পোখরায় আমরা (নবম পর্ব) – সত্যম ভট্টাচার্য

পোখরায় আমরা (নবম পর্ব) – সত্যম ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

নবম পর্ব

অলটিচুড সিকনেস যে কী মারাত্মক জিনিস যার হয়েছে সে জানে। প্রচণ্ড মাথাব্যাথায় মাথা যেন ছিঁড়ে যায়, সাথে খানিক পর পর বমি আর সর্বক্ষণ গা গোলানো। এ এমন এক রোগ যার তৎক্ষণাৎ কম উচ্চতায় নেমে যাওয়া ছাড়া কোনো প্রতিকার নেই।

বিকেলের নরম হলদে রোদে সেই অপরূপ দৃশ্যপটকে পেছনে ফেলে আমরা যখন নামছিলাম, নীচে একটা জায়গায় গাড়িগুলো অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য আর ওপর থেকে দেখা যাচ্ছিল একটা জটলা মতো। তাপসই প্রথম সেটা লক্ষ করে বলল—তপনদার কিছু হয়নি তো আবার? বলার সাথে সবার যেন সম্বিত ফিরল। সেই স্বপ্নদৃশ্যের থেকে মুখ ফিরিয়ে আমাদের সবার মনে একটাই প্রশ্ন তখন—সত্যিই তপনদার কিছু হল না তো?

পাহাড়ের ঢাল দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে অকুস্থলে পৌঁছে দেখলাম আমাদের আশঙ্কাই সঠিক। তপনদা একটা বন্ধ দোকানের সামনে টান টান হয়ে শুয়ে আছেন। তবে মারাত্মক কিছু ঘটে যায়নি তখনও। ‘তপনদা, তপনদা’ বলে ডাকাতে তিনি চোখ খুলে তাকিয়ে হাত তুললেন, যার মানে–‘ঠিক আছি’।

এরপর স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে জানা গেল আমরা তপনদাকে রেখে এগিয়ে যাবার পর তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে এক্ষেত্রে চূড়ান্ত কাজ দিয়েছে পাহাড়ি টোটকা। তপনদাকে সেখানকার লোকজন থেতো করে খাইয়ে দিয়েছে বেশ খানিক রসুন এবং গরম কিছু আর তাতেই তপনদা রক্ষা পেয়ে গিয়েছেন এ যাত্রায়। ফেরার আগে দেখলাম স্থানীয় মহিলারা ঐ বাজার চত্বরে বসেই চড়কা মতো যন্ত্রে ভেড়ার লোম থেকে উল বানিয়ে চলেছেন।

যে লোক সবসময় বকবক করে যায় সে যদি চুপ করে থাকে আহলে আশঙ্কার আর শেষ থাকে না। ফেরার সময় তপনদা গোটা রাস্তায় একটাও কথা বলেনি। যতবার ডাকা হয়েছে শুধু হাতটা একটুখানি তুলে সাড়া দিয়েছে। আমরা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছি। তবে একটাই শুধু আশার কথা ছিল যে আমরা কম উচ্চতায় নেমে আসছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

আর সেটাই যেন ঠিক হল। জুমসুমে নেমেই তপনদা মুখ খুললেন। ক্ষীণ স্বরে বললেন—“হয়েছিল আর কি! ভাগ্য ভালো মুখে রসুন দিয়েছে না হলে আরেকটু পরই চোখে তুলসী পাতা দিতে হত।” আর এই কথার সাথে সাথেই মুখ তুলে দেখলাম দুধ সাদা জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে জুমসুমের চরাচর। ততক্ষণে রাত হয়ে গিয়েছে। দূরের বরফ ঢাকা পাহাড় চূড়াগুলোর ওপর চাঁদের আলো পড়ে এমন এক সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়েছে যাকে ভাষায় বর্ণণা করা মুশকিল।

চাঁদ উঠেছে মুক্তিনাথে

ঘরে এসে যত বাইরে দেখছি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি বললে খুবই কম বলা হবে। মনে শুধু প্রশ্ন জাগছে, জেগে আছি তো? যা দেখছি তা কি সব সত্যি? কাঁচের জানালার ওপারে যে মাতাল করা ভুবন দাঁড়িয়ে আছে তা কি বাস্তব? জানালা খোলা যাচ্ছে না কারণ, তাহলেই এমন ঠান্ডা বাতাস ঘরে ঢুকে যাচ্ছে যে মনে হচ্ছে বিছানা বালিশ সব যেন বরফ হয়ে গেল।

এদিকে আবার সাতটা বেজে যাবার পর থেকেই খাবার অর্থাৎ ডিনারের তাড়া দিতে শুরু করেছে। অগত্যা তাতেই আমাদের রাজি হতে হল। কেউ খানিক খেলো, তপনদা আবার যেমন খেলোই না। তবে যাই হোক ডিনার পর্ব আটটার আগেই শেষ। এবারে ঠিক হল আমরা সবাই মিলে একটু ছাদে যাব। মই আছে শক্তপোক্ত, অসুবিধা হবে না। ছাদে গিয়ে চর্মচক্ষে এই জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া দুধ সাদা চরাচরকে না দেখলে জীবন বৃথা।

যতদূর মনে পড়ে প্রথমে উঠেছিল তাপস। তারপর একে একে আমরা সবাই। তপনদা গিয়েছিলেন কি না ঠিক মনে পড়ে না। তবে খানিক ওই বরফ ঢাকা পাহাড় আর ওই অপূর্ব দৃশ্যের দিকে তাকানোর পর একটা জিনিসের দিকে চোখ পড়াতে আমরা আরও আরও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। হতভম্ব আমাদের সবার কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

ছাদের তিনদিক দিয়ে সাজিয়ে রাখা একের পর এক ইয়াকের মাথা। আর তা যে কত কত বড়ো হতে পারে একদম সামনে থেকে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ওই দৃশ্য দেখার পর আমরা কেউই আর বেশিক্ষণ ছাদে থাকতে পারিনি।

মুক্তিনাথ বাজার এলাকা
শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২