মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা – তাপস কুমার দাস

শেয়ার করুন

মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা – শ্রেণীহীন সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ

প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগে আধুনিক ভারতের শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানসাধকদের একজন লিখেছিলেন :
“কিছুদিন আগে এই প্রস্তাব আমি দিয়েছিলাম যে, আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি পরিবর্তনের এবং স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরেই শিক্ষার বাহন হিসেবে মাতৃভাষা ব্যবহারের সময় এসে গেছে।”
(শিক্ষা ও বিজ্ঞান, কালান্তর, ১১ই মে, ১৯৬৩)
অন্যত্র তিনি বলেন –
“মাতৃভাষাকে শিক্ষার ক্ষেত্রে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়ার প্রশ্নটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সভ্যগণ ও আইনসভার সভ্যগণকে বিশেষরূপে বিবেচনা করে দেখতে হবে”
(আমাদের উচ্চশিক্ষা ও মাতৃভাষা)
বাংলাভাষার মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষাদানের, বিশেষতঃ বিজ্ঞানশিক্ষার ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানি সত্যেন্দ্রনাথ বোসের  এই উপলব্ধি থেকে আমরা কতটা বিচ্যুত হয়েছি সে প্রশ্ন তোলাটাই  অর্থহীন – কারণ আমরা তাঁর (এবং  বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু ইত্যাদি সম-মনস্ক বৈজ্ঞানিকের) বৈপ্লবিক চিন্তাধারার ধারেকাছেও যেতে পারি নি।  প্রকৃত প্রস্তাবে আমরা যেতে চাইনি, কারণ ঔপনিবেশিক সীমাবদ্ধতা এবং ব্রাহ্মণ্যবাদ এর বিষ আমাদের রক্তে প্রবাহিত গর্বিত ঔদ্ধত্যে।  তাই বিভিন্নভাবে কুযুক্তি সাজিয়েছি যাতে ভারতীয় সমাজে উচ্চতর শিক্ষার সাবঅল্টারনাইজেশন এর প্রক্রিয়া  ব্যাহত করা যায়। সে সকল কুযুক্তি, এবং তার প্রয়োগের নির্মাণ বহুমাত্রিক, কূট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, এবং  বৈষম্যমূলক।
এ প্রসঙ্গে প্রথমেই আসে আঞ্চলিক ভাষায় (ভার্নাকুলার) বৈজ্ঞানিক পরিভাষা প্রয়োগের জটিলতার প্রসঙ্গ টেনে উৎসাহ হননের অপচেষ্টা।  বাংলায় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা প্রয়োগে করলে উচ্চশিক্ষার  মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, এই ছদ্ম-আশঙ্কাকে মানুষের মনে গিঁথে দেওয়া।  বহু যুগ ধরে ইংরাজি শব্দ  (যেগুলো মূলতঃ ল্যাটিন, এবং কিছু  কিছু ক্ষেত্রে গ্রীক থেকে বিবর্তিত) ব্যবহারে শিক্ষার্থীরা অভ্যস্ত, সুতরাং  নতুন , আড়ষ্ট,  অপ্রচলিত বাংলা পরিভাষার জড়তা সেই স্বাছ্যন্দ কে বিপন্ন করবে – প্রস্তাবটি এভাবেই রাখা হয়ে থাকে, কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে।  একটু গভীরে গিয়ে ভাবলে এই (কু)যুক্তিজালের অসারতা সহজেই নজরে আসে।
বাংলায় বিজ্ঞান বোঝাতে গেলে অক্সিজেন এর জায়গায় অম্লজান, হাইড্রোজেন এর বদলে  উদযান বলতে হবে কে বলেছে? রোজকার কথ্য বাংলায় পেয়ালা পিরিচ কেদারা বলা হয়ে থাকে কি? মাতৃভাষায় উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষা ও শিক্ষণ প্রক্রিয়া সুতরাং, পরিভাষার অভিধান  মুখস্ত  করা নয়, কাজটি হলো  নিজের ভাষায় সর্বজনবোধ্য করে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তুলে ধরার কোনো প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর, এবং তার মাধ্যমে অতিপ্রাকৃত ঘটনার অযৌক্তিক বিশ্বাস ও অন্ধ কুসংস্কার কে দূর করার সবরকম চেষ্টা করার – যেটা করা কিনা যে কোনো সমাজসচেতন মানুষের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। বিজ্ঞান নিয়ে যাঁরা পড়াশোনা করছেন, সেই সামাজিক দায়িত্ব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের ওপরে একটু বেশি মাত্রায় বর্তায়। মাতৃভাষায়  বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে না পারা বিজ্ঞানের ছাত্রের  কাছে যথেষ্ট বড়োরকমের অপারগতা।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা হয় না বা সম্ভব না এই বক্তব্য সম্পূর্ণ মূল্যহীন। ষাটের দশকের শেষের দিকে ভারত সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক (শিক্ষা) থেকে আঞ্চলিক ভাষায় মহাবিদ্যালয়/বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের গ্রন্থ রচনার প্রকল্প নেওয়া হয়। সেই অনুসারে ১৯৭০ সালে কোঠারি কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থানুকূল্যে তৈরী হয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ যার বর্তমান অফিস কোলকাতায় সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার এ, এবং  বই বিক্রি হয় (প্রধানতঃ) সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল এর একতলার বিপণনকেন্দ্রে। শুধু বিজ্ঞান নয়, প্রতি বিষয়েই বাংলায় বই বার করা হয়েছিল। অসাধারণ, অনন্য সব বই। বইগুলি  লেখান হয়েছিল বিভিন্ন মহাবিদ্যালয়  ও বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রথিতযশা অধ্যাপক দের দিয়ে – তাঁরা যে যা বিষয়ে লিখছেন সেই বিষয়ে বিদেশী ভাষায় যাবতীয় আকরগ্রন্থের একত্রীকরণ  ঘটান সেই সব বই এ – ফলতঃ একটি মাত্র বই এই অধিকাংশ রেফারেন্স বই এর তথ্য একসাথে পাওয়া অনেক সহজ হয়ে দাঁড়ায়।  আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত থেকে দেখলে, এতে করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি  বিশেষ সুবিধা হয়েছিলো। অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া ঘর থেকে যেসব পড়ুয়ারা আসবেন, তাঁদের একাধিক বই কেনার খরচ অনেক বেঁচে যাবে এইভাবে মাত্র একটি বা দুটি বই স্বল্পমূল্যে কিনে। বইগুলির দাম অবিশ্বাস্য ভাবে  কম ছিলো। উদাহরণস্বরূপ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর খয়রা অধ্যাপক  (খয়রা অধ্যাপক এবং পালিত অধ্যাপক এই দুটি সেসময়ে কলকাতা বিশ্যবিদ্যালয় এর সবথেকে সম্মানজনক দুটি `চেয়ার প্রফেসর’  [১] পজিশন) সমরেন্দ্রনাথ ঘোষাল এর লেখা পরমাণু ও কেন্দ্রক গঠন পরিচয় [২]। দু খন্ডে সম্পূর্ণ এই পুস্তকের প্রথম খন্ডের (দ্বিতীয় সংস্করণের) দাম,  নব্বই এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, ছিলো পয়ঁত্রিশ টাকা, এবং দ্বিতীয় খন্ডের চল্লিশ টাকা।  বই দুটির পাঠ্যসূচীতে শুধু স্নাতক স্তরের ই নয়, স্নাতকোত্তর স্তর এর ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্য বিষয় জায়গা পেয়েছিলো।
 অধ্যাপক ঘোষাল ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় এ ডক্টরেট করেছেন, ওনার `ঘোষাল এক্সপেরিমেন্ট’  [৩] পৃথিবীবিখ্যাত কাজ, নিউক্লয়ার ফিজিক্স এ পৃথিবীর সব দেশের  স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তর এর পাঠ্যপুস্তকে এ যা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পড়ানো হয়। অধ্যাপক ঘোষালের সুপারভাইসর ছিলেন এমিলিও সেগ্রে – `সেগ্রে-চেম্বারলেন’ কাজের [৪] জন্য ১৯৫৯ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ পাওয়া বৈজ্ঞানিক সেগ্রে। কথিত আছে নোবেল যে জন্য দেওয়া হয় সেই এক্সপেরিমেন্ট এর সেট আপ অধ্যাপক ঘোষাল নিজ হাতে তৈরী করেন সেগ্রের গবেষণাগারে। ভারতীয় বিজ্ঞানী মহলে একসময় একথা প্রচলিত  ছিল যে, আরো বিভিন্ন উদাহরণের  (যেমন, জোসলিন বেল [৫]) মতোই, অধ্যাপক ঘোষাল ও নোবেল এর সময় উপেক্ষিত হন, সে শুধু তিনি ছাত্র ছিলেন বলেই – অথবা কে জানে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ ছিলেন বলেও হয়তো বা। যদিও অধ্যাপক ঘোষাল সম্পর্কে এই আলোচনার (নামকরা লোকেদের সম্পর্কে এরকম অনেক সম্মানজনক গল্পকথা থাকে অনেক সময় পরিপূর্ণ সত্য নাও হতে পারে) ঐতিহাসিক সত্যতা সেভাবে  যাচাই করে উঠতে পারা যায় নি। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানের ইতিহাস বিষয়ক কোনো `পিয়ার রিভিউড’ গবেষণা পত্রে কোনো লেখা বেরিয়েছে বলে বর্তমান প্রতিবেদকের জানা নেই।  তবে ঘটনাটি সত্য হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে, ভারতীয় ও বিদেশী বিভিন্ন প্রথিতযশা বর্ষীয়ান বিজ্ঞানীদের সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তেমনই মনে হয়েছে প্রতিবেদকের।
সুতরাং বুঝে নিতে অসুবিধা হয়না  মাতৃভাষায় উচ্চস্তর এ বিজ্ঞান চর্চায় এগিয়ে এসেছিলেন (সাম্প্রতিক কালেই – সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা, প্রফুল্লচন্দ্র রায় বা জগদীশচন্দ্র বসু এর অনেক পরেও) কোন পর্যায়ের ধীমান বৈজ্ঞানিক রা। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে বাংলায় বিজ্ঞান হয় না শুনলে বালখিল্য মন্তব্য মনে হয় বই কি। সত্যেন্দ্রনাথ বোস এর একটি বহুল প্রচলিত উক্তি এ বিষয়ে স্মরণযোগ্য  – `যাঁরা বলেন বাংলায় বিজ্ঞান চর্চ্চা সম্ভব নয় তাঁরা হয় বাংলা জানেন না অথবা বিজ্ঞান বোঝেন না’।  প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, ১৯৪৮ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বসু বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ স্থাপন করেন কলকাতায়।  সেই সংস্থার মুখপত্র জ্ঞান ও বিজ্ঞান, যা এখনো প্রকাশিত হয়।  বাংলা ভাষায় উচ্চতর বিজ্ঞানের বিষয় গুলি সরল ও সাবলীল ভাবে ব্যাখ্যা করে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ দের লেখা থাকতো জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায়।  ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় জ্ঞান ও বিজ্ঞানের `রাজশেখর বসু’ বিশেষ সংখ্যা [৬]।  সেই সংখ্যার প্রতিটি লেখা ছিল মৌলিক গবেষণা ধর্মী – অর্থাৎ কিনা পিয়ার রিভিউড ওরিজিনাল রিসার্চ আর্টিকল।  সুতরাং শুধু  স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তর এ বিজ্ঞানের পঠন পাঠনই  নয়, এমনকি মৌলিক গবেষণাপত্র লেখাও আঞ্চলিক ভাষায় সম্ভব, তা বহু আগেই হাতে কলমে প্রমাণিত হয়েছে।
উপরোল্লিখিত অধ্যাপক  সমরেন্দ্রনাথ ঘোষাল ই একমাত্র উদাহরণ নন – এরকম আরো অনেক  বিশিষ্ট চিন্তক ও পর্ষদের বাংলা বই লিখেছেন। বইগুলোয় পরিভাষা সামান্য জটিল  ছিলো প্রাথমিক স্তর এ, তবে সেগুলি খুব কিছু  অনতিক্রম্য সমস্যা নয়। বাংলা শব্দগুলো প্রধানতঃ নেওয়া হতো সাহিত্য সংসদ এর `সংসদ বাঙ্গালা অভিধান’ এবং ভারত সরকারের শিক্ষামন্ত্রক থেকে প্রকাশিত `বিজ্ঞান শব্দাবলী’ এই দুটি গ্রন্থ  থেকে। আপাতভাবে প্রতিশব্দগুলি কিঞ্চিৎ  অতি-তৎসম দোষে দুষ্ট মনে হতে পারে । তবে পাশে ইংরেজি তেও দেওয়া থাকতো, এবং বইয়ের শেষে (প্রায় সব বইয়ের ই) থাকতো পারিভাষিক শব্দাবলীর তালিকা – ইংরেজি থেকে বাংলায় এবং বাংলা থেকে ইংরেজি তে। এখনো থাকে।  ফলে বিশেষ অসুবিধা হওয়ার কারণ নয় শিক্ষার্থী দের। সরাসরি ইংরেজি পরিভাষা দিয়ে প্রকাশ করলেও অসুবিধার কোনো কারণ নেই কেননা দৈনন্দিন জীবনে সমস্ত অবজেক্ট বা কনসেপ্ট এর ধ্রুপদী বাংলা পরিভাষা ব্যবহার  করার প্রয়োজন পড়ে না – নিবন্ধের শুরুতেই এ কথা বলা হয়েছে।  এবং সেটা যে শুধুমাত্র বিজ্ঞান বিষয়ক উচ্চতর শিক্ষাতেই প্রযোজ্য তেমনটি নয়।  উদাহরণস্বরূপ  মিশেল ফুকোর  সাহিত্যকর্মের উল্লেখ করা যেতে পারে।  ফুকো, ফ্রেডরিক নিৎসে বা মার্টিন হাইডেগার এর দর্শন  নিয়ে ফরাসী ভাষায় লেখার সময়  [৭]  মূল রচনাগুলির বেশ কিছু জার্মান পরিভাষা অপরিবর্তিত রাখেন।  তাতে  কোন অসুবিধা হয়েছিল বলে জানা যায়না।  প্রখ্যাত  মার্ক্সীয়  তাত্ত্বিক পল মার্লার স্যুইজি ও এ প্রসঙ্গে মার্কসের বক্তব্য ইংরেজি তে অনুবাদের ক্ষেত্রে পরিভাষার ভূমিকা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন  বিভিন্ন লেখায় [৮] ।
এ প্রসঙ্গে বাংলা পরিভাষার ব্যাবহার  বিশেষ একটি ব্যাপারে অত্যন্ত উপযোগী। বাচনগত ধ্বনিবিদ্যার  (ফোনেটিক্স) ক্ষেত্রে ইংরেজি  কিছুটা  দুর্বল ভাষা। বিদেশী নামের সঠিক উচ্চারণ বোঝা যায় না সেখান থেকে। তুলনায় বাংলায় অনেক বেশি ডায়াক্রিটিক্যাল মার্ক থাকার জন্য বাংলা বর্ণমালা তুলনায় ফোনেটিক্যালি অনেক সমৃদ্ধ। যে কোনো অতি জটিল ধ্বনিগত উচ্চারণ কে একদম সঠিক ভাবে বর্ণে লিখে ফেলা যায়। স্লাভিক বা অন্যান্য অনেক পূর্ব ইউরোপিয়ান ভাষাতেও  যেটা সম্ভব হয়। ফলে বাংলা বইগুলি পড়ে বিভিন্ন বিদেশী নাম অনেক পরিষ্কার ভাবে বুঝতে ও বলতে শেখা  যায়। পরে যা অসম্ভব কাজে লাগে,  ইংরেজি মাতৃভাষা নয় এরকম দেশগুলিতে গবেষণার কারণে থাকার সময়।
যেহেতু ইংরেজি ই আন্তর্জাতিক উচ্চশিক্ষার মাধ্যম, ফলে বিজ্ঞান সেই ভাষায় না পড়লে পিছিয়ে পড়তে হবে – এই বক্তব্যের ও কোনো সারসত্য নজরে আসেনা প্রকৃত প্রস্তাবে। রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া – ইত্যাকার যাবতীয় দেশ ই বিজ্ঞান চর্চায় আমাদের দেশের থেকে বহু মাইল এগিয়ে (জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি এবং ইজরায়েল  কে না হয় বাদ  ই দেওয়া গেলো আপাততঃ) – মৌলিক গবেষণা পত্রের `পেপার প্রতি সাইটেশন’ এর নিরিখে ভারত এই সব দেশগুলির ধারে কাছে আসে না। এইসব দেশের পড়ুয়াদের ইংরেজি জ্ঞান ভয়াবহ হয়ে থাকে সাধারণতঃ।  এইসব দেশে উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষা কিন্তু মাতৃভাষা তেই হতো। এখনো হয়। এবং অনেক সময় ই প্রায় পুরোটাই মাতৃ ভাষায় পি এইচ ডি থিসিস এর কাজ করে (গবেষণা পত্র লেখার জন্য পেশাদার দ্বিভাষিক অর্থাৎ বাইলিঙ্গুয়াল ইন্টারপ্রেটার থাকেন অনেক সময়) এনারাই হার্ভার্ড এমআইটি প্রিন্সটন কেমব্রিজ ভরিয়ে রাখেন পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা  করার সময়।  ভারতীয়রা সেসব প্রতিষ্ঠানে তুলনায় নিতান্তই সংখ্যালঘু।
বিষয়টা অতএব, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব কিনা সেটা নয়, সেই মানসিকতা আছে কিনা আমাদের এলিট ক্লাস এর, সেটার ই। দৃশ্যতই, অর্থনৈতিক ভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে যাঁরা আছেন, মাতৃভাষায় উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষা চালু হলে তাঁরা মুশকিলে পড়ে যেতে পারেন, পায়ের নিচের মাটি হারিয়ে যেতে পারে প্রতিযোগিতায়।  অখ্যাত গন্ডগ্রাম থেকে উঠে আসবে আকাটা হীরের মতো মেধাসম্পন্ন সাবল্টার্ন পড়ুয়ারা।   শহুরে এলিট দের সন্তানদের ভিত আমূল টলিয়ে দেবে  পেশাগত প্রতিযোগিতার বাজারে। ইংরাজি আঁকড়ে থাকা, অতএব, এক শ্রেণীর মানুষের কাছে অস্তিত্বের লড়াই।  কারণ সেখান থেকেই উঠে আসবে শাসক শ্রেণীর প্রতিভূরা।  সেই অবস্থান অতো সহজে বেহাত হতে দেওয়া কি চলে?
কিছু মানুষ এই ভাবে যুক্তি সাজানোর চেষ্টা করে থাকেন যে চীন রাশিয়া ইত্যাদি দেশের সাথে  ভারতবর্ষের একটি মৌলিক পার্থক্য আছে।  ভারত বহুভাষী রাষ্ট্র।  সেখানে যে যার মাতৃভাষায় উচ্চতর শিক্ষা লাভ করলে, পঠনপাঠন ও গবেষণা সংক্রান্ত বিভিন্ন সম্মেলনে বক্তব্য  বিনিময় করা অসুবিধাজনক হয়ে উঠতে পারে। ধারণা টি ঠিক নয়।  উচ্চতর শিক্ষাক্ষেত্রে যাঁদের বিচরণ, সেইসব গবেষক দের আপন প্রচেষ্টায় ইংরেজি শিখে নেওয়া এবং মত  বিনিয়োময়ের ক্ষেত্রে ইংরেজি তে আলোচনা করা এমন কিছু কঠিন কাজ বলে মনে হয় না।  ভাষা শিক্ষা, অন্ততঃ কাজ চালানোর স্তর এ,  সর্বদাই সহজ, বিষয় শিক্ষার  তুলনায়।  গবেষকের জ্ঞান ও মেধা কখনো একটি নির্দিষ্ট ভাষায় তাঁর কতটা দখল, সেই বিষয়ের ওপরে নির্ভর করে না।  প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য সোভিয়েত রাশিয়ায় দিকপাল বৈজ্ঞানিকদের গবেষণা প্রবন্ধ এক কালে শুধুমাত্র রাশিয়ান ভাষাতেই ছাপানো হতো তাঁদের নিজস্ব গবেষণা পত্রিকায়।  পাশ্চাত্যের দেশগুলি পরে নিজেদের স্বার্থে সেই গবেষণা পত্র গুলির ইংরেজি অনুবাদ করেন।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর আগে জার্মান (সাধারণভাবে প্রাশিয়ান) বৈজ্ঞানিক দের ক্ষেত্রেও এক ই কথা প্রযোজ্য।  সত্যেন্দ্রনাথ বোস এর যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা স্বয়ং আইনস্টাইন ছাপিয়েছিলেন নিজ উদ্যোগে, এবং যে গবেষণা পত্রর ওপরে ভিত্তি করে পরবর্তীকালে বহু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হয়েছে বিজ্ঞানের জগতে – প্রকাশিত হয়েছিল `সাইতশ্রিফ্ট ফুর ফিজিক’ গবেষণা পত্রিকায়, জার্মান ভাষায়।  স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তর এ বাংলায়  (অথবা অন্য যে কোনো আঞ্চলিক ভাষায়) বিজ্ঞান বা অন্য বিষয়ের পঠনপাঠন চালু হলে উচ্চতর মৌলক গবেষণা করাকালীন শিক্ষার্থিদের খুব একটা অসুবিধায় পড়ার কথা নয়।
বরং মাতৃভাষায় বিজ্ঞানশিক্ষার বিশেষ কিছু জরুরি প্রয়োজনীয়তা আছে, ভারতবর্ষের মতো তৃতীয়বিশ্বের দেশগুলিতে যা অনস্বীকার্য।  যে দেশে কয়েক লক্ষ শিশু অপুষ্টি তে মারা যায়, এক থালা ভাতের বিনিময়ে বিকিয়ে যায় নারীশরীর অথচ গনেশ ঠাকুরের খাওয়ার জন্য দুধের বরাদ্দে হাত পড়েনা কখনো – হাত পড়েনা শিবরাত্রির দিন হাজার হাজার লিটার দুধ প্রাণহীন পাথরের খন্ডের মাথায় ঢেলে অপচয় করার, যে দেশে বাবা, গুরু, এবং তাঁদের চ্যালাদের কথায় ওঠবোস  করেন দেশ ও মানুষের ভাগ্যনিয়ন্তা রাজনীতিবিদ রা, যে দেশে ISRO (ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন – ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংক্রান্ত প্রধান সরকারি সংস্থা) র মহাকাশযান  উৎক্ষেপণ  কক্ষটি, সতীশ ধবন স্পেস সেন্টার যার নাম, তার মিডিয়া সেন্টার  – তৈরী হয় বাস্তু মেনে, মঙ্গলগ্রহে রকেট পাঠানোর প্রকল্প `মঙ্গলায়ন’ এর উৎক্ষেপণ সময় ঠিক করা হয় কেরালার এক জ্যোতিষীর মত  অনুসারে পঞ্জিকা মেনে যাতে রাহুর দৃষ্টি থেকে মুক্তি পেয়ে সাফল্য লাভ করে এই প্রকল্প,  এবং সেই রকেট ওড়ানোর আগে তার মিনিয়েচার মডেল নিয়ে তিরুপতির  স্বামী ভেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে পুজো দিয়ে দেবতার আশীর্বাদ চাইতে যান ISRO র সর্বাধক্ষ – সেই দেশে, সেই দুর্ভাগা দেশে, জনসাধারণের করের  পয়সা ব্যবহার করে অন্ধ ধর্মবিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়ার অশ্লীল প্রক্রিয়া রমরম করে চলা সেই  ঘৃণ্য ও নির্লজ্ব  রাষ্ট্রব্যবস্থায় –  উপযুক্ত বিজ্ঞানশিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সামান্যতম সন্দেহের অবকাশ  থাকতে পারে না।
আর সেই বিজ্ঞানচেতনা আসবে গণবিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ শিক্ষার হাত ধরেই একমাত্র।  তার জন্য প্রয়োজন সাধারণ দেশবাসীর সাথে শিক্ষিত মানুষের যোগাযোগ স্থাপনের – যা মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে অসম্ভব, কারণ দারিদ্ররেখার কাছাকাছি অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো ভারতের সাধারণ নাগরিক কে ইংরেজি তে বিজ্ঞান বোঝাতে যাওয়ার প্রস্তাবের মতো হাস্যকর ভাবনা আর কিছু হতে পারে না।  মানুষ মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিখবেন, সেই সূত্রে উঠে আসবেন অসংখ্য প্রান্তিক (অর্থনৈতিক বা সামাজিক ভাবে) পড়ুয়ারা, যাঁরা নিজের অবস্থান সম্পর্কে সম্যক অবহিত।  তাঁরা উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে অন্ধ কুসংস্কার থেকে মুক্তি পাবেন, গড়ে উঠবে প্রকৃত চেতনা।  সেই চেতনাকে তাঁরা ছড়িয়ে দেবেন অত্যাচারিত, শোষিত, অবহেলিত প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে – কুসংস্কার, জাতপাত, লিঙ্গবৈষম্য, ধর্মীয় মৌলবাদ থেকে তবেই ঘটবে সার্বিক মুক্তি।  তৈরী হবে শোষণমুক্ত সমাজ।  আঞ্চলিক ভাষায় বিজ্ঞানশিক্ষার ভূমিকা, অতএব, সীমাহীন গুরুত্বপূর্ণ।  সেই ভূমিকা কে অস্বীকার করার প্রচেষ্টার মতো প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান খুব কম ই আছে।  রাষ্ট্রশক্তি যে  তাই প্রানপনে বিরোধিতা করবে মাতৃভাষায় উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষা চালু করার প্রক্রিয়াকে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।  রাষ্ট্রশক্তির সেই প্রবল প্রতাপ এর বিরুদ্ধে এক প্রধান অস্ত্র তাই মাতৃভাষাকে বিজ্ঞানচেতনা জাগ্রত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা।
——
তথ্যসূচি
——
১) চেয়ার প্রফেসর (Endowment Professor/Name Professorship) কোনো বিশ্বাবিদ্যালয় এর বিশিষ্ট অধ্যাপক হওয়ার স্বীকৃতি।  এই  ধরণের পদ এ বেতন এবং বিভিন্ন গবেষণা সংক্রান্ত আর্থিক সুযোগসুবিধা আসে কোনো বিশেষ ব্যক্তি (বিশেষ কোনো ধনী ব্যক্তি, যেমন কোনো `স্থানীয় রাজা’ অর্থাৎ নেটিভ/প্রিন্সলি স্টেট্ এর রাজা – বর্ধমান এর মহারাজা বা ভুকৈলাশের  রাজা, উদাহরণস্বরূপ) দ্বারা আর্থিক অনুদান থেকে।  স্যার তারকনাথ পালিত অধ্যাপক এবং খয়রা অধ্যাপক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এইরকম দুটি সম্মানজনক পদ।  ১৯১৪ সালে প্রখ্যাত আইনজীবী স্যার তারকনাথ পালিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কে পনেরো  লক্ষ টাকার অনুদান দেন।  সেই অনুদান এর অর্থ থেকে পরবর্তী কালে `পালিত অধ্যাপক’ পদ টি তৈরী হয়।  নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী সি ভি রামন ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পালিত অধ্যাপক।
১৯১৯ সালে যখন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা হাইকোর্ট এর প্রধান বিচারপতি ছিলেন সেই সময়ে খয়রার রাজা কুমার গুরুপ্রসাদ সিং এর বিরুদ্ধে তাঁর স্ত্রী রানী বাগেশ্বরী দেবী মামলায় জিতে ছয় লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পান।  তিনি সেই টাকা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর উন্নতিকল্পে দান করেন।  স্যার আশুতোষ মুখার্জি দ্বিতীয় বারের  জন্য যখন কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে যোগ দেন, সেই অনুদান দিয়ে খয়রা অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করেন। পদার্থবিদ্যায় প্রথম খয়রা অধ্যাপক ছিলেন মেঘনাদ সাহা।
উপরোক্ত বিষয়গুলি আরো বিশদে জানার জন্য নিচের বইটি দেখা যেতে পারে :
Nucleus and Nation – Scientists, International Networks and Power in India, Anderson, Robert S., University of Chicago Press, July, 2010.
বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন চেয়ার প্রফেসর এর বিষয়ে বিশদ তালিকা পেতে নিচের ওয়েবসাইট টি দেখা যেতে পারে:
২) পরমাণু ও কেন্দ্রক  গঠন পরিচয়  (An Introduction to Atomic & Nuclear Structure)- ঘোষাল, সমরেন্দ্রনাথ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, দ্বিতীয়  সংস্করণ ১৯৮৬।
৩)  An Experimental Verification of the Theory of Compound Nucleus, Ghoshal, Samarendra Nath, Physical Review D, 80, 939 – Published on 15 December 1950।
৪)  Observation of Antiprotons, Chamberlain, Owen.; Segre, Emilio.;  Wiegand, Clyde Ypsilantis  Thomas.,  1955, Lawrence Berkeley National Laboratory, University of California, Berkeley.
৫) বিজ্ঞানে উপেক্ষিতাদের অন্যতম হলেন অধ্যাপক সুশান জোসলিন বেল বার্নেল।  স্নাতকোত্তর স্তর এ গবেষণারত থাকাকালীন তিনি প্রথম রেডিও পালসার (এক বিশেষ প্রকারের নক্ষত্র) আবিষ্কার করেন, যে আবিষ্কারের ওপরে ভিত্তি করে ১৯৭৪ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ পান জোসলিন এর একাডেমিক সুপারভাইসর অধ্যাপক এন্টোনি হিউইশ এবং অধ্যাপক মার্টিন রাইল।
নিচের লিংক টিতে অধ্যাপক বেল এর একটি তথ্যনিষ্ঠ ইন্টারভিউ দেওয়া হলো:
The Astronomer Jocelyn Bell Burnell Looks Back on Her Cosmic Legacy
By Marguerite Holloway, The New Yorker,  December 30, 2017
৬) বাংলায় বিজ্ঞানচর্চায় সত্যেন্দ্রনাথ বোস এর অবদান সংক্রান্ত ব্যাপারে আরো বিশদে জানার জন্য নিচের বইটি দেখা যেতে পারে:
Satyendra Nath Bose — His Life And Times: Selected Works (With Commentary, Kameshwar C. Wali,  World Scientific Publishing Company, First Edition, 2009, 512 pages.
৭) এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে এই বইটি দেখা যেতে পারে:
Foucault and Philosophy, O’ Leary, Timothy (ed.) & Falzon, Christopher (ed.), Wiley-Blackwell,  First  edition, March 29, 2010
৮) এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে নিচের রচনাসংগ্রহটি দেখা যেতে পারে:
Paul Sweezy and Monopoly Capital, Foster, John Bellamy, in `Understanding Capitalism: Critical Analysis From Karl Marx to Amartya Sen’, by Dowd, Douglas (ed.), Pluto Press, First Edition, 2002.
শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২