ভোজ কয় যাহারে (প্রথম পর্ব) : কুলাচার – সত্যম ভট্টাচার্য

ভোজ কয় যাহারে (প্রথম পর্ব) : কুলাচার – সত্যম ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

এখন আর কটা লোককে হাতে বোনা উলের সোয়েটার গায়ে দিতে দেখা যায়? স্বাভাবিকভাবে একজনকেও নয়। অথচ বছর বিশ-পঁচিশেক আগেও এমন একটা সময় ছিল যে শীতকালে প্রায় সব মা-মাসিমা-জেঠিমাদের হাতেই উলকাঁটা দেখা যেত। পাড়ায় কারুর না কারুর বাড়িতে পাওয়া যেত একখানা সোয়েটারের ডিজাইনের বই। সে বই নিয়েই একের পর এক সকলে ডিজাইন তুলতেন। বোনার আবার ভাগ ছিল। সোজাকাঁটা-উলটোকাঁটা আরও কত কী। উলের দোকানগুলিতে শীত পড়তে না পড়তেই তারা ভিড় করতে শুরু করে দিতেন রকমারি উলের জন্য। কাশমিলিয়ন না কি কি যেন নাম ছিল বিভিন্ন প্রকার উলের। তারপর সে-সব নিয়ে একজন আরেকজনের বাড়িতে যেতেন সোয়েটারের ডিজাইন দেখতে। সেখানে কত গল্প-আড্ডা-কথা জমে উঠত। কথা বলতে বলতে অশ্রু ঝরত প্রাণের সখীর কাছে। আচ্ছা তারাই কি নামত হাত বেয়ে সোয়েটারের ডিজাইন হয়ে? 

ছিল উল বোনার মেশিন। তাড়াতাড়ি সোয়েটার লাগলে সেই মেশিনের সাহায্য নিতে হত। তবে হাতে বোনা সোয়েটারের মতো তার আভিজাত্য ছিল না। কোনো এক বাড়ির বারান্দায় দুপুর-বিকেল নাগাদ পাড়ার মা-মাসিমা-জেঠিমারা মিলে রোদে বসে উল বুনছেন, এই ছিল শীতের পরিচিত দৃশ্য যা আজ বিগতপ্রায়। কে কত দ্রুত বুনতে পারেন তা নিয়ে তাদের মধ্যে একটা চোরা প্রতিযোগিতাও ছিল। আর সে-সব সোয়েটার গায়ে দিয়ে বন্ধু-বান্ধবদের বাড়ি গেলে তাদের বাড়ির মহিলারাও আবার তার ডিজাইন দেখে সেটা নিয়ে কথা বলতেন। মনে রাখতে হবে মা-দিদিমারা কিন্তু এসবের বেশিরভাগই বুনতেন বাড়ির পুরুষদের জন্য। এখনকার আট-দশ বছরের বাচ্চাদের এসব কথা বললে ভাববে গল্প বলছি।

এই যে এত কথা বললাম একটাই জিনিস বোঝাতে যে সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবন থেকে এরকম অনেক কিছুই হারিয়ে গিয়েছে বা যাচ্ছে এবং যাবেও হয়তো আরও ভবিষ্যতে। কারণ এক-একটি প্রজন্ম চলে যাবার সাথে সাথে শুধু তারাই চলে যান না, চলে যায় তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-লোকাচার-খাওয়াদাওয়া এবং আরও আরও অনেক কিছু। মধ্যবিত্ত বাঙালির কটা বাড়িতে গেলে এখন আর ‘দ্যাশের’ বাড়ির কথা শুনতে পাওয়া যায়? অথচ খুব বেশিদিন আগেও নয়, এই তো বছর বারো-পনেরো আগেও দাদু-দিদিমা-ঠাকুমাদের সাথে গল্প করতে বসলেই বেরিয়ে আসত ‘দ্যাশের’ বাড়ির কথা। সে-সব নিয়ে আমাদের মসকরা করবারও শেষ ছিল না। আমার দাদু যেমন হাঁটতে বেরুলেই, পাড়ার প্রথম মোড় ঘোরার পর থেকেই ঢাকা-বিক্রমপুর আর ভাওয়ালের রাস্তায় চলে যেতেন। সঙ্গে থাকা আমরা নাতি-নাতনিরা একবার জাস্ট নিজেদের মধ্যে চোখের ঈশারা করে নিতাম। বুড়ো আবার সেটা বুঝতে পেরে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকতেন। 

আসলে জীবন তো এরকমই। বয়ে যায়, বয়ে যায় আর শুধু বয়েই যায়। ভাঁড় ছেড়ে বাচ্চারাও যেমন চলে যায় পিগি ব্যাঙ্কের দুনিয়ায় আমরাও তেমনি তোশক-বালিশের তল ছেড়ে চলে আসি মিউচুয়াল ফান্ড-শেয়ার বাজারের দুনিয়ায়। চলতে চলতে ছেড়ে তো আসতেই হয় কত কিছু। সে-সব ভেবে পড়ে থাকলেও চলে না। আবার ভাবনারা স্বাভাবিকভাবেই চলেও আসে। মনখারাপ না করে তাই তাকে চেরিশ করলেই ভালো। 

একটা সময় ছিল যে প্রায় সকল বাঙালি বাড়িতে শীতকালে যেটুকু রোদ এসে পড়ত তাতে নিজের পিঠটুকু দেওয়া ছাড়া দাদু-ঠাকুমা-দিদিমারা আচারের বোতল কটিকেও নিয়ে বসতেন। পরম মমতায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সারাদিন ধরে সেগুলোকে রোদ খাইয়ে ঘরে তুলতেন। আসলে সে বছর বা তার আগের বছরই তো কত কষ্ট করে কত কিছু জোগাড় করে কত পরিশ্রম করে সে আচার বানাতে হয়েছে। তাই তাকে ভালোবেসে রোদ না খাওয়ালে চলে? যেমন গায়ে দেবার আগে রোদ খাওয়াতে হত লাল টুকটুকে লেপটাকেও। সারাটা বছর সিলিং বা কোনো অজ্ঞাত স্থানে কাটানোর পর সে ডানা মেলত শীতের নরম রোদে। তারপরে তাকে পড়াতে হত ওয়ার বা ওসাড়। কত পরিশ্রমে কত মমতায় ভালোবাসায় এইসব কাজ সাধারণত করতেন বাড়ির মহিলারা।

ঠিক সেরকমই ছিল আচার। শীতের শুরুতে যখন কুল নিয়ে রামুরা (আমাদের স্কুলগেটের বাইরের যে কোনো বিক্রেতাকে আমরা ওই নামেই ডাকতাম) বসা শুরু করত, সেই টসটসে লাল পাকা কুলগুলো যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকত। ওদের কাছে আচারও থাকত। বাড়ির আশপাশের কুলের গাছগুলোর কুল কিন্তু ওইভাবে ডাকত না। ওদিকে আবার সরস্বতী ঠাকুরের ভয়। অকুতোভয়রা কাঁচাপাকা কুলই তেল-লবণ-চিনি-লঙ্কা-কাসুন্দি দিয়ে মেখে খেত। চোখের সামনে সে-সব দেখে কতক্ষণ আর জিভের নোনাজল আটকে রাখা যায়? আর তারপর কোনোক্রমে একখানাও যদি পেটে গিয়েছে তা হলেই পরীক্ষা খারাপ হয়ে ফেল করবার ভয়। তখন, ঠাকুর আর কোনোদিন তোমার পুজোর আগে কুল খাব না। সেবারের মতো পাশ করিয়ে দেবার আকুল প্রার্থনা।

এসব কথা মা-ঠাকুমারা বোধ হয় জানতেন। তাই তো কোনো একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখতাম পাকা কুল চটকে তাকে হলুদ-লবণ দিয়ে মেখে চালনে করে দেওয়া আছে রোদে। সেটাকে ঘরে এনে রাখতে হবে বিকেলে। আর গোটা ঘর ভরে যাবে সেই পাকা কুলের বিটকেল গন্ধে। কিন্তু কিচ্ছু বলা যাবে না। কারণ জানি তো দুদিন পরই এই গন্ধ চলে যাবে। আর তারপর একদিন বাড়ি ম ম করতে থাকবে আচারের মশলা ভাজার গন্ধে। তার কদিন আগে থেকেই অবশ্য পরিষ্কার করে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হতে থাকবে মৌরি আর আরও অনেক মশলা। তারপর একদিন দুপুরে গোটা পাড়া মাতাল হয়ে উঠবে মৌরি আর সেইসব মশলা ভাজার গন্ধে। আর তারপরই উনুন থেকে নামবে কুল-জলপাই-চালতা ইত্যাদির সব আচার।  

তখনই এ-বাড়ি ও-বাড়ির জানালা থেকে গন্ধের উৎস বুঝে নিয়ে শুরু হয়ে যাবে আবদার। তারপর একসময় ছোটো ছোটো কাগজ কেটে তাতে আচারের কড়াই থেকে চামচে করে তুলে দেওয়া হবে ঈষৎ গরম গরম আচার। আহা…তার যা স্বাদ। এরপর গরমকালে বা যে কোনো সময় ডালের সাথে বা শেষ-পাতে ওই আচার যারা খায়নি তারা সেই মহার্ঘ বস্তুর মূল্য বুঝবে না। 

তাই তো ওই আচারের বোতলগুলোকে অত ভালোবেসে রোদ খাওয়াতেন দাদু-ঠাকুমারা। আর তারপর সেই টক স্বাদের আস্বাদ নিয়ে জিভের টাকরায় একটা টক করে আওয়াজ করে চোখটা একটু কুঁচকে নিয়ে মুখটা বিকৃত করে বলতেন—চুকা, যার মানে খুব টক। মনে রাখতে হবে যে এটা কিন্তু বিরক্তির প্রকাশ নয়, ভালোবাসার বা আদরের ডাক। এই ডাক যে কোনো টক বস্তু বা আচারের ক্ষেত্রেই তারা প্রযুক্ত করতেন। তা সে কুলই হোক অথবা চালতা বা জলপাই। অবশ্য দাদু-ঠাকুমা-দিদিমা বা উনাদের সমসাময়িক লোকেরা কোনোদিনই কুলকে কুল বলতেন না, বলতেন বোরোই।

এই আচার বা টকপ্রীতি এমনই যে দাদুকে দেখতাম যখন খুব অশক্ত হয়ে পড়েছেন, বাড়িতে টক জাতীয় কিচ্ছু নেই, বলতেন গোল লেবু এনে দিতে। তারপর চেয়ারে বসে বসেই লেবুগুলোকে খরখরে দেওয়াল বা পরিষ্কার মেঝেতে ঘষে কাউকে বলতেন ধুয়ে দিতে। তারপর সেগুলোকে নিয়ে একখানা কাঁচের বোতলে প্রথমে ভরতেন। তারমধ্যে প্রথমে একটু ‘ত্যাল’ আর চিনি দিতেন। তারপর ঠেসে ভরে দিতেন লবণ। কিছুদিন রোদ খাবার পর সে লেবুগুলো জারিয়ে চমৎকার স্বাদ নিত।

তবে এখন বাজারে কিন্তু কাঁচাপাকা লোকাল কুলের দেখা সাধারণ সবজির দোকানে মিলবে না। পাঠকগণ নিরাশ হতে পারেন। কিন্তু না, অতটাও নিরাশ হবার ব্যাপার নেই। বাজারের একটু আনাচে-কানাচে দেখবেন। দু-একজন মহিলা বা পুরুষ থাকেন যারা পাঁচ-দশটা ডিম, একটু শাক বা কচুর লতি নিয়ে এককোণে বসেন। তাদের কাছেই একমাত্র সময় মতো এই বস্তুটির দেখা মিলবে। তবে বেশি হাঁকডাক বা রোয়াবি করবেন না। কারণ মনে না ধরলে তারা আপনাকে পাত্তাই দেবে না। তাই মাসি বা দিদি বলে ডেকে ভালো করে কথা বলুন। প্রথমের দিকে একটু দাম বেশি নিলেও পরে এদের কাছে কোনো জিনিস আপনি খুবই অল্প দামে পেলে পেয়েও যেতে পারেন। যেমন সময় মতো এদের কাছেই পাবেন চালতা, জলপাই বা কতবেল ইত্যাদি সব দুষ্প্রাপ্য বস্তুর সন্ধান। 

তবে কয়েক বছর হল বাজারে একখানি নতুন কুলের আমদানি হয়েছে, নাম তার আপেলকুল। ফলের দোকানে পাওয়া যায়। স্বাদে সাধারণত মিষ্টি। তাই টকের খোঁজে আপনি কুল কিনতে চাইলে সে কুল না কেনাই ভালো। গোল কাঁচাপাকা কুলই আচার বা চাটনির জন্য আদর্শ। তবে সবই কমছে। কুলওয়ালাদের কাছেও আগের মতো মিষ্টি বনকুলের দেখা মেলে না। ডুয়ার্সের জঙ্গল একসময় শীতে এই কুলে ভরে থাকত। তবে কষ্ট পাবার কিছু নেই। ওই যে বলেছি, ছেড়ে আসার নামই জীবন।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২