পুথি থেকে সম্পাদনা : প্রসঙ্গ ‘অন্নদামঙ্গল’ – শুভাশিষ গায়েন
উনিশ শতকে বাঙালির সর্বাধিকজনপ্রিয় কাব্য ‘অন্নদামঙ্গল’। ছাপাখানার প্রথম যুগে সবচেয়ে বেশি মুদ্রিত হয়েছিল কাব্যটি। ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দেকাব্যটি রচিত হলেও মুদ্রণেরপ্রথম সুযোগ পায় ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের হাত ধরে। তার আগে পর্যন্ত বাঙালি হাতে লেখা পুথি পড়ে ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের রস আস্বাদন করত। তারপর ১২২৪ বঙ্গাব্দে বা ১৮১৭-১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বনাথ দেবের ছাপাখানায় ‘অন্নদামঙ্গল গ্রন্থান্তঃপাতী বিদ্যাসুন্দর’ মুদ্রিত হয়। ১২৩৫ বঙ্গাব্দে বা ১৮২৮-১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সিমুলিয়ার পীতাম্বর সেনের ছাপাখানা থেকে ‘অন্নদামঙ্গল-বিদ্যাসুন্দর’ প্রকাশিত হয়। রাধামোহন সেন সমগ্র ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের টীকা-টিপ্পনী সহ (পদ্যে)একটি কাব্য প্রকাশ করেন। ভারতচন্দ্রের কাব্যের কয়েকটি স্থানের তিনি সমালোচনা করেন এবং সেই অংশের টীকা-টিপ্পনী তৎকালীন রীতি অনুযায়ী কবিতার ছন্দে রচনা করেছিলেন।১এরপর ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর সংস্কৃত মুদ্রণ যন্ত্র থেকে ‘অন্নদামঙ্গল’কাব্যের একটি সুন্দর সংস্করণ প্রকাশ করেন। তিনি কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি থেকে ‘অন্নদামঙ্গল’-এর পুথি আনিয়েছিলেন। এই গ্রন্থের আখ্যাপত্রে মুদ্রিত ছিল“কৃষ্ণনগর রাজবাটীর মূল পুস্তক দৃষ্টে পরিশোধিত” হয়েছিল। এই পুথিটি ভারতচন্দ্রের মূল পুথি না একটি সাধারণ পুথি তা বোঝা যায় না। তাছাড়া ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের কোন্ অংশে ওই পুথি ব্যবহৃত হয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেননি। এই সমস্ত প্রকাশিত ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য ছাড়াও বটতলা থেকে প্রকাশিত ‘অন্নদামঙ্গল’, বঙ্গবাসী প্রেস থেকে প্রকাশিত ‘অন্নদামঙ্গল’ এবং বসুমতি-সাহিত্য মন্দির থেকে প্রকাশিত ‘অন্নদামঙ্গল’ উনিশ শতকে বাঙালির ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য রসাস্বাদনেরআগ্রহকে বাড়িয়ে দিয়েছিল।কিন্তু কোনো সংস্করণেই অষ্টাদশ শতাব্দীর ভাষা মেলে না। যা মেলে তা ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রকাশিত বটতলা সংস্করণের ভাষা। বটতলার প্রকাশকরা‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের ভাষাকে মেজে-ঘষে একেবারে তাদের সমসাময়িক করে তুলেছিল, এমনকি মুদ্রিত ‘অন্নদামঙ্গল’কাব্যগুলির পরস্পরের মধ্যে পাঠের বৈসাদৃশ্য লক্ষকরা যায়। ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর ষাট বছরের মধ্যে ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য মুদ্রিত রূপ পায়। এতদসত্ত্বেও এই কাব্যের পাঠ বৈসাদৃশ্য লক্ষ করে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আক্ষেপ করেছেন-
ভারতচন্দ্রের কাব্যের একটি যুগোপযোগী প্রামাণিক এবং সুন্দর সংস্করণ প্রকাশিত হওয়া উচিত। বাঙ্গালার ব্রিটিশ-পূর্ব যুগের শ্রেষ্ঠ কাব্য শিল্পী হিসাবে এইরূপ একটি সংস্করণ না থাকা বাঙ্গালাদেশের ও বাঙ্গালী জাতির পক্ষে লজ্জার কথা।২
তিনি আশা করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের একটি স্বতন্ত্র পাঠ গড়ে তুলবেন, কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হয়নি।বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদের পুথিশালায় ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের ছয়টি সম্পূর্ণ এবং বেশকিছু অসম্পূর্ণ পুথি রক্ষিত আছে। এই পুথিগুলিরবিষয়ের একটি নামও নির্দষ্ট নয়। পুথিগুলির মধ্যে ‘কালিকামঙ্গল’, ‘অন্নদামঙ্গল’, ‘বিদ্যাসুন্দর’, ‘কালিকাপুরাণ’ প্রভৃতি নাম পাওয়া যায়। অথচ সমস্ত বিষয়বস্তু ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যেরই।
এই সকল প্রকাশিত গ্রন্থ ও অপ্রকাশিত পুথি ছাড়াও সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আরেকটি ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের পুথির সন্ধান দিয়েছিলেন ‘সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা’য় ১৩৪৫ বঙ্গাব্দের তৃতীয় সংখ্যায় ‘ভারতচন্দ্রের একখানি পুঁথি’ শীর্ষক আলোচনায়। তিনি এই পুথিটি দেখেছিলেন প্যারিসের ‘বিব্লিওথেক ন্যাসিওনাল’বা ফরাসি জাতীয় গ্রন্থাগারে ভারতীয় পুথি সংগ্রহের মধ্যে। পুথিটি ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের অন্তর্গত ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর। এই পুথিটির অনুলিপিকাল ১১৯১ বঙ্গাব্দ বা ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ। বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদে রক্ষিত সবথেকে প্রাচীন পুথিটি ১২০৪ বঙ্গাব্দ বা ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে অনুলিখিত। সে দিক থেকে ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের সবথেকে প্রাচীন পুথি এটি। পুথিটি Augustn Aussant নামে এক ফরাসি কর্মচারী অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে চন্দননগর থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বর্ণনা অনুযায়ী পুথিটির পত্র সংখ্যা ৫০। শুধু তাই নয় এই পুথিটির ভাষাও প্রাচীনত্বের দাবী রাখে।৩ পুথিটির শুরু এইভাবে— “৭ শ্রী শ্রী কৃষ্ণ। অত অন্নপূর্ণ্ণা ঠাকুরানির পুস্তক লিক্ষতে। কবি সক্তী শ্রীতারাচরণ রায়। আজ্ঞা শ্রী যুক্ত রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় মহাশয়”ইত্যাদি।৪পুথিটির শেষের অংশে আছে এইভাবে—“বিদ্যাসুন্দরে লইয়া কালিকা কৌতুকী হয়্যা কৈলাসেতে করিলা প্রবেশ। কালিকা-মঙ্গল সায়ঃ ভারথ ব্রাহ্মণ গায়ঃ রাজা কৃ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আদেস।। ইতি কালিকামঙ্গল সমাপ্ত। সন ১১৯১ সাল তারিখ ১৪ কার্ত্তিক।”৫ পুথিটি তিনি অনুলিপি করে আনতে পারেননি। পরবর্তীকালে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদের উদ্যোগে এই পুথিটির ফটোকপি আনা হয়। যা পরবর্তীকালে ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের স্বতন্ত্র পাঠ নির্মাণে সহায়ক হয়েছিল।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের তিন বছর পর ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে ‘সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা’র দ্বিতীয় সংখ্যায় রমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় ‘ভারতন্দ্রের অন্নদামঙ্গল’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের উপযুক্ত সম্পাদনার কথা অনুভব করেন এবং একই বছরে পরপর দুটি কিস্তিতে তিনি ভারতচন্দ্রের মুদ্রিত ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের সঙ্গে পুথির পাঠ বিচার করেন। তারপর একই পত্রিকায় একই শিরোনামে ১৩৪৯ বঙ্গাব্দে আরেকটি আলোচনায় তিনি মুদ্রিত পাঠের সঙ্গে পুথির পাঠের বৈসাদৃশ্য তুলে ধরেন। তিনি বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে প্রকাশিত ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ এবং ১২৯৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত বঙ্গবাসী সংস্করণের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের সঙ্গে ১১৯২ বঙ্গাব্দে অনুলিখিত পুথির পাঠ মিলিয়ে একটি আদর্শপাঠ তৈরি করতে চেয়েছিলে। ১১৯২ বঙ্গাব্দের এই পুথিটি বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ সংগ্রহ করেছিল বাংলাদেশের নড়াইলের কবি গঙ্গারাম দত্তের পুত্র শ্রীধর দত্তের কাছ থেকে। পুথিটির পত্র সংখ্যা ১৩৭। একটি পুথির মধ্যে ‘অন্নদামঙ্গল’ ও ‘বিদ্যাসুন্দর’ পরপর লিখিত। প্রতিটি পত্রের ছত্র সংখ্যা নয়। এক থেকে আটাত্তর সংখ্যক পত্র পর্যন্ত ‘অন্নদামঙ্গল’-এর প্রথমভাগ সম্পূর্ণ হয়েছে। পরবর্তী পত্র থেকে ১৩৭ পত্রে ‘বিদ্যাসুন্দর’ সমাপ্ত।
রমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় ভারতচন্দ্রের মুদ্রিত গ্রন্থের সঙ্গে পুথির পাঠভেদ করার জন্য গ্রন্থের বামদিকে মুদ্রিত গ্রন্থের পাঠ এবং ডানদিকে ১১৯২ বঙ্গাব্দের পুথির পাঠ রেখেছিলেন। তাঁর অভিমত এই পুথিটির সঙ্গে বঙ্গবাসী সংস্করণের পুথির অনেকাংশে পাঠসাদৃশ্য বর্তমান।৪৮৪ তিনি ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের ‘গণেশবন্দনা’, ‘শিববন্দনা’, ‘সূর্যবন্দনা’, ‘বিষ্ণুবন্দনা’, ‘কৌশিকীবন্দনা’, ‘লক্ষ্মীবন্দনা’, ‘সরস্বতীবন্দনা’, ‘অন্নপূর্ণাবন্দনা’, ‘গ্রন্থ সূচনা’, ‘কৃষ্ণচন্দ্রের সভা বর্ণনা’, ‘সতীর দক্ষালয়ে গমনোদ্যোগ’, ‘পীঠমালা বর্ণনা’, ‘শিবের বিবাহ মন্ত্রনা’, ‘শিবের ধ্যানভঙ্গ ও কামভস্ম’, ‘শিবের বিবাহ যাত্রা’ প্রভৃতি অংশে মুদ্রিত পাঠের সঙ্গে পুথির পাঠের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈসাদৃশ্য উপস্থাপন করেন। তিনি এইভাবে ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের প্রথম খণ্ডের পাঠভেদ নির্ণয় করেছেন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের এই (সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং রমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়) নতুন পুথি সংগ্রহ এবং আদর্শ পাঠ নির্মাণের প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছিল। তাঁদের দেখানো পথ ধরে ১৩৫০ বঙ্গাব্দে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাসের যৌথ সম্পাদনায় ‘বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ’ দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থমালার অন্তর্গত ‘ভারতচন্দ্র গ্রন্থাবলী’ নামে একটি প্রামাণিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই সংস্করণটি তৎকালীন প্রকাশিত সংস্করণের থেকে উৎকৃষ্ট ছিল এবং ভারতচন্দ্রের সমকালের ভাষার ছাপ লক্ষ করা যায়।
সূত্রনির্দেশ
১. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড; সুকুমার সেন; আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড; কলকাতা; দশম মুদ্রণ ১৪১৮ বঙ্গাব্দ;পৃষ্ঠা-৪২৫।
২. সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, পঞ্চচত্বারিংশ ভাগ; ১৩৪৫ বঙ্গাব্দ; ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত; প্রবন্ধ – ‘ভারতচন্দ্রের একখানি পুঁথি’; প্রাবন্ধিক – সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়; পৃষ্ঠা-১৪৯।[অতঃপর পত্রিকাটি সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, পঞ্চচত্বারিংশ ভাগ নামে উল্লেখিত হবে।]
৩. তদেব; পৃষ্ঠা-১৫০।
৪. তদেব; পৃষ্ঠা-১৫০।
৫. তদেব; পৃষ্ঠা-১৫০।
খুব ভালো লেখা
নতুন ধরনের তথ্য সম্বলিত