন রে? কোনও নোটিফেকশন হয়েছে? সার্কুলার?”

আমি উত্তর দিই, “আমি এখনও কোনও স্যালারির মেসেজ পাইনি। স্কুলের আর কেউও পায়নি।”

প্রলয় আবার বলে, “ফালতু ভাবিস না। বেতন বন্ধ হবে এসব অস্বাভাবিক কথা ভেবে রাতের ঘুম বরবাদ করছিস কেন? আমাদের কাজ এখন দেশের পাশে দাঁড়ানো। প্রশাসন আর পুলিশকে সহযোগিতা করা। যারা করবে না তারা গদ্দার।”

ক’দিনের মধ্যেই পৌরসভার নির্দেশে ঘরে ঘরে আমরা জানালা বন্ধ করে দিই। এরপর পৌরসভার লোকজন গাড়ি করে এসে কীসব যন্ত্রপাতি দিয়ে বাইরে থেকে এমনভাবে সিল করে দেয় যে আমরা জানালাগুলো আর ভিতর থেকেও খুলতে পারি না। দরজাগুলো ভিতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়ে ওরা চলে যায়। সঙ্গে কত লোকজন, বিরাট টিম, সারা শরীর ঢাকা, বাক্সে ওষুধ আর স্প্রে আর কী বলব!

এর মাত্র তিনমাসের মাথায় প্রলয়কে দেখি। কারখানায় যাওয়ার পথেই। ব্যাঙ্কের দিকে যাওয়ার বড়ো রাস্তাটায় গর্ত খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। নতুন কীসব হবে। অনেক অনেক যন্ত্রপাতি আর রোবটের মাঝখানে প্রলয়ও কাজ করে চলেছে কয়েকজন মানুষ শ্রমিকের সঙ্গে। 

সারা জামায় জল, কাদা, কালিঝুলি মাখা প্রলয়। একটা সবুজ বারমুডা আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা। 

তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের ইঞ্জিনিয়ার প্রলয়কে তো ওরা ওর নিজের সাবজেক্টেই কাজে লাগাতে পারত!

আমি প্রলয়ের দিকে না তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে চলে যাই।

প্রলয় কি দেশের কাজ করছে?

রাসায়নিক যুদ্ধ, জৈব যুদ্ধ— এসব শুনেছি বটে। বইপত্রে, কাগজে পড়েওছি কিছু কিছু। কিন্তু সেরকম ধারণা তো নেই। তাছাড়া ওপরওয়ালাদের কথা তো বিশ্বাস করতেই হয়। সত্যিই তো কম মানুষ মরছে না।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রশাসনও বলছে, এ মুহূর্তে সব কিছু বন্ধ করে ঘরে বসে থাকাই সবচেয়ে বড়ো দেশপ্রেম।

কিন্তু দিন-দুই পরে এমন একটা ব্যবস্থা চালু হল যে আর সন্দেহ সংশয় করার মতো জোরই পাই না।

পৌরসভা থেকে বাড়িতে বাড়িতে খাবার পাঠানো শুরু হল। বড়ো বড়ো গাড়িতে। বেশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন প্যাকেটে, তৈরি খাবার। 

ইউনিফর্ম পরা পৌরকর্মীরা এত এত সংখ্যায়, আগে দেখিনি কখনও, সুশৃঙ্খল বাহিনীর মতো খাবার বিতরণ করে যাচ্ছে, পরিবার ধরে ধরে।

অত্যাবশ্যক কিছু ওষুধও দিচ্ছে তারা।

ক’দিন পর থেকে না কি স্বাস্থ্য পরীক্ষার গাড়িও বেরোবে পাড়ায় পাড়ায়।

এই বাহিনী শুধু অনুরোধ করে যাচ্ছে দিন পনেরো কী বড়োজোর মাসখানেক যেন এই ব্যবস্থার সঙ্গে নাগরিকেরা সহযোগিতা করেন। 

আমরা অভিভূত। আমরা আপ্লুত। কোনো প্রশাসন এতটাই সংবেদনশীল হয়! তাছাড়া এত এত খরচ করছে ওরা। দশ মিনিটের মতো অপরাধবোধে ভুগে নিলাম।

কিন্তু আমার মনে বড়ো প্যাঁচ। প্রায়শ্চিত্তের ওই দশ মিনিটের ঠিক সাড়ে আট মিনিটের মাথায় ভিতরে কূট প্রশ্ন পেঁচিয়ে উঠল।

এত পুলিশ কেন? খাবার দেবে, ওষুধ দেবে, তাতে এত এত সশস্ত্র লোক লাগে কীসে?

পরে কারখানায় গিয়ে যেটুকু যা সুযোগ পেয়েছি চুরি করে কথা বলার, তাতে জেনেছি পৌরসভাগুলো নিজেরাই সশস্ত্র আধা সামরিক বাহিনী নিয়োগ করার ক্ষমতা পেয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগ ছাড়াও ওয়ার্ড ভিত্তিক কিছু যুবককে চাকরিও দেওয়া হয়েছে। তবে এক ওয়ার্ডের লোককে অন্য ওয়ার্ডে।

কিন্তু তবু, ঠিক যুক্তিতে ধরতে পারি না। একটাও বিদেশি শত্রু বা বিদেশি সৈন্য দেখা যায় না। তবে কাদের জন্য এত এত সশস্ত্র লোকজন?

এই দেশ তবে কাদের শত্রু ভাবছে?

যুদ্ধের ঘোষণা কোথাও হয়নি। কোনও চ্যানেলে না।

যাক্ গে, প্রশ্ন আর দ্বিধা নিয়ে দিন পনেরো কি মাসখানেক কাটিয়ে দেওয়া যাক। নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারকে অনেক কিছুই গোপন রাখতে হয়।

এই কদিন না হয় টিভি দেখে আর মোবাইল ঘেঁটে…

নাহ্ মোবাইল ঘেঁটে কাটিয়ে দেওয়া গেল না।

ঘোষণা করে এক সকালে নেট বন্ধ করে দেওয়া হল। চ্যানেলে চ্যানেলে তখন সারাদিন ধরে এই খবর। শত্রুরা আমাদের তথ্য প্রযুক্তি সিস্টেমে মারাত্মক আগ্রাসন চালিয়েছে। আর এ-ও এক ভাইরাস, যে ভাইরাস কম্পিউটার হ্যাঙ করে দেয়। 

প্রত্যেক নাগরিকের বক্তিগত তথ্য সমেত দেশের অতীব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এমনকি প্রতিরক্ষা বিভাগের তথ্যও তারা হ্যাক করে নিচ্ছিল প্রায়।

চ্যানেলেই শুনলাম বহু লোকের অ্যাকাউন্টের টাকা নাকি লোপাট। 

ইন্টারনেট নির্ভর সমস্ত ব্যবস্থাকেই এবার আক্রমণ করবে ওরা। ভালো করে ভাবলে শিউরে ওঠার মতো ব্যাপার।

একদিন নিশ্চয়ই মহামারী দূর হবে। মহামারীর ভাইরাস দুর্বল হয়ে পড়বে। কিন্তু তার পরেও তো ব্যাংক, রেল, বিমা, রেশন কার্ড, জিনিসপত্র কেনাকাটি, অফিসের পোর্টালে কাজ… তো এসব তো থাকবেই। সেই ব্যবস্থাটাই যদি ভেঙে যায়! কল্পনা করতেই শরীরে কেমন…।

বললামই তো যুদ্ধের ধরন-ধারণ পালটে গেছে। তাই প্রতিরোধের রীতিও পালটে হবে। এখন শুধু ধৈর্য ধরে চোখ-কান বুজে অথবা খুলে, যদিও দুটো একই ব্যাপার আসলে, তো অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। যে সকালে নেট বন্ধ হয়ে গেল সেই সন্ধ্যাতেই মোবাইল ফোনগুলো কাজ করা থামিয়ে দিল। কোনও সিমেই ফোন হয় না। এটা কিন্তু ঘোষণার মধ্যে ছিল না। 

বহু দেশভক্তই এটা মেনে নিতে পারেনি, আমি অনুমান করতে পারি। অবশ্য পরদিন ওরা চ্যানেলে দুঃখপ্রকাশ করে এজন্য। আর সাতদিন সময় চায় মেবাইল সিমগুলো চালু করে দিতে। যে সাতদিন আজও আসেনি।

আমরা তিনটে প্রাণী, আমি বউ আর ছেলে, বিশ্বজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরবন্দি হয়ে গেছি। বেতন যথারীতি আর ঢোকেনি। ঢুকলেই বা কী! ব্যাংক বন্ধ। এটিএম চলে না। নেট কাজ করে না। পুরসভা রোজ খাবার দেওয়া বন্ধ করেছে। এখন সপ্তাহে দুদিন দেয়। তাও শুকনো খাবার। গ্যাসের লাইনটা চালু আছে এখনও। ক্যাশ টাকা ফুরিয়ে আসছে। থাকলেই বা কী হয়! যাবতীয় অনলাইন লেনদেন বন্ধ। বিছানায় শুয়ে শুয়ে দামি রেস্তোরাঁর খাবার আনিয়ে খেয়েছি কতদিন, মোবাইলের কয়েকটা ক্লিকে। আজ সব অ্যাপস অচল। হাতে নগদ নেই। আমরা মিথ্যের স্বর্গ থেকে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়েছি।

আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কারুর সঙ্গে, পৃথিবীর কারুর সঙ্গেই পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই।

দরজা বন্ধ, জানালা বন্ধ, বাইরে টহল দেয় সেনা।

ঘরে লুডো খেলা, তাস খেলা উঠে গেছে।

আমরা তিনজনে তিনটি আলাদা ঘরে থাকি। বিছানা আলাদা। আমরা ছায়াচ্ছন্ন, তমসাবৃত।

বউ হঠাৎ বলে, ‘তুমি অপদার্থ। ভেড়ুয়া একটা। কিছুই টের পেলে না আগে থেকে?’

—‘আগে থেকে মানে? কী করে বুঝব? বুঝলে কী করতাম?’

—‘কেন? পালিয়ে যেতে? তোমার বন্ধুদের মতো?’

আশ্চর্য কথা বলে বউ, ‘পালাব কোথায়? কার কাছে? তুমি জানলে কী করে বন্ধুরা…’

‘ওরা অবশ্যই নিজেদের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। কারণ ওরা ভেড়ুয়া নয়। তোমার মতো ইডিয়ট নয়, নিশ্চয়ই এই এলাকার বাইরে এসব ব্যাপার-স্যাপার নেই।’

ইচ্ছে করে ওকে খুন করে ফেলি। কিন্তু তাতেও ঝামেলা অনেক।

চুপচাপ হাত কামড়াই। আলো নিভিয়ে শুয়ে থাকি।

চোখে ঘুম নেই। শীতঘুমে চলে যাই না কেন?

অথবা মরণঘুমে?

একদিন দরজা খুলে জোর করে বেরোতে গেছিলাম… টহলদার পুলিশ না সেনা কে জানে, লোকটা সোজা ওর মেশিন তাক করে রইল আমার কপাল বরাবর।

টিভিতে এখন মাত্র দুটি সরকারি আর দুটি বেসরকারি চ্যানেল পাওয়া যায়। সারাদিন শত্রুর আগ্রাসনের খবর। মহামারীতে মৃত্যুর খবর। সঙ্গে দেশাত্মবোধক গান। অহেতুক আতঙ্কিত না হওয়ার অভয় বাণী। এখনও আতঙ্কিত না হলে আর কবে হব!

ছেলের স্কুলের বইগুলোয় ধুলো জমেছে। আমাদের তিনজনের মধ্যে বাক্যালাপ কীভাবে যেন বন্ধ হয়ে গেছে। তেরো বছরের ছেলেকেও আমার বিদেশি শত্রু শত্রু লাগে।

একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে বেশ ক’দিন। মাঝে মাঝে না খেয়ে শুয়ে থাকি। তবে অভিমান কার ওপরে করব ঠিক করতে পারি না।

প্রতিদিন অন্ধকারের একটা স্তর থেকে নতুন আরেকটা স্তরে ঢুকে পড়ছি যেন। চাই বা না চাই।

ঠিক এইসময় একরাতে দরজায় কড়া নাড়া। ঘড়িতে তখন সোয়া ন-টা। দরজা খুলতেই দেখি, ফোর্স। সবার হাতে অস্ত্র।

আমার নানা কাগজপত্র, ক্রেডেনশিয়াল দেখতে চাইল ওরা। 

দেখাতে হল। সে সব নিয়ে ওদের সঙ্গে যেতে বলল।

‘পাঁচ মিনিটে তৈরি হয়ে আসুন। জরুরি ওষুধপত্র আর একসেট পোশাক নিন।’

সেই দিনটাতে প্রায় সারাদিন মুখে কিছু তুলিনি। অফিসারের কথায় ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি এ সেই ২২১, সেটাই প্রথম দেখা…..

হ্যাঁ তার কথায় আমার আধপাগলা মন হঠাৎ মানিকবাবুর গল্পটা মনে করে ফেলল। 

মানুষ না খেয়ে খেয়ে এমনই দুর্বল হয়ে পড়ে যে সে আর ছিনিয়ে যায় কী করে?

খেতে পায় না বলেই তো ছিনিয়ে খেতে পারে না।

সারাদিন না খাওয়া আমার মাথায় তখন রোখ চেপে গেছে। ভাবি, মানিকবাবুর গল্পটাকে মিথ্যে করে দিই।

চিৎকার করে উঠি, “কোথায় যাব? কেন যাব? কোন্ অর্ডারে বলতে পারেন? এসব কি নখরাবাজি হচ্ছে!”

কথাটা আমার শেষ হওয়ার আগেই মুখে এক প্রচণ্ড থাপ্পড় কষালো লোকটা। মানে এই ২২১ মালটা। 

থাপ্পড়টা খেয়ে বহুদিন বাদে মনে পড়ল আমি একজন শিক্ষক। আমারও অনেক…

নাহ্… শেষ কথাটা পুরোটা ভেবে উঠতে পারিনি।

লোকটা আমার কাছে এগিয়ে এসে মুখের কাছে মুখ নামিয়ে, 

“থুঃ……”

হ্যাঁ, একদলা থুতু সজোরে ছুঁড়ে দিল। পাথরের মতো।

আমার কান ধরে, হাত ধরে, হিড় হিড় করে টানতে টানতে… আমায় অবশ্য হাঁটার কষ্ট করতে হয়নি সেভাবে… তো কালো গাড়িতে উঠে গেলাম।

একুশ বছর ধরে অঙ্ক করানো মানুষকে ওরা কুত্তার বাচ্চার মতো ঘর থেকে বের করে চালান করে দিল।

মানিকবাবুও নাকি খুব অঙ্ক করতেন। তারপর সাহিত্য করতে এসে না খেয়ে মরে ছিলেন। আর আমি এক অঙ্কের মাস্টার, মরণের দোরগোড়ায় এসে সাহিত্য মাড়াতে গিয়েছিলাম। 

কালো গাড়িতে উঠতে উঠতে আমার বউ আর ছেলের তুমুল কান্না শুনেছি। ওরা না সত্যিই কাঁদছিল! হ্যাঁ সত্যি সত্যিই! আর হ্যাঁ, আমারই জন্য। আশপাশ থেকে কোনও সাড়া-শব্দ নেই। কেউ দরজা খোলে না। জানালা তো বন্ধই কতদিন। সেই সব-হারানো রাতে এই সম্মিলিত কান্নাই আমার একমাত্র ফিরে পাওয়া সম্পত্তি।

কালো গাড়িতে বসে বোঝার চেষ্টা করি কেন আমাকে ধরল ওরা। আমার কাগজপত্রে কোনও গোলমাল ছিল। আসলে এভাবেই আমরা বড়ো বড়ো কারণগুলিকে ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার পরিসরে নিয়ে আসার ভুল করি।

এটা বুঝেও জ্বালা কমে না।

মুখের ওপর থুতু দিল?

অচেনা লোকের ওপরেও এত ঘৃণা ওদের?

এখন বুঝি, এসব রাগ ঘৃণা-বিদ্বেষ ভিতরে ভরে দেওয়া হয়েছে। বুনে গেঁথে দেওয়া হয়েছে একেবারে। 

দিনের পর দিন প্রশিক্ষণ ছাড়া চর্চা ছাড়া এমন হতে পারে? দেশজুড়ে তবে গোপনে গোপনে আড়ালে আবডালে এরকম চলেছে তাহলে?

স্কুল আর কারখানা—ঘৃণা তৈরির কর্মশালা?

আমাদের গাড়িটা আশি নম্বর গলিতে ঢুকতেই আমার স্কুল পড়ল।

স্কুলটা ভাঙা হচ্ছে…! হ্যাঁ আমাদের একশো বছরের পুরানো স্কুলটা ভেঙে দিচ্ছে। 

একটা সাইনবোর্ড টাঙানো। কী এক কোম্পানির নাম। অত রাতে সবটা স্পষ্টভাবে দেখতে পাইনি।

একুশ বছর যে স্কুলে পড়িয়েছি সেটাকে আমি চোখের সামনে নেই হতে দেখছি গাড়ির জানালায় বসে।

রাস্তায় সব কিছু বন্ধ। একটাও লোক নেই। একটাও গাড়ি চলছে না কালো গাড়ি ছাড়া। এখানে সব কিছু থেমে গেছে। এটা ঠিক, গাড়িতে তোলার পর ওরা মারধোর করেনি। কথাও বলেনি একটাও। আমি কি পূর্ব অথবা পরজন্মে পৌঁছে গেছি? না কি ঘুমের মধ্যে কেউ তুলে নিয়ে যাচ্ছে অন্য দেশে…?

ঘরবন্দি হওয়ার পর প্রথম বেরিয়ে দেখলাম দেশটা জেলখানা হয়ে গেছে। সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। পরে কারখানায় গিয়ে ইতিহাসের রিয়াজ আর জীবন বিজ্ঞানের সুকল্যাণকে দেখি, দূর থেকে।

স্কুলের আরও কয়েকজনকে না কি খনিতে লাগিয়েছে। কাউকে খাবার তৈরির কারকানায়।

গাড়ির ভিতরে আরও কেউ কেউ বসে আছে। বন্দি অথবা রক্ষী। মুখ দেখা যায় না। একটা জমাট মৃত অন্ধকারের মধ্যে বসে আছি। আবার চলছিও বটে। ওই অন্ধকারের অনির্দ্দেশ্য পথের যাত্রী, আমার, হঠাৎ মনে পড়ে যায় সত্তর দশকের কথা। স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা। তেভাগার কথা….

আজকের সময়ের যুবক-যুবতীরা তরুণ-তরুণীরা এখন কোথায়? কীভাবে আছে? তারা কি এই ভয়ংকর অন্ধযামিনীর শরিক না শিকার? 

আমার পাড়ার ছেলেমেয়েরা, আমার এত এত ছাত্ররা। ছাত্রীরা?

কিছু বোঝার আগেই ধরা পড়ে গেল নাকি ওরা?

এখন আমি বুঝতে পারছি। মনে হয়, আমার মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ বুঝতে পেরে গেছে। একটা বিশাল বিপুল কর্মযজ্ঞ চলছিল, মহামারীর আতঙ্ক আর আচ্ছন্নতার আড়ালে। কিন্তু বুঝে কী লাভ এখন? 

আমরা সবাই অন্ধকার সমুদ্রে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো হয়ে আছি।

কারখানায়

কাজের ফাঁকে দুমিনিটের জন্য কারখানার মাঝখানের বাঁধানো চত্বরে এসেছি। সেটুকুও অনুমতি নিয়ে। MRVZ131-এর থেকে। পায়ের ওপর পা তুলে বসেছিল হতচ্ছাড়া রোবটের বাচ্চা। তিন তিনবার নক্ করায় দাঁত কেলিয়ে অনুমতি দিল শালা। কী বীভৎস বিচ্ছিরি হাসি দানবটার।

আকাশ দেখে মালুম হয় পুজো আসছে। দু-একটা পুজো নাকি হবে প্রশাসনের উদ্যোগে। টিভিতে দেখাবেও।

এ পুজোর কী অর্থ? কী প্রয়োজন এই শরতের আর শারদীয়া মেঘের?

একদিনের জন্য ওরা বাড়িতে যেতে দেবে। ঘরে ফিরব কী? ফেরার আছেটা কী?

শেষবার গিয়ে ছেলেকে দেখিনি। ওরা আমার তেরো বছরের ছেলেটাকে তুলে নিয়ে গেছে— হ্যাঁ দেশের জন্য। সামরিক প্রশিক্ষণ দেবে। 

আমার ছেলেটা এখন কোন্ পাহাড়, জঙ্গল বা সমুদ্র উপকূলে ট্রেনিং নিচ্ছে কে জানে! ওই নরম আঙুলগুলো দিয়ে ও কি গুলি চালিয়ে দেবে? মানুষের বুকে?

নিজের খোপে ফিরে এসে নাট বল্টু টাইট করতে করতে বিশ্বাস হয় না এই জীবন কি সত্যি আমার? আমারই?

এক বিরাট ল্যাবরেটরিতে বহু যত্ন আর গোপনীয়তায় তৈরি করা একটা স্বপ্ন অথবা বিস্মরণ আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কারখানায় প্রথম দিন খুব অবাক হয়েছিলাম। কত কত লোক আলাদা আলাদা খোপে ঢুকে কাজ করছে। কোথাও আবার খোপ নেই। খোলা চত্বর। বিরাট এলাকা জুড়ে কত শত যন্ত্রপাতি।

কিছু লোকজন, কর্মচারী। সবই সামরিক পোশাকে।

আর বিরাট রোবট বাহিনী।

একটা জিনিস বোঝা গেল; সব কাজ যন্ত্রে হয় না। মানুষের হাত লাগে। হাতের পাঁচ আঙুলের বিচিত্র সূক্ষ্মতা আর সূক্ষ্ম রিফ্লেক্স লাগে। আমাদের মতো আন‌্‌পড় লোকদেরও তাই মেলা কাজ।

কতরকম স্ক্রু টাইট করা, ছোটোখাটো মেশিনে ঢুকিয়ে নির্দিষ্ট শেপ-এ আনা, এটা কাটা, ওটা সমান করা। এর সঙ্গে ওকে জোড়া… এমন অসংখ্য টুকরো ছোটো ছোটো কাজ। কিন্তু পরিমাণে বিপুল। একটানা দেড়-দুঘণ্টা করলেই শিরদাড়া… থাক, সেটা ভেবে কী ফায়দা। 

আমি সহজ করে স্ক্রু বা নাট-বল্টু বলছি বটে। আসলে ওগুলো যে কত বিভিন্ন আর বিচিত্র রকমের ছোটোখাটো যন্ত্রপাতি, স্পেয়ার পার্টস—কী বলব! নামও জানি না। আমাদের ঘাম রক্ত দীর্ঘশ্বাস যন্ত্রদানবগুলোর তেল আর মোবিল বা লুব্রিক্যান্ট হিসেবে কাজ করে। 

কিন্তু এই সকল কাজ জুড়ে গিয়ে ফাইনাল ফিটিংস-এর পরে কী উদ্দেশ্যে কী তৈরি হবে আমরা জানি না। এক-একটা আলাদা অংশ ধরে কাজ করলে সেটা বোঝাও শক্ত। আর কতরকম যে বিভাগ—

যান্ত্রিক, বৈদ্যুতিক, রাসায়নিক… আরও কী সব কাজ। কাজ বিপুল। করতে হয় সেনা আর রোবটের প্রহরায়, সর্বক্ষণ।

কেউ বলে আমরা নাকি যুদ্ধ বিমানের পার্টস তৈরি করছি। কেউ বলে বোমা তৈরির প্ল্যান্ট। জানি না কোন্‌টা ঠিক। সবই শুনি দেশের কাজ। আমাদের সেট করা জিনিসগুলো আবার গাড়িতে চাপিয়ে কোথায় যেন নিয়ে যাওয়া হয়।

তবে আমাদের কাজের মূল্য আমরা বুঝতে পারি পুলিশ বা সেনা ও রোবটের পাহারার ধারে, ভাবে, তৎপরতায় আর নিশ্ছিদ্রতায়।

ক’দিন দেখেই মনে হয় পুলিশ আর সেনা যেন ক্রমশ রোবট হয়ে উঠছে আর রোবটগুলো মানুষের কাছাকাছি। কিন্তু ওরা সবাই আমাদের বস্। এতে সন্দেহ নেই।

মাঝে মাঝে মাইকে আমাদের কাউন্সেলিং করা হয়। আমরা দেশের কাজ করছি অথচ যথেষ্ট গর্বিত দেখাচ্ছে না আমাদের। 

সঙ্গে সঙ্গে অং বং চং মন্ত্র। এসব মন্ত্রের কী বালছাল মানে জানি না। এখানে এসে বুঝছি মন্ত্রে ভয় জাগে। ছোটোবেলা থেকে মন্ত্রতন্ত্র নিয়ে কত হাসাহাসি করেছি। এখন টের পাই মন্ত্রে সত্যিই ভয় পায় মানুষ। যত দুর্বোধ্য মন্ত্র, ভয় ততই বেশি। এরা তো নানাপ্রকারে চাবুক মারে— হাতে, পেটে, পোঁদে, মগজে… তো চাবুকের সঙ্গে জুড়ে আছে বলে মন্ত্রে ভয় লাগে। পাভলভের কুকুরটার যেমন ঘণ্টা বাজলে জিভে জল এসে যেত।

একদিন একটু অন্যমনস্ক হয়ে অন্য কেবিনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ভালো লাগছিল না কিছু।

হঠাৎ মাথায় এক গাঁট্টা। তাকিয়ে দেখি এখানেও এক রোবট। গাঁটা মেরে মাথাটা আমার কেবিনের দিকে ঘুরিয়ে দেয় শয়তানটা। 

মাথাটা গরম হয়ে যায়। “শালা শকুনের বাচ্চা”, ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে চিৎকার করে উঠি। 

রোবটটা দেখি খট্ খট্ করে হাসতে থাকে। “শালা তোর চোদ্দ গুষ্ঠীর পিন্ডি চটকে…”, আমি তখন ভুলেই গেছিলাম কাকে বলছি। 

এবার দেখি যন্ত্রটা শরীরে ঢেউ তুলে তুলে হাসছে। যেন হাসি চেপে রাখতে গিয়ে পেট ফেটে মরে আর কী। 

হাসতে হাসতে কী একটা স্ক্রু মতো ওর পেট থেকে খুলে ঠং করে নীচে পড়ে গেল।

হতভাগাটা নিজেকে সামলে নিয়ে মাটি থেকে স্যাট করে মালটা তুলে আবার সঠিক জায়গায় বসিয়ে দিল।

ওর দেখাদেখি পাশের, তার পাশের, তারও পাশের— এভাবে সব রোবটগুলোই হাসতে থাকে। সেই জান্তব বা যান্ত্রিক হাসি কেবিন থেকে কেবিনে ছড়িয়ে পড়ে।

এবার আমার আর রাগ হয় না। রেগে ওঠার সাহসই হারিয়ে ফেলি।

আমাদের দিন বোধহয় শেষ হয়ে এল।

এই সামান্য টুকটাক কাজের জন্য আমাদের ওপর নির্ভরতা আর ক’দিন? যেভাবে এগোচ্ছে ওরা।

তখন? 

সেই অনিশ্চিত অনন্তের কথা মনে এলে ভাবি এই স্ক্রু টাইট বা নাট বল্টু লাগানো জাতীয় কাজটাও হয়তো খুব খারাপ ছিল না।

তবে এই একই কাজ যখন হাজারে হাজারে কাতারে কাতারে… শরীর অস্থির লাগে। ইচ্ছে করে ভিতরের আত্মাটাকেও বমি করে দিই। 

ক্লাস নাইনের তরুণ অঙ্কে কাঁচা ছিল। কতবার বলেছি, ‘তোর মাথার স্ক্রুটাই তো ঢিলে। আয় টাইট মেরে দিই।’
 
আজ স্ক্রু টাইট দেওয়ার কাজ হাজারে হাজারে করতে গিয়ে বুঝি আমরাও শেখানোর নামে এমন কিছু একঘেঁয়েমি তৈরি করেছিলাম যাতে তরুণের মতো অনেকের বমি আসত।

কারখানায় কাজ করতে করতে হাতটাকে একটুও না থামিয়ে মনে মনে হঠাৎ হঠাৎ ভেবে নিই ছাত্রবয়সে আমিও অঙ্কের মধ্যে ছন্দ, মাত্রা, প্রতিসাম্য খুঁজে পেতাম। কবিতা খুঁজে পেতাম। আর এসব কিছুর মধ্য দিয়ে এক অপরূপ অনিশ্চয়তার ছোঁয়া পাওয়া যেত যে অনিশ্চয়তা আবার কখনও-বা অনন্তের দিকে নিয়ে যেত মনকে। হ্যাঁ, অঙ্কেও এসব সম্ভব।

অসীম বীজগাণিতিক সিরিজগুলো লক্ষ্য করে করে বিস্ময় কাটত না আমার।

আহা! এমন একটা গল্পের চরিত্র যদি সৃষ্টি করতে পারি যার মন ওরকম কোনও একটা সিরিজের নিয়মে চলবে আর বদলাবে!

কিন্তু ছাত্রদের পড়াতে শুরু করে কী করে যেন এসব মাথা থেকে উবে যেত। শুধু সিলেবাস শেষ করাটাই হয়ে উঠত একমাত্র অগ্রাধিকার। 

আর কোনোদিনই সে সুযোগ পাব না আমি। এখন নিজেরাই বৈচিত্র্যহীন স্বাধীনতাহীন সব নাট বল্টু, স্ক্রু পেরেক হয়ে গেছি। মেশিন বনে গেছি।

মেশিন বলে মেশিন? বউয়ের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতেও পারি না আর। শেষবার গিয়ে বুঝতেই পারিনি সন্তান কেড়ে নেওয়া মায়ের চোখে চোখ রাখব কীভাবে? অবশ্য বলার এমনিতেও কিছু নেই। ও হয়তো ভাবে ওকে বন্দি রেখে আমি মুক্তি পেয়েছি। যেহেতু ‘বাইরে’ বেরিয়েছি।

আধঘণ্টা দম আটকে বসেছিলাম ঘরে। কী জ্বালা রে বাবা! বিদায় নিতেও তো ভূমিকা লাগে একটা।

পনের বছর ধরে ঘর করা একটা মানুষের ক্ষেত্রে নতুন করে অপরিচয়ের অন্ধকার তৈরি হতে পারে এটা জানতাম না। 

কিছু না বলেই উঠে পড়ি। রাস্তায় কালো গাড়ি। হঠাৎ দরজার মুখে এসে বউ বলে, ‘একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে গেছে ওরা।’ 

অবাক হয়ে তাকাই।

সে স্পষ্টভাবে বলে, ‘গর্ভ নিরোধক। একেবারে জন্মের শোধ।’

ঠিক ধরতে পারি না। এর মানে কী?

এবার সে সোজা আমার চোখে চোখ রেখে বলে, ‘তুমি জানতে?’ 

আশ্চর্য! আমি কী করে জানব। পুরো জীবনটাই তো ধাঁধায় পরিণত হয়েছে।

তার কথার উত্তর না দিয়ে আমার পৌরুষের শেষ তলানিটুকু জড়ো করে নিয়ে বলি, ‘তুমি বাধা দাওনি?’

বউটা চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে পাগলের মতো হেসে ওঠে সে।

“বাধা? বাধা?…”

‘হাঃ হাঃ হিঃ হিঃ বে—শ করে বাধা দিয়েছি… যাতে ওর গা জোয়ারিটা এনজয় করতে পারি।’

হাসিটা মাঝখানে তীক্ষ্ণভাবে কেটে দিয়ে রক্ত ওঠা মুখে সে চেঁচায়, ‘যাও! যাও! ভাগো!’

ততক্ষণে ভরা কালো গাড়িতে তুলে নিয়েছে আমাকে।

এই গার্হস্থ্য রসিকতার ওপরেও যে কোনও রসিকতা থাকতে পারে তা মালুম হল আজ সকালে। এই কিছুক্ষণ আগে। 

বউ ভাবে তাকে যেন একাই জুলুম পোহাতে হয়। আমাদেরও যে নিতে হয় সেটা বলার সুযোগই পাইনি ওকে।

আজ সকালে কাজ শুরুর আগে যথারীতি ছুঁচ ফোটানোর লাইনে দাঁড়িয়েছি। 

এই ওষুধটায় ঝিমুনি আসে না। ঘুম ঘুম ভাব চলে যায়। কখনও কখনও রাত জেগে কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য সন্ধের দিকেও বাড়তি একটা ডোজ দেওয়া হয়।

এসবে শরীরে কী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, কীই-বা দীর্ঘ মেয়াদি ফল এসব জেনে বা বুঝে কোনও লাভ নেই বলে ভাবিই না। তো লাইনে দাঁড়িয়ে দেখি, একটা লোককে টেনে হিঁচড়ে মাটিতে ছেঁচা খাওয়াতে খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। লোকটা যাচ্ছে, পড়ছে, উঠছে—পশুর মতো… ঠিক পশুও নয়, আসলে বস্তুর মতো, ঝড়ে ওড়া টিনের চালের মতো হয়তো..। আমাদের দিকে তার পিছনটা।

ওই পিছন থেকে দেখেই চিনেছি।

চেনার পরেও চেনার আনন্দটা বেশি করে পেতে একটু নিশ্চয়তা চাই।

তাই অনেকটা মাথা ঘুরিয়ে সাইডে সরে ভালো করে দেখি। হ্যাঁ—সেই ২২১।

লোকটা আছাড়ি বিছাড়ি খেয়ে খেয়ে পায়ে পড়ছে—একবার এক পুলিশের পায়ে, একবার রোবটের পায়ে, পর্যায়ক্রমে। 

শুনলাম কাজে নাকি মারাত্মক কোনও ভুল করেছে সে। এ সেই ২২১, আমাকে থাপ্পড় মারা, থুতু দেওয়া ২২১। লোকটা বুঝতেই পারছে না তাকে বাঁচাবার মালিকটা কে?

তারই মতো একটা মানুষ না একটা রোবট।

এই না বোঝার সংকট তাকে পশুর স্তরের থেকেও নীচে নামিয়ে দিয়েছে।

একটা অস্পষ্ট অনিশ্চয়তার এক চিলতে সরু সুতোর ওপর আমাদের অস্তিত্বটা কেঁপে কেঁপে দুলছে। সমস্ত অস্থি মজ্জা, শরীরের সমস্ত ঘাম রক্ত দেওয়ার পরেও কতটুকু আর কতদিন পর্যন্ত আমাদের শুধুমাত্র বেঁচে থাকার অধিকারটুকু এই দেশ স্বীকার করে নেবে সেটা সম্পূর্ণ একক, একা হয়ে যাওয়া আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

One Comment

  1. কোনো কোনো লেখক গল্প লেখেন।
    বাকীরা গল্প ছাপেন।

    কুর্নিশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২