কুমায়ুন ভ্রমণ ও তার নানা কিস্‌সা – শিবু মণ্ডল (পর্ব ১)

শেয়ার করুন

পথের গন্ধ ও নেশায়

বাচ্চাদের গরমের ছুটি শেষ হয়ে আসছে, কিন্তু গরম বাতাসের দৌরাত্ম্য থামছে না। বৃষ্টির ছিটেফোঁটারও গন্ধ পাচ্ছি না। একদিকে আসাম মেঘালয় সহ উত্তরপূর্ব ভারতে যখন বর্ষা রেকর্ড ভাঙছে তখন হরিদ্বারে দিনে দিনে উষ্ণতার রেকর্ড গড়ছে। এমন সময় আমরা হরিদ্বারস্থিত তিনটি বাঙালি পরিবার ঠিক করলাম সপরিবারে ঘুরতে যাবো রানিখেত ও বিনসার। বাঙ্গালির ঘুরতে যাবার প্ল্যান হলে যেন ঘরের ভেতর ও মনের ভেতর দুজায়গাতেই উৎসবের আমেজ লাগে। হোটেল বুকিং, ট্রেনের টিকিট বুকিং, কোথায় কতদিন, কীভাবে ঘোরাঘুরি হবে, সব মিলিয়ে মন যেন উড়ুউড়ু।একহপ্তা আগে থেকেই কর্তার অফিসের কাজে মন বসে না, কর্ত্রী রান্না করতে করতে করতে তরকারিতে লবণ দিতে ভুলে যায়। ছানাপোনারা ইউটিউবে সার্চ করতে করতে স্থানগুলির জনমকুণ্ডলী থেকে শুরু করে নাড়ীনক্ষত্র সবকিছু মুখস্থ করে নেয়। সবকিছু মিলিয়ে ভ্রমণ শুরু হবার আগেই এক মানসভ্রমণ শুরু হয়ে যায় আমাদের মননে। সেই ঢুলুঢুলু চোখেই সবাই উঠে বসলাম রাত একটার কাঠগোদাম এক্সপ্রেসে। পরদিন সকাল সাতটায় যখন কাঠগোদাম পৌঁছলাম তখন আমাদের চোখের ভিতরে বিগত রাতের অসম্পূর্ণ ঘুম আর বাইরে একটি গোটা পাহাড় ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে। কাঠগোদাম আমার ভীষণই পছন্দের একটি রেল ষ্টেশন। এর আগেও নৈনিতাল ও আলমোরা ঘুরতে আসার সুবাদে দু-দু’বার এই ষ্টেশনে পদার্পণ করেছি। নামি ভোরে আর ছেড়ে যাই সন্ধ্যায়। সুতরাং একে যখনই দেখি এক মায়াবি আলো লেগে থাকে যেন এর গায়ে। কেন জানিনা এখানে এলে আমার মালগুড়ি ডে’ইজ এর কথা মনে পড়ে যায়। তাই কিছুক্ষণ বসে থেকে এর রূপ উপভোগ করি। সব যাত্রী প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গেলেও বসে থাকি খালি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে। স্থানীয় ট্যাক্সি ড্রাইভারদের দু-একজন পেছন পেছন ঘুরঘুর করতে থাকলে একসময় সেই সুন্দর আমেজটি ভেঙে যায়। এরপরের গন্তব্যে পৌঁছতে ট্যাক্সি করা ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় থাকে না।

ছোটবড় মিলিয়ে আমাদের পুরো একটি ফুটবল টিমকে নিয়ে টেম্পো ট্র্যাভেলার চলেছে পাহাড় বেয়ে। গানে-আলাপে সবাই উজ্জীবিত। একটু একটু করে চড়াই চড়ছি আর বাতাসের মিষ্টি ভাব বাড়ছে তার সাথে। মাঝে মাঝে রেফারীর নির্দেশমতো বিরতি। যে তৃষ্ণা নিয়ে পথে বেরিয়েছি তাকে সিক্ত করতে পাহাড় ক্রমশ পাহাড় হয়ে সেজে উঠছে। এই পথে যদিও তেমন কোনও বড় নদী নেই, তবুও বাতাসে মেঘ, খাদের দুপাশে ঘন সবুজের সমাহার। সেজে থাকা পাহাড়ের গায়ে কোনও নাম লেখা থাকে না। তার শরীর জুড়ে শুধু সর্পিল পথের নেশা। আমরা সেই পথের গন্ধ ও নেশায় খেলোয়াড় থেকে ক্রমশ পর্যটক হয়ে উঠছি। একটু বিরতি পেলে পাহাড়ের কাছে যাই, তার শরীর ছুঁয়ে দাঁড়াই কিছুক্ষণ, শুঁকিয়ে যাওয়া ঝরনার দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছি বোধহয়। যুগ যুগ ধরে চাপা পড়ে থাকা পাষাণের বুকে মাথা রাখি, তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কান পাতি তার হৃদয়ে। তার চাপা কান্না আমদেরকেও নিঃসঙ্গ ও একই সঙ্গে ভয়ার্ত করে দিল কি! সভ্যতার কিছু খেলোয়াড় এই পাহাড়কে নিয়ে খেলছে তাদের মতন। জটিল ও কুটিল এই খেলোয়াড়দের ফাউলে ফাউলে বিধ্বস্ত পাহাড়ের শরীরে গভীর ক্ষত। রক্ত ঝরছে অনবরত। নদী আর নদী নেই, পাথর আর পাথর নেই,গাছ আর গাছ নেই। সভ্যতার উন্নয়নের পথ কেবলই চওড়া হচ্ছে পাহাড়ের চিৎকার সত্ত্বেও। যেতে যেতে দেখি পথের ধারে বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থাকা রেস্টুরেন্টে সেজে উঠেছে আমার প্রিয় নাগরিক বনসাই। সভ্যতার পার্থিব উন্নয়নের ধুয়ো ধুলো গায়ে মেখে আমরা এগিয়ে চলেছি এক অপার্থিব আনন্দের খোঁজে।

তবে খুব বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হয়নি। ড্রাইভারকে যেমনটি বলা ছিল তেমনই সরাসরি ম্যাল রোডস্থিত কেএমভিএন- এর ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউস পরিসরের ভিতরে আমাদের নামিয়ে দিল। রানিখেত বাজারের ভিড়কে পাশে ফেলে রেখে একটি সবুজ পাইন ঘেরা পথ উঠে গেছে এক নির্জন আশ্রয়ের খোঁজে! এখানে পাহাড় কিছুটা ঝুঁকে গেছে, তার প্রশস্থ বুকে আমাদের আশ্রয় দেবে বলে। ধাপে ধাপে অনেকটা জায়গা জুড়ে রেস্ট হাউসের সবুজ মেরুন ঘরগুলি গড়ে তোলা হয়েছে। পথের ক্লান্তি মুহূর্তে শুষে নিতে পারে এমন উদার বারান্দা ও প্রশস্ত লন আমাদের স্বাগত জানাল। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে একটু বিশ্রামের পর মন যেন উদাসী বাউল। নগরের প্রান্তে এই রেস্ট হাউস যেন বাউলের আখড়া। উঁচু উঁচু পাইনের ছায়া লম্বা হতে হতে অপরপ্রান্তের পাহাড় ছুঁতে চায়। নিচের ধাপের স্টাফ কোয়ার্টারের পাশের ওক গাছটির মগডালে বসে থাকা দুটি ঘুঘু পাখি উড়ে চলে গেল আরও দূরে আরেকটু নিচের ওক গাছটিতে। বারান্দার চেয়ারে বসে এই সব দেখি আর দেখি। এই সব দৃশ্য ছেড়ে মন নড়তে চায়না কিছুতেই। কোথায় যাবো এসব ছেড়ে! এইসব চক্ষু স্থির করে দেওয়া দৃশ্য দেখবার জন্যই তো এখানে আসা। তবু উঠতে হয়, নিজের জায়গাটি ছাড়তে হয় সবার কথা ভেবে। বেলা থাকতে থাকতে যতটা পারা যায় ভ্রমণের আস্বাদ নেওয়া যাক। গাড়ি ভাড়া করে সকলে চললাম রানিঝিল! শহরের মধ্যেই রানিঝিল ছোট্ট অথচ ভারী সুন্দর একটি লেক। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে একটি ঝরনাকে আটকে এই কৃত্রিম লেকটি বানানো হয়েছে। বর্ষাজল সংরক্ষণের সুন্দর একটি দৃষ্টান্ত এটি। নানা রঙিন মাছে ভরপুর লেকটিতে বোটিং এর ব্যবস্থাও আছে। আছে ফ্লাইং ফক্স, ওয়াটার রোলার ইত্যাদি সব মনোরঞ্জনের ব্যবস্থাও। এসব ছাড়িয়েও যেখানে সবচেয়ে বেশি ভিড় লেগেছে সেটা হল সেলফি পয়েন্ট। লেকের একেবারে সামনে উঁচু ধাপে বড় বড় গ্লোসাইনে লেখা আছে ‘I LOVE RANIKHET’। এখানে সেলফি না তুললে কোনো প্রমাণই থাকবে না যে রানিখেত এসেছিলাম ও তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আমরাও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এক এক করে ছবি তোলার সুযোগ পেলাম। পরে দেখি শিখা আমার যে ছবিটা তুলেছে সেটাতে উঠেছে শুধু I Love Rani। খেত উধাও। এই নিয়ে বেশ হাসাহাসিও হল। যাই হোক এখানে এসে রানিই হোক অথবা খেত দুজনেরই প্রেমে পড়ে গেছি। চারিদিকে এত সুন্দর সুন্দর খেত ও উপত্যকা দিয়ে ঘেরা এই পাহাড়ি শহরকে যে না ভালোবাসতে পারবে সে ভারতবর্ষকেও ভালোবাসতে পারবে না। এমনই মোহময় ও মায়াময় এই স্থান। কথিত আছে দ্বাদশ শতাব্দীতে কুর্মাঞ্চলে রাজত্ব করা কাত্যুরি রাজবংশের এক স্থানীয় রাজা সুধারদেব তাঁর রানিকে নিয়ে সসৈন্যে শিকারে বেরিয়েছিলেন। পথে এই অঞ্চলে রাত্রিবাসের জন্য তাঁবু গাড়েন। এখানে তখন পাহাড়ের ধাপে ধাপে ছোট ছোট খেত করে চাষবাস করে স্থানীয়রা। এখানকার মনোরম সৌন্দর্য রানিকে মুগ্ধ করে। তিনি প্রেমে পড়ে যান এই পাহাড়ি উপত্যকার। অতঃপর রাজার কাছে আবদার করে বসেন এখানে একটি বসবাসের বন্দোবস্ত করে দেবার জন্য। রাজকীয় আবদার বলে কথা। রাজারও কোনো উপায় নেই রানির অবদারকে অবহেলা করবার। শেষে এখানেই মহল বানিয়ে থেকে যান তারা। তখন থেকেই রাজা সুধরদেব এই অঞ্চলটির নাম দেন রানিখেত! অর্থাৎ খেতের রানি।

এখনো সন্ধ্যে হতে বাকি। তাই সবাই মিলে চলে গেলাম সদর বাজার ঘুরতে।সাধারণত কিছু কেনাকাটা থাকলেই আমরা বাজারে যাই, তবে এখানে তেমন উদ্দেশ্য নিয়ে আসা হয়নি।শুধু ঘুরে দেখবার জন্যই এসেছি। হেঁটে হেঁটে বাজারে ঘুরতে ভালোই লাগে।জমজমাট বাজার, তবে বিরক্ত করা ভিড় নেই। এই গ্লোবাল ভিলেজের যুগে সব শহরেই মোটামুটি সবকিছু পাওয়া যায়। তাই একইরকম লাগে। কিন্তু মানুষগুলি আলাদা হয়, দোকান, হোটেল বাড়িগুলির গঠন আলাদা হয়, এইসব দেখি। দেখি কোন হোটেলটি কত পুরানো। দেখি সেখান থেকে কতটা পাহাড়ের ঢেউ দেখা যায়। কোথাও কোথাও বড় বিল্ডিংয়ের জন্য সেই দৃশ্য আড়ালে চলে যায়, আবার হয়তো ফাঁকা জায়গা দেখে হাতছানি দেয়। আমাদের মহিলা পার্টিগণ চলতে ফিরতে ফুটপাথে কিংবা সুদৃশ্য সাজানো দোকানে ঢুকে ড্রেসের দরদাম করে যাচাই করে নিচ্ছে নিজের শহর থেকে কতটা দামি অথবা সস্তা। কোনো শহর কতটা সুশৃঙ্খল তা বোঝা যায় সেখানকার ফুটপাথের হকার ও ট্যাক্সিওয়ালাদের ব্যবহার দেখে। এখানে তারা পাহাড়ের মতোই আপাত শান্ত। কোনো হাঁকডাক নেই, গ্রাহক ধরতে কোনও অতিরিক্ত পেছনে লাগা নেই, দু’চারটে পোশাক নেড়েচেড়ে দেখে না কিনলেও কোনো বিরক্তি প্রকাশ নেই। তাই আমাদের মহিলা টিমও আপাত শান্ত। আর আমরা পুরুষপার্টি খুঁজছি একটি অফসপ! বাচ্চাপার্টির নজর শুধু খাবার ও খেলনার দিকে।কেউ খাবে পিৎজা, কেউ চিপস। আর অদৃজা খুঁজছে বেলুন। শিশুদের বেলুনের প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ! বেলুনকে উড়তে দেখে হয়তো ওদের শিশুমনেও ওড়ার স্বপ্ন গড়ে ওঠে। বাঙালি যেখানেই যাক, চা না হলে চলে না তার। তাইতো দিনের আলো নরম হতেই মন এক কাপ চা চা করে ওঠে। সদর রাস্তা থেকে একটা গলিতে ঢুকে খুঁজে পেলাম এক চাচার চায়ের ঠেক। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রানিখেতের পাহাড়ে সন্ধ্যের ছায়া নেমে আসে। আমরাও ফিরে আসি আলো জ্বলে ওঠা আমাদের দুদিনের আখড়ায়।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *