পান্থপাদপের কাছে – এণাক্ষী রায়

পান্থপাদপের কাছে – এণাক্ষী রায়

শেয়ার করুন

রাত প্রায় দুটো বাজে। চারদিক নিস্তব্ধ। ঘুমন্ত শহর। রাস্তার কুকুরগুলোও চুপ হয়ে আছে। হাওয়ার শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছে দরজা-জানলা বন্ধ অন্ধকার ঘরে। পুরনো ফ্যানের হাওয়ার শব্দটাকে ভোঁ-ভোঁ করে ভিমরুলের ডানা ঝাপটানো মনে হয়। এই একঘেয়ে শব্দের মাঝে কিচকিচ করে একটু পর পর ঢুকে পড়ছে আরেকটা শব্দ। হয়তো কোনো ঢিলে কলকব্জার কাতরানি। বেশ একটা ছন্দ তৈরি করে ফিরে ফিরে আসছে শব্দটা। মনটাকে খোলা হাওয়ার মধ্যে ছেড়ে দিয়ে বসে আছি। ওই ভোঁ-ভোঁ শব্দের তালে তালে মনটাও ঘুরপাক খায় অন্ধকারে। কোথাও দরজা খোলার শব্দ। পেছনের ফ্ল্যাটবাড়ির কোনো তলায় কেউ বাথরুমে গেল বোধহয়। খুকখুকে একটু কাশির শব্দ করে থেমে গেল কেউ। এটুকু শব্দের যতি না থাকলে ওই ফ্যানের শব্দটাকেই নিঝুমের বলে মনে হত।

আসলে নিঝুমেরও একটা শব্দ থাকে। ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক, বাতাসের শোঁ শোঁ, টিকটিকির ঠিক ঠিক ঠিক, সব মিলেমিশে নিঝুমের একটা শব্দ তৈরি হয়। প্রকৃত নির্জনতা বলে কিছুই হয় না পৃথিবীতে। যদি না কান বধির হয়ে যায়। এই সময়গুলোতে আমার একটা খেলা আছে। কল্পনায় যা ভাবি, তাই-ই সত্যি সত্যি অনুভব করি। যেমন কখনও চোখ বন্ধ করে সমুদ্রের ধারে চলে যাই। জগৎ-সংসার লুপ্ত হয়ে সামনে বিরাট একটা সমুদ্র চলে আসে তখন। ফ্যানের একঘেয়ে শব্দটা সমুদ্রের বাতাস হয়ে যায়। বিছানাটা বালুভূমি। কখনও কল্পনা করি বন্ধ জানলার ওপারে বৃষ্টি হচ্ছে। ধীরে ধীরে ঝিরিঝিরি থেকে তীব্র হয়ে ওঠে বৃষ্টির শব্দ। এত তীব্র হয়, এতটাই সত্যি হয়, যে জানলা খুলে না দেখলে নিজেরই বিশ্বাস হয় না।

বিছানায় হাতের কাছে একটা লাঠি থাকে, সেটা দিয়ে জানলার একটা পাল্লা ঠেলা দিয়ে খুলে ফেলি। পান্থপাদপ গাছটা ময়ূরের পেখমের মতো ছড়িয়ে আছে। গাছটা ভেদ করে ওপাশের বাড়িগুলো স্পষ্ট দেখা যায় না। এত গাছের মধ্যে খুব একা লাগে গাছটাকে। নিজের মতো একা। মাঝে মাঝে বুকের মাঝখানে ব্যথা হয়। তখন মনে পড়ে আজ ওষুধ খাওয়া হয়নি। মনে পড়লেও তখনই ওষুধ খেতে ইচ্ছে করে না। বরং ব্যথাটাকে জিইয়ে রেখে বাঁদিকের কাঁধ অবধি উঠতে দিই। কাঁধ বেয়ে বাঁ হাতের পাতা অবধি ছড়িয়ে যায় ব্যথাটা। একেবারে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ভাবি। ভাবি, কবে কবে কোন্ ব্যথা ঘায়েল করে ফেলেছি এভাবেই। দাঁতে ব্যথাটা বেশি কষ্টের ছিল? না, পেটে গ্যাসের ব্যথাটা! আধখানা মাথার যন্ত্রণাটার কথাও ভাবি। এইসব ব্যথাগুলোর মধ্যে ঠিক কোন্ ব্যথাটা আমাকে মৃত্যুর কথা মনে করিয়েছিল, মনে করার চেষ্টা করি।

বুকের ব্যথা হাতের আঙুল অবধি ছুঁয়ে দেয়। বুকের মাঝখানে তখন ঢেউয়ের মতো ধাক্কা দেয় ব্যথার স্রোত। ঘড়ির কাঁটার দিকে না তাকিয়েও প্রতিটা সেকেন্ড গোনা যায়। সেকেন্ডের কাঁটার মতো ব্যথাটা ধাক্কা মারে বুকে। তখন বাঁচতে ইচ্ছে করে। ওষুধ খাই। ওষুধ খাবার পর অপেক্ষায় থাকি ব্যথার স্রোতে ভাটা আসবে কখন। এই সব অপেক্ষার মধ্যে খোলা দরজার ওপাশে বারান্দায় পাখিরা কিচিরমিচির করে। ছাতার আর বুলবুলি ঝগড়া বাধিয়ে দেয়। ঘরের চারদিকে ওষুধের গন্ধ নিয়ে আমি বসে থাকি। নল বেয়ে ক্যাথিটারে পৌঁছে যাওয়া আমার পেচ্ছাবের রং শনাক্ত করার চেষ্টা করি। পেচ্ছাবটা কি লালচে? আরো জল খেলে রংটা সাদা হবে। কিন্তু বেশি জল খাওয়া বারণ। নলের মধ্যে সাদাটে পদার্থ ভেসে থাকে।

পিরিয়ড হবার আগে আমার কালো রং-এর পপলিনের ইলাস্টিক দেওয়া বেঢপ প্যান্টের মধ্যে এরকম সাদা স্রাব লেগে থাকত। লজ্জায় প্যান্ট কাউকে কাচতে দিতে চাইতাম না। স্নান করার সময় সামান্য ঘেরাটোপে উবু হয়ে বসে সেই সব ঘন, আঠালো সাদা স্রাব নখের আগায় ঘষে ঘষে তুলতাম। গন্ধ শুঁকলে মাছের আঁশের মতো গন্ধ পেতাম নাকে। সেই সব লজ্জার দিন পেরিয়ে ঋতুমতী হবার লজ্জা পেরিয়ে কতগুলো বছর কেটে গেছে। এখন একটি যুবক এসে আমার যোনিদ্বার ফাঁক করে নল গুঁজে দিয়ে যায় প্রতিমাসে। সাদা স্রাবের মতো ভাসমান পদার্থগুলোকে বলে সেডিমেন্ট পড়েছে। কোনো লাজ লজ্জার বালাই নেই।

আমি কষ্টের মধ্যে শুয়ে থাকি। স্যান্ডেলগুলো কাগজের বাক্সে গোছানো। হাঁটার জন্য, বাথরুমে যাবার জন্য, ইচ্ছেগুলো তীব্র হয়ে ওঠে। মাথার কাছে সারিসারি ওষুধ। কোন্‌টা কখন খাব জানি। হাতে ভর দিয়ে উঠে বসি। নিজেই খাই। হাতের কাছে সবকিছু গুছিয়ে রাখে রান্নার মেয়ে শ্যামলী। এক অক্ষরও পড়তে পারে না। কিন্তু ওষুধের খাপ দেখে দেখে চিনে রাখে। খাবার সময় থালায় বাটি বসিয়ে নিয়ে আসে ভাত-তরকারি। খাওয়াই বা কতটুকু! পায়খানা হয়ে যাবার ভয়ে বেশি খেতেও পারি না আজ-কাল। কিছু তরকারি বাটিতেই পড়ে থাকে। ছোটো বোতলে মাপা জল, সেটাও মাথার কাছেই রেখে যায়।

অখণ্ড এই সময়ে পুরনো কথাই মনে পড়ে শুধু। জানলার একটা পাল্লা আর বারান্দার দিকের খোলা দরজার ফ্রেমটুকুই আমার বাইরের জগৎ। দরজার ওইটুকু ফ্রেমে একটা নারকেল গাছ এঁটে যায়। আর নিম গাছের একটা ডাল। সেই গাছে আসা সমস্ত পাখিদের আমার চেনা হয়ে গেছে। আমার স্মৃতির ভেতরে খুব আবছা ভাবে আসে ছেলের বাবা। সে এসে ডেকে তোলে প্রতি সকালে। নিজের হাতে বানানো চা দেয়। মিটসেফ থেকে দুটো থিন অ্যারারুট বিস্কুট। সকালে দেরি করে ওঠে ছেলে। দেরি করে চা বানায়। ওর না-ওঠা পর্যন্ত ওর বাবা আবছা হয়ে যাওয়া ছবি থেকে বের হয়ে ঘোরাফেরা করে। চা বানিয়ে খাওয়ায়। ছেলে জানে না। আমার এই অন্য সময়ে ফিরে যাওয়াটা আমার একেবারে নিজের। এই সময় আমি কয়লার উনুনে আঁচ দিই। গলগল করে ধোঁয়া বের হয়। ছেলের বাবা উনুনের হাতল ধরে বাইরে রেখে আসে সেটা। বড়ো উঠোনের একদিকে কুয়োটা তাকিয়ে থাকে সেই ধোঁয়ার দিকে। কুয়োর পাড়ের কাঁঠাল গাছটা তাকিয়ে থাকে। ওতে এঁচোড় এসেছে দেখতে পাই। ছেলের বাবা চা করে স্টোভ নিভিয়ে দেয়। পোড়া কেরোসিনের গন্ধটা বেশ লাগে। নাক দিয়ে গন্ধটা টানি।

– গামছাটা ময়লা হয়ে গেছে, কেচে দিও
বলে, ছেলের বাবা বাথরুমে ঢোকে। ঠান্ডা চৌবাচ্চার জলে মগ ডুবিয়ে জল ঢালতে ঢালতে আমাকে ডাকে।
– পিঠে সাবান ঘষতে শেখোনি এখনও?
আমি মুখ ঝামটা দিই। কিন্তু এই মুহূর্তটা ভালো লাগে আমার। ওর ফরসা পিঠে প্রচুর লোম। লোমের মধ্যে আমার হাত ঘোরাফেরা করে। আমার সামান্য শাঁখা-পলা পরা হাত, ব্রোঞ্জের চুড়ি, ওর পিঠের সাবানে মাখামাখি হতে থাকে। ওর গায়ের বাসি গন্ধটা নাক দিয়ে টানতে টানতে সাবান ঘষি। চুলের নারকেল তেলের গন্ধ আমার নাকের খুব কাছে ঘষা খায়। উনুনে বাতাস দিতে হবে, ভুলে যাই। আগের দিনের ভেজানো চালে দুটো আলু ফেলে ফুটিয়ে দিতে হবে। চান হতে না হতেই খিদে পায় মানুষটার। অথচ এই অসময়ে বাথরুমে আটকে রেখেছে আমাকে। কোনোরকমে ভাতে ভাত খেয়েই অফিসে ছুটবে। সেই সন্ধেরাত্তিরে খাবে ভালো করে। আমিও তাই। দুপুরে ধীরেসুস্থে রান্না করে আমি খাই। সব রান্না রেডি। তাও খেতে পারি না সব কিছু। আমিও ভাতে ভাত যেটুকু থাকে, খেয়ে উঠে পড়ি।

– মা, শ্যামলী আসলে কী কী রান্না হবে বলে দিও। ফ্রিজে বাঁধাকপি, ফুলকপি, মুলো আর বেগুন আছে। ও হ্যাঁ, পালং শাকও আছে এক আঁটি। মাছ আছে দুরকম। কোনটা করবে বলে দিও। আমি বেরচ্ছি।
– এসো, খেয়ে নিও সময়মতো।

ছেলে অফিসের ক্যান্টিনে খায় দুপুরে। বাড়িতে যে কিছু থাকে না, তা নয়। ফ্রিজ আছে। আগের দিনের সব রান্নাও থাকে কিছু কিছু। মাইক্রোওভেনে গরম করে খেতেই পারে। তা নয়, অফিসে খাবে। আমি যখন ভালো ছিলাম, তখন থেকেই এই চলছে। আমি না থাকলে বোধহয় বাড়িতে রান্নার পাটই উঠিয়ে দেবে। অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়েছিলাম। বিয়েটা টেকেনি। বউমা বিয়ের পর ছ মাসও থাকেনি এ-বাড়িতে। মেয়েটাকে চিনতে না চিনতেই বাপের বাড়ি পালাল। দু-বছর পর ডিভোর্স। বউমা নাকি আবার বিয়ে করেছে। ছেলেপুলেও হয়েছে। আমার ছেলে আবার বরাবরই মা-ন্যাওটা। সবাই বলে মেয়েলি। এই তো সেদিন শ্যামলী এসে বলছিল, ওকে পাড়ার কে জানি জিজ্ঞেস করেছে– তুই করিস্মা কাপুরের বাসায় কাজ করিস?

ছেলেকে করিস্মা কাপুর বলে নাকি ডাকে পাড়ার মেয়েরা। যে ছ-মাস ঘর করেছিল বউমা, সেও যাবার আগে বলে গিয়েছিল এরকমই কী যেন। অত মনে থাকে না আজ-কাল। অমন ফরসা ধবধবে ছেলেটাকে ছোটোবেলায় সবাই মেয়ে বলে ভাবত। রেডিওতে যে-কোনো সিনেমার গানের সঙ্গে নাচত ছেলেটা। বড়ো ননদ একবার বেড়াতে এসে ধমক দিয়েছিল আমাকেই– ওকে নাচতে বারণ করবে বউদি, যখনই দেখবে বারণ করবে। ছেলেরা নাচলে বিশ্রী দেখায়। কেমন হিজরার মতো।

এই সময় কামিনী গাছটা ফুলে ফুলে ভরে যায়। কই তার গন্ধ তো আসে না আমার নাকে! নাকে সবসময় কেমন একটা ওষুধ আর ডেটলের গন্ধ লেগে থাকে। এই গন্ধের মধ্যেই শ্যামলী খাবারটা রেখে যায়। শ্যামলী যেদিন যেমন আসে, সেই হিসেবে একেক দিন একেক সময়ে খাবার খেতে হয়। গামছা ভিজিয়ে সারা গা মুছিয়ে দেয় শ্যামলী। কাপড়গুলো কেচে দেয়। বাথরুম থেকে ছপ ছপ জল পড়ার শব্দ এলে পাহাড়ি ঝর্নার কথা মনে পড়ে। খুব ইচ্ছে করে একদিন জলের নিচে বসে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করতে। কতদিন স্নান করা হয় না, এক বছর চার মাস! না পাঁচ মাস!

– কালকেরে থেকে চার দিন আমি আসব না মাসিমা। দেশে যাব।

শ্যামলী আসবে না শুনলেই বুক ধড়ফড় করে। মনে হয় সারাদিন এই খাটটার মধ্যে অচল হয়ে পড়ে আছি, থাকব। মাথার কাছে রাখা জল শেষ হয়ে যাবে। খিদেয় নাড়িভুঁড়ি দলা পাকিয়ে যাবে। খাবারহীন, জলহীন মরুভূমির মধ্যে আমি। একা মরে যেতে থাকব। অনেকদিন আগে দেখা ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ছবিটার কথা মনে হয়। স্পষ্ট টের পাই ওই রকম ধুধু মরুভূমির মধ্যে মরে যাচ্ছি। পান্থপাদপ গাছটার দিকে তাকাই। গাছটার কাছে পৌঁছাতে পারি না কিছুতেই।

– মাসিমা, শুনছেন! দাদাকে বলে দিয়েন, কয়টা দিন আসব না।
– আগে থেকে বলিস নাই কেন দাদাকে? আমাকে বললে হবে? তুই না থাকলে আমাকে চান করাবে কে? রান্না করবে কে? লোক দিয়ে যা।
– লোক আমি কোতায় পাব? কেউ বলে নিজের কাজটাই করচে না! তুমি তো বাইরে বেরোওনি, জানো না। কালকে জনতা কারফু না কি ঝেন! দেকো গে দাদাও বেরবে না। সারা পিতিবিতে নাকি পোকা কিলবিল করবে কালকেরে। ছেন্টার থেইকে লোক পাও কী না দ্যাকো! তোমার ক্যাডিটা পালটাতে হবে। দাদাকে বলে দিও।
– কী পোকা! কে বলল তোকে! কোত্থেকে কী শুনে আসিস, পারিসও তোরা।
– কোত্থেইকে মানে? পোধানমন্তি বলল, করোনা পোকায় ভত্তি হয়ে যাবে কালকেরে। রাস্তায় কেউ বেরবে না। মাইকে বলে গেছে বস্তিতে। তার পরে আবার মুক্কমন্তিও ছুটি দিইচে। মাইনে কাটা যাবে না কারুর।

ক্যাথিটারকে ক্যাডিটা বলে শ্যামলী। অ্যাকোয়াগার্ডের জলকে বলে অপঘাটের জল। এই সব শুনে হাসি পায় অন্যদিন। আজ সমস্ত হাসি উবে গেছে আমার। আগেও শ্যামলী এমন করেছে। ঠিক শেষ মুহূর্তে বলে যায়, কাল থেকে আসব না। একেক বার একেক গল্প দেয়। আজ আবার করোনা পোকার গল্প বানাচ্ছে। বাপের জন্মে করোনা পোকার কথা শুনিনি। কতবার বলা হয়েছে দু-দিন আগে থেকে বলবি, কে কার কথা শোনে! গতবার সেন্টারের থেকে লোক এসে দেখাশোনা করেছে ঠিকই। কিন্তু রান্না করে না ওরা। গতবার তো এমন হাত-পা টিপে যত্ন-টত্ন করে গেল! যাবার দু-দিন পর আবিষ্কার হল, পাঁচ-ছটা শাড়ি আলমারি থেকে গায়েব। বাড়িতে একটাও চামচ নেই। ছেলের নতুন কেনা বেল্ট, আমার চামড়ার চটি, অনেক কিছুই টুকটাক জিনিস খুঁজে পাওয়া গেল না। টাকা পয়সা নিয়েছে কিনা টের পাওয়া যায়নি অবশ্য।
কথাগুলো বলে এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না শ্যামলী। ওর হাতের গোলাপি রং-এর ব্যাগটা নাচাতে নাচাতে চলে যায়। নীচের থেকে সাইকেল বার করার শব্দ পাই। সাইকেলে করে আসে মেয়েটা। কত আর বয়স হবে! পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ। দুই ছেলে নিয়ে একা থাকে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে চোদ্দটা বাড়িতে কাজ করে। ওর সময় কোথায়? বরটা নাকি বদমাশ। শ্যামলী নিজেই তাড়িয়ে দিয়েছে লোকটাকে। ক্যাথিটার লাগানো আছে, তবু তলপেটে পেচ্ছাপের চাপ অনুভব করি। চাপটা বাড়ছে। আবার সেডিমেন্ট পড়েছে ক্যাথিটারের পাইপে। তলপেট থেকে ব্যথাটা উঠে আসছে ওপরের দিকে। এসব কিছুর চিন্তার ওপরে, শ্যামলী আসবে না, এই কথাটিই ভাবাচ্ছে বেশি। কী করে চলবে! মাথার কাছে একটা মোবাইল ফোন থাকে। দরকার হলে ছেলেকে ফোন করি। আত্মীয়স্বজনও কেউ কেউ ফোন করে খবর নেয়। অপেক্ষা করে থাকি, কে কখন ফোন করবে। নিজে নম্বর দেখে ফোন করতে পারি না। শুধু ছেলে কী যেন একটা করে দিয়েছে, এক টিপলে ছেলের ফোনে কল চলে যায়। ছেলেকে ফোন করে শ্যামলীর ব্যপারটা জানিয়ে দিতে হবে।

ফোন হাতে রিং করতে করতে ঘুম ঘুম পায়। এক নম্বরটা টিপতে হবে ভাবতে ভাবতেই গান বাজে মোবাইলে। “কথা ছিল হেঁটে যাব ছায়াপথ”

– গলাটা এমন কেন আজ?
ছেলের বাবার গলা।
– দুপুরটা বড্ড খাঁ খাঁ করে, তুমি অফিসে চলে যাও। একা একা চড়ুই পাখিদের বালিস্নান দেখি।
– আমি তো আর অফিসে যাই না। তাও একা লাগে!
– তুমি কখনও আস, কখনও আস না। সক্কাল সক্কাল দাড়িটারি কেটে ফিটফাট হয়ে বেরিয়ে যাও। জানো, আমি কতদিন স্নান করি না! এই বিছানায় সারাদিন বন্দি।
– তাহলে চলো, তোমাকে নিয়ে আজ বেরিয়ে আসি। আবার হানিমুনে যাবে? এক কম্বল জড়িয়ে বসে থাকব সেই টাইগারহিলে।

আমার চারপাশে কেউ নেই। কেউ থাকেও না সারাদিন। শ্যামলী আরও দু-বাড়ি কাজ সেরে একবার দেখে যায় বেঁচে আছি না মরে গেছি। তবু চারপাশ দেখে নিই। ছেলের বাবার তো আর আমার মতো বয়স বাড়েনি। দেওয়ালে ছবিটা ঝুলছে। চোখে দুষ্টু হাসি। আমার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টে। লজ্জা করে খুব।
– কী হল! লজ্জা?
– একটু
ছোট্ট করে উত্তর দিই। সত্যিই লজ্জা লাগে। সেই ফুলশয্যার রাতের মতো লজ্জা।
– আমাকে ক্যাথিটার লাগিয়ে দিয়েছে ডাক্তার। হাঁটতে পারি না। কীভাবে যাব! তুমি এসো।
– কোথায়?
– কেন এখানে!
– আমি তো যেতে পারব না। তুমি এসো, দেখো ঠিক হাঁটতে পারবে। খাঁ খাঁ দুপুরে রোজ একা একা কী করো? আমাকে ভাবো?
– হুঁ, কতকিছু ভাবি।
– কতকিছু! কতকিছু কী কী?
– কতকিছুই। আমার ভাবনার কোনো আকাশ-পাতাল নেই। ভাবি পাগলা ঝোরার কথা, টয়ট্রেন। আমার খিদে পেয়েছিল, মাথায় বাক্স নিয়ে হেঁটে আসা নেপালি বুড়োটাকে দাঁড় করিয়ে তুমি পাউরুটি কিনতে চাইলে। আমি তো অবাক! ওর বাক্সতে পাউরুটি আছে তুমি জানলে কী করে! তারপর রাস্তার ফেটে যাওয়া পাইপ থেকে আমাদের জল খাওয়া।
– মনে আছে? সেবার টয়ট্রেন মাঝপথে আটকে গেল, ধস নেমেছিল! তোমার কী আফসোস। এবার নিয়ে যাব পুরোটাই।

কাঞ্চনজঙ্ঘার শরীরে কী অদ্ভুত আলো! টাইগারহিলে, হোটেলের কম্বল জড়িয়ে দুজন। বুকের ভেতরে আমার কাঁপুনি। চেপে ধরে রেখেছিল ছেলের বাবা। কী ঠান্ডা! আলোটা একটু একটু করে আবির মাখাচ্ছিল বরফে। আমাদের মুখ দিয়ে বেরচ্ছিল ধোঁয়া ।
– তুমি চলে গেলে। তোমার ছেড়ে যাওয়া জামাটায় ঘামের গন্ধ লেগেছিল। দুদিন ধরে শুঁকেছি। তারপর আর খুঁজে পেলাম না জামাটা। কে যে লুকিয়ে রাখল!
– আগের দিনই সকালে স্কুটারে করে আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম। সেই ডাবু পার্ক পর্যন্ত। আরেকবার গড়চুমুক।
– সেবার বাবুঘাট থেকে ইলিশ মাছ আনাটা মনে আছে। সদ্য সদ্য তুলেছে, আমি কেনার জন্য বায়না ধরলাম। তুমি কিনে দিলে ঠিকই, কিন্তু পরে বললে, ওরা কোলে মার্কেট থেকে কিনে নৌকায় নিয়ে বেচছে আমাদের বোকা বানাবে বলে। তারপর রান্না খেয়ে কী প্রশংসা।
– কী ভাবছ? তোমাকে যে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কাছে এসো। ওসব নাইটি-টাইটিতে তোমাকে মানায় না, শাড়ি পরে এসো। তোমার গোলাপি ঢাকাইটা আছে তো?

কবেকার কথা। আমার ছোট্ট কালো ফোনটা ফুলশয্যার জানলা হয়ে যায়। ফুলে ভরা খাটে দুষ্টু যুবক। আমার ব্লাউজের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বলে আমার পায়রা দুটো। আর কারোর না। চোখ বন্ধ করে আলো নিই। খোলা জানলায় বাতাসের ঝাপটা কামিনী ফুলের গন্ধে ভরে যায় ঘর। বুকের মৃদু চাপটা বাড়ছে। তীব্র হচ্ছে চাপ। নিশ্বাস জুড়ে কামিনী গন্ধের ঘোর। ফুলশয্যার জানলাটা ভালোবাসার কথা বলে যাচ্ছে অনর্গল।

– হ্যালো, হ্যালো, শুনতে পাচ্ছ?

ছেলের বাবা ডাকছে কতদিন পর। বিছানার থেকে তিনফুট দূরে আলমারিটা। তার পাশে ড্রেসিং টেবিল। একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে ঠেলায় করে নিয়ে এসেছিল ছেলের বাবা। আমি তো অবাক। কোনোদিন বলিনি, কিন্তু মনে মনে একটা ড্রেসিং টেবিলের সখ ছিল কবে থেকে। ড্রেসিং টেবিলের ওপরের ড্রয়ারে আমার কানের দুল, টিপের পাতা। শ্যাম্পুর বোতল, পাউডার, কাজল-পেনসিল ড্রেসিং টেবিলের ওপরে। ক্যাথিটারের নলটা পাশে খুলে পড়ে আছে। বিছানা থেকে উঠতে কোনো অসুবিধা হয় না। শ্যাম্পুর সবুজ বোতলটা প্রায় ভরা। বাথরুমে তোয়ালে সাবান। কতদিন পর পণ্ডস শ্যাম্পুর গন্ধ। এই গন্ধটা খুব ভালোবাসে ছেলের বাবা। শাওয়ার খুলে দিই।

ড্রেসিং টেবিলের টুলটার ধুলো ঝেড়ে নিয়ে বসতেই আয়নায় ভেজা এক ঢাল চুল। সিঁদুরের কৌটোর ভেতর একটা পুরনো দেশলাই কাঠি। কাঠিটা দিয়ে সিঁদুর পরতে পরতে অজান্তেই পেছনে তাকাই। পেছনে কেউ নেই। তবু মনে হয় একরাশ মুগ্ধতা চোখে নিয়ে তাকিয়ে আছে ছেলের বাবা। পাউডার দেব অথচ পাউডারের পাফটা খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও। দেরি হয়ে যাবে। ছেলের বাবা ঘনঘন ঘড়ি দেখছে নিশ্চয়ই। রুমালে পাউডার নিয়ে ঘাড়ে গলায় মুখে ছোঁয়াই। কাজল পেনসিলের শিসটা ভাগ্যিস কাটা আছে, নইলে আরও দেরি হত। লাল টিপের পাতা, কানের ঝুমকো, পেয়ে যাই ঠিকঠাক। এখন আর কাউকে শাড়ির কুঁচি ধরে দিতে হয় না। একা একাই পরে ফেলতে পারি গোলাপি ঢাকাই। আমরা আবার দার্জিলিং যাব।

ঝর্নার শব্দটা কত কাছে। কোন্ ঝর্না এটা? পাগলা ঝোরা? ছোটো-বড়ো নুড়ি ছড়ানো চারদিকে। হাত বাড়িয়ে দেয় ছেলের বাবা। পায়ের পাতায় ঠান্ডা জল। লাফ দিয়ে দিয়ে পাথর ডিঙোই। গায়ে জলের ঝাপটা খুব শীত করে। আহ্ স্নান। খুব করে স্নান করি। ফুরফুরে চুলে শ্যাম্পুর গন্ধ। লাল টিপ, ঝুমকো, গোলাপি ঢাকাই, শাড়িটা প্রথম বিবাহবার্ষিকীর। ভ্যানিটি ব্যাগে ফুলছাপ রুমালটা ঠিক আছে। পাথর ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে ঝর্নার অনেকটা ওপরে চলে এসেছি। একটানা ঝিঁঝিঁ ডাকের মাঝে মাঝে একটা তক্ষক ডাকছে, টক্টক টক্টক টক্টক।

শীত বাড়ে। পা ঠান্ডা হয়ে যায়। খালি পা। পুরনো মেরুন স্যান্ডেলটা ফেলে রেখে এসেছি ঝর্নার নীচে। স্যান্ডেলটা এতক্ষণে ঝর্নায় ভেসে ভেসে অনেক দূর চলে গেছে বোধহয়। স্যান্ডেলটার জন্য কষ্ট হয়। ছেলেকে বলে আসা হয়নি। বাড়ি ফিরে খুঁজবে। এতক্ষণে বাড়ি ফিরে এসেছে বোধহয়। জানলাটা কী খুলে এসেছিলাম! বৃষ্টি এলে বিছানা ভিজে যাবে। ফিরে গিয়ে দেখে আসার উপায় নেই আর। আরেকবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে পান্থপাদপ গাছটার কাছে।

গল্প ক্যাটেগরিতে ক্লিক করে অন্যান্য প্রকাশিত গল্প পড়তে পারবেন।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২