কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, উপমহাদেশের প্রথম মহিলা চিকিৎসক – দীপক সাহা 

কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, উপমহাদেশের প্রথম মহিলা চিকিৎসক – দীপক সাহা 

শেয়ার করুন

ঊনবিংশ শতাব্দীতে চার দেয়ালের বাইরে বের হওয়া নারীদের জন্য ছিল দুঃসাধ্য। সেই শতাব্দীর মেয়ে হয়ে চলমান প্রথা ভাঙেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী। হয়ে ওঠেন উপমহাদেশের প্রথম নারী চিকিৎসক। সাফল্যের পথটা মসৃণ ছিল না তাঁর, ছিল কাঁটায় ভরা। রক্তচক্ষু দেখিয়েছে তৎকালীন সমাজ। সেই রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অনেকটা পথ একাই হেঁটেছেন কাদম্বিনী। সইতে হয়েছে শত অবহেলা। সমাজের মানুষের ধারণা ছিল, একটা মেয়ে কীভাবে ডাক্তার হয়? নেতিবাচক ধারণা ভেঙে বারবার আঙুল তোলা মানুষগুলোর প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী। হীরকখণ্ডের মতো ছিল কাদম্বিনীর বহুমুখী ব্যক্তিত্ব। প্রতিভা, অপরিসীম সাহস ও আত্মশক্তির বলে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একজন অত্যন্ত সফল মহিলা-চিকিৎসক রূপে, অসংখ্য প্রতিবন্ধকতাকে নির্ভয়ে জয় করে রেখেছিলেন অতুলনীয় কীর্তির স্বাক্ষর। 

কাদম্বিনী গাঙ্গুলী

কাদম্বিনী গাঙ্গুলী তাঁর সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা একজন আশ্চর্য মানুষ। ১৮৬১ সালে জন্ম হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, ডাক্তার নীলরতন সরকারের। আর এই বছরেই জন্ম কাদম্বিনী বসুরও, ১৮৬১ সালের ১৮ই জুলাই বিহারের ভাগলপুরে। পরিবারের আদি বাসস্থান বরিশালের চাঁদসীতে। ব্রাহ্মসমাজ সংস্কারক তাঁর পিতা ব্রজকিশোর বসু ভাগলপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। 

মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে কাদম্বিনী আসেন ভাগলপুর থেকে কলকাতায়, ভর্তি হন ‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে’। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন স্ত্রীশিক্ষায় প্রবল উৎসাহী ব্রাহ্মসমাজ নেতা, পণ্ডিত দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী। পরবর্তীতে হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় বেথুন স্কুলের সঙ্গে মিশে যায়। বেথুন স্কুল থেকে ১৮৭৭ সালে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু যখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসার উপযুক্ত হলেন, তখন দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি অনুযায়ী মহিলারা পরীক্ষায় বসতে পারেন না। এই সময়ে দেরাদুন থেকে চন্দ্রমুখী বসু নামে আর একজন মহিলাও এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসার জন্য আবেদন করেন। দ্বারকানাথ এই মেয়েদের জন্য প্রচণ্ড লড়াই করে, বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য স্যার আর্থার হবহাউসের সাহায্যে পরীক্ষায় বসার অনুমতি আদায় করেন। কাদম্বিনী প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন, মাত্র এক নম্বরের জন্য প্রথম বিভাগ পাননি। 

এরপর শুরু হল কাদম্বিনীর একটির পর একটি বাধা অতিক্রম করে ইতিহাস নির্মাণ করার ইতিহাস। মনে রাখতে হবে, সমস্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে তখনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা পড়ত না। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য তাঁর গভীর আগ্রহে প্রভাবিত হয়ে কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র কাদম্বিনীকে ছাত্রী তালিকাভুক্ত করে ১৮৭৯ সালে বেথুন কলেজের কার্যক্রম শুরু করে। স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর কাদম্বিনী দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ার। নারী শিক্ষার সমর্থক পিতা ব্রজকিশোর বসু সানন্দে কন্যার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। 

ডাক্তারি পড়ার জন্য কাদম্বিনী মেডিকেল কলেজে আবেদন করলেন, কিন্তু কলকাতা মেডিকেল কলেজ কাউন্সিল সম্মতি দিল না। আবার দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর সংগ্রাম শুরু হয় এবং ১৮৮৩ সালে তিনি অসাধ্য সাধন করেন। ১৮৮৩ সালের ২৯শে জুন সরকারিভাবে কাদম্বিনীকে মেডিকেল কলেজে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হল। যুগযুগান্তের এক রুদ্ধদ্বার খুলে গেল নারীদের জন্য। তাঁকে মাসিক কুড়ি টাকা জলপানিও দেওয়া হয়। মেয়েরাও যে বিজ্ঞানসাধনা করতে পারে তার উদাহরণ সৃষ্টি করলেন কাদম্বিনী।

ডাক্তারি পড়ার সময়ও নানা বাধা। কাদম্বিনীর মেডিকেল কলেজে পড়া নিয়ে সমাজে ভয়ংকর সমালোচনা হয়েছিল, অদ্ভুত বিরোধিতা ছিল ডাক্তারদের মধ্যেও। এই সময় আবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন সেই ঋষিতুল্য শিক্ষক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি। কাদম্বিনীর লড়াইয়ের শরিক হয়ে গেলেন সেই শিক্ষক। ভরসা পরিণত হল প্রণয়ে। সেই থেকে লড়াইয়ের সঙ্গীকে জীবনের সঙ্গী করে নিলেন কাদম্বিনী। বয়সে আঠারো বছরের তফাৎ, বিপত্নীক, কিছুই বাধা হলো না। ব্রাহ্মসমাজের নেতা, সমাজ সংস্কারক এই লোকটির মধ্যে কাদম্বিনী খুঁজে পেলেন এক প্রকৃত মানুষকে। মেডিকেল কলেজে নাম রেজিস্ট্রেশন করার এগারো দিন আগে (১২ই জানুয়ারীই, ১৮৮৩) কাদম্বিনী তাঁর শিক্ষক, বিখ্যাত সমাজ-সংস্কারক ও মানবদরদি সাংবাদিক,‌ বিপত্নীক, ঊনচল্লিশ বছর বয়স্ক, দুই সন্তানের পিতা দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীকে বিবাহ করেন। কাদম্বিনীর তখন ২১ বছর। অনেক নিকটজন এমনকি অনেক ব্রাহ্ম নেতাও এই বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। রাগ করে এই বিয়েতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিবনাথ শাস্ত্রী পর্যন্ত আসেননি।

স্বামীর উৎসাহ ও নিজের অদম্য চেষ্টায় কাদম্বিনী পেলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র ডিগ্রি। মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করার পর, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের সুপারিশে কেবলমাত্র মহিলা রোগীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত ডাফরিন হাসপাতালে কাদম্বিনী ৩০০টাকা মাসিক বেতনে যোগ দেন, তখনকার হিসেবে যা ছিল বেশ উচ্চ বেতন। কিন্তু এখানেও তিনি জাতি-বৈষম্যের শিকার হলেন। মেমসাহেব ডাক্তাররা কাদম্বিনীকে রোগীদের সরাসরি চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে, অন্য ধরনের কাজ করিয়ে নিত। অন্যদিকে, গোঁড়া হিন্দুরা তাঁর ডাক্তার হওয়াটাকে মোটেই ভালো চোখে দেখেনি, সমাজছাড়া জীব হিসেবে তাঁকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা-মসকরা, এমনকি চরিত্রহনন শুরু হয়। তখনকার ‘বঙ্গবাসী’ গোষ্ঠীর ‘বঙ্গবানিবাসী’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকার ডাকসাইটে সম্পাদক মহেশচন্দ্র পাল একটি কার্টুন (বারবণিতা ডাঃ কাদম্বিনী স্বামী দ্বারকানাথের নাক ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন) ছেপে কাদম্বিনীকে ‘স্বৈরিণী’-র সঙ্গে তুলনা করেন। দ্বারকানাথ অবিলম্বে পত্রিকা অফিসে হাজির হয়ে সম্পাদককে কার্টুনটি জল দিয়ে গিলে খেতে বাধ্য করেন ও আদালতে মামলা করেন। আদালতে সম্পাদকের ১০০টাকা জরিমানা আর ৬ মাসের জেল হয়। এক নারীর সম্মানরক্ষার্থে তাঁর স্বামীর করা ১৮৯১ সালের এই মামলাটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। 

একটা গল্প আছে–বড়ো বাড়ির সবার আদরের মেয়ে অসুস্থ। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার আনতে ছুটল গাড়ি। গাড়ি থেকে যখন কাদম্বিনী নামলেন, বাড়ির সবাই বলে উঠল, ‘ওমা, ডাক্তার কই? এ তো মেয়ে!’ এত কিছুর পরেও কিন্তু লোকের মন থেকে তাঁর দক্ষতার ব্যাপারে ভুল ধারণা ভাঙা যাচ্ছিল না। কাদম্বিনী বুঝতে পারেন, বিলিতি ডিগ্রি না-হলে এইসব বাধা বা দ্বিধা দূর করা যাবে না।

দ্বারকানাথের অতুলনীয় উৎসাহ, প্রেরণা ও সহায়তায় এক বছর বয়সের কনিষ্ঠ পুত্রসহ পাঁচটি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েকে স্বামী এবং সৎ কন্যা বিধুমুখীর তত্ত্বাবধানে রেখে এক রবিবারের সন্ধ্যায় (২৬ শে ফেব্রুয়ারী, ১৮৯৩) কাদম্বিনী জাহাজে বিলেত যাত্রা করেন। লন্ডন পৌঁছনোর কুড়ি দিনের মধ্যে কাদম্বিনী তাঁর অস্থায়ী ঠিকানা 35, Blackfield road, Mydavelle, London থেকে ক্লাস করা শুরু করেন। তিনি পরতেন শাড়ি, ফুলহাতা ব্লাউজ, স্কার্টব্লাউজ। সেই সময় বিলেতের বুকে বিলিতি পোশাককে অগ্রাহ্য করে ভারতীয় পোশাকে ক্লাস করাটা কত কঠিন ছিল, সেটা আজ হয়তো বোঝা সম্ভব নয়। তিনি হলেন বিলিতি ডিগ্রিধারী (LRCP, LRCS, LFPS) প্রথম ভারতীয় পেশাদার মহিলা ডাক্তার। এক ইতিহাস সৃষ্টি করলেন।    

তখন দেশীয় মহিলা ডাক্তারের অসম্ভব প্রয়োজন ছিল, তাই ভারতে ফেরার পর কাদম্বিনীকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নীলরতন সরকার, জে এন মিশ্র, প্রাণকৃষ্ণ আচার্য ইত্যাদি সুবিখ্যাত চিকিৎসকদের সঙ্গে তখন তাঁর নাম উচ্চারিত হত। তাঁর খ্যাতির জন্য তিনি ১৮৯৫ সালে সুদূর নেপাল থেকে ডাক পান রাজমাতার চিকিৎসার জন্য, নেপালে একমাস থেকে তিনি রাজমাতাকে সুস্থ করে তোলেন। দীর্ঘদিন নেপালের রাজপরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল তাঁর, কৃতজ্ঞ রাজপরিবার থেকে পেয়েছিলেন প্রচুর উপহার—সোনা ও মুক্তার গয়না, রূপার বাসন, বহুমূল্য পোশাক, হাতির দাঁত, একটা সাদা গোলগাল ছোট্ট টাট্টু ঘোড়া—রায় ও গাঙ্গুলী পরিবারের বাচ্চারা মহানন্দে তার পিঠে চড়ত। 

দ্বারকানাথ-কাদম্বিনীর ছয় নম্বর গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনের বাড়ির ছাদে মাঘোৎসবের প্রস্তুতি হিসেবে গান শিখতে আসতেন বিভিন্ন বয়সের ছেলেমেয়েরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন নরেন্দ্র দত্ত। বেহালা হাতে এসে বসতেন সত্যজিতের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর। সেই সময়ের দুই বিখ্যাত পরিবার, রায় পরিবার ও গাঙ্গুলি পরিবারের মধ্যে গড়ে ওঠা বহুকালের বন্ধুত্ব আরও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার বন্ধন রচনা করে। ধীরে ধীরে বাংলার দুই নামকরা বাড়ির মধ্যে সাংস্কৃতিক বাঁধনের সঙ্গে জীবনের গাঁটছড়াতেও বন্ধন রচিত হয়। বাঁধা পড়েন উপেন্দ্রকিশোর দ্বারকানাথের কন্যা বিধুমুখীর সঙ্গে। উপেন্দ্রকিশোরের সাথে বিবাহ হয় বিধুমুখীর। বিশেষ স্নেহাষ্পদ নাতি সুকুমারের সন্তান সত্যজিৎ জন্মায় তাঁর তত্ত্বাবধানে, ১৯২১ সালের ২রা মে।

লীলা মজুমদার ‘উপেন্দ্রকিশোর’ বইতে লিখেছেন, “সাজসজ্জাতেও কাদম্বিনী ছিলেন তখনকার আধুনিকা। তখনকার মহিলারা কৃত্রিম কিছু ব্যবহার করতেন না কিন্তু ভারতের ভিক্টোরীয় যুগের এই আধুনিকা মহিলার চালচলন সাজসজ্জাতে ভারি একটা সম্ভ্রান্ত রুচির সঙ্গে গাম্ভীর্যের মিশ্রণ ছিল। …উপেন্দ্রকিশোরের পরিবারের ওপর তাঁর যে একটা গভীর প্রভাব থাকবে, এতো বলাই বাহুল্য।” 

ডাক্তারির পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজে ও রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিতেও দেখা গেছে তাঁকে সারা জীবন। তিনি কখনও ভুলে যাননি সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি তাঁর দায়িত্বের কথা। ১৮৮৫ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বারকানাথ কংগ্রেসে নারীদের প্রতিনিধিত্বের দাবি তোলেন, ফলে কাদম্বিনীর নেতৃত্বে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ৬ জন নারী কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের অগ্রজা স্বর্ণকুমারী দেবী ও তাঁর কন্যা সরলা দেবী চৌধুরাণী ছিলেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৯০ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে কাদম্বিনী ইংরাজিতে ধন্যবাদ (Vote of Thanks) দেন। কাদম্বিনী-ই কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রথম কোনো নারী বক্তা। মাতৃভাষার মতো স্বচ্ছন্দে ও নিখুঁত উচ্চারণে প্রদত্ত তাঁর বক্তব্য সকলের মনে দাগ কেটেছিল। রাজনীতি ও নারী আন্দোলনের নেত্রী আনি বেসান্তের মতে, ‘The first woman who spoke from the Congress platform, is a symbol that India’s freedom would uplift India’s womanhood.’

সেই সময় আসামের চা-বাগানগুলিতে বাগিচা-শ্রমিকদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাত ইংরেজ বাগান-মালিকরা। দ্বারকানাথ আসামের চা বাগানের শ্রমিকদের কাজে লাগানোর পদ্ধতির তীব্র নিন্দা করেছিলেন। স্বামীর সঙ্গে কাদম্বিনীও এই ব্যাপারে প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। ভারতের বিভিন্ন খনিতে কর্মরত নারীদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যহানির ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে এই বিষয়ে কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করার জন্যে পরামর্শ দেন এই দম্পতি। ইউরোপীয় মালিকদের অত্যাচারের খবর দ্বারকানাথের প্রতিষ্ঠিত এবং সম্পাদিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সঞ্জীবনী’তে প্রকাশিত হয় এবং এর ফলে গণসচেতনতার মাধ্যমে এক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ১৯২২ সালে সরকার বিহার ও ওড়িশার খনিগুলিতে কর্মরত মহিলা শ্রমিকদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি নিয়োগ করে। এই কমিটির সদস্যা হিসেবে কাদম্বিনী মহিলা শ্রমিকদের দুর্দশা সরেজমিনে তদন্ত করে দেখার জন্যে বিহার ও ওড়িশায় যান।

১৮৯৮ সালের ২৭শে জুন মৃত্যু হয় দ্বারকানাথের। এই মহাবিচ্ছেদের পরেও প্রায় চব্বিশ বছর কাদম্বিনী ঘরে ও বাইরে তাঁর বিপুল কর্মযজ্ঞ অব্যাহত রাখেন। আটটি ছেলেমেয়ের প্রত্যেককে কৃতী মানুষ করে তোলেন, তাদের বিয়ে দেন, নাতি ও নাতনিদের নিয়ে তাঁর বিশাল সংসার ছিল জমজমাট। জীবনের শেষ দিনটাতেও কাদম্বিনী রোগীর বাড়ি গেছেন। জটিল অস্ত্রোপচার করেছেন। ঘরে এসে পরিতৃপ্ত কাদম্বিনী পুত্রবধূকে বলেছিলেন, সার্থক ও সুন্দর দিন ছিল সেটা। তাঁর এত ভাল লাগছিল যে তিনি শূন্যে উড়ে বেড়াতে চাইছিলেন। পুত্রবধূর সাথে কথা বলার কিছুক্ষণ পরই স্নান করতে গিয়ে কঠিন সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান কাদম্বিনী। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর হাতব্যাগে পাওয়া যায় পঞ্চাশটি টাকা। তাঁর শেষ রোজগার। দিনটি ছিল ৩ রা অক্টোবর, ১৯২৩। শেষ হল ব্যতিক্রমী এক পথ-প্রদর্শকের অভূতপূর্ব জীবন। 

সমাজের কলঙ্ক গায়ে মেখেও সংকল্পে ছিলেন অটুট। তাঁর থেকে সাহস পেয়ে, তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বহু নারী এগিয়ে এসেছেন নিষেধের বাধা ঠেলে। এগিয়েছে সমাজ, এগিয়েছে দেশ। ভারতের মহিলাদের কাছে তিনি পথপ্রদর্শক। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি, শুধু চিকিৎসক নন, এক লড়াই, এক সংস্কারক, এক প্রেরণা। কিন্তু চরম আক্ষেপের বিষয়, তাঁর স্মৃতিতে হয়নি মেডিকেল কলেজ, রাস্তা, মূর্তি কোনও কিছুই। তিনি আজ বিস্মৃতির অন্ধকারে।             

ঋণস্বীকার – বিভিন্ন পত্রপত্রিকা    

ছবি – আন্তর্জাল           

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২