সুকান্তকল্প – অমিতাভ গুপ্ত
কবিতা অনুরাগীদের পক্ষে আক্ষেপের বিষয় এই যে রুশ ভাষায় অনূদিত হলেও লেনিনের জীবদ্দশায় সুকান্তের কবিতা রাশিয়ায় পৌঁছোয়নি। লেনিন সম্ভবত সুকান্ত ভট্টাচার্য নামে সদ্যজাত কবিপ্রতিভা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অসচেতন ছিলেন যেহেতু তাঁর অকালমৃত্যুর আগে সুকান্ত ভট্টাচার্য কোনো কবিতাই লেখেননি, অনূদিত হওয়া তো দূরের কথা।
আক্ষেপটি অবিন্যস্ত, কিন্তু মনে এলো এই কারণে যে মায়কোভস্কির কবিতা সম্পর্কে লেনিন যে কারণে আগ্ৰহী ছিলেন না, যেসব দুর্বলতা তিনি মায়কোভস্কির কবিতায় খুঁজে পেয়েছিলেন, যে ঐতিহ্যবিমুখতা মায়কোভস্কির কবিতায় এবং কাব্যতত্ত্বে উচ্চকিত ছিল তাদের কোনোটিই সুকান্ত ভট্টাচার্যের রচনায় কখনোই পরিলক্ষিত হয় না। সুকান্তের ছন্দকৃতি, তাঁর গীতিকবিতার ট্র্যাডিশনের প্রতি ঝোঁক এবং স্বদেশের ও বিদেশের বিভিন্ন প্রগতিশীল ঐতিহ্য সম্পর্কে তাঁর আগ্ৰহ, অনুমান করা যেতে পারে, লেনিনকে মুগ্ধ করতেই পারত। মনে রাখতে হবে, মায়কোভস্কির ‘ফিউচারিজম’-এর তত্ত্ব লেনিনের কাছে বিশেষ আপত্তিকর ছিল। সুকান্ত ভট্টাচার্য কখনোই ফিউচারিস্ট কবিতা লেখেননি যদিও মায়কোভস্কির কবিতার সঙ্গে যথেষ্ট পরিচয়ের সুযোগ তাঁর ছিল। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং উৎসাহদাতা কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় মায়কোভস্কির কাছে অনেকসময়ই নিগূঢ় অন্তর্বয়ানে জড়িয়ে ফেলেছেন নিজেকে, এমনকি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্য-পঙ্ক্তি বিন্যাসের পদ্ধতিটিও প্রায়শই মায়কোভস্কির পদ্ধতির কথা মনে পড়িয়ে দেয়। অবশ্য ‘ফিউচারিজম’-এর তত্ত্ব সম্পর্কে, ঐতিহ্যকে উপেক্ষা করার আদর্শ সম্পর্কে সুভাষ মুখোপাধ্যায়েরও তেমন কোনো আগ্ৰহ ছিল না। বলাবাহুল্য কাব্যতত্ত্বে তিনিও যথার্থ মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী। এ-কথাও মনে রাখতে হবে, মার্ক্স ও লেনিন উভয়েরই প্রিয় কবি ছিলেন পুশকিন। সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায় উভয়েই পজেটিভ রোম্যান্টিসিজম পুশকিনের কবি চেতনার কাছাকাছি। এই রোম্যান্টিসিজমের মাধ্যমে মানববিশ্বের সারাৎসারটিকে চিহ্নিত করা একেবারে অসম্ভব নয়।
যেকোনো বিপ্লবী কবির মতোই সুকান্তও তাই একজন সদর্থক রোম্যান্টিক কবি। শেক্সপিয়ার থেকে পুশকিন এবং পুশকিন থেকে এল্যুয়ার ও নেরুদা এবং একালের সমাজসচেতন কবিদের প্রাথমিক রোম্যান্টিসিজম হল শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন। শ্রেণিসমাজের মধ্যে বাস করে, অপরিসীম গ্লানি সহ্য করতে করতে সুকান্ত উপলব্ধি করেছিলেন:
“আজকেও রাশিয়ার নগরেপ্রান্তরে হাজার লেনিন যুদ্ধ করে…
বিদ্যুৎ-ইশারা চোখে আজকেও অযুত লেনিন
ক্রমশ সংক্ষিপ্ত করে বিশ্বব্যাপী প্রতীক্ষিত দিন।
বিপর্যস্ত ধনতন্ত্র, কণ্ঠরুদ্ধ, মুখে আর্তনাদ
আসে শত্রু জয়ের সংবাদ।”
মায়কোভস্কির লেনিনকে নিয়ে লেখা সুদীর্ঘ কবিতাটির সঙ্গে সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘লেনিনের প্রতি’ কবিতাটি মিলিয়ে পড়লে একটি নান্দনিক আততি প্রস্তুত হয়। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার শেষ পঙ্ক্তিতে এসে কী বাঙ্ময় নীরবতার কাছে পাঠক পৌঁছে যান তাকে লক্ষ্য করা মায়কোভস্কির অভীষ্ট ছিল না। সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছেন:
“বিপ্লবস্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন।”
মায়কোভস্কির রণবাদ্য বাজিয়ে দ্রুতছন্দ অবিচল থাকে অন্তিম স্তবকেও, ট্রাম্পেট বাজতেই থাকে, কবি ও পাঠকের সঙ্গে লেনিনের একাত্ম হওয়ার কোনো প্রয়োজন ঘটে না।
লেনিন সম্পর্কে যত বাংলা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে কোথাও, একবারের জন্যেও, সুকান্ত ভট্টাচার্যের কোনো উল্লেখ ঘটে না। না ঘটাই স্বাভাবিক। নিছক ঐতিহাসিক কারণেই লেনিন প্রসঙ্গে সুকান্ত ভট্টাচার্য অনুপস্থিত। কিন্তু লেনিনের সাম্যবাদী আদর্শের এবং স্বপ্নের ধারাবাহিকতাকে বুঝতে পারলে সুকান্ত ভট্টাচার্যকে জানতেই হবে। এর সঙ্গে শেক্সপিয়ার সম্পর্কিত যে যথার্থ আবেগ মার্ক্সবাদীরা প্রকাশ করেছেন তাকে অনুধাবন করতে গেলে সুকান্তের ‘গীতিগুচ্ছ’ সংকলনটির পাঠ করা দরকার। শেক্সপিয়ারের শতাধিক গানে, তাঁর ১৫৪টি সনেটে আর্ত দীর্ঘনিশ্বাস যেন সুকান্তের এই কৃশ কবিতা সংকলনটির মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে। এতকাল সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘গীতিগুচ্ছ’-কে নিতান্ত রাবীন্দ্রিক কবিতা বলে উপেক্ষা করা হয়েছে। উপেক্ষাটি সম্ভবত যুক্তিগ্ৰাহ্য নয় যেহেতু যে কথনের স্পন্দনে এই ছোটো লিরিকগুলি রচিত তা বাংলা কবিতার আবহমান কালের সুরের ও স্বরন্যাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, শুধুমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে নয়।
মনে রাখতে হবে, সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় সলিল চৌধুরীর সুরারোপিত গানগুলি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পরিবেশন করেছেন। যে কবিতাগুলি এখনও সাংগীতিক কাঠামো পায়নি তারা অন্য এক আবিষ্কারের জন্য নতুন প্রজন্মের, নতুন প্রতিভার অপেক্ষায় রইল। কল্পনা করতে ভালো লাগে কোনো এক সুকান্তকল্পের কথা, যখন দীপ্ত, দৃপ্ত তরুণ-তরুণীরা পথে পথে হাসিমুখে হাত ধরাধরি করে ঘুরছে আর গাইছে সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা গান:
“আকাশে আকাশে ধ্রুবতারায়
কারা বিদ্রোহে পথ মাড়ায়
করে দিগন্ত দ্রুত সাড়ায়
জানে না কেউ।