প্রজ্ঞাদ্রুমের কথা – জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

সেই অঞ্চলে তুষারপাত দেখতে কোনো পর্যটক আসত না। সেই প্রবল আর দীর্ঘমেয়াদী তুষারপাত শুরু হওয়ার আগেই অঞ্চল ত্যাগ করে পাহাড়ের উপত্যকায় নেমে আসতে চাইত অঞ্চলের মানুষ। 

চায় অনেকেই, পারে আর কজন? 

যে সব দোতলা কাঠের বাড়ি, সাজানো বাগিচা দিয়ে ঘেরা বিলাস-কুটির ছেড়ে চলে যেত অবস্থাপন্নরা… তাদের বাড়ির চিমনি দিয়ে আর ধোঁয়া বেরোতে দেখা যেত না। দরজা-জানলার কাচের ফাঁক দিয়ে আর সন্ধের পর দেখা যেত না নরম হলদে আলো। ভেসে আসত না বেহালা, হার্মোনিকা অথবা ব্যাঞ্জোর সুর। দেখা যেত না মনিবের প্রিয় চঞ্চল রোমশ কুকুরদের। আর জ্বলত না দরজার মাথায় গ্রীক পৌরাণিক প্রাণীর মতো পাহারা দেওয়া লাল অথবা কমলা লণ্ঠন। 

একরাশ সাদা বরফের মাঝে কনকনে ঠান্ডা পাহাড়ি হাওয়া সহ্য করতে করতে এক ক্ষুধার্থ বৃদ্ধ দৈত্যের মতো হাঁটু মুড়ে বসে থাকত সেই সব পরিত্যক্ত আবাস… বিষণ্ণ… একা। ক্রমে আরও শক্তিশালী এবং নির্মম হয়ে ওঠা শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে অসম যুদ্ধ করতে করতে নির্জীব হয়ে যেত বাহারে গাছের ঝোপ, আর লতাগুল্ম। খিলখিল করে হাসা সোনালি দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে ঘাসের গালিচা, হাঁটু অবধি বেড়ে ওঠা বরফের স্তরের নীচে চোখ বুজত। 

অথচ মহীরূহদের কথা আলাদা। 

যারা বেঁচে থাকে, তাদের শিকার আর রসদ খুঁজতে হয়… তাদের কথা আলাদা।   

যারা কোনোদিনই সব ছেড়ে উপত্যকা বেয়ে নীচে চলে যেতে পারবে না… তাদের কথা আলাদা। 

এমনই এক ওক গাছের ব্রতই ছিল–তাদের আশ্রয় দেওয়া যারা প্রবল শীত সহ্য করেও টিকে থাকতে চাইছে। গাছেরা পালাতে পারে না। তারা সহ্য করে। সহ্য করতে করতে বুড়ো ওক গাছ সাহায্য করতে শিখেছে। 

তারই বুকের কাছাকাছি একটা কোটরে বাস করত একটা কাঠবিড়ালী পরিবার। তুষারপাত বাড়তে তারা বেরোতে পারত না। আর কমলে খাবার খুঁজে পেত না পরিচিত অঞ্চলে। যারা যেতে পারে না কোথাও, তাদের ঘর খুঁজতে হত, যদি কিছু পাওয়া যায় সেদিনটা চলে যাওয়ার মত। 

সেই ওক গাছ থেকেই কিছু দূরে, পাহাড়ি জঙ্গলে থাকত একটা একলা নেকড়ে। প্রবল শৈত্যপ্রবাহে তার দল অন্যত্র চলে গেলেও, সে আর যায়নি তাদের সাথে। গত শীতে যাত্রাপথেই বিদায় নিয়েছে তার শেষ সঙ্গিনী। তার স্মৃতি যেন আরও বেশি করে জাঁকিয়ে বসেছে এই শীতে। কোনো বৃদ্ধ নেকড়ে দলের সঙ্গে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে অন্য নেকড়েরা বুঝতে পারে। তাদের অনুভূতির  গভীরতা… তাদের আকুতি-মিনতি, শৈত্যপ্রবাহে জমে বরফ হয়ে গেছে। ঘাসেদের মতো চাপা পড়ে গেছে পুরু বরফের চাদরে। বৃদ্ধ নেকড়ে জানত, ক্ষুধা উপেক্ষা করে বেঁচে থাকা যায় না। সহ্য করে, অথচ ক্ষুধাপীড়িত হয়ে উপবাস করে মরতে সায় পেত না তখনও। প্রত্যাশা করত অতর্কিতে দুর্বল কোনো শিকারকে দিয়ে যদি কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়, সদ্য মৃত অথবা স্থানীয় মানুষদের ফেলে দেওয়া কিছু দিয়ে যদি চলে যায়। তাকেও চেষ্টা করতে হত তাদের ঘরের কাছাকাছি সন্ধান করার… যারা শৈত্য প্রবাহ সহ্য করে কোনোক্রমে টিকে আছে, যেতে পারেনি কোথাও। 

সেই নেকড়ে যেখানে যেখানে আহার-সন্ধান করত লোকচক্ষু এড়িয়ে… তারই একটি সাধারণ বাড়িতে থাকত এক বৃদ্ধ—বাৎজরিগ। 

তার একমাত্র ছেলেকে  রাজার সৈন্যরা বন্দি করে নিয়ে চলে গেছিল। ছেলে ফেরেনি। খবর এসেছিল—ছেলের চোখ উপড়ে নিয়ে তাকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল পাহাড়ের খাদ থেকে। ছেলের অপরাধ—সে খুনি। 

ছেলে রাজার সেনাপতির একটা চোখ লক্ষ করে তির ছুঁড়েছিল, পাহাড়ি গ্রাম থেকে চারটে মেয়ে উঠিয়ে নিয়ে তাঁবুতে রাত কাটানোর আগেই মরে গেল সেনাপতি।

ছেলে ফিরল না। ছেলের বউ আর নাতিও চলে গেল পাহাড় ছেড়ে, বউয়ের নিজের দেশে। বুড়ো বাৎজরিগের আর কোথাও যাওয়া হল না!

এমন প্রবল তুষারপাতের মরশুমে বাৎজরিগ ঘরে বসে থাকে। ঠান্ডা সহ্য করতে করতে পুরনো দিনের কথা ভাবে। পরিবারের কথা ভাবে। পুরনো রাজার আমলে বসন্ত আর গ্রীষ্মের উৎসবে রাত জেগে নাচ-গান করার কথা ভাবে। ঘরের মোমবাতি জ্বলতে জ্বলতে ফুরিয়ে যায়। অন্ধকারে চুপ করে বসে থাকে বৃদ্ধ, ঘুমোয়। খিদে সহ্য করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভেঙে যায় খিদে বাড়লে। জমানো রসদ আর খোঁজ করে জোগাড় করা কিছু শুকনো খাবার আর মদ দিয়ে চালায় একটু একটু করে। আগুন না জ্বালালে ঠান্ডায় মরে যাবে। তাই জ্বালানিও জোগাড় করতে হয়। পরিত্যক্ত বাড়িগুলো থেকে চুরি করে নিয়ে আসে সাহস আর শক্তি সঞ্চয় করে। যখন সবাই ছেড়ে চলে যায়, তখন অসম লড়াই ও এক যুদ্ধ।

বাৎজরিগ উপার্জনজ্ঞানেই চুরি করে আনে, নিঃসংকোচে। কাঠবেড়ালি এসে দ্রুত কিছু টুকরো মুখে করে নিয়ে যায় কোনো জানলায় ফাঁক পেলে। নেকড়ে অপেক্ষা করে–দুর্বল, মৃত অথবা উচ্ছিষ্টের।

একদিন বৃদ্ধ ওকগাছ দেখল–তার আশ্রিত কাঠবিড়ালীর খুব কাছাকাছি চলে এসেছে বৃদ্ধ নেকড়ে। কাঠবিড়ালী টেরও পায়নি। সে তখন বাৎজরিগের ফেলে দেওয়া রুটির টুকরো শুঁকতে ব্যস্ত। নেকড়ে যখন কাঠবিড়ালীর ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখনই হাঁক পারল বাৎজরিগ। সেও দেখেছে ওকগাছের মতো। তার হাঁক শুনে চমকে উঠল কাঠবিড়ালী আর নেকড়ে। কাঠবিড়ালী পালিয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে, অদৃশ্য হয়ে গেল কোনো গাছ অথবা বাড়ির আড়ালে। আর হাড়-পাঁজর এক হয়ে যাওয়া নেকড়ে ঘুরে দাঁড়াল বাৎজরিগের মুখোমুখি। বাৎজরিগ তার দোনলা বন্দুক তাক করে নেকড়ের দিকে তুলে নিশানা স্থির করল। কিন্তু গুলি চালাল না। সেই নেকড়ে বাঘও বাৎজরিগের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হল… অথচ ঝাঁপিয়ে পড়ল না।

জাতক বৃক্ষ প্রজ্ঞাদ্রুম ক্ষণিকের জন্য ভুলে গেল সে আসলেই স্থবির, চলচ্ছক্তি হীন। তার শাখা-প্রশাখা শিরশির করে উঠল। পাহাড়ি-হাওয়ায় মড়মড় করে ওঠা ডালপালার শব্দ শুনে মনে হল—সে আসলেই নিজের ডালপালা নিজেই নাড়াতে সক্ষম। সে চাইলে পারে দুই অসহায় বৃদ্ধের মধ্যে একজনকে রক্ষা করতে। এরা হয় একে অপরকে মারবে অথবা আত্মাহুতি দেবে আজ। অথচ প্রজ্ঞাদ্রুমের ব্রতই ছিল—তাদের আশ্রয় দেওয়া যারা প্রবল শীত সহ্য করেও টিকে থাকতে চাইছে।

অসহায় জাতক প্রজ্ঞাদ্রুম, শেকড় তুলে দু-পা এগোতে অক্ষম। শুনতে পেল গুলির গর্জে ওঠা। বৃদ্ধ বাৎজরিগ নিজেই নিজের চিবুকের নীচে গুলি করেছে। নেকড়ে বোকার মতো তাকিয়ে রইল সেদিকে কিছুক্ষণ।

সে ধীরে ধীরে বাৎজরিগের শরীরের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ শুঁকে দেখল তার প্রাণহীন দেহ। তারপর আকাশে মুখ তুলে আউ-উ-উ করে এক দীর্ঘ ডাক ছড়িয়ে দিল তুষার-মণ্ডিত পাহাড়ের আকাশে-বাতাসে। ততক্ষণে আবার তুষারপাত শুরু হয়ে গেছে। বাৎজরিগের দেহ ডিঙিয়ে নেকড়ে ধীরপদে হেঁটে চলে গেল বাৎজরিগের শূন্য কুটিরের দিকে; খোলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করল ভেতরে… শীতল অন্ধকারে।

ঠিক তখনই হঠাৎ সেই কাঠবিড়ালী এসে ওক বৃক্ষের হৃদয়ের কাছে সেই কোটরের ভেতর ঢুকে পড়ল। কাঠবিড়ালীর হৃৎপিণ্ডের ধ্বনি, প্রজ্ঞাদ্রুমের নিজের হৃৎপিণ্ডের ধ্বনি মনে হল।

এই পাহাড়ে, ওক বৃক্ষের প্রবীণতম বন্ধু বাৎজরিগ… ও চেয়েছিল নেকড়ে ওর মাংস খেয়ে বাঁচুক। কিন্তু নেকড়েটা ওকে রেখে চলে গেল ওর ফাঁকা ঘরের ভেতর। আর নিজের ডালপালা, ছায়া, শেকড়, পাতা, কিছু দিয়েই ওই নেকড়ের কোনো উপকার করতে পারবে না প্রজ্ঞাদ্রুম। এমনকি তার কাছে আশ্রয় নেয়, এমন কাউকে ভেটও দিতে পারবে না ক্ষুধার্থ নেকড়েকে। এমনকি, নিজেকেও না।

কারণ, প্রজ্ঞাদ্রুমের ব্রতই ছিল—তাদের আশ্রয় দেওয়া যারা প্রবল শীত সহ্য করেও টিকে থাকতে চাইছে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *