জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ১১ )

জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ১১ )

শেয়ার করুন

মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

পর্ব – এগারো

এই ঘটনার প্রায় ষাট বছর পরে আমার পঞ্চম উপন্যাস ‘কলেরার সময়ে প্রেম’ লেখার জন্য যখন স্মৃতির অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তখন একদিন বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তাঁদের টেলিগ্রাফ অপারেটরের পেশায় এক অফিসের সঙ্গে অন্য অফিসের সংযোগ করার যে প্রক্রিয়া তার কোনো নির্দিষ্ট পরিভাষা আছে কিনা। উত্তর দেওয়ার জন্য বাবাকে মুহূর্তও ভাবতে হল নাঃ ‘enclavijar’[১] (ইংরাজি ভাষায় pegging in)। শব্দটি অভিধানে আছে। আমি ঠিক যে অর্থে খুঁজছি সরাসরি তা না হলেও যথাযোগ্য মনে হল। কারণ, এক অফিসের সঙ্গে অন্য অফিসের যোগাযোগ স্থাপনের জন্য টেলিগ্রাফের টার্মিনালে একটা বোর্ডের উপর ‘clavija’ (peg) বসানো হয়। এই উপন্যাস লেখার কথা বাবাকে আমি কখনও বলিনি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে যখন এক সংবাদপত্র থেকে সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তাঁকে প্রশ্ন করা হয় যে তিনি কখনও কোনো উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলেন কিনা, তিনি বলেন যে হ্যাঁ, তাঁর ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সে ইচ্ছা ত্যাগ করেন যখন আমি তাঁকে ‘enclavijar’ ক্রিয়াপদটি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। কারণ তাতেই বুঝে নিয়েছিলেন, যে বইটা তিনি লিখতে চান, সেটা আমি-ই লিখছি। 

এই কথা প্রসঙ্গে বাবা একটি গোপন তথ্য প্রকাশ করেছিলেন যা হয়তো আমাদের জীবনকে সম্পূর্ণ পালটে দিতে পারত। ছ’মাস বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে-বেড়ানোর পর মা যখন সান হুয়ান দেল সেসার শহরে রয়েছেন, গাব্রিয়েল এলিহিয়ো বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারলেন যে মিনা আবার পুরো পরিবার নিয়ে পাকাপাকিভাবে বাররানকিয়াসে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অবশ্য মেদার্দো পাচেকোর ঘটনাটা যদি ধামাচাপা পড়ে গিয়ে থাকে, তবেই। বাবার কাছে কথাটা অবিশ্বাস্য ঠেকেছিল। কেন-না এটা ছিল সেই সময় যখন দুরবস্থা কেটে গিয়ে কলা কোম্পানির সর্বময় কর্তৃত্ব তাদের প্রতিশ্রুত ভূমিতে স্বপ্নরাজ্য প্রতিষ্ঠা সবে শুরু করেছে। তবে তার সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে মার্কেস ইগুয়ারান পরিবারের যা জেদ তাতে বাজপাখির ছোঁ থেকে মেয়েকে রক্ষা করার জন্য নিজেদের সুখকে জলাঞ্জলি দিতেও তাঁরা পিছ-পা হবেন না। তাই খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে গাব্রিয়েল এলিহিয়ো বাররানকাস থেকে কুড়ি লিগ মতো দূরের রিওয়াচা শহরে নিজের বদলির দরখাস্ত করলেন। কিন্তু সেখানে তখন জায়গা ফাঁকা ছিল না। তবে তাঁর অনুরোধের কথা মাথায় রাখবেন বলে কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতি দিলেন।

অন্যদিকে লুইসা সান্তিয়াগা মায়ের মনের ইচ্ছেটা পুরোপুরি ধরতে পারছিলেন না। আবার ব্যাপারটাকে অগ্রাহ্যও করতে পারছিলেন না। কারণ তিনি খেয়াল করে দেখলেন যে বাররানকাসের যত কাছে তাঁরা এগোচ্ছেন মাকে তত বেশি শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন লাগছে। চোন, যে কিনা সবার আস্থাভাজন, সেও কোনো সঠিক ধারণা দিতে পারল না। সত্যিটা জানার জন্য লুইসা একদিন কথা প্রসঙ্গে মাকে বললেন যে বাররানকাসে থাকতে তাঁর দারুণ ভালো লাগে। উত্তরে মা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত চুপ করে রইলেন। আর তাতেই মেয়ে ভেবে নিলেন সত্যিটা প্রায় ধরে ফেলেছেন। তখন তিনি এত অস্থির হয়ে পড়লেন যে শেষ পর্যন্ত রাস্তার ধারের এক যাযাবর মেয়ের কাছে তাস দিয়ে ভাগ্য-গণনা করাতে গেলেন। কিন্তু সেও তাঁর বাররানকাসে থাকার ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু বলতে পারল না। কিন্তু মেয়েটি তাঁকে অন্য অনেক কিছু বলে দিল। সে বলল যে লুইসা কোনো সমস্যা ছাড়া এক দীর্ঘ ও সুখী জীবন কাটাবেন আর যে মানুষটার সঙ্গে থাকবেন তাকে তিনি খুব একটা ভালো করে চেনেন না। তবে সেই মানুষটা তাঁকে আমৃত্যু ভালোবাসবে। তারপর সেই লোকটার যে বর্ণনা সে দিল তাতে লুইসার ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। বর্ণনার অনেক কিছুই মিলে গিয়েছিল তাঁর প্রেমিকের সঙ্গে, বিশেষ করে স্বভাবের দিকটা। সবশেষে মেয়েটি ভবিষ্যৎবাণী করল, সেই লোকের সঙ্গে তাঁর ছ’টি সন্তান হবে। “আমি তো ভয়েই মরি”, মা বললেন, যখন প্রথম এই ঘটনাটা আমায় বলছিলেন। কিন্তু বলার সময় একবারও ভাবলেন না যে বাস্তবে সেই সন্তান সংখ্যা আরও পাঁচটা বেশি। যাই হোক, লুইসা ও গাব্রিয়েল দুজনেই এই গণনা নিয়ে এতটা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন যে তাঁদের টেলিগ্রাফ-যোগাযোগ তখন থেকে আর কল্পরাজ্যে পাখা মেলে উড়ে বেড়াল না, বরং তা হয়ে উঠল অনেক বেশি শৃঙ্খলাবদ্ধ, বাস্তববোধ সম্পন্ন ও প্রবল শক্তিশালী। তাঁরা স্থির করলেন বিয়ে করবেন। অন্য কারুর সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই। এমনকি তার জন্য বিভিন্ন তারিখ ও উপায়ও ঠিক করে ফেললেন। দুজনেই একটা ব্যাপারে তখন সমান দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, যেখানে যেমনভাবেই দেখা হোক না কেন, আবার দেখা হলেই তাঁরা বিয়ে করবেন। 

এই সম্পর্কের প্রতি লুইসার নিষ্ঠা ছিল সুগভীর। ফোনসেকা শহরে যখন ছিলেন একটি নাচের আসরে যোগ দিতে তিনি ইতস্তত করছিলেন। কারণ একটাই, প্রেমিকের সম্মতি নেওয়া হয়নি। গাব্রিয়েল এলিহিয়ো তখন ১০৪ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে হ্যামকে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। এমন সময় একটি জরুরি টেলিগ্রাম আসার শব্দ শোনা গেল। টেলিগ্রামটা এসেছে ফোনসেকা শহরে তাঁর সহকর্মীর কাছ থেকে। নিরাপত্তা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার জন্য লুইসা জানতে চাইলেন অন্য প্রান্তে কে আছেন? আনন্দিত হওয়ার চেয়েও বেশি অবাক হয়ে গাব্রিয়েল তাঁদের একটি সংকেতবাক্য ব্যবহার করলেন, ‘ওকে বলো যে আমি তার ধর্ম-ছেলে।’ আমার মা বুঝে নিলেন সেই সংকেত। তারপর তিনি নাচের আসরে গেলেন। সেখানে ছিলেন একেবারে সকাল সাতটা পর্যন্ত। তারপর তাড়াহুড়ো করে জামাকাপড় পালটে গির্জায় গেলেন, নাহলে প্রার্থনায় পৌঁছাতে দেরি হয়ে যেত। 

বাররানকাসে পৌঁছে লুইসারা শত্রুতার কোনো চিহ্ন তো খুঁজেই পেলেন না, এমনকি বুঝতে পারলেন যে সেই দুর্ঘটনার সতের বছর বাদে মেদার্দো পাচেকোর আত্মীয়দের মধ্যে আসলে এক ধরনের খ্রিস্টানসুলভ ক্ষমা ও বিস্মৃতির বোধ কাজ করছে। সেখানকার লোকজন এই মা-মেয়েকে এত আপন করে নিল যে এবারে লুইসা নিজেই ভাবতে শুরু করলেন আরাকাতাকার ওই গরম, ধুলো, রক্তাক্ত শনিবার ও স্কন্দকাটা ভূতেদের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এই পাহাড়ি মরুদ্যানে যদি আবার ফিরে আসা যেত। শেষ পর্যন্ত এ কথা গাব্রিয়েল এলিহিয়োকেও বলে ফেললেন, অবশ্য যদি গাব্রিয়েলের বদলি সম্ভব হয়, তবেই। আর গাব্রিয়েলও রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি জানতে পারলেন যে বাররানকাসে চলে আসার গল্পটা আসলে একেবারেই ভিত্তিহীন। তাছাড়া মিনা ছাড়া আর কেউ তা চায়ও না। মিনা তাঁর ছেলে হুয়ান দে দিয়োসের চিঠির প্রত্যুত্তরে যে চিঠি লিখেছিলেন তাতেই এটা পরিষ্কার হয়ে গেল। মেদার্দো পাচেকোর মৃত্যুর পরে কুড়ি বছরও পার হয়নি, তাই ভয় পেয়েই হুয়ান দে দিয়োস মাকে চিঠিতে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর অসম্মতি জানিয়েছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল গুয়াখিরাদের আইন থেকে কেউ পালাতে পারে না। আর সেই ধারণা এত গভীর ছিল যে অর্ধ-শতাব্দী পরে যখন তাঁর ছেলে এদুয়ার্দো বাররানকাসে পাবলিক হেলথ সার্ভিসে যোগ দিতে চায় তখন তিনি বিরোধিতা করেছিলেন। 

কিন্তু এত সব ভয়-ভাবনা সত্ত্বেও মাত্র তিন দিনের মধ্যে পরিস্থিতি পুরো পালটে গেল। যে মঙ্গলবারে লুইসা গাব্রিয়েল এলিহিয়োকে জানাল যে মিনা বাররানকাসে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছে না, সেদিনই গাব্রিয়েলের কাছে খবর এল রিওয়াচার টেলিগ্রাফ অপারেটর হঠাৎ মারা যাওয়ায় তার জায়গা খালি হয়েছে। ঠিক তার পরের দিন মুরগি কাটার কাঁচি খোঁজার জন্য মিনা ভাঁড়ার ঘরের ড্রয়ার খালি করতে গিয়ে হঠাৎই ইংলিশ বিস্কুটের টিনের ঢাকনা খুললেন আর দেখে ফেললেন লুকিয়ে রাখা মেয়ের সব প্রেমের টেলিগ্রাম। তিনি এত রেগে গিয়েছিলেন যে মেয়েকে শুধু এটুকুই বলতে পারলেন, ‘ঈশ্বর আর সবকিছু ক্ষমা করে দেন, একমাত্র অবাধ্যতা ছাড়া।’ খুব খারাপ অবস্থায় পড়লে তবেই তিনি এই কথাটা বলতেন। তারপর সেই সপ্তাহের শেষে তাঁরা রিওয়াচা চলে গেলেন যাতে রবিবারের নৌকায় সান্তা মার্তায় পৌঁছানো যায়। দুজনের কারুরই ধারণা ছিল না ফেব্রুয়ারি মাসের ঝড়ের রাতে কী ভয়ংকর অবস্থা হতে পারে। মা তখন পরাজয়ের গ্লানিতে বিধ্বস্ত আর মেয়ে খুব ভয় পেলেও মনে মনে খুশি।

চিঠিগুলো দেখার পর মিনা যে স্থৈর্য হারিয়ে ফেলেছিলেন স্থলভূমির কাঠিন্যে পা দিয়ে আবার তা ফিরে পেলেন। পরের দিন লুইসাকে ছেলে হুয়ান দে দিয়োসের তত্ত্বাবধানে রেখে দিয়ে একাই আরাকাতাকায় চলে গেলেন। এই ভেবে যে প্রেমের শয়তানের হাত থেকে নিশ্চিতভাবে তিনি তাঁর মেয়েকে উদ্ধার করতে পেরেছেন। অথচ বাস্তবটা ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সেই সময় গাব্রিয়েল এলিহিয়ো যখনই পারতেন আরাকাতাকা থেকে সান্তা মার্তায় চলে আসতেন। এদিকে হুয়ান দে দিয়োস যখন দিলিয়া কাবাইয়েরোর প্রেমে পড়েছিলেন বাবা-মায়ের দিক থেকে একই রকম বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাই বোনের সমস্যায় তিনি কোনো পক্ষের হয়ে দাঁড়াতে চাইলেন না। কিন্তু আসল সত্যিটা হল বোনের প্রতি ভালোবাসা আর বাবা-মায়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা–এই দুয়ের দ্বন্দে তিনি আটকে পড়েছিলেন। আর শেষ পর্যন্ত সততার পরাকাষ্ঠাকেই বেছে নিলেন। তাই নিজের বাড়ির বাইরে তিনি এই প্রেমিক-প্রেমিকাকে দেখা করার অনুমতি দিলেন, তবে কখনোই একা নয় আর তাঁর জ্ঞাতসারে তো নয়ই। তাঁর স্ত্রী দিলিয়া কাবাইয়েরো অতীতের ঘটনা ভুলে গেলেও মন থেকে ক্ষমা করে দিতে পারেননি। নিজে ঠিক যেভাবে শ্বশুর-শাশুড়ির নজরদাড়ি এড়িয়ে প্রেম করেছিলেন তেমনভাবেই ননদের জন্য অভ্রান্ত ও সুচতুর সব কৌশল উদ্ভাবন করতে লাগলেন। গাব্রিয়েল ও লুইসা প্রথমে দেখা করতেন বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে। তারপর ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে, তবে জনবহুল নয় এমন সব জায়গায়। সব শেষে সাহস করে নিজের বাড়িতে। তবে বাড়ির ভিতরে দেখা না করার নির্দেশটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। তাই হুয়ানিতো যখন বাড়ি থাকতেন না তখন জানলা দিয়ে গল্প করতেন–লুইসা বসার ঘরের মধ্যে আর গাব্রিয়েল রাস্তায় দাঁড়িয়ে। জানলাটা যেন তৈরিই হয়েছিল নিষিদ্ধ প্রেমের জন্য। তার পুরোটায় আন্দালুসিয়ার গ্রিলের কারুকার্য আর তার গা বেয়ে উঠেছে এক লতাবিতান, নিদ্রালস রাতে মাঝে মাঝেই যার থেকে ভেসে আসত জুঁই ফুলের সুবাস। দিলিয়া আগে থেকে সব ব্যবস্থা করে রাখতেন। এমনকি কয়েকজন প্রতিবেশীকেও বলা ছিল, বিপদ বুঝলেই সংকেত অনুযায়ী শিস দিয়ে সতর্ক করে দেবে। কিন্তু একদিন রাতে এই সমস্ত বন্দোবস্ত অকৃতকার্য হল এবং হুয়ান দে দিয়োস সব কিছু জেনে গেলেন। দিলিয়া তখন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এই প্রেমিক-জুটিকে বসার ঘরের ভিতরে আহ্বান জানালেন ও সব জানলা খুলে দিলেন, যাতে তাঁদের প্রেমালাপ গোটা বিশ্ব জানতে পারে। আমার মা কোনোদিন তাঁর ভাইয়ের সেই স্বস্তির উচ্চারণ ভুলতে পারেননি, ‘উঃ! বাঁচলাম।’ 

এই সময়েই গাব্রিয়েল এলিহিয়ো রিওয়াচায় পোস্টিং পেলেন। নতুন এক বিচ্ছেদের আশঙ্কায় আমার মা গেলেন সেখানকার গির্জার যাজক ও মনসিগনর[২] পেদ্রো এস্পেখোর কাছে, তাঁকে অনুরোধ করতে, যদি তিনি অভিভাবকের অমতে তাঁদের বিয়ে দিতে রাজি হন। এই যাজক খুবই বিখ্যাত ছিলেন এবং লোকে তাঁকে সাধু বলে মনে করত। এমনকি অনেকেই তাঁর প্রার্থনাসভায় যেত তিনি সত্যি সত্যি মাটি থেকে কয়েক সেন্টিমিটার উঁচুতে উঠে যান কিনা তা দেখতে। লুইসা সান্তিয়াগা যখন তাঁর কাছে সাহায্য চাইলেন, তিনি আরেকবার প্রমাণ করলেন যে বুদ্ধি হল সাধুতার অন্যতম অপরিহার্য অংশ। তিনি কোনো পরিবারের ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে রাজি হলেন না ঠিকই, বিশেষত যে পরিবার নিজেদের গোপনীয়তার ব্যাপারে এত বেশি সচেতন। কিন্তু কুরিয়ার (curia)[৩] মাধ্যমে আমার বাবার পরিবার সম্বন্ধে গোপনে অনুসন্ধান করলেন। সিন্সের যাজক আর্হেমিরা গার্সিয়ার স্বাধীনচেতা জীবন-যাপনকে বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না এবং ভদ্রজনোচিতভাবে তাঁকে উত্তরে লিখলেন, ‘পরিবারটি খুব ঈশ্বর ভক্ত না হলেও যথেষ্ট সম্মানযোগ্য।’ তখন পেদ্রো এস্পেখো প্রেমিক-প্রেমিকা দুজনের সাথে প্রথমে একসঙ্গে ও পরে আলাদা আলাদা ভাবে কথা বললেন। তারপর নিকোলাস ও ত্রাঙ্কিলিনাকে চিঠিতে নিজের উপলব্ধির কথা লিখে পরিষ্কারভাবে জানালেন যে এমন কোনো মানুষী শক্তি নেই যা এই প্রেমের সুদৃঢ় বন্ধনকে ধ্বংস করতে পারে। আমার দাদু-দিদিমা ঈশ্বরের শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে এই বেদনাদায়ক অধ্যায়ের পাতা উলটে গেলেন এবং হুয়ান দে দিয়োসকে পুরো দায়িত্ব দিলেন সান্তা মার্তায় বিয়ের আয়োজন করতে। তবে নিজেরা বিয়েতে আসেননি। ফ্রান্সিসকা সিমোদোসেয়াকে ধর্ম-মা হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। 

আমার বাবা-মা’র বিয়ে হয়েছিল ১৯২৬ সালের ১১ জুন সান্তা মার্তার এক ক্যাথিড্রালে, নির্দিষ্ট সময়ের ৪০ মিনিট দেরিতে। কারণ কনে তাঁর বিয়ের তারিখ ভুলে গিয়েছিলেন আর তাই সকাল আটটা বাজার পর তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হয়। সেদিন রাতেই তাঁরা আবার সেই ভয়ংকর নৌকাযাত্রায় সামিল হন। গাব্রিয়েল এলিহিয়োকে শীঘ্রই রিওয়াচার অফিসে কাজে যোগ দিতে হবে। তাই বিয়ের প্রথম রাত কাটল নৌকায়, সমুদ্রপীড়ায় বিদ্ধস্ত এক প্রেমহীন রজনী।

আমার মা সারাজীবন মনে রেখেছিলেন সেই বাড়িটির কথা, যেখানে মধুচন্দ্রিমা যাপন করেছিলেন। সেই স্মৃতি মায়ের মনে এতটাই দৃঢ়প্রোথিত ছিল যে আমরা, মায়ের জ্যেষ্ঠ সন্তানেরা, সে বাড়ির প্রতিটি ঘর নিখুঁতভাবে বর্ণনা করতে পারতাম। যেন মনে হবে আমরা নিজেরাই সেখানে বাস করেছি। এখনও অবধি সেই ভুল স্মৃতি আমার মনে রয়ে গেছে। যদিও আমার ষাট বছর বয়সের কিছু আগে যখন প্রথমবার গুয়াখিরা উপদ্বীপে যাই ও সেখানকার টেলিগ্রাফ অফিসটা দেখি, সেদিন হতবাক হয়ে দেখেছিলাম যে আমার স্মৃতির সঙ্গে সেই বাড়ির কোনো মিল-ই নেই। আর যে আদর্শ রিওয়াচার ছবি ছোটোবেলা থেকে মনের মধ্যে সঞ্চিত ছিল, বালিমাখা রাস্তাগুলো সোজা গিয়ে মিশছে কাদার সমুদ্রে, তা আসলে দাদু-দিদিমার কাছে শোনা কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু সত্যি বলতে কি, আজ যখন রিওয়াচার কথা ভাবি, তখন বাস্তবের শহরটাকে নয়, বরং দেখি সেই জায়গাটা যাকে পাথরের পর পাথর সাজিয়ে আমার কল্পনায় আমি গড়ে তুলেছিলাম। 

বিয়ের দু’মাস পরে হুয়ান দে দিয়োস আমার বাবার কাছ থেকে একটা টেলিগ্রাম পেলেন–লুইসা সান্তিয়াগা গর্ভবতী। খবরটা আরাকাতাকার বাড়ির ভিত পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিল। যদিও মিনা তখনও পর্যন্ত তাঁর তিক্ততা কাটিয়ে উঠতে পারেননি, তবুও তিনি এবং কর্নেল শেষ পর্যন্ত সবকিছু মেনে নিলেন যাতে সদ্য বিবাহিত মেয়ে-জামাই তাঁদের কাছে ফিরে আসে। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ ছিল না। বেশ কয়েক মাস ধরে ভদ্র ও যুক্তিসঙ্গত প্রতিবাদের পর তবেই গাব্রিয়েল এলিহিয়ো রাজি হলেন যে তাঁর স্ত্রী বাপের বাড়িতে সন্তান প্রসব করবে।

এর কিছুদিন পরে স্টেশনে নিতে এসে গাব্রিয়েল এলিহিয়োকে আমার দাদু যে কথা বলেছিলেন তা বংশের ইতিহাসে সোনার জল দিয়ে বাঁধানো থাকবেঃ ‘তোমার খুশির জন্য যা যা দরকার সব কিছু করতে আমি প্রস্তুত।’ দিদিমা তাঁর নিজের শোবার ঘর সারিয়ে মেয়ে-জামাইকে সেখানে রাখলেন। তারপর সেই বছরেরই পরের দিকে গাব্রিয়েল টেলিগ্রাফ অপারেটরের ভালো চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে নিজের প্রতিভাকে উৎসর্গ করলেন এমন এক বিজ্ঞানের সাধনায় যা তখন উন্নতি নয়, অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে: হোমিওপ্যাথি। যাই হোক, আমার দাদু কৃতজ্ঞতা বা অনুশোচনা যে-কোনো কারণেই হোক সরকারের সঙ্গে কথা বলে আরাকাতাকায় আমরা যে রাস্তায় বাস করতাম তার নামকরণ করলেন মনসিগনর এস্পেখো এভিনিউ। এখনও সেই নামই আছে।

এইভাবে সাত ছেলে ও চার মেয়ের প্রথমটির জন্ম হয় ১৯২৭ সালের ৬ মার্চ, রবিবার, সকাল নটার সময়। আর বাইরে তখন অসময়ের অঝোর বর্ষণের মধ্যে আকাশে উদিত হচ্ছে বৃষরাশি। জন্মের সময় গলায় নাড়ি জড়িয়ে আমি প্রায় মরেই যাচ্ছিলাম। কেন-না আমাদের পরিবারের ধাত্রী সান্তোস বিয়েরো সংকট মুহূর্তে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন। তবে ফ্রান্সিসকা সিমোদোসেয়া আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠে বাড়িতে যেন আগুন লেগেছে এমনভাবে চিৎকার করতে করতে সদর দরজার দিকে ছুটে যান:

—‘ছেলে হয়েছে, ছেলে!’ আর তারপরই সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘শিগগির চলো, ওর শ্বাস আটকে গেছে।’

বাড়িতে উৎসবের সময় রাম খাওয়া হত না ঠিকই, কিন্তু নবজাতকের শুশ্রুষায় রাম দিয়ে মালিশ করা হত। মিসিয়া হুয়ানা দে ফ্রেইতেস, যিনি সেই সময় ঘরে উপস্থিত ছিলেন, আমাকে বহুবার বলেছেন যে নাড়ি জড়িয়ে নয় মায়ের শোয়ার ধরণের জন্যই সমস্যা হয়েছিল। একেবারে শেষ সময়ে মা অবস্থান ঠিক করে নিয়েছিলেন, কিন্তু আমাকে বাঁচিয়ে তোলা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। আর তাই ফ্রান্সিসকা জরুরি প্রয়োজনের জন্য রাখা পবিত্র জল আমার গায়ে ঢেলে দেন। আমার নাম হওয়া উচিত ছিল ওলেগারিয়ো। সেই দিনটা ছিল ওই সাধুর দিন। কিন্তু তখন কারুর হাতের কাছে সাধুদের ক্যালেন্ডার ছিল না। তাই তাড়াহুড়োয় আমার প্রথম নাম দেওয়া হয় বাবার নামে ও দ্বিতীয় নাম হয় আরাকাতাকার প্রধান সাধু হোসে দ্য কার্পেন্টারের নামে, যাঁর মাস হচ্ছে মার্চ মাস। মিসিয়া হুয়ানা দে ফ্রেইতেস তৃতীয় একটি নাম রাখেন, পৃথিবীতে আমার আগমন উপলক্ষে পরিবার ও বন্ধুদের মধ্যে যে মিলনোৎসব সম্ভব হয়েছিল তাকে মনে রেখে। কিন্তু তিন বছর বাদে আমার ব্যাপ্টিজমের সময় সেই তৃতীয় নামটি বলতে ভুল হয়ে যায়ঃ গাব্রিয়েল হোসে দে লা কোনকোর্দিয়া। 

টীকাঃ

১। enclavijar—বাংলা অর্থ গোঁজ পোঁতা। কিন্তু টেলিগ্রাফ-ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এই শব্দটির কোনো বাংলা পরিভাষা নেই বলে মূল স্প্যানিশ শব্দ ও তার ইংরাজি ব্যাখ্যা ব্যবহার করেছি। 

২। মনসিগনর–রোমান ক্যাথলিক চার্চের পুরুষ যাজকদের প্রদেয় সম্মানজনক পদবী। মূল ইতালীয় শব্দটির অর্থ ‘হে প্রভু’।  

৩। কুরিয়া–ক্যাথলিক চার্চের অধীন একটি সংঘ।  

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২