ভোজ কয় যাহারে (দ্বিতীয় পর্ব) : গুণাগুণ – সত্যম ভট্টাচার্য

ভোজ কয় যাহারে (দ্বিতীয় পর্ব) : গুণাগুণ – সত্যম ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

গত শতকের আশির দশকে লেখা গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের একটি গানের লাইন ছিলো-ভালো কইর্যাি রাইন্ধ বেগুন কালাজিরা দিয়া গো… শুনলে মনে হয় এই দলটির বা গৌতমের কি কোনো সফট কর্ণার ছিলো বেগুনের প্রতি? আবার ঐ দলেরই গাওয়া আরেকটি গান মানুষ চেনা দায়/ চিনতে কষ্ট হয়। এই কথাকটি জীবনের যে কত বড় সত্য তা বিচক্ষ্ণণ ব্যক্তি মাত্রেই জানেন। বড় হবার সাথে সাথে জীবনের হাজারো প্যাঁচপয়জার জানতে জানতে আমরা এই সত্যও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে থাকি। বেগুনও ঠিক তেমনই একটি বস্তু। ঋতু পালটালে সেও যেন আমুল পালটে যায়। আমাদের আজকের কথা বেগুন নিয়ে।

আসলে যতই বেগুনকে অবহেলা করে আমরা বলে থাকি নেই গুণ যার কিন্তু নিত্যদিনের জীবনে বিশেষত শীতকালে এই বেগুনের গুরুত্ব অসীম। সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, যার নিজের জীবনই একটি উপন্যাস প্রায়, তিনি তার বাজার সফর গ্রন্থে বাজারকে একটি উপন্যাস বলে অভিহিত করেছেন। আর উপন্যাসের চরিত্ররা যেমন তাদের হাজার রং-রূপ-গন্ধ-বর্ণ নিয়ে হাজির হয় একেকটি শাকসবজিরও ঠিক তেমনই একেক ঋতুতে একেক রকমের বাহার।

এই বেগুনই যেমন। ঋতু পাল্টালে চেনা সহজ নয়। গ্রীষ্মকালে যেমন তাকে কেউ প্রায় পাত্তাই দেয় না। বাজারের এককোণে সে পড়ে থাকে। লোকে তাকে তখন শুধু খোঁজে কালোজিরে কাঁচালঙ্কা আলু বড়ির পাতলা ঝোলে খাবার উপাদান হিসেবে। শীত আসলে কিন্তু তখন তার কদরই আলাদা। গ্রীষ্মকালে যে বেগুনের কোনোটা ভাজলে বা হাজার ঝোলে ফুটোলেও থেকে যায় শক্ত, শীতকালে তার তুলতুলে স্বাদটি যেন ছোট্টো শিশুর আঙুল, পেলেই যাকে একটু জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে বা সে নিজেই জড়িয়ে ধরে আপনার কোনো একটি আঙুল।
তবে এত যে গ্রীষ্মকালের বেগুনের দুর্নাম করছি পুরোটাই কিন্তু তা নয়। সরু সরু লম্বা লম্বা যে বেগুন যাকে চাষীরা বলে থাকেন বারোমেসে বেগুন কালো হলুদ ট্যাংরার ঝালটাই তো জমবে না সে না পড়লে। তবে শীতে বেগুনের ব্যাপারটাই আলাদা।
বাজারের মুখ্য সবজি হিসেবে দোকানীরা তখন তাকে সাজিয়ে রাখেন দোকানের একদম সামনে। গ্রীষ্মের শেষে মোটামুটি এই দুর্গাপুজো লক্ষীপুজো যখন যাচ্ছে, সকালের দিকে একটু একটু ঠান্ডা পড়ে, ইচ্ছে করে হালকা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে নিতে, ঠিক সে সময়ই বাজারে যে বেগুনটি চলে আসে তার রঙ বেগুনী, তবে বোঁটার দিকে থাকে হালকা একটু সবুজের এক পোঁচ। একে উত্তরবঙ্গের দিকে চাষীরা ডেকে থাকেন শীত্যাইলা বেগুন নামে। আর যত শীত এগোয় এই বেগুন তার একের পর এক রূপ নিয়ে বাজারে উপস্থিত হতে থাকে।
দ্বিতীয় স্পেলে এই ডিভাই হাজির হয় তার সবুজ পোশাকে। ঠিক তখনই চারিদিকে কুয়াশা। শীত তার রহস্য রোমাঞ্চ নিয়ে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে আমাদের সাথে জড়ানো। তখন সকালের নরম রোদে বসে একটু ভাত যদি খেতে পাওয়া যায় এই গোল চাক চাক সবুজ বেগুন ভাজা, ঘি আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে মনে হয় জীবনে তার চাইতে বড় শান্তি আর কিছুতে নেই।
তার কিছুদিন পরই বাজারে চলে পাঞ্জিপাড়া আর বিকোরের বেগুন। তার একটার রঙ বেগুনী আরেকটার রঙ সবুজ। সাইজে গোল লাউয়ের থেকে একটু ছোট এই বেগুনের ওপর যখন আলো পড়ে তখন মেরিলিন মনরো অথবা মাধুরী দিক্ষীতের ত্বকের কথা আপনার মনে পড়তে বাধ্য কারণ মাছিরাও সেই বেগুনের ওপর পিছলে যাবার ভয়ে বসার সাহস পায় না।
আর তার স্বাদ? সে কথা না বললে আমার বিরুদ্ধে কোনো খাদ্যরসিক ফৌজদারী মামলা করে দিতেই পারেন অনায়াসে। জুবুথুবু শীতে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সামনে যখন গিয়ে বসা হবে, রান্নাঘর ভরে থাকবে সেই বেগুন পোড়ার সুবাসে আর থালার একদিকে রাখা সেই অমোঘ খাদ্যবস্তু থেকে অল্প অল্প করে বেরিয়ে আসবে সোনালী তেল, ওপরের কুঁচি কুঁচি পেঁয়াজ-লঙ্কা-ধনেপাতা, ঠিক তখনই অনেকদিন পর আপনার প্রথম প্রেমের কথা মনে পড়ে যেতে বাধ্য।
অথবা বেগুন ভর্তা আর গরম গরম ফুলে থাকা রুটি! যেন লাহোরে মান্টোর জীবনের খুব অল্প কটি সুখের দিন। মুখে পুড়ুন আর হা করে গরম ভাপটি ছেড়ে দিন। কি চাই আর জীবনে। হামিনস্ত-হামিনস্ত-হামিনস্ত।
ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় তো বাবলু-বিলু-ভোম্বল-বাচ্চু-বিচ্ছুর সাথে আমাদের বড়ই করলেন রোববারের সকালে লুচির সাথে বেগুন ভাজা খাইয়ে। তাই তার প্রতি যদি এরকম প্রেম জন্মায় তা কি আমাদের দোষ বলুন তো?

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২