|

‘আমি তাঁর অপেক্ষায় বসে আছি’ – কাজী জহিরুল ইসলামের সাক্ষাৎকার

শেয়ার করুন

[তরুণ কথাশিল্পী মুহিম মনির কবি ও কথা সাহিত্যিক কাজী জহিরুল ইসলামের এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন ৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৮, কবির ৫১তম জন্মদিনের একদিন আগে]

মুহিম মনিরঃ আপনার লেখালেখির শুরুটা ঠিক কখন এবং শুরুটা কি কবিতা দিয়েই?
কাজী জহিরুল ইসলামঃ শুরুটা খুব ন্যাচারালি হয়েছে, যখন কিছুই বুঝতাম না, তখন। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি, গ্রামের বাড়িতে, ফসলের মাঠে মামারা কাজ করছেন, তখন দুটি লাইন মনে আসে। এটাই আসলে শুরু না, শুরু নিশ্চয়ই অনেক আগে, হয়ত কবি হয়েই আমি জন্মেছিলাম, তবে মনে আছে এই দুটি লাইন, ‘হাত নেড়ে নেড়ে তামাকের চারা লাগায় ক’জন চাষী/ বটছায়াতলে কে বসে বাজায় অমন মধুর বাঁশি”। কবি আল মাহমুদ ২০০৭- এ আমার সম্পর্কে লিখেছিলেন, আমি যা লিখি তা লেখার জন্য নাকি কবি হয়ে জন্মাতে হয়, জন্মে কবি হওয়া যায় না। হ্যাঁ, কবিতা দিয়েই শুরু, তবে আমার প্রথম প্রকাশিত বই গল্পগ্রন্থ, ১৯৯৪ সালে।

মুহিমঃ আপনার কবিতায় ক্রিয়াপদের ব্যবহার বেশ কম। অনেকের মতে ‘ক্রিয়াপদহীন কবিতা’ লেখেন আপনি। এ ব্যাপারটা নিয়ে কবিতাপ্রেমীদের উদ্দেশে যদি কিছু বলতেন!
জহিরঃ ক্রিয়াপদ বাংলা কবিতা থেকে তুলে দিয়ে আমি বেশ কিছু কবিতা লিখেছি। সেগুলো দিয়ে “ক্রিয়াপদহীন ক্রিয়াকলাপ” গ্রন্থটি বের হয় কোলকাতার সৃষ্টিসুখ প্রকাশন থেকে ২০১৬-তে। আমিই সম্ভবত প্রথম বাংলা কবিতা থেকে ক্রিয়াপদ তুলে দেবার ঘটনাটি ঘটাই। তাই লোকে আমাকে ক্রিয়াপদহীন কবি বলে। তবে আমার মূল লক্ষ ক্রিয়াপদ একেবারে তুলে দেয়া নয়, কবিতা থেকে ক্রিয়াপদ কমিয়ে ফেলা। এতে কবিতায় পাঠকের ভাবনার জায়গাটা প্রসারিত হয়। ‘ক্রিয়া’টা থাক না পাঠকের জন্য। ক্রিয়াপদ বাদ দিতে পারলে কবিতা কিন্তু খুব মজবুত এবং শৈল্পিক হয়ে ওঠে। তুমিও তো কিছু পড়েছ, তাই মনে হয় না?

মুহিমঃ আমিতো আপনার ক্রিয়াপদহীন কবিতা সিরিজের একজন ভক্ত। আমিও মনে করি দূর ভবিষ্যতের কবিরা ক্রিয়াপদহীন কবিতাই লিখবেন। বাংলা কবিতার প্রচলিত আঙ্গিক ভেঙে একটি নতুন এবং অধিক্তর শৈল্পিক আঙ্গিক নির্মাণের জন্য ইতিহাসে আপনার নাম লেখা থাকবে। আপনার ‘সূর্যাস্তের পরের ফিরিস্তি’ কাব্যগ্রন্থে কবি শহীদ কাদরীর শেষ কথাগুলো নিয়ে একটি কবিতা আছে, ‘দৃষ্টি বদলে যায়’। কবিতাটি রচনার প্রেক্ষাপটটা ঠিক কেমন?
জহিরঃ ২০১৬-র আগস্ট মাস। ১৪ তারিখে আমরা তাঁর জন্মদিন পালন করলাম। এর সপ্তাহ খানেক পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমি এবং আমার স্ত্রী তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যাই। আমাকে দেখে তিনি এতোই উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন যে অসুস্থতার কথা ভুলে আড্ডায় মেতে ওঠেন। আমরা এক-দেড় ঘণ্টা ছিলাম। সেই সময়ে তাঁকে বলি শহীদ ভাই, কিছু উপদেশ দেন। অসুস্থ অবস্থায় কবির উপদেশ কবিতা হয়ে যায়। তিনি বলে তাই নাকি? এরপর পুরো সময়কাল জুড়ে তিনি যে কথাগুলো বলেন, আমি সেগুলোকে কবিতার ফর্মে দাঁড় করাই।
[পাঠকদের সুবিধার্থে কবিতাটি এখানে তুলে দেওয়া হল]
দৃষ্টি বদলে যায়
(শহীদ কাদরী’র শেষ কথাগুলো)

মানুষের দৃষ্টি ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে
ক্রমশ বদলে যায়
কম বয়সের দৃষ্টি, মধ্য বয়সের দৃষ্টি
পরিণত বয়সে অন্যরকম হয়ে যায়
বুড়ো বয়সের দৃষ্টি ছিল বাহাদুর শাহ জাফরের
ছিল রবীন্দ্রনাথের
রুচী, পাঠাভ্যাস সবই বদলে যায়
সুলিখিত প্রবন্ধই এখন সুখপাঠ্য, কবিতায় আর হয় না এন্টারটেইনমেন্ট
একটা সময় ছিল, কান্ট গিলতে শুরু করি, এথিক্যাল সোশ্যালিজম
বোঝার-শেখার কি আকুতি, মুখ গুঁজে পড়ি থাকি লাইব্রেরির রো’তে
নাওয়া-খাওয়া সবই অগুরুত্বপূর্ণ
দান্তের দর্শনে কি কাটিনি সাঁতার?
মদ-সিগারেটেও কৈশোরক নেশা ছিল, ছিল আড্ডাবাজি চায়ের টেবিলে
একদিন শামসুর রাহমান বলেন,
‘উঠে আসুন, না হলে কবিতা চলে যাবে’
তবু উঠে আসিনি। আড্ডায় আড্ডায় সম্পূর্ণ করেছি কৈশোর।

দৃষ্টি বদলে যায় জহির, বুঝলে কবি
করো, মন যা চায় তোমার, লিখো যা লিখতে ইচ্ছে করে,
মনের আনন্দের জন্যে করে যাও…
যদি রেখে যেতে চাও দাগ, খোঁজো ভার্জিন পথ
যে পথে এখনো পড়েনি পা কোনো কবির,
বুঝলে, দৃষ্টি বদলে যায়, গেছে। 

এলআইজে, নর্থ শোর হাসপাতাল
লঙ আইল্যান্ড, নিউ ইয়র্ক
২৩ আগস্ট ২০১৬
রাত ৯:৩০  

মুহিমঃ যাঁরা নতুন কবিতা লিখতে আসছেন, তাঁদের পড়াশোনা-প্রস্তুতি সম্পর্কে একজন অগ্রজ কবি হিসেবে আপনি কী বলবেন?

জহিরঃ কবিতাকে ভালোবাসো, অগ্রজদের ভালো কবিতা পড়ো। বাংলা কবিতার এবং বিশ্ব কবিতার ধারাবাহিক ইতিহাস জেনে নাও। বাংলা কবিতার প্রচলিত তিনটি ছন্দ ভালো করে শেখো। এই কাজগুলো তরুণ কবিকে সমৃদ্ধ করবে। তবে কোনো প্রশিক্ষণ কিংবা শিক্ষাই একজন মানুষকে কবি বানাতে পারে না। আর কবিতা আসলে কবি নিজেও লেখেন না, প্রকৃত পঙক্তিরা ওহির মতো নাজেল হয়। আজকাল আমি অবশ্য বলি, বই মানুষকে যে জ্ঞান দেয় তা প্রাথমিক জ্ঞান। আসল জ্ঞান মানুষের ভেতরেই আছে, তবে তা অন্ধকারে নিমজ্জিত। সেই অন্ধকারে আলো জ্বালানোর জন্য একটি দেশলাইয়ের কাঠি দরকার। বই হচ্ছে সেই দেশলাইয়ের কাঠিমাত্র। এই কথাগুলোও আমি তরুণদের বলতে চাই।

মুহিমঃ কাব্যচর্চা নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ ভাবনা কেমন?
জহিরঃ যে কবিতা কেউ লিখেননি সেই কবিতা লিখতে চাই। আমি ঠিক জানি না সেটা কেমন হবে? কি তার আঙ্গিক, কি বিষয়বস্তু, সেই কবিতায় ছন্দ, ক্রিয়াপদ ইত্যাদি থাকবে কি-না, আমি কিছুই জানি না। তবে আমার মনে হয় আলোর কেন্দ্রে আছে এক গভীর অন্ধকার, সেই অন্ধকার থেকেই উঠে আসবে কাঙ্ক্ষিত কবিতার পঙক্তিগুলো। কখন আসবে জানি না, আমি তার অপেক্ষায় বসে আছি। 

মুহিমঃ আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
জহিরঃ তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ মুহিম মনির। ভালো থেক।

শেয়ার করুন

Similar Posts

3 Comments

  1. আমরা নুতন রা আপনাকে দেখে অনবদ্য সব সৃষ্টি থেকে বোঝার চেষ্টা করছি আর প্রতি মুহূর্তে শেখার চেষ্টা করছি ,আপনার নুতন সৃষ্টিশীল কাজের অপেক্ষায় আছি ,….

    কবিতা কেউ লিখেননি সেই কবিতা লিখতে চাই। আমি ঠিক জানি না সেটা কেমন হবে? কি তার আঙ্গিক, কি বিষয়বস্তু, সেই কবিতায় ছন্দ, ক্রিয়াপদ ইত্যাদি থাকবে কি-না, আমি কিছুই জানি না। তবে আমার মনে হয় আলোর কেন্দ্রে আছে এক গভীর অন্ধকার, সেই অন্ধকার থেকেই উঠে আসবে কাঙ্ক্ষিত কবিতার পঙক্তিগুলো। কখন আসবে জানি না, আমি তার অপেক্ষায় বসে আছি।

  2. আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ফারহানা নাজ শম্পা। শুভ কামনা রইল।

  3. ফারজানা নাজ শম্পা, অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *