জানাজার খুতবা – হের্টা মুলার ভাষান্তর: দীপাঞ্জনা মণ্ডল

জানাজার খুতবা – হের্টা মুলার ভাষান্তর: দীপাঞ্জনা মণ্ডল

শেয়ার করুন



[লেখক পরিচিতি:- হের্টা মুলারের জন্ম ১৭ আগস্ট ১৯৫৩-তে রোমানিয়ার টাইমিস প্রদেশে রনিটচিডর্ফে। রোমানিয়ায় তাঁর জন্ম, আর লেখালেখি জার্মানে। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, কবি, প্রাবন্ধিক; ২০০৯-তে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। নয়ের দশকের শুরু থেকে আন্তর্জাতিক ভাবে তিনি পরিচিতি পান, কুড়িটির বেশি ভাষায় তাঁর লেখা অনূদিত। মুলারের লেখায় মূলত রোমানিয়ায় নিকলাই চসেস্কুর শাসনকালের দমননীতির হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা এবং সন্ত্রাস প্রকাশ পায়। তার অধিকাংশ লেখাই রোমানিয়ায় বসবাসকারী জার্মান সংখ্যালঘু মানুষদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা কিংবা বলা যায় তার লেখায় বানাত ও ত্রান্স্যল্ভানিয়ার আধুনিক ইতিহাস ফুটে ওঠে। ]

স্টেশনে, ভিড়ে ঠাসা ট্রেনের আশেপাশে যাত্রীদের স্বজন পরিজনেরা একরকম দৌড়াদৌড়িই করছিল। আর তার সঙ্গে তাল রেখে তাদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া যাত্রীদের উদ্দেশ্য করে হয়ে চলেছিল তাদের হাত নাড়া।

এক তরুণ ট্রেনের জানলার পিছনে দাঁড়িয়েছিল। জানলার কাঁচের উচ্চতা ছিল মোটামুটি তার বাহুমূল পর্যন্ত। সে তার বুকের কাছে সাদা বিস্রস্ত একটা ফুলের তোড়া ধরে মুখটাকে কঠিন করে বসেছিল।

এক তরুণী একটি মিষ্টি বাচ্চাকে হাত ধরে স্টেশনের বাইরে নিয়ে যাচ্ছিল। মেয়েটি আদতে কুঁজো।

ট্রেনটা যুদ্ধে চলেছিল।

আমি টিভি বন্ধ করলাম।

বাবা ঘরের মাঝে একটা কফিনে শুয়ে ছিলেন। ঘরের দেওয়ালগুলো এত রকমের ছবি দিয়ে ঢাকা যে কেউ চাইলেও দেয়ালের শরীর দেখতে পাবে না।

একটা ছবিতে, বাবা চেয়ার ধরে দাঁড়িয়েছিল। ছবি তোলার সময় বাবার উচ্চতা ছিল সেটার অর্ধেক।

তিনি সুন্দর পোশাক পরেছিলেন আর হাঁটু গেঁড়ে বসা তাঁর পা ছিল মেদে ভরা। তার মাথার গড়ন নাসপাতির মতো আর ন্যাড়া।

আরেকটা ছবিতে বাবা বর। সেখানে তাকে দেখতে পাওয়া যায় আবক্ষ। ছবির অন্যদিকে মায়ের হাতে বিস্রস্ত সাদা ফুল বুকের কাছে ধরা।

তাদের মাথা দুটো এত কাছাকাছি যে মনে হয় যেন তাদের কানের লতি পরস্পরকে ছুঁয়ে আছে।

অন্য আরেকটা ছবিতে বাবা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একটা বেড়ার সামনে। বুটের নীচে বরফ। সেই বরফ এত সাদা যে বাবার চারদিকে শুধুই শূন্যতা ছড়িয়ে। তার হাত স্যালুটের ভঙ্গিতে মাথার ওপরে তোলা আর জামার কলারের ওপরে রিপু করা আছে প্রাচীন জার্মান বর্ণমালার অক্ষর।
এর পরের ছবিতে, বাবার কাঁধের ওপরে একটা নিড়ানি বিশ্রামরত। তার পিছনে একটা শস্যকুঁড়ি আকাশ ভেদ করে গেছে। বাবার মাথায় একটা টুপি। সেই টুপি দীর্ঘ ছায়া ফেলে তার মুখ আড়াল করেছে।

পরের ছবিটায়, বাবা একটা ট্রাকের স্টিয়ারিং-এর পিছনে বসে। ট্রাকটা গরুতে ভরা। প্রতি সপ্তাহে বাবা শহরের কসাইখানায় গরু নিয়ে যেতেন। এ যে সময়ের ছবি, সেইসময়ে বাবার মুখ ছিল রোগা আর কাটা-কাটা।

ছবিগুলোয়, বাবা একেকটা বিশেষ বিভঙ্গে স্থির। ছবিগুলো দেখে মনে হয় বাবা যেন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। আদতে কিন্তু বাবা জানতেন তাঁকে কী করতে হবে। সেই কারণে এই সমস্ত ছবিই মিথ্যে। এই সমস্ত মিথ্যে ছবি, এই সমস্ত মিথ্যে অবয়ব ঘরটাকে শীতল নিষ্প্রাণ করে রেখেছিল। আমি চেয়ার থেকে উঠতে চাইছিলাম, কিন্তু আমার পোশাক তখন কাঠের মতো খটখটে আর শক্ত হয়ে গেছে। আমার পোশাক ছিল স্বচ্ছ আর কালো। আমি নড়লেই সেটায় খচমচ আওয়াজ হচ্ছিল। আমি উঠে বাবার মুখ ছুঁলাম। তার মুখ ঘরের অন্য সমস্ত জিনিসের থেকে ঠান্ডা। অথচ বাইরে গ্রীষ্ম। মাছি উড়তে উড়তে তার ডিম পাড়ছিল। রাস্তা ছিল গরম আর ধুলোভরা। তার ছটা যেন চোখ পুড়িয়ে দেবে।
চারপাশে পাথরের সমাধিক্ষেত্র। বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই সমাধির ওপরে।

যখন আমি নীচে তাকালাম, তখন আমার ক্ষয়ে যাওয়া জুতোর সুকতলা দেখতে পেলাম। পুরো সময়টা, আমি আমার জুতোর ফিতের ওপরে হাঁটছিলাম। আমার পিছনে সেগুলো পড়েছিল; লম্বা আর ভারী, আর তাদের প্রান্তগুলো গুটিয়ে গেছিল।

দুজন টালমাটাল ছোটখাটো মানুষ দুটো জীর্ণ দড়ি দিয়ে শববাহী গাড়ি থেকে শবাধার নামিয়ে দিচ্ছিল সমাধিতে। শবাধারটা দুলছিল আর দড়িদুটো আর তাদের হাত কেবলই প্রলম্বিত হচ্ছিল তখন। পিপাসার্ত সমাধিটি ছিল জলে পূর্ণ।

এক ছোটোখাটো মাতাল মানুষ বলল, তোমার বাবা অনেক মানুষ মেরেছেন।

আমি বললাম : উনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন। প্রতি পঁচিশজনকে মেরে তিনি একেকটা পদক পেয়েছেন। তিনি অনেক পদক এনেছিলেন বাড়িতে।

ছোটো মানুষটি বলল, তিনি শালগমের জমিতে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করেছিলেন। আরও চারজন সৈনিকের সঙ্গে। তোমার বাবা মেয়েটির দুপায়ের মাঝে একটা শালগম গুঁজে দিয়েছিলেন। যখন আমরা চলে গেছিলাম মেয়েটির রক্ত ঝরছিল। সে ছিল রাশিয়ান। কিছু সপ্তাহ পরে, আমরা সমস্ত অস্ত্রকে শালগম বলে ডাকা শুরু করব।

সেটা ছিল হেমন্তের শেষাশেষি, ছোটো মানুষটা বলল। শালগমের পাতাগুলো কালো হয়ে গেছিল আর বরফে চাপা পড়েছিল। তারপর ছোটো সেই মানুষ শবাধারের ওপরে একটা বড়ো পাথর রাখল।

অন্য মাতাল ছোটো মানুষটি বলে চলল:

নতুন বছর উদ্‌‌যাপনের জন্য আমরা জার্মানির এক ছোটো শহরে একটা অভিনয় দেখতে গেলাম। গাইয়ে মহিলার গলা ছিল সেই রাশিয়ান মেয়েটির চিৎকারের মতোই তীক্ষ্ণ। একে একে আমরা থিয়েটার ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। তোমার বাবা থাকলেন শেষ পর্যন্ত। কিছু সপ্তাহ পরে, তিনি সব সঙ্গীতকে শালগম ডাকা শুরু করলেন আর সব মেয়েকেও।

ছোটো মানুষটি চোলাই মদ খাচ্ছিল। তার পেট তখন মদে টইটম্বুর। কবরে যতটা জল জমে, ততটা চোলাই আছে আমার পেটে, ছোটো মানুষটি বলল।

তারপরে ছোটো মানুষটি একটা বড়ো পাথর রাখল শবাধারের ওপর।

যে মানুষটি জানাজার খুতবা পড়ছিলেন, তিনি সাদা মার্বেলের তৈরি যিশুর ক্রুশবিদ্ধ মূর্তির পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন। তিনি তার দুই হাত কোটের পকেটে পুরে রেখেছিলেন।

যে মানুষটি জানাজার খুতবা পড়ছিলেন তার জামার বোতামঘরে একটা একমুঠো পরিমাণ গোলাপ ছিল। সেটা ছিল মখমলের। তিনি আমার ঠিক পাশে এসে দাঁড়ালেন আর পকেট থেকে একটা হাত বের করলেন। হাতটা ছিল মুঠো করা। তিনি তার আঙুলগুলো সোজা করতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। ব্যথায় তার চোখ যন্ত্রণায়‌ ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল। তিনি ভেতরে ভেতরে কাঁদছিলেন।

যুদ্ধে তুমি তোমার দেশবাসীর সঙ্গে যেতে পারো না, তিনি বললেন। তুমি তাদের আদেশ করতে পারো না।

তারপরে সেই জানাজার খুতবা পড়া লোকটি শবাধারের ওপর একটা বড়ো পাথর রাখলেন।

এবার একজন মোটা মানুষ এসে আমার পাশে দাঁড়াল। তার মাথা যেন মুখহীন একটা নলের মতো।

তোমার বাবা আমার স্ত্রীর সঙ্গে বছরের পর বছর সহবাস করেছেন। আমি যখন মদ্যপ অবস্থায় ছিলাম তিনি আমায় সব ফাঁস করে দেবার ভয় দেখিয়ে আমার টাকা ছিনিয়ে নিয়েছেন।

তিনি একটা পাথরের ওপরে বসলেন।

তারপরে এক কৃশ বলিচিহ্নিত মহিলা এগিয়ে এলেন আমার দিকে, মাটি চাপড়ালেন, আর অভিশাপ দিলেন আমাকে।

জানাজার জমায়েত ছিল কবরের বিপরীত দিকে। আমি নীচু হয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম, কারণ তারা সবাই আমার স্তন দেখতে পাবেন। আমি পাথর হয়ে গেলাম।

প্রত্যেকের দৃষ্টি তখন আমার ওপরে নিবদ্ধ। আর সেই দৃষ্টি শূন্য। তাদের চোখের মণি চোখের পাতার নীচে থেকে আমায় বিদ্ধ করছিল। পুরুষদের কাঁধের ওপরে বন্দুক ছিল, আর মহিলারা মালা জপছিলেন।

যে মানুষটি জানাজার খুতবা পড়ছিলেন তিনি তার গোলাপটি ছিঁড়ছিলেন। তিনি রক্তলাল একটি পাপড়ি ছিঁড়ে সেটা খেয়ে ফেললেন।

তিনি তার হাত দিয়ে আমায় ইশারা করছিলেন। আমি জানতাম আবার আমায় কিছু কথা বলতে হবে। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে।

আমি একটা শব্দও ভাবিনি। আমার চোখ উঠে যাচ্ছিল কপালে। মুখে আঙুল পুরে আমি চিবোতে থাকলাম। কেউ চাইলে আমার হাতের পিছনে আমার দাঁতের দাগ দেখতে পেতো। আমার দংশন উষ্ণ ছিল। আর উত্তপ্ত রক্তের স্রোত আমার কান গলা গরম করে দিচ্ছিল।

তখন বাতাসের দাপটে আমার পোশাকের একটা হাতা ছিঁড়ে গেছে। সেটা পিছনে ঝুলছিল আর দুলছিল বাতাসে।

একজন তার ছড়ি একটা বড়ো পাথরের গায়ে ঠেস দিয়ে রেখেছিল। তিনি তার রাইফেল তাক করে উড়ন্ত হাতাটা নামালেন। যখন সেটা আমার সামনে মাটিতে পড়ল, সেটা ছিল রক্তে ভেজা। জানাজার জমায়েত বাহবা দিয়ে উঠল।

আমার হাত খোলা। আমার মনে হল সেটা বাতাসে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

অধ্যক্ষ ইশারা করলেন। বাহবা থেমে গেল।

আমরা আমাদের জাতি সম্বন্ধে গর্বিত। আমাদের কৃতিত্ব আমাদের অধঃপতনের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। আমরা কখনোই নিজেদের অপমান করব না, তিনি বললেন। আমরা আমাদের নিন্দিত হতে দেব না। জার্মান জাতির নামে তোমায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল।

তারা সবাই তাদের বন্দুক আমার দিকে তাক করল আর তারপর আমার মাথার মধ্যে কানে তালা লাগানো একটা আওয়াজ হল।

আমি পড়ে গেলাম, কিন্তু মাটিতে পৌঁছালাম না; বন্দুকবাজদের হাতের ওপরে বাতাসে ঝুলন্ত হয়ে রইলাম।

আর তারপর শান্তভাবে আমি দরজা ঠেলে খুললাম।

আমার মা সমস্ত ঘর পরিষ্কার করে রেখেছেন।

এখন ঘরে একটা বড়ো টেবিল রয়েছে যাতে দেহটি শোয়ানো ছিল। এটা আসলে একটা কসাইয়ের টেবিল। সেখানে ছিল একটা শূন্য সাদা থালা আর বিস্রস্ত সাদা ফুলের তোড়াসহ একটা ফুলদান।

মা ঘরে একটা স্বচ্ছ কালো পোশাক পরে, হাতে একটা বড়ো ছুরি ধরে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রথমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মা তার মোটা পাকা চুলের বিনুনি কেটে ফেললেন। তারপর তিনি দুহাতে সেই কাটা বিনুনি টেবিল অব্দি নিয়ে এলেন। তার একটা প্রান্ত তিনি রাখলেন থালার ওপর।
আমি আমার বাকি জীবনটা শুধুই কালো রং পরবো, তিনি বললেন।

এরপর বিনুনির এক প্রান্তে তিনি আগুন দিলেন। সেটা টেবিলের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পৌঁছল। বিনুনিটা সলতের মতো জ্বলে গেল। আগুন ক্রমশ সব গিলে ফেলছিল।

রাশিয়ায় তারা আমার চুল কামিয়ে দিয়েছিল। সেটা ছিল সবচেয়ে কম শাস্তি, তিনি বললেন। আমি খিদেয় টলছিলাম। রাতে আমি শালগমের ক্ষেতের মধ্যে ঢুকেছিলাম। পাহারাওয়ালার একটা বন্দুক ছিল। আমায় দেখতে পেলে সে নির্ঘাত মেরে ফেলত। মাঠটায় কোনও শুকনো পাতার আওয়াজ ওঠেনি। সেটা হেমন্তের শেষাশেষি, শালগমের পাতা কালো হয়ে বরফে চাপা পড়েছিল।

আমি মাকে আর দেখতে পাইনি। বিনুনিটা জ্বলছিল। ঘরটা ধোঁয়ায় ভরে গেল।

তারা তোমায় মেরে ফেলেছিল, আমার মা বলল।

ঘরে এত ধোঁয়া ছিল যে, আমরা পরস্পরকে আর দেখতে পাইনি।

আমি আমার খুব কাছে মায়ের পায়ের শব্দ পেলাম। আমি দুহাত বাড়িয়ে তাকে অনুভব করতে চাইছিলাম।

হঠাৎ তিনি তার শুকনো কেঠো হাত আমার চুলের মধ্যে ঢুকিয়ে আমার মাথাটাকে জোরে জোরে ঝাঁকাতে লাগলেন। আমি চিৎকার করে উঠলাম আর হঠাৎই চোখ খুললাম। ঘরটা আমার চারদিকে ঘুরছিল। আমি বিস্রস্ত সাদা ফুলের গোছার মধ্যে পড়েছিলাম আর বন্ধ ছিলাম ঘরে।

তারপরে আমার এমন মনে হল যেন পুরো ফ্ল্যাটবাড়িটা নিজেকে উপুড় করে মাটিতে খালি করছে।

অ্যালার্ম বাজল। শনিবার সকাল, সাড়ে পাঁচটা।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২