রূপকথা – শান্তনু ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

যদিও হেঁটে যেতে হত অনেকটা পথ এবং সে-পথ ছিল বড়ো জটিল, যেন এক গোলকধাঁধা— তবু বারবার চাইতাম ও-পথে হাঁটতে। খুব চেষ্টা করতাম হাঁটতে হাঁটতে চিনে নিতে সে-পথের মানচিত্র। তবে প্রতিবারই হাঁটা শুরু করার পর ক্রমশ ভয়ে ভারী হয়ে উঠত আমার বুক, মনে হত হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পথেই মরে যাব। প্রতিবারই আমার মনের কথা পড়ে ফেলত বাবা। হাঁটার গতি না কমিয়ে, না থামিয়ে আমার ঘামে ভেজা মুখের ওপর দৃষ্টি নামিয়ে জিজ্ঞাসা করত, ‘কষ্ট হচ্ছে?’ একই প্রশ্ন প্রত্যেক বার, মাত্র দুটোই শব্দ সে প্রশ্নে! আমি দু-পাশে মাথা নাড়তাম। তারপর পালটা প্রশ্ন করতাম, ‘আর কত দূর?’ প্রতিবার আমারও ওই একই প্রশ্ন, সাকুল্যে তিনটে শব্দে তৈরি হত যে প্রশ্ন! মিথ্যা আশ্বাস দিত না বাবা, সময়ের মাপে যতটুকু পথ বাকি থাকত, ঠিক ততটুকুই জানাত। ওই পথে হাঁটতে হাঁটতেই আমি যেন একটু একটু করে শিখে নিচ্ছিলাম অদৃশ্য সময়ের হিসাব। উত্তর শেষে কখনও কখনও বাবা হাঁটা থামিয়ে দু-হাতের তালু বুলিয়ে তুলে নিত আমার কপাল, গাল, চিবুকের ওপর জমে ওঠা ঘাম। তারপর সেই ঘাম মুছে নিত তার গোলাপি, আকাশি, কিংবা সাদা জামার বুকে।

শিল্পী: ভাস্কর প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

একটা সময় বাতাসের বেগে শীতের অনুভূতি জাগত আমার শরীর জুড়ে, প্রতিবারই। বুঝতাম, গন্তব্যের কাছাকাছি চলে এসেছি আমরা। আমার শরীর থেকে ফিকে হয়ে আসত ক্লান্তি। দৃষ্টিপথের শেষে তখন হয়তো ফুটে উঠেছে একটা সবুজ রেখা। মনে হত, ছুটতে শুরু করি বাবার পাঁচটা শক্ত আঙুলের বন্ধন মুক্ত হয়ে। কিন্তু মুক্ত করতে পারতাম না নিজেকে। সেটা বাবার প্রতি ভয়ে নাকি বাবার স্পর্শে হেঁটে চলার ভালোলাগায়, আজও জানি না। সবুজ রেখাটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠত চোখের সামনে। চরমে উঠত আমার শিশু-মনের উত্তেজনা। বাবা কিন্তু থাকত নির্বিকার। সবুজের টানে এতটুকু গতি বৃদ্ধি হত না তার দু-পায়ে। সবুজ রেখা যত উজ্জ্বলতা পেত দৃষ্টিতে, ততই বাড়ত আমার ব্যাকুলতা। রাগ হত বাবার প্রতি, প্রতিবারই। ভাবতাম, বাবা যেন পরিকল্পিতভাবে আমার জন্য বরাদ্দ বিকেলটা ক্ষয়ে দিতে চাইছে… কী আশ্চর্য! প্রত্যেক বার আমার মনের অতি গোপন কথাটি পড়ে ফেলত বাবা। বলত, বিকেলের এখনও অনেক বাকি… মনের ভেতর শান্ত হয়ে পড়তাম আমি। জানতাম, বাবা মিথ্যে বলে না কখনও।

যখন সবুজ রেখাটির খুব কাছে পৌঁছে যেতাম তখন প্রতিবারই, বাবা হাত ছেড়ে দিত আমার। যদিও তখন গতি উঠত না আমার পায়ে। বাবার গা-ঘেঁষে আসতাম আরও। আমার মনের ভেতরটা দেখে ফেলত বাবা। বলত, কোনো ভয় নেই— যেন এক ম্যাজিক, প্রতিবারই বাবার এই অভয়বাক্যে সাহস ছড়িয়ে পড়ত আমার বুক জুড়ে। দৌড়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়তাম আমি এবং এক অদ্ভুত সুবাসে ভরে উঠত আমার ভেতরটা! এ সুবাস কীসের— ফুলের? পাতার? জংলি ঘাসের? নাকি কোনো বন্য পশু-পাখির লোম-পালকের? জানতে চেয়েছি কখনও-কখনও বাবার কাছ থেকে। প্রতিবার একই কথা উচ্চারণ করত বাবা, যার ভেতর উত্তর থাকত না, থাকত আর এক পাথুরে প্রশ্ন— আমি বলব না, তুমি খুঁজে বের করবে এ গন্ধের উৎস।

বাবা সে প্রশ্নের উত্তর জানায়নি আমায়। উত্তর জানাবার আগেই সে হারিয়ে গেছে ঘন জঙ্গলে। বাবা হয়তো চাইত অরণ্যের বাতাসে ভেসে থাকা গন্ধের উৎস অন্বেষণে আমি আমৃত্যু বজায় রাখি আমার অরণ্য ভ্রমণ— বাবার অব্যক্ত ইচ্ছা পূরণের অঙ্গীকার করেছি আমি আমার নিজের কাছে। যখনই জঙ্গলে গেছি, চারপাশে ভেসে থাকা গন্ধের উৎস খুঁজেছি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসায়।

আজ দুপুরে হঠাৎ এসেছিল এক পশলা বৃষ্টি। পশ্চিমাকাশে এক টুকরো ছাই-মাখা মেঘ ছাড়া বৃষ্টির আর কোনো পূর্বাভাস ফুটে ওঠেনি চারপাশে। সেই বৃষ্টিতেই এখন জলধোয়া হয়ে রয়েছে চারপাশের সবুজ। আমি হাঁটছিলাম জঙ্গলের চেনা পথে। সামনে একটা বাঁক। বাঁক পেরোলেই সেই ছোটো ঘাসজমিটা, যেখানে বসে কখনও-সখনও নিজের কথা ভাবি। জঙ্গলের ওই বাঁকে আজ প্রথম দেখলাম মানুষটাকে। হঠাৎ দর্শনে ভয় পেলাম খুব— কে এই অদ্ভুত-দর্শন মানুষ? এ কি কোনো অরণ্যচারী বন্যপুরুষ? নাকি এক জঙ্গলদেবতা, যে আজ তার পাথুরে শরীর থেকে রক্তমাংসের শরীরে রূপান্তরিত হয়েছে স্ব-ইচ্ছায়?

আশ্চর্যজনকভাবে, বাবার মতোই সে পড়ে ফেলল আমার মনের কথা। ক্রূর হেসে বলল, কী মনে হচ্ছে, আমি এক জংলি মানুষ, নাকি আমি এক বনদেবতা?

আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকলাম মানুষটার দিকে। বুকের ভেতর ক্রমেই বেড়ে চলেছে হৃৎপিণ্ডের কাঁপন-মাত্রা, যে-কোনো সময় গোলাপি হৃৎপিণ্ডটা বুক ফাটিয়ে ছিটকে পড়তে পারে জঙ্গলের সবুজ মাটিতে। আমার খুব কাছে এগিয়ে এল মানুষটা। তার গলায় ঝুলে থাকা জংলি ফুলের মালাটা সে পরিয়ে দিল আমার গলায়। সরু ডাল-পাতার যে-মুকুটটা শোভা পাচ্ছিল তার কপালের ওপরে, সেটা দু-হাতে নামিয়ে তুলে দিল আমার মাথায়। ভারী স্বরে বলল, বেশ দেখতে লাগছে। মনে হচ্ছে, জঙ্গল-যুবরাজের অভিষেক হল আজ!

তার কথার মধ্যে এমন কিছু একটা আছে যা আমার বুক থেকে মুছে দিল ভয়; সবটা না হলেও, অনেকটা। আমার হাত চেপে ধরল সে। বলল, চলো…

বাবা যেভাবে হাত ধরে আমাকে জঙ্গলের পথে হাঁটিয়ে নিয়ে যেত, সেভাবেই অচেনা মানুষটা আমায় হাঁটিয়ে নিয়ে চলেছে জঙ্গলের সবুজ ছায়ায়। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারছি না, সে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। আমি যেন সম্মোহিত! হেঁটে যাচ্ছি তার সঙ্গে পা মিলিয়ে।

অনেকটা হাঁটলাম। তারপর থামলাম একচিলতে সবুজ ঘাস জমিতে এসে। একটু দূরে একটা পাহাড়ি ঝর্না। ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া জলের শব্দে বাতাস এখানে ভারী। চারপাশের জঙ্গল নিবিড় ঘন। বনের এ অংশের বর্ণনা আমি বাবার মুখে শুনেছিলাম। বাবা মানা করেছিল জঙ্গলের এ প্রান্তে আসতে। বলেছিল, জঙ্গলের উত্তর-পশ্চিম অংশটি ভয়ংকর, বিপজ্জনক। কেন ভয়ংকর, কেন বিপজ্জনক, তা বলেননি বাবা।

লোকটা আমাকে কচি সবুজ ঘাসে ভরা একটা ছোটো ঢিপির ওপর বসাল, নিজেও বসল পাশে। চারপাশের সবকিছুকে ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার দৃষ্টি— আমার অতি চেনা জঙ্গলের সঙ্গে মেলানো যাচ্ছে না এই জঙ্গলকে। আমার প্রিয় জংলি গন্ধটা এখানে নেই। পুরোনো ভয়টা ফিরে আসছে বুকে, আগের মতোই আড়ষ্ট জিভ। লোকটা এবারও পড়ে ফেলল আমার মনের কথা। বলল, তোমার ভয় পাবারই কথা! এ জায়গাটা ভালো নয়, এ এক ভয়ংকর জায়গা।

ভয়ের ভেতর দিয়েই এক ফালি সাহস ফিরল আমার বুকে। যে প্রশ্ন বাবাকে জিজ্ঞাসা করে উত্তর পাইনি, তা রাখলাম লোকটার সামনে— কেন-র উত্তরে সে জানাল, বহু আগে এই জঙ্গলের নীচে ছিল এক শহর। কোনো এক প্রাকৃতিক কিংবা অপ্রাকৃতিক কারণে সেই শহর ধ্বংস হয়ে যায়। সম্পূর্ণ শহরটা চলে যায় মাটির তলায়। ক্রমশ মাটি ফুঁড়ে আকাশে মাথা তোলে একের পর এক দানব বৃক্ষ। একটা শহর একটা জঙ্গলে রূপান্তরিত হয়। জঙ্গলের এই অঞ্চলের নীচে ছিল শহরের বিরাট কারাগারটি। যেখানে লোহার কালো গরাদের পিছনে ভয়ংকর সব বন্দিদের থামিয়ে রাখা হত। যদিও সেই শহরে চুরি-ডাকাতি-ধর্ষণের ঘটনা কখনও ঘটত না।

যখন আমি ভাবছি, তাহলে কোন্ অপরাধে, কাদের বন্দি রাখা হত ওই কারাগারে, তখনই লোকটা বলল, যারা চারপাশের সময়টা বদলে দিতে চাইত, মানুষকে মুক্তির মন্ত্র শেখাত অতি গোপনে, সেই অপরাধীদের বিচার হত ওই কারাগারে বন্দি রেখে…

লোকটার কথার মধ্যে যে সম্মোহনী শক্তি ছিল, তা ফিকে হয়ে আসছে আমার কাছে। আমার মনে হচ্ছে, বানিয়ে-বানিয়ে মিথ্যে কথা বলছে লোকটা‌। এ ঘটনা সত্য হলে বাবা-ই আমাকে জানিয়ে যেত তা!

এবারও লোকটা পড়ে ফেলল আমার মনের কথা। বলল, তোমার বাবা এ ইতিহাস জানত। তুমি ভয় পাবে ভেবেই তোমার কাছে গোপন রেখেছিল সত্যটা।

লোকটার কথা যখন আমাকে বাবার মুখোমুখি হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তখন সে বলল, তুমি কখনও তোমার বাবার বাজানো বাঁশির সুর শুনেছো?

মনে হল, কেউ যেন আমার বুকে বিরাট এক লোহার হাতুড়ির আঘাত হানল। আমার ভগ্নাংশ প্রশ্নের আগেই সে তথ্য জুড়ে কথা সাজাল— তোমার বাবা এ অরণ্যের সবচেয়ে বড়ো বংশীবাদক ছিল।

আমাদের ছোট্ট ঘরের টালির চালের বাঁশের কাঠামোর খাঁজে একটা আড়বাঁশি গোঁজা থাকতে দেখেছিলাম সেই কোন্ ছোটোবেলা থেকে। কিন্তু বাবাকে আমি কখনও বাঁশি বাজাতে দেখিনি। বাবা হারিয়ে যাবার পর মা জানিয়েছিল, বাবা নাকি বলে গেছে, নতুন কোনো সুর খুঁজে পেলে তবেই বাঁশির গায়ে ঠোঁট ঠেকাবে। মা বলেছিল, বাবা এক নতুন সুরের খোঁজেই ঘর ছেড়েছে।

কিন্তু লোকটার একটা কথা আমার চারপাশে কুয়াশা নামিয়ে আনল— তোমার বাবা এই জঙ্গলের সবচেয়ে বড়ো বংশীবাদক ছিল, তার মানে বাবাকে বাদ দিয়ে আরও অনেকে বাঁশি বাজাত এ অরণ্যে? কিন্তু আমি তো কখনও কাউকে বাঁশি বাজাতে দেখিনি এই জঙ্গলে, বনভ্রমণে কোনো সুরস্মৃতি তো জমা নেই আমার ভেতরে!

মন জুড়ে যখন রহস্যের নীল কুয়াশা ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে তখন লোকটার ধাতব স্বর কাঁপিয়ে দিল আমাকে— সামনে একটা গাছের গুঁড়ির ওপর আঙুল নির্দেশ করে তার ওপর আমাকে বসতে বলছে সে। স্থির হয়ে যাওয়া আমার হৃৎপিণ্ডটা কাঁপতে থাকল তুমুল গতিতে। মনে হচ্ছে, আগলে রাখা হৃৎপিণ্ডটা এবার বুকের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে পড়বে বাইরে!

আমি কোনো প্রতিবাদ করতে পারলাম না, শ্যাওলা-মাখা গুঁড়ির ওপর গিয়ে বসলাম— এ-ও যেন লোকটার সম্মোহনী ক্ষমতা! লোকটা ঢিপির ওপর বসে তার অতি বড়ো ঝোলার ভিতর হাত ঢোকাল। আমি ধরেই নিলাম, লোকটা ধনুক বের করে আমার বুকে তির ফোটাবে। হয়তো নিশানা অনুশীলনের মোক্ষম সুযোগ আজই সে প্রথম হাতে পেয়েছে। কথা অমান্য করলে হয়তো কাটারি বের করে কোপ বসাবে গলায়! মায়ের মুখটা মনে পড়ছে আমার। উপলব্ধি করছি, বাবা কেন নিষেধ করেছিল জঙ্গলের উত্তর-পূর্ব দিকে যেতে। কোনো কিছুই না-দেখার চেষ্টায় আমি দৃষ্টি নিয়ে গেছি মহাশূন্যে।

লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, নড়বে না, তোমার একটা ছবি আঁকব…

আমার ভেতরের আমি-টা ধাক্কা খেল। যদিও জমাট বেঁধে রইল বুকে জমে থাকা ভয়টা।

আমি জড়বৎ, মৃত্যুবেলার প্রহর গুনছি— ছবি আঁকার বাহানায় খুনি লোকটা হয়তো আমার মন বুঝে নিতে চাইছে! মূল উদ্দেশ্যে এগোবে এর পরে!

অনেকটা মাথা ঝুঁকিয়ে, কালো কালিতে কাঠি ডুবিয়ে খানিকক্ষণ কী সব আঁকিবুকি করে লোকটা উঠে এল আমার সামনে। তার দু-হাতের তালুর ওপর একটা শুকনো গাছের পাতা মেলে ধরল আমার দু-চোখের নীচে। এত অবাক কি আমি কোথাও, কখনও হয়েছি— বাদামি হয়ে আসা ছোটো এক পাতার ওপর যে-পুরুষ মুখটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে, সে কি গতজন্মের আমি? যার মাথায় পাতার মুকুট, গলায় বনফুলের মালা!

শিল্পী হেসে বলল, ছবিটা তোমাকে উপহার দিলাম। আজ তো তোমার জন্মদিন!

কী করে জানল সে, আজকের দিনে আমি পৃথিবীতে এসেছিলাম— আমি যখন এ কথার উত্তর খুঁজছি তখন সে বলল, চলো, জলের কাছে যাই।

এমন আন্তরিক আহ্বান কি ফেরানো যায়! ঝাঁপিয়ে নামা জলধারার খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা। উড়ে আসা জলরেণুতে ভরে যাচ্ছে আমার বুক-কপাল-চোখের পাতা।

জলের দিকে তাকিয়ে কিছুটা সময় নিজের জন্য আগলে রাখল শিল্পী। তারপর কোনো ভূমিকা তৈরি না করে বলল, তুমি জানো, তোমার বাবা কোথায় গেছে?

একটু সময় নিয়ে আমার জানা উত্তরটা তাকে জানাবার জন্য যখন প্রায় মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি, তখন সে বলল, তোমার বাবা একটা নতুন দিন খুঁজতে গেছে— আলো ঝলমলে একটা নতুন দিন!

আমার জানা উত্তরটার সঙ্গে এ উত্তর না মেলায় ছায়া নামল আমার বুকের ভেতর। নতুন দিন নয়, আমি জঙ্গলের নীচে চাপা পড়ে থাকা শহরটার কথা ভাবছি। মনে হচ্ছে, এই ফুরিয়ে আসা বিকেলে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ওই শহরের ধ্বংসাবশেষের ভেতর এখন হেঁটে যাচ্ছে বাবা।

নতুন দিনটা খুঁজে পেলেই বাবা ফিরে আসবে তোমার কাছে— কী শান্ত স্বরে কথা বলছে শিল্পী! যেন কথাগুলো আমাকে জানাবার জন্যই এতদিন অপেক্ষায় ছিল সে। তোমার বাবা নতুন দিনটা খুঁজে আনার পর আবার আমরা বাঁশির সুরে ভরিয়ে দেব এ অরণ্য।

আমরা! আমরা কারা?

আমরা, যারা একটা নতুন দিনের মাঝে দাঁড় করাতে চাই মানুষকে— শিল্পীর কপালে-চিবুকে-চোখের পাতায় জলধুলো।

শিল্পী বলল, চলো, যাই…

সে আমায় আবার কোথায় নিয়ে যেতে চাইছে, আমি জানতে চাইলাম না। জানতে চাইলাম না, বিপদসংকুল জেনেও কেনই-বা সে আমায় নিয়ে এল জঙ্গলের এ প্রান্তে! কেবল হেঁটে চললাম তার পাশে, সম্মোহিত হয়ে। জঙ্গলের সেই চেনা গন্ধটা উড়ে বেড়াচ্ছে আমার চারপাশে।

এটা কীসের গন্ধ বলো তো— আমার আবাল্য প্রশ্নের উত্তর শিল্পী আমার কাছে জানতে চাইল।

গন্ধের আবেশে কোনো কথা উচ্চারণ করতে পারলাম না আমি, মাথা নাড়লাম দু-পাশে। শিল্পী বলল, যারা এ অরণ্যে আসে, তারা প্রত্যেকে এ গন্ধ অনুভব করে। কিন্তু অনুভবে উঠে আসা গন্ধ কারও সঙ্গে কারও মেলে না। প্রত্যেকের কাছে এ গন্ধ ভিন্নতায় ধরা দেয়। এ সুবাস যে উঠে আসে তার মাতৃগর্ভের স্মৃতি থেকে!

আমি হাঁটছি নাকি ভাসছি? জঙ্গলের অতি চেনা পথটাও এখন আমার অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে, আজই প্রথম হাঁটছি এই অরণ্যপথে।

শিল্পী বনের প্রান্তে এসে দাঁড় করাল আমায়। হেসে বলল, দেখো, একদিন পুরো জঙ্গলটা মেতে উঠবে বাঁশির সুরে। খুব বেশি দূরে নেই সে দিন।

আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে জঙ্গলের গভীরে ফিরে যাচ্ছে শিল্পী। আমি মুখ ফিরিয়ে দূরের জনবসতির দিকে তাকালাম, যেখানে আমার ঘর। যে ঘরে একটু পরে প্রদীপ জ্বালবে আমার মা। মনে পড়ল, আমার ডান হাতের মুষ্টিতে ধরা আছে উপহার পাওয়া সেই মুখটা। চোখের খুব কাছে তুলে এনে খুলে ফেললাম মুঠো। তালুর ওপর ছড়িয়ে রয়েছে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া কালির রেখায় গড়া আমার সে-মুখ। যার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে শেষ-বিকেলের আলো ও আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকার।

ভেঙে যাওয়া শুকনো পাতার অজস্র খণ্ড বুনোবাতাসে উড়ে যাচ্ছে তালু-সীমানা ছেড়ে। শুধু পাতার টুকরো নয়, বাতাসে ভাসিয়ে দিলাম একটা প্রশ্নও— বাবা কি একটা নতুন দিনের খোঁজে ঘর ছেড়েছে নাকি একটা নতুন সুরের খোঁজে?

বাবার চিনিয়ে যাওয়া জটিল, গোলকধাঁধার পথ ধরে হাঁটছি আমি। ফিরে যাচ্ছি ঘরে। কালো হয়ে আসছে আকাশ। ওই আকাশের নীচে বয়ে চলা মহাজাগতিক বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে আমার অজস্র খণ্ড-বিখণ্ড স্মৃতি। একদিন এইসব স্মৃতির মাঝখান থেকেই আমাকে খুঁজে নিতে হবে আমার মাতৃগর্ভের স্মৃতিগুলোকে— জানি, এ কাজ তেমন কঠিন নয়!

ছবিকথা ক্যাটেগরি বা ভাস্কর প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য ছবি-কথা গুলি পড়তে পারবেন।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

2 Comments

  1. শান্তনুর গদ্য ভালো। ‘বাবা যেন পরিকল্পিতভাবে আমার জন্য বরাদ্দ বিকেলটা ক্ষয়ে দিতে চাইছে’ — এই জায়গাটা একটু কেমন যেন লাগছে।

  2. আর একটা কথা, ‘বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা’ বলে কি কিছু হয়?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২