মণিকর্ণিকা অথবা চন্দ্রকামিনী – রক্তিম ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

বাতাসের ঘুম যখন ভেঙে যায়, ঠিক তখন গাছেরা নুয়ে পড়তে চায় মাটির কাছাকাছি। তাদের কেউ তুলে ধরতে পারে না। তারা নিজেরাও নিজেদের তুলে ধরতে চায় না। তুলোর মতো হালকা একটা আলোর বাষ্প জমে চোখের কোণে। নীরব কুয়াশার গন্ধ কেমন কঠোর হয়ে পড়ে। কেউ যেন সমুদ্রে নামে এই সময়। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে নোনা জলে। লবণের প্রাবল্যে শরীরটা ভেসে ওঠে। ডানা ঝাপটায়। স্তনের ওপর জড়িয়ে যায় ঢেউয়ে ভেসে আসা চুল। নাভির গহীনে উত্তাপ আনে সোঁদা আমের স্তব। আলোর রঙে কাটাকুটি খেলতে খেলতে হাওয়ারা বয়ে চলে। ধূপের গন্ধে ভরে যায় ঘর। চুপ করে জেগে থাকে একাকী চাঁদ, তার জ্যোৎস্নায় কেউ ধর্ষিত হবার নির্লজ্জ সাক্ষী থাকবে বলে।

মণিকর্ণিকা উঠে আসে বিছানায়। চাদরে বিলি কাটে শুশুকের মতো। পা ছড়িয়ে দেয় অতলে। শিশিরের মতো রোমকূপ জেগে ওঠে নিঃশব্দে। জানলায় ঝরে পড়া আলোর দিকে চেয়ে থাকে সে। ময়ূরের মতো স্নিগ্ধতা তার শরীরে। বর্ষার বাদামী বৃষ্টি শুরু হতে পারে – এরকম একটা ধারণা জন্মায় তার হৃদয়ের মন্থকূপে। কিন্তু তাহলে যে হারিয়ে যাবে চাঁদ। তার পাগল-প্রেমিক। চাঁদকে হারিয়ে সে কি বেঁচে থাকতে পারে? চাঁদের ওমের পরশ ছাড়া কি তার কোনো অস্তিত্ব আছে এই দানবীয় পৃথিবীতে?

সর্বনামের জন্ম হয় এই অকল্পনীয় সময়ে। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সুর ভেসে আসে ময়দানি বেহালায়। ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ অস্পষ্ট হয়ে আসে। কানের ভেতর জমাট বাঁধে ঘূর্ণিঝড়। নাসারন্ধ্রে শিহরিত হয় অন্ধকার। চোখের পাতায় গুমরে ওঠে সর্বনাশ। কেমন আছে সে? তার পার্থিব চান্দ্রস্বর?

পাগল! পাগল! পয়সা ছাড়া শিল্প হয় না। কোনোদিন হয়নি, আজও হবে না।

চুপ করে থাকে মণিকর্ণিকা। অভিমানের পাহাড় ভেঙে উঠে আসে চাপা ক্রোধ। আগ্নেয়গিরির শীতল গহ্বরে ঘুম ভাঙে দৈত্যের। দরজা খুলতে চায় নৈসর্গিক ধাক্কায়। নির্নিমেষে ছড়িয়ে যায় রেওয়াজ করা অসন্তোষ।

তুমি আমার একটা ছবিও এঁকে দিতে পারবে না? একটা ছবিও না?

বললাম তো, হাতে টাকা নেই। পোর্ট্রেট আঁকার টাকা অনেক। আর টাকা ছাড়া আমি আঁকতে পারব না।

আমার জন্যও না?

না, তোমার জন্যও না। কে তুমি? আমার প্রেমিকা। তা বেশ। কিন্তু আঁকার সময়? পাতি মডেল বই আর কেউ না।

দু’চোখে ঘনিয়ে আসে মহাজাগতিক অন্ধকার। বিক্ষুব্ধ নক্ষত্রপুঞ্জ ছুটি নিয়েছে তুষারযুগের আগেই। চরাচরজুড়ে শুধুই এখন সতর্কতা। আর গাছেদের অনিশ্চিত বার্ধক্য।

দরকার নেই। চললাম আমি। তোমার এত অহংকার নিয়ে মরো তুমি। আমার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নেই তোমার। এলাম।

ভুল ভুল, আবারও ভুল করছ তুমি। আমি তোমার কাছ থেকে টাকা চাইনি মণি। আমি টাকা চেয়েছি আমার মডেলের কাছ থেকে। এটা আমার পারিশ্রমিক মণি, তোমার বিনিময় মূল্য নয়।

টাকা দেব না আমি তোমায়। এক পয়সাও নয়। পারিশ্রমিকই চাও যখন, অন্য কিছু চাও। আর তাছাড়া অন্য কিছু তো তুমি এমনিতেই পাবে। আমি তো আর সেই অন্য কিছুর দাম চাইনি, তাই না?

কী অন্য কিছু? কী বলতে চাইছ তুমি?

কেন? আমি যেভাবে ছবিটা আঁকতে বলেছি, তাতে তুমি আমার শরীর চক্ষুবিদ্ধ করবে না? তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করবে না আমার প্রতিটা খাঁজ, প্রতিটা চক্রব্যূহ? তার বেলা পারিশ্রমিক কোথায়, মিস্টার শিল্পী?

ঝাঁ ঝাঁ করে মাথা। কানে বাষ্প আসে স্বভাবোচিত। হাত শক্ত হয়, নিয়মবিরুদ্ধ।

এরকম ছবিতে মডেল হবার জন্য নগ্ন হতেই হয় মণি। ওতে নতুন কিছুই নেই।

তাই? নতুন কিছুই নেই? তোমার আগেকার সব মডেল, আর আমার উত্তাপ এক? সবার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আর আমার বৈশিষ্ট্য এক? সব কবিতারই কি অন্ত্যমিল হয়, স্যার?

কী চাও তুমি? বলো কী চাও। আমার শিল্পীসত্তার অপমৃত্যুতেই কি তোমার শান্তি?

না। শান্তি নয়, স্বস্তি। অন্তত তোমার সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ থাকবে তাতে। এমন নিস্পৃহ যৌনচেতনা এবার যে অসহ্যকর হয়ে উঠছে। দমবন্ধ লাগছে আমার।

তাহলে প্রস্তুত হও, মণি। প্রস্তুত হও তোমার মত্ততা প্রকট করার জন্য।

লাভাদের অট্টহাসি ছড়িয়ে পড়ে গ্রহান্তরে। আদিভৌতিক তরঙ্গে সঞ্চারিত হয় সোমত্ত বারিধারা। অযাচিত ধারাবাহিকতায় উন্মুক্ত হয় বিষণ্ণতা। বিষাক্ত প্ররোচনায় ফণা তোলে শঙ্খচূড়। নেমে আসে অনাবিল কামনা, ফুটে ওঠে পুষ্পবৃন্ত, সজ্জিত হয় প্রশস্ত প্লীহা, ঘেমে ওঠে দল, শঙ্কিত হয় আর্তনাদ, আর শেষটুকুর ভুলে নিষিক্ত হয় স্বয়ম্ভূ স্বপ্নদোষের একচ্ছত্র নবাবিয়ানা।

কী করলে এটা তুমি? কী করলে? এভাবে বিষিয়ে দিলে আমায়?

কেন? শিল্পের জন্ম হল তোমার গর্ভে। আমাদের সমূলে মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করে যে বিধাতা, তাকে ফাঁকি দেওয়ার সর্বতো প্রচেষ্টা তো চিরকাল জারি আছে, মণি।

কিন্তু এখন কী হবে? তোমার কাছে তো আমার আর অবস্থান নেই। আমি যাব কোথায়?

সে আমি জানি না। আমি শিল্প করতে এসেছি, মণি। দোষ কাটাতে নয়।

পাপী! শয়তান! শকুন একটা!

চাঁদের বুকে মধুচন্দ্রিমা বিলীন হয়। কলঙ্কের অভ্যুত্থানে কেঁপে ওঠে কেউটে সাপ। সময় বইতে থাকে। সমুদ্রে নেমে যাওয়া মানবশরীর খুঁজে বেড়ায় কালকূট। অমৃতমন্থনে কোনো উৎসাহ নেই আর, যতখানি আছে শিল্পের আমলাতন্ত্রে।

মণিকর্ণিকা ভাবতে থাকে। ভাবতে থাকে তার অনিশ্চিত ভবিষ্যত। কেউ যেন ডাক দেয় ওকে। সাড়া দেওয়ার ইচ্ছেটুকু জাগে না। সন্তানধারণে নারীত্বের অপমান – নিষিদ্ধ আবেগে দগ্ধে ওঠে সে। কোথায় ভুল হল তার? শতাব্দীর কাছে কোন্ ক্ষতচিহ্ন রেখে দিল সে? কোন্ ইষ্টদেবতা ক্ষতিপূরণ দেবে তার জৈবিক অগ্নিকুণ্ডে?

তৃণের শরীরে রক্তপাত হয় আগের মতোই। যুদ্ধের পর আকাশ এখনও আগের মতোই নীল। এখনও ঘুড়ি ওড়ে স্বরচিত ষড়যন্ত্রে, এখনও ডাহুকপাখি জেগে থাকে ঈশপের অনুবাদে নিস্পন্দ, এখনও বই পায় বিদগ্ধ মানুষের স্নেহ, এখনও নির্জীব প্রতিবাদে অহঙ্কারী হয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।

মণিকর্ণিকা চাঁদের দিকে তাকিয়ে হা হা করে হাসে। অপার্থিব চরাচরের বুক ফাটিয়ে সোনালি ঘাসের ডগা উচ্চতা মেখে নেয়। নাম-না-জানা, পরিত্যক্ত স্টেশনের অমলতাস নিজের অস্তিত্বকে আরো একবার স্পষ্ট করে নেয় সময়ের অবলুপ্তির কাছে।

মণিকর্ণিকা ছটফট করে বিছানায়। পোশাকের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে সারা রাত। পোশাকি চাঁদের আলো আলুথালু নেমে আসে সশব্দে। আগের মতোই। মণিকর্ণিকা রেগে ওঠে। অভিশাপ ছুটে যায় নিভৃতে। অভিমানাহত রক্তিম চাঁদ ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। এ-সময় কান্না পায় প্রসূতির। কেঁদে ওঠে সদ্য মা-হারানো বালক। প্রগাঢ় চুম্বনে নিজেকে সঁপে দেয় অশরীরী যৌবনোত্তীর্ণা।

মণিকর্ণিকা অস্থির হয়। চাঁদের গভীরে সেজে ওঠে অস্ত্রাগার। পার্থিব অপমানে অনভ্যস্ত চাঁদ প্রতিশোধে তেতে ওঠে। আক্রমণ শানায়। মণিকর্ণিকা সতর্ক হয়। ছাদে ওঠে সাবধানে। ধেয়ে আসে আগুন। ঝলসে ওঠে টলটলে দীঘিসমা চোখ।

ফিরে যাও, ফিরে যাও তুমি। আমি আর পারছি না। ফিরে যাও।

শিল্পের মতো চাঁদের আলো হাহাকার করে অন্ধকার জ্যোৎস্নায়। অহঙ্কারী যুবতীর শরীরে ধর্ষণের চিহ্ন এঁকে দেয় সবলে। সকৌতুকে কামড়ে ধরে ঊরুসন্ধি।

ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও।

চিৎকার ম্লান হয়ে ওঠে। ক্রমশ সাড়া দেয় অভ্যস্ত শরীর। চাঁদ গিলে নেয় মুহূর্তের দোটানা, শরীরে স্তব করে কলঙ্করেখা।

সেলেনোফোবিয়ায় আক্রান্ত মণিকর্ণিকা কল্পনা করে একটা মহাকাব্যিক ছবি – লাল রঙের আকাশ-কাঁপানো মোহময়ী জ্যোৎস্নায় শুয়ে আছে সে। আদিম, নগ্ন, প্রস্তরীভূত। নাভিমূল থেকে জন্ম নিয়েছে পৃথিবীর প্রথমতম গাছ। চরাচর জুড়ে ভয়ঙ্কর লাল, আর রক্তের ফোঁটায় ভরে যাওয়া তার শরীরের প্রতিটা দেওয়াল।

চাঁদ এখন একা। সে ধেয়ে যায়। সে ফিরে আসে। তার বাণিজ্যিক আলোকে ঘিরে স্বপ্ন রচিত হয়। কিন্তু বাস্তবে ব্যূহ রচনা করে স্নায়বিক প্রতিষেধক। মণিকর্ণিকার আর চাঁদ পাওয়া হয় না। চাঁদেরও আর আদিম রিপুতে মগ্ন হওয়া হয় না।

শিল্পের কাছে সরগম আহূতি দিয়ে ধোঁয়ায় মুখ গুঁজে থাকে চিলের শ্বাপদবাহিনী। শরীর ধোয়া আলোয় অনাদরের রূদালী হয়ে থাকে মণিকর্ণিকা, নাগরিক সভ্যতার আকস্মিক চন্দ্রকামিনী।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *