পারমিতা ও একটি চিঠি – প্রতিমা সেনগুপ্ত
কল্যাণীয়াসু পারমিতা,
আজ প্রায় তের বছর পর তোমাকে দেখলাম। অনেক দিন বাদে একটা কাজে কৃষ্ণনগর যেতে হল। তোমার বিয়ের খবরটা পেয়েছিলাম। কিন্তু তোমার শ্বশুরবাড়ি কৃষ্ণনগর – তা জানা ছিলনা। স্টেশনে টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে আসতেই, তোমাকে চোখে পড়ল। লেডিজ কম্পার্টমেন্ট যেখানে পড়ে, সেখানে সিটে বসে ছিলে। দূর থেকে দেখে মনে হল, আগের থেকে খানিক মোটা হয়েছ, চোখে চশমা নিয়েছ এবং চুলে ঈষৎ পাক ধরেছে। তুমি আমাকে দেখে, অন্য সহযাত্রীদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে। ডাউন ট্রেনে উঠে পড়লাম, তুমি চলে গেলে তোমার গন্তব্যে আর আমি আমার। শুধু আজ বাড়ি ফিরে মনে হল, তোমাকে একটা চিঠি লেখা খুব দরকার। সে চিঠি তোমার কোন দিনও পড়া না হোক, তবুও। তেরো বছর আগে যে কথাগুলো গুছিয়ে বলে উঠতে পারিনি, আজ সেগুলো ভয়ানক ভাবে ঘিরে ধরেছে।
ঠিক আজকের মতো, এমনি ভাবেই একদিন শিয়ালদহ স্টেশনে তোমার সঙ্গে পরিচয়। তখন আমি মেডিক্যালের ছাত্র আর তুমি ইংরাজি সাহিত্যের। মাঝে মাঝেই দেখা হতো আর ট্রেনে অনেকটা সময় কেটে যেতো নানা গল্প–গুজবে। পাশ করার পর আমি ঢুকলাম বেসরকারি নার্সিংহোমে আর তুমি গেলে সরকারী স্কুলে শিক্ষকতা করতে। ভেবেছিলাম, স্থায়ী হবে সম্পর্ক। কিন্তু তা হয়নি। সেদিন শুধু বাস্তবতাটুকুই বলতে পেরেছিলাম, পরিপ্রেক্ষিতটা কোন দিনও বলা হয়নি। বলবার কোন সুযোগ তুমি আমাকে দাও নি। কোন আত্মগ্লানি আমার নেই, কারণ আমি অসত্য বলিনি বা কোন মিথ্যাচার করিনি। কোন অন্যায়, অবাঞ্ছিত প্রত্যাশাও রাখিনি। শুধু সব কিছু বলতে চেয়েছিলাম।
তখন সদ্য পাশ করে ডাক্তারিতে যোগ দিয়েছি মফস্বলের ছোট্ট নার্সিংহোমে। সঙ্গে দু’টো চেম্বারে বসি। একদিন পাড়ার দিব্য কাকু বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। ওরা পাড়ার পুরনো বাসিন্দা এবং ওনার মেয়ে তিন্নি আমার বিদ্যালয়ের সহপাঠিনী। দিব্য কাকু বলে দিয়েছিলেন, ‘তিন্নির শরীরটা ভালো নেই। তুমি ওকে নিয়ম করে চেকআপ করে যেও।’ তিন্নির বিয়ে হয়েছিল বছর তিনেক আগে। বছর দু’য়ে-ক বাদে তাঁর একটি কন্যা সন্তান হয়। সেই থেকেই শ্বশুর বাড়ির সঙ্গে গণ্ডগোল এবং শেষ পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদ। এখন তার কন্যার বয়স সাড়ে আট মাস। ইতিমধ্যে তিন্নির মা, পরলোকগত হয়েছেন। দিব্য কাকু বাতের বেদনায় প্রায় শয্যাগত। আমাকে যখন তিন্নিকে দেখার জন্য ডাকা হল, ঠিক তার আগেই তিন্নির ব্রেস্ট ক্যানসার ধরা পড়েছে। সল্টলেক ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার থেকে এক প্রকার জবাব দিয়েই তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
তিন্নিকে দেখে, সমস্ত ডাক্তারি পরীক্ষার কাগজপত্র ও দিব্য কাকুর কথা শুনে বুঝতে পারলাম – মৃত্যু পথযাত্রী আমার বান্ধবীটির শেষ সময় পর্যন্ত যতটুকু মেডিক্যাল ম্যানেজমেন্ট বাড়িতে দেওয়া সম্ভব সেটুকু যাতে ঠিক ভাবে হয়, তার জন্যই আমাকে ডাকা। যথারীতি আমি নিজের দায়িত্বে লেগে গেলাম। সপ্তাহে দু’দিন, প্রয়োজনে আরও বেশী বার তিন্নিকে দেখতে যেতে হচ্ছিল। একটা বিচিত্র হতাশার মধ্যে ডুবে থাকা পরিবারকে, নিয়মিত প্রত্যাশার স্তুতি দেওয়াটাই ছিল আমার কাজ। কেবল সাড়ে আট মাসের এক ছোট্ট মানুষ, তাঁকে দেখা–শোনার ভার যে আয়া দিদির উপর – তার কোলে চড়ে, আমাকে স্বাগত ও বিদায় জানাতে লাগল। আর প্রত্যেকবার আমাকে সে, মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করে চলছিল।
তিন্নির মা পরলোকগত, বাবা বৃদ্ধ এবং শয্যাগত। তিন্নি এঁদের একমাত্র সন্তান। তাঁর অবর্তমানে, এই শিশু কন্যাকে কে দেখাশোনা করবে এটা দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল। আত্মীয়–স্বজন তেমন কেউ নেই যে, এতো ছোটো বাচ্চার দায়িত্ব নিতে চাইবে। কি হবে কন্যার ভবিষ্যৎ? কেউ বুদ্ধি দিচ্ছেন, ‘ওকে হোমে পাঠিয়ে দাও। ওখানেই ছোট থেকে মানুষ হোক’। কাউর বক্তব্য–‘কোন প্রাইভেট অর্গানাইজেশন যাঁরা বাচ্চাদের দেখভাল করে সেরকম কোন জায়গায় দেওয়া হোক। যেহেতু মাইনর ক্যান্ডিডেট, পরিবারের অবর্তমানে তার প্রপার্টি কোন আত্মীয়কে ট্রাস্টি করে দায়িত্ব দিয়ে দাও। যেখান থেকে বাচ্চাটা নিয়মিত আর্থিক সাহায্য পাবে। তিন্নি এই অনিশ্চয়তার কারণে অশ্রু বিসর্জন করে চলল। ইহজগতে তাঁর যে, আর বেশী দিন বাকী নেই তা সে বেশ বুঝতে পেরেছিল। অথচ, যাঁর জন্য সবার এত দুর্ভাবনা তাঁর কিন্তু কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে দিবারাত্র খেলাধুলায় মগ্ন। তাঁর জীবনে যে কি অন্ধকার নেমে আসতে চলেছে, তা কেবল ঈশ্বরই জানতেন। এই অনাগত ভবিষ্যতের ভাবনায় আমারও বুক কেঁপে উঠছিল।
এমনই একদিন তিন্নিকে দেখতে গিয়েছি। বারান্দার এক প্রান্তে জুতো ছাড়ার জায়গায়, জুতো রাখেতে গিয়ে চোখে পড়ল দু’টো ছাড়া জুতো মাটিতে পড়ে। ঠিক তার পাশে মাটিতে তিন্নির কন্যা ‘দেবোষ্মিতা’কে কাঁথা পেতে শুয়ে রাখা হয়েছে। সে, সেখানেই ঘুমিয়ে কাদা। আমার সমস্ত অস্তিত্ব কেমন যেন ধাক্কা খেয়ে গেল। এতো বড় একটা বাড়িতে যে প্রান্তে জুতো ছাড়ার জায়গা, তার পাশে কিনা বাড়ির একমাত্র ভবিষ্যতের স্থান হয়েছে। কেন? কারণ তাঁর পিতা ইহজগতে থেকেও তাঁকে স্বীকার করেননি। তাঁর মা শয্যাগত, মৃত্যু পথযাত্রী। তাকে দেখার মতো কোন অভিভাবক নেই। মুহূর্তের মধ্যে সেই নিদ্রাতুর ছোট্ট প্রাণকে মাটি থেকে তুলে নিয়ে আসি বসার ঘরে। একটা চেয়ারে তাকে কোলে নিয়ে চুপ করে বসে থাকি। অবহেলার যন্ত্রণায় বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। অথচ যাঁর জন্য এতো কিছু, তার কোন তাপ–উত্তাপ দেখা যায় না। সে আমার কোলে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাতে থাকে।
কিন্তু এই সামান্য ঘটনা কোন মতেই আমাকে স্থির থাকতে দিল না। আমার বাবা–মা ইতি পূর্বেই ইহজগৎ ত্যাগ করে ছিলেন। কাছের মানুষ বলতে, বিবাহিতা এক দিদি ছিলেন। প্রায় নিঃসঙ্গ জীবনে আমি প্রতি মুহূর্তেই তোমার অনুপস্থিতি বোধ করতাম – পারমিতা। কিন্তু সেদিনের পর আমি অগ্র–পশ্চাৎ কিছু ভাবার মতো অবস্থাতেই ছিলাম না। সোজা দিদির কাছে গিয়ে বলি, ‘আমি তিন্নির কন্যা দেবোষ্মিতাকে দত্তক নেবো।’ আমার দিদি প্রায় আকাশ থেকে পড়লেন। নিঃসঙ্গতার কারণে আমার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে বলেই তাঁর ধারণা হল। তিনি অতি দ্রুত তোমার পরিবারের সঙ্গে বিবাহের কথা বলতে আগ্রহী হন। কিন্তু আমি তাঁর কথায় কান দিইনি। একটি আট মাসের শিশু আমার সমস্ত অস্তিত্বকে এমন আচ্ছন্ন করেছিল যে, আমি সমাজ, পরিবার, নিজের ভবিষ্যৎ সমস্ত কিছু বিস্মৃত হই। দিদি বলেছিলেন, আমি বিবাহিত নই, আমার বাড়িতে কোন মহিলা সদস্য নেই, এতোটুকু বাচ্চার দায়িত্ব আমি কিভাবে নেবো? কিন্তু আমার কেবলই মনে হতে লাগল, যে সন্তানকে তাঁর মা বেঁচে থাকতেই জুতোর পাশে শুয়ে ঘুমাতে হয়, মায়ের অবর্তমানে সে আদৌ নিয়মিত সময়ে বেবীফুড পাবে তো? দিদি বোঝাতে চেষ্টা করেন, এটা আমাদের মতো মধ্যবিত্ত সমাজে সহজে গ্রহণযোগ্য হবেনা। বাচ্চাটার জন্য অন্য কোন সুবন্দোবস্ত হতে পারে, আমাকেই কেন দায়িত্ব নিতে হবে? কিন্তু কোন কিছুই আমাকে সেদিন ফেরাতে পারেনি। অস্থির মস্তিষ্ক নিয়েই আমি উপস্থিত হই স্থানীয় এক অ্যাডভোকেট বন্ধুর কাছে। কিন্তু আমার সমস্ত কথা শোনার পর, বন্ধুটি কোন ধরনের আইনি সহায়তা করার পরিবর্তে – আমার ও তিন্নির সম্পর্ক এক্সট্রা ম্যারিটাল রিলেশন, বাচ্চাটা আসলে আমারই এবং এটিই তিন্নির বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ বলে সন্দেহ প্রকাশ করে। ফলত: আমি বন্ধুর, বন্ধুত্বের আশা ত্যাগ করে অন্য অ্যাডভোকেটের সঙ্গে শলা–পরামর্শ করি।
তিন্নিকে যখন বললাম, দেবোষ্মিতাকে আইনত দত্তক নিতে চাই। তার কোন অনাদর হবে না। আমার নিজের সন্তানের মতোই সে মানুষ হবে। প্রথমে খুশি হলেও, সে নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। আমি অবিবাহিত। কিভাবে এতো ছোটো বাচ্চার দায়িত্ব নেবো? পরে যদি বিবাহ করি, নিজের পরিবারকে বাদ দিয়ে – তাঁর মেয়ের দায়িত্ব পালন করবো কিভাবে? কিন্তু এতো দীর্ঘ ভাবনার অবকাশ তাঁর ছিলনা …।
তাঁর অবর্তমানে আমি দেবোষ্মিতার আইনানুগ অভিভাবকে পরিণত হই। তাঁকে দেখাশোনার জন্য দিবারাত্র দু’জন আয়ার বন্দবস্ত ছিল। কিন্তু নার্সিংহোম এবং চেম্বারের বাইরে তাঁকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করতে পারিনি। একজন মৃত্যু পথযাত্রী মানুষকে কথা দিয়েছিলাম, তাঁর সন্তানের কোন অযত্ন হবে না। ব্যাস এটুকুই শুধু মনে রেখেছি।
আজ অনেক বছর পর তোমাকে দেখে, সেদিনের কথাগুলিই বলতে চেয়েছি – পারমিতা। সেদিন একার সিদ্ধান্তে কন্যার দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। যদি তুমি চাও, সব জেনে – আসতে পারো। না চাইলে কোন জোর নেই। কিন্তু কোন কথাই বলা হয়নি। তোমাকে কিছু না জানিয়ে এতো বড় সিদ্ধান্ত হয়ে যায় কিভাবে? – তুমি কিছুই শুনতে চাও নি।
ছোট্ট ঐটুকু প্রাণ আমি কিভাবে তিলে তিলে গড়েছি – তা কেবল আমিই জানি। আয়ারা ছুটি করেছে, মেয়ের ধুম জ্বর – সারাদিন কিছু না খেয়ে বেহুঁশ থেকেছে, রাতবিরেতে কেঁদে কেঁদে উঠেছে, সারারাত মেয়েকে কোলে নিয়ে ইজি চেয়ারে বসে কাটিয়েছি। কি করে হাতে ধরে অ, আ, ই – শিখিয়েছি, স্কুলে বন্ধুরা বলেছে – তোর বাবা তো সেকেন্ডহ্যান্ড। মেয়ের হাজারো প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দিয়েছি, কিভাবে বুঝিয়েছি – ‘যাই হোক, শেষ পর্যন্ত আমি তাঁর পাশে থাকবো এটাই একমাত্র সত্যি।’
আজ সে তেরো বছরের কিশোরী। এখন আমি তাঁকে দেখি, আর সে আমাকে দেখে। কিন্তু সমাজের এই বিপরীত স্রোতে দাঁড়িয়ে, এটা এতো সহজ ছিলনা। প্রচুর পথ একা হেঁটে এখানে এসেছি এবং আরও অনেক পথ দেবোষ্মিতাকে নিয়ে একাকেই হাঁটতে হবে। কেবল তোমার সঙ্গে যতটুকু অন্যায় হয়েছে, যতটুকু অমর্যাদা হয়েছে, সেটুকুই জীবনের আক্ষেপ।
ভালো থেকো,
ইতি শুভাশিস।