আন্তর্জাতিক নারী দিবসটা আশা করি সবাই খুব উৎসাহের সাথে পালন করেছেন, কি তাইতো? অবশ্য আমি কিন্তু ভুলে গেছিলাম একদম; সোশ্যাল মিডিয়া গুলো এত হাকডাক করছিল ওই দিনটাকে নিয়ে- তারপর মনে পড়ে গেছে। এতে হয়তো আপনারা ভাবতেই পারেন, একজন নারী হয়ে নারী দিবসের কথা ভুলে গেছি! তা অনেক কিছুই ভাবতে পারেন…তবে তার জন্য আমার তরফ থেকে কোনও দুঃখজনক মন্তব্য পাবেন না। বিভিন্ন জায়গায় দেখছি পুরুষশাসিত সমাজে মহিলাদের কোন অধিকার দেয়া হয়না বলে অনেক হাঁকডাক করছে, কোথাও বা নারী নির্যাতনের জন্য কত সংগ্রাম…কত বিক্ষোভ…কত কিছু…নারী জাতির প্রতি এত সহৃদয় ভাবনা দেখেও ভালো লাগে! কিন্তু দুঃখের বিষয় এই চিত্র বেশি দিন থাকবেনা… কয়েকদিন যাক, পাশের বাড়ির কাকিমা ঠিক এসে বলবেন-
-কি গো বাবা, তোমার মেয়ে বিয়ে হয়ে যাবার পরও এতদিন বাপের বাড়ি থাকছে কেন? শ্বশুরবাড়িতে বুঝি এডজাস্ট হয় না?
আরো কতকিছু… আমি কোন বিকৃত মনস্ক পুরুষকে সমর্থন করছি না; কিন্তু আমরা নারীরা খুব সহজেই কোন কাজের জন্য পুরুষকে দায়ী করে থাকি। বিকৃত মনস্ক পুরুষদের না হয় বাদের তালিকায় রাখলাম, তারা নয় অপরাধী, একটা অপ্রীতিকর ঘটনা, একটা ধর্ষণ, একটা লাঞ্ছনা হলে আমাদের অতি প্রিয় কাকিমা-মাসীমা-দিদিমা-জ্যেঠিমা- পিশিমা কি বলেন? জানেন…বলি শুনুন-
-নিশ্চয়ই মেয়েটার কোন দোষ ছিল। ওই তো দেখতাম অমুকের সঙ্গে ঘুরত….তমুকের সঙ্গে ঘুরত….আর পোশাক-আশাকে যা বালাই….. ধর্ষণ হবে না কেন…..
আপনাদের কাছে প্রশ্ন, আপনার আদরের ছেলেটা যখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার গোপন অঙ্গ বার করে, মূত্রত্যাগ করে তখন কী কোন নারীর তার গোপন অঙ্গ দেখে মনে কোন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়? কোথায়ও এমন কি কোনদিন হয়েছে সেই সময় তাদেরকে আমরা আস্ত ছিঁড়ে খেয়েছি…..আপনার আদরের সন্তানটি যখন রাস্তায় গামছা পড়ে স্নান করে, কই কোন মেয়েরতো চোখ তার যৌনাঙ্গের দিকে যায় না, তার মাংস পেশীর দিকে যায় না..ও সে বুঝি পুরুষ! তাই তার সব দোষ মাফ! পুরুষের শরীর দেখানো যদি পুরুষত্বের বিঞ্জাপন হয়, তাহলেতো নারীর শরীরের দর্শন পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, কারণ তার সমস্ত শরীর জুড়ে ছড়িয়ে থাকে বর্তমান প্রজন্মকে আশ্রয় দেওয়ার আস্তানা। সে যদি শরীর ঢাকতে না চায় তবে তাকে উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখা হবে কেন? মহাপ্রলয়কালে উলঙ্গ রূপে মা কালী ধ্বংস করেছিলেন অসুরদের, সেই উলঙ্গ মা কালীকে দেখতে গেলে, সেই মানুষদেরই ভক্তি-শ্রদ্ধা-হাতভর্তি জবাফুল আর ভক্তিতে মুখ গদগদ হয়ে ওঠে, এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হবে কেন? ও…. মা কালী পৌরাণিক কোন চরিত্র বলে….. মা কালীর বাস্তবিক কোনো অস্তিত্ব নেই বলে….. একটা কথা জেনে রাখবেন- একটা কথা জেনে রাখবেন সকলেই, আমাদের মধ্যেও মা কালী লুকিয়ে আছে যেদিন অপমান-অবহেলা বিন্দু বিন্দু করে জমা হবে সেদিন আমাদের হাতেও খাড়া ঝুলবে, গলায় মুণ্ডমালা, আমরা হয়ে উঠবো মা কালী।
একটা গল্পের কথা মনে পড়ল, একবার একটা কুরুল তার ধারালো ফলা দিয়ে আস্তে আস্তে একটা প্রকাণ্ড গাছকে কেটে ফেলেছিল। তারপর যখন গাছটা পুরো কাটা হয়ে গেল, গাছটার নিচে পড়ে গেল। তখন কুরুলটি বেশ গর্ববোধ করে বলে উঠলো- দেখলে তো বৃক্ষ, আমার আয়তন কি ক্ষুদ্র, কিন্তু তোমার মতন অত বড় আয়তন কে নিমেষে ধূলিসাৎ করে দিতে পারি….. অসহায় নিষ্পাপ গাছ হাসতে হাসতে বলল সে তো অবশ্যই ভাই, কিন্তু তোমার ফলার পিছনে আমার জাত ভাই যদি হাতল হিসাবে না থাকতো তবে কি তুমি এত জোর পেতে…..
পুরুষতন্ত্র বলে অনেক হাঁকডাক করি, অনেক বড় বড় কথাবার্তা বলি, কিন্তু নারীর মনের কথা বুঝতে পারি কতটুকু- নারীর প্রতি আক্রমণ হলেই আমরা সহজেই আঙ্গুল তুলি একটা ছেলের দিকে, কিন্তু আঙুল তুলন নিজের দিকে, আঙ্গুল তুলুন সেই মাসিমা-পিসিমা-কাকিমা-দিদিমা তাদের দিকে, যারা বাড়িতে সন্তান জন্মালে যদি সে ছেলে হয়, তবে তারা তাকে উপহার দেয় একটা ফুটবল, আর যদি মেয়ে হয় তাকে উপহার দেয় খেলনা বাটি, বড় হলে ছেলেটিকে নিয়ে যায় ক্রিকেট খেলাতে, মেয়েটিকে বাড়ির আনাজপাতি কাটাতে। আমরা কথায় কথায় বলি আমাদের একান্ত আপন পুরুষটি অর্থাৎ আমাদের স্বামী, অথবা কারো বয়ফ্রেন্ড প্রচন্ডভাবে সংরক্ষন মানসিকতার। কিন্তু তাদের প্রতি আঙুল তোলার আগে, আগে আঙ্গুল তুলুন মাসীমা-কাকিমা-পিসিমা-দিদিমা দের উপর যারা চিরকাল বাড়ির মেয়েকে সংরক্ষনে বেঁধে রেখেছে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন- “কোন সমাজ তখনই উন্নতির শিখরে পৌঁছবে যখন সেই সমাজের নারীরা প্রগতিশীল হবে”। আর তার প্রগতিশীল না হলেই মেয়েদের সংরক্ষণে বাঁধবে, আর মেয়েদের প্রতি সংরক্ষন যতদিন না বন্ধ হবে, ততদিন মেয়েদের প্রতি লাঞ্ছনা চলবে…. ততদিন মেয়েদের প্রতি অত্যাচার চলবে…. ততদিন মেয়েদের চোখের জল পড়বে এবং ততদিন তাদের আদুরে পুরুষ সন্তানটিও অবুঝ থাকবে। তাই যতদিন না তারা ঠিক হচ্ছে, ততদিন কোন পুরুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।
পুরুষ তো লোহার ন্যায়, নরম মাংসপিণ্ড পেলেই তাকে খুবলে খাওয়ার চেষ্টা করবে- কিন্তু দয়া করে সেই মাসীমা-পিসীমার-দিদিমা-কাকিমারা তাদের সহায় হয়ে দাঁড়াবেন না। তাদেরকে সমর্থন করবেন না। একটা কথা মনে রাখবেন তাদের সমর্থন করা মানে নিজেই নিজেকে অসমর্থন করা। তাদের সমর্থন করতে গিয়ে আপনি যে নারীর পোশাক নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, সেই নারীর মতনই কিন্তু আপনিও একজন নারী। কোন নারীর পাশ্চাত্যমুখী পোশাক পরা যদি অপরাধের হয়, তবে বাঙালি নারীর কোমর আর ব্লাউজের মাঝখানে, যে চার ইঞ্চির শরীর দেখা যায় সেটাও অশ্লীল তবে….. তাহলে আপনিও সেই অশ্লীল পোশাক পড়ে রাস্তায় বের হন। অর্থাৎ সেই মেয়েটি যদি আধুনিক পোশাক পরে দোষী হয়, আপনিও তবে সমান দোষী।
আমি আজও বিশ্বাস করি সমাজে কিছু ভালো পুরুষের অস্তিত্ব আছে, যারা নারীকে শুধু এক টুকরো মাংসের খন্ড নয় একটা মানুষ হিসেবে পরিচিতি দেয়, কিন্তু দুঃখের বিষয় এখানেই তারা সমাজে মুখ খুলতে সাহস পায় না…তাদের সাহস দেওয়া হয়….তাদের সুযোগ দেয়া হয় না….. বউয়ের কথা শুনে যদি কোন পুরুষ চলে তবে সে কাপুরুষ আর যদি বউয়ের কথা না শোনে তাহলে অত্যাচারী! কী বিচিত্র এই সমাজ! সমাজে সমগ্র পুরুষজাতি যদি খারাপ হতো, চিল-শকুনের মতন ছিড়ে কামড়ে খেত নারীমাংস তাহলে আমাদের অস্তিত্ব থাকত না…. কোন সমাজ জন্ম নিত না… সমাজে যদি বিকৃত পুরুষ থেকে থাকে, তবে বিকৃত নারীর সংখ্যাও কম নয় বরং বেশি। তারা পরাধীন থাকতে যেমন ভালবাসে তেমনি আর দশটা মানুষকে পরাধীন করে রাখতে ও ভালবাসে। তাই লোক দেখানো নারী দিবস এর কোনো প্রয়োজন হয় না। নারী দিবস মানেই একদিন কোন নারীকে নিয়ে ভালো ভালো কথা বললাম, ভালো উপহার কিনে দিলাম, একসঙ্গে দামি রেস্তোরাঁ গিয়ে খেলাম, ঠিক পরের দিন সকালবেলা উঠে আবার তাকে পন্য এর মতন ব্যাবহার করলাম….এটা কোন নারী দিবসের সংজ্ঞা হতে পারে না। আজকে যদি পৃথিবীর সমস্ত নারী মরে যায় সমাজের শেষ হয়ে যাবে একজন নারী পারে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সমাজের জন্ম দিতে। তাই নারী দিবস কেবল একদিন নয় বছরের ৩৬৫ দিনই নারী দিবস।