রবি সেন-এর সঙ্গে আলাপচারিতা

শেয়ার করুন

[কলকাতার দক্ষিণে, যাদবপুরের কাছে বাঘাযতীন এলাকার এক কোণে পড়ে থাকা এক ফ্ল্যাট বাড়ির একতলায়, এক আশি পেরোনো দৃঢ়চেতা, বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ গদ্যকারের সঙ্গে বেশ কয়েকদিন ধরে হয়েছিল এই আলাপচারিতা। ছয় দশক ধরে নিরলস সাহিত্যচর্চা করে চলা তিনি এক বিস্ময়কর কথাকার, যার সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে চোখের সামনে কেবলই ভেসে ওঠে এক ঋজু বৃক্ষের প্রতিকৃতি যে শত ঝড়-ঝঞ্জা, রোদে-তাপে নুইয়ে পড়তে নারাজ। আজও তিনি শিশুর মতন সব বিষয়ে কৌতূহলী, সদা জানতে উৎসুক এবং নিজের অভিজ্ঞতা এবং অধ্যাবসায়ের ওপর বিশ্বাসী।]

গৌতম চক্রবর্তী: আপনার প্রথম কবে উপলব্ধি হল যে আপনি লেখক হতে চান?

রবি সেন: আমাদের ছোট শহরে গণমিছিলের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম । তখন কী বা আমার বয়স! সেদিন বাড়ি ফিরে এসে অনেক রাতে ভেতরের বারান্দায় লণ্ঠনের আলোয় একটা গদ্য লিখি – যেন অটোমেটিক রাইটিং!  সেদিন বুঝি নি, পরে বুঝেছিলাম আমি একটা আপোক্রিফা – নিষিদ্ধ ইস্তাহারই লিখেছিলাম। এই আমার লেখালেখির সূচনা । যদিও দিশা-অভিমুখ তখনও স্থির হয় নি।

গৌতম চক্রবর্তী: লেখক হয়ে ওঠার পথে বহরমপুরের পরিবেশ ঠিক কতটা উপযোগী ছিল?

রবি সেন: আমাদের মফস্সল শহরে তখন বামপন্থার উত্থান কাল। ছাত্র রাজনীতি ছিল তেজী। শহরে কয়েকটা সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক সংবাদপত্র বের হতো। কল্লোল যুগের যুবনাশ্ব – মনীশ ঘটক ও কবি যতীন্দ্র সেনগুপ্ত (তখন নীরব) ছিলেন শহরের অধিবাসী। নিরুপমা দেবীর ভাই লেখক – অধ্যাপক বিভূতি ভট্ট মহাশয় অনেক রাতে রেজাউল করীম সাহেবের বৈঠকখানার আড্ডা থেকে লণ্ঠন হাতে বাড়ি ফিরতেন। গণনাট্য সঙ্ঘ ও ক্রান্তিশিল্পী সঙ্ঘ – এর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মাঝে মধ্যে হতো। জেলার জঙ্গীপুর থেকে দাদাঠাকুর তাঁর ‘জঙ্গীপুর বার্তা’ hand press-এ বের করতেন। যুবনাশ্ব অনেকদিন পরে ‘চতুরঙ্গে’ পূর্ববঙ্গের মৌখিক ভাষায় ‘বুচি’ গল্প লিখলেন। পরে ‘কনখল’ উপন্যাস। পঞ্চাশের দশকের শেষ লগ্নে আমরা সদ্য তরুণরা একটা সাহিত্য পত্রিকা (উত্তরকাল) বের করতে উদ্যোগী হলাম।

গৌতম চক্রবর্তী: আপনার বাড়িতে সাহিত্যের পরিবেশ কেমন ছিল?

রবি সেন: দাদা শহরের লাইব্রেরী থেকে জাঁ ক্রিস্তফ, গলসওয়ার্দি, ডিকেন্স বা বাংলা উপন্যাস, কবিতা কিংবা প্রবন্ধের বই আনতেন। আমিও পড়তাম। সাহিত্যের পরিবেশ তেমন কিছু ছিল না। তবে বড়রা আমার লেখালেখি করার উদ্যোগকে মনোযোগ সহকারে লক্ষ করতেন। বিশেষ করে মা।

গৌতম চক্রবর্তী: কিশোর বয়স থেকেই আপনি সাহিত্য মণ্ডলী গড়ার দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন। এ নিয়ে বিস্তারিত ভাবে আমাদের কিছু বলুন।

রবি সেন: বাংলা বিহার সংযুক্তির বিরুদ্ধে একটা যুবমোর্চার নেতৃত্ব দিয়ে আইন অমান্য করে জেলে গিয়েছিলাম। জেল থেকে বেরিয়ে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে মানে যারা লেখালেখি নিয়ে নিজেদের মতো করে ভাবছিল, তারা জেলার সদরে ভাষা ও সাহিত্য সম্মেলন করার উদ্যোগ নিয়েছিল। এই সম্মেলনের চেয়ারপার্সন হলেন মনীশ ঘটক। সিংহ-হৃদয় মানুষ, তখন বুঝেছিলাম। এই সম্মেলনের অব্যবহিত পরে আমরা জেলা সাংস্কৃতিক পরিষদ গড়ে তুলি। মনীশ ঘটকের সভাপতিত্বে ঘরোয়াভাবে ছোটগল্প পাঠ হতো। কখনও বা সাহিত্য আলোচনা। ‘উত্তরকাল’ নামে এক সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশ করি। চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের কবি জগন্নাথ বিশ্বাস বা কিছুটা সময় ডঃ গুরুদাশ ভট্টাচার্য আমাদের সঙ্গে ছিলেন। পরে কলকাতায় থিতু হলে আমি একটা লেখক সমবায় গড়ার উদ্যোগ নিই। কিন্তু ব্যর্থ হই। পরে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের উদ্যোগে একটি লেখক সমবায় গড়ে ওঠে। দুটি বই – বিজ্ঞান আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ‘বিজ্ঞানে সঙ্কট’ ও বিষ্ণু দে’র ‘রবীন্দ্রনাথ, আধুনিকতা ও ব্রেশট’-এর আলোচনা সমৃদ্ধ একটা বই ঐ লেখক সমবায় থেকে বের হয়। কিন্তু ঐ সমবায়ও বেশিদিন স্থায়ী হয় নি।  

গৌতম চক্রবর্তী: ছোটগল্পকার হিসাবে সাহিত্য জগতে আপনি আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। ওইসময় ‘দেশ’, গণবার্তা ও অন্যান্য সমসাময়িক পত্রিকায় যখন আপনার লেখা প্রকাশ পায়, তখন কলকাতা সাহিত্য পরিবেশ কেমন ছিল?  

রবি সেন: তখন ‘কৃত্তিবাসের’ কবিরা খুব দাপাচ্ছে। আত্মরতির খোলকরতাল বাজছে। বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকাও বর্তমান। আধুনিকতার ছদ্ম অভিভাবক বুদ্ধদেব বসুর নির্ঘোষ ‘কবি হওয়ার জন্যই জন্মেছিলেন সুকান্ত, কিন্তু কবি হওয়ার আগেই তিনি মারা গেলেন।’ এই বাচালতা সাহিত্যের অন্যান্য অংশেও পল্লবিত। ‘দেশ’ পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদক বিমল কর ছোটগল্পে নতুন রীতিকে উৎসাহ দিচ্ছেন। ‘পরিচয়’ পত্রিকা তখনও খাড়া। পরিচয় পত্রিকায় দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর গল্প বা সুশোভন সরকার, হীরেন মুখোপাধ্যায়ের, নীরদ সি চৌধুরীর ‘Continent of Circle’-এর বুদ্ধিদীপ্ত ও যুক্তিসমৃদ্ধ সমালোচনা আমার মনে দাগ কেটেছিল। কিন্তু অচিরেই ‘পরিচয়’ পত্রিকা eclecticism বা সর্বগ্রহীতাবাদের চর্চা শুরু করল। হাংরি জেনারেশনের লেখকদের ছবি বিদেশী পত্রিকায় বের হতে, কিছুটা খুচরো হৈ চৈ হয়। হ্যা, উৎপল দত্তর ‘কল্লোল’ সাড়া ফেলেছিল।  

গৌতম চক্রবর্তী: তখন আপনি রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এই যোগাযোগ মানুষ এবং লেখক হিসাবে আপনার ওপর কিরকম প্রভাব ফেলেছিল?

রবি সেন: আমি প্রধানত গণ-আন্দোলনেরই কর্মী ছিলাম। রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ততোটা নয়। তবে সত্তরের দশকে আরও শক্ত করে হাত মুঠো করি। ব্রেশট বা লুই আঁরাগ-এর মতো বলতে হয় মার্ক্সবাদের চিরায়ত লেখার সঙ্গে বা মাও চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত না হলে, আমার জীবন ও লেখালেখি সঠিক দিশা-অভিমুখ পেত না। রাজনীতির প্রাঙ্গনে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দু’রকম অভিজ্ঞতাই হয়েছিল। মানুষ পরিবর্তন চায়-সুবাতাস ও সমুজ্জ্বল সমাজ তার স্বাভাবিক আকাঙ্খা। সেই মানুষকে সর্বতোভাবে প্রস্তুত করা, তাকে শ্রেণীসংগ্রামে যুক্ত করাই গণ-রাজনীতির প্রধান কাজ। দু’টো radical rapture বা মৌলিক বিচ্ছেদের কথা ‘Communist Manifesto’ বলেছে – হাজার হাজার বছরের কুসংস্কার ও অপচিন্তা থেকে বিচ্ছেদ ও সম্পত্তি প্রথা থেকে বিচ্ছেদ।  

গৌতম চক্রবর্তী: সত্তরের দশকে আপনি কিছু সময়ের জন্য জেলে কাটান। এই সময় জেলে আপনি একটা নাটক লেখেন ও পরবর্তী কালে বেশ কিছু লেখার খসড়াও করেন। সেইসময়ের কথা আমাদের বলুন। নাটকের মতো একটা ফর্ম কেন বেছে নিয়েছিলেন সে বিষয়ে বলুন। 

রবি সেন: জেলখানা এক আজব জায়গা। প্রথমে গোড়ার কথাটা বলি – শ্রেণী বিভক্ত সমাজে প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের হাতে জেলখানা নিপীড়নের এক মস্ত হাতিয়ার। রাজনৈতিক বন্দীদের কথা মনে রেখেই লেনিন জেলখানাকে বলেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়। সত্যিই অনেক কিছু শেখা যায় – বিশেষ করে নিজের নেতিবাচক দিকগুলি। প্রেসিডেন্সি জেলে খাসখাতার আমি যে ফাইলে ছিলাম সেখানে কৃষক সংগ্রামের জীবন্ত চরিত্র জঙ্গল সাঁওতাল থাকতেন। সেইসময় আমরা জেলে এক দীর্ঘস্থায়ী অনশনের মধ্য দিয়ে সংগ্রাম করেছিলাম । সম্ভবত জেলের ইতিহাসে এরকম দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের নজির আর নেই। 

সন্ধ্যায় তরুণ কমরেডদের নিয়ে যৌথপাঠে বসা হতো। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ ও মাও চিন্তাধারা বিষয়ক বইপত্র পড়া হতো। দুপুরে জেলখানা নিঃঝুম হয়ে গেলে আমাদের ফাইলে ১৯-২০ বছরের এক তরুণ, তার মা বাজারে শাকপাতা বিক্রি করতেন, মেঝেতে বুক ঠেকিয়ে বিষণ্ণ কণ্ঠে গান গাইত- ‘তরাই’ জ্বলছে রে, / জ্বলছে আমার হিয়া / আর নকশালবাড়ির মা কাঁদে গো বাবুলালের লাগিয়া।’

রোজ। প্রতিদিন।

সার্ত্র জেলখানা নিয়ে ‘Man Without Shadow’ নাটক লেখেন। পরে গল্প ‘The Wall’। বোর্হেস লেখেন ‘Handwriting of God’। নজরুল কারার লৌহকপাট ভেঙ্গে ফেলতে ডাক দেন।

হ্যা, লু সুনের ‘জ্ঞানী, বোকা ও ক্রীতদাস’ পড়ে একটা পথ-নাটক লেখার ভাবনা মাথায় এসেছিল। ছড়ার সুরে সেটা পদ্যে লিখি। কিছুদিন মহড়ার পর লক-আপ হলে আমরাই সেটা মঞ্চস্থ করি। আরেকটা নাটকে হাত দিয়েছিলাম- ‘এসো, হুনান করি ‘। কিন্তু নাটকের ফর্মে আমার কোন অর্জিত হক নেই বলে, সেটি যথেষ্ট নাটক হয় নি। কিছু কবিতা – যা ফাইলবন্দী হয়ে আছে আর মাও চিন্তাধারা নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখি। এছাড়া করি ব্রেশট-এর কবিতার অনুবাদ।

গৌতম চক্রবর্তী: ‘সূর্যবেড়িয়ার কড়চা’ আপনার প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসের ভাবনা আপনার মাথায় কীভাবে এলো?

রবি সেন: ১৮-১৯ বছর বয়সে সুন্দরবনের একটা অন্তরীপে এক কৃষি খামারে দপ্তর বাবু হয়ে যাই। বিদ্যাধরী ও পাঠানখালি দিয়ে ঘেরা দ্বীপ সূর্যবেড়িয়ার গাংভেরী, হেঁতালের সারি, শাংখাল-ক্ষেতপাতি-কিষান-কিষানী, মাতলা-বাসন্তী, পুরন্দরের মুখ সবার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়েছি ক্রমে। ঘোর আঁধারে নোনা জলে আগুন জ্বলে। ভাঁটার মুখে জল কেটে দ্বারিক সর্দার নৌকো লাগু করে। গ্যারাপি ফেলে। একটা রাতচরা পাখি ডানায় শব্দ জাগিয়ে উড়ে গেল। তখন মাথার ওপর বাঘের চোখের মতো চকচকে চাঁদ উঠেছে। যেন ভেটকির একটা আস্ত আঁশ।

একদিন ঐ অন্তরীপ থেকে আবার আমার ছোট শহরে ফিরে আসি। মধ্যরাত্রির স্বপ্নের উন্মাদনায় উপন্যাসটা লিখতে বসি। শরীর ও মনে এক অনবদ্য স্বাদ নিয়ে অনেক বেলায় জেগে উঠতাম। তা হয়তো ঐ-লেখার জন্যই।

গৌতম চক্রবর্তী: আপনার নিজের উপন্যাস নিয়ে আপনার ধারণা কী?

রবি সেন: বক্তব্যধর্মিতা।  

গৌতম চক্রবর্তী: উপন্যাস সম্পর্কে আপনার ধারণা কী ?

রবি সেন: এপিকের মধ্যেই উপন্যাস লুকিয়ে ছিল। অবশ্যি একটা ধারণা আছে উপন্যাস শিল্প বিপ্লবেরই ফসল। কিন্তু ভাষার সংলাপ ধর্মিতা বোঝাতে গিয়ে বাখতিন ইউরোপের রেনেসাঁর সময়কার (ষোড়শ শতাব্দী) রেবেলেইস (Francois Rabelais)-এর ‘Gargantula and Pantagruel’ উপন্যাসের স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন বা ‘Art of Novel’-এ মিলান কুন্দেরা ‘ডন কিহোতে’র স্রষ্টা সার্ভেন্তেসকে আলোচনায় আনেন। তাতে বোঝা যায় উপন্যাসের অংকুর অনেক আগে থাকতেই মুখ তুলেছিল। Individual-এর ধারনাটা বুর্জোয়া গণতন্ত্রে অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে। ইউরোপ তো রুশ উপন্যাসের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। আর ইতালো কালভিনো Hyper Novel-এর কথা বললেন। এই Hyper Novel-এর নমুনা হিসেবে তাঁর নিজেরই -‘If on a Winter Night, এ Traveler’ বা ফরাসি জর্জ পেরেক-এর ‘Life a User’s Manual’ নেওয়া যেতে পারে।

গৌতম চক্রবর্তী: আপনার উপন্যাসে ফর্ম বা বিষয় অনেকটাই বদলেছে। এই যে দীর্ঘ ছয় দশকের পরিক্রমা, যার ফলে এই বহু চর্চার মধ্য দিয়ে এই ক্রম বিবর্তন সে বিষয়ে কিছু বলুন।

রবি সেন: প্রথম উপন্যাস লেখার সময় সম্ভবত ‘পথের পাঁচালি’ মাথায় ছিল। অনেক পরে আমার গদ্যে এরকম একটা পংক্তি লিখি – ফিলেম ছাপা ‘পথের পাঁচালি’র চেয়ে বইয়ে ছাপা ‘পথের পাঁচালি’ আমার বেশি প্রিয়।দেশ-বিদেশের উপন্যাস পড়ে একটা ধারণা গড়ে উঠছিল। তবে ফর্ম নিয়ে আমি খুব বেশি ভাবি নি। আসলে ছোট বা বড় গদ্যের দাবি মেনে বিষয়টা নিয়ে আমি মনে মনে অনেক দিন ধরে ভাবি। একটা রসায়ন তৈরি হয়। সেটাই কৃৎ কৌশলকে নিয়ন্ত্রণ করে। Idiosyncracy of Style যদি কিছু থাকে তবে সেটাই। জেল থেকে বেরিয়ে এসে বেশ কয়েক বছর পরে ‘শিশুরা এখন কোথায়’ লিখেছি। একটা চিত্রনাট্য লেখার সময়কালে ‘তরণ’ উপন্যাস মুখ বাড়িয়েছিল। ‘তরণ’ উপন্যাসে সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঢোড়াই চরিত মানস’-এর একটা সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন আছে। অর্থাৎ উপন্যাসের মধ্যে উপন্যাসের মূল্যায়ন। এটা আখ্যানের হাত ধরেই এসেছিল। জীবনানন্দ দাশের ‘সিন্ধুসারস’ পড়তে পড়তে (অনেক সময়ই ঐ কবিতার সামনে বসতাম) ‘কলরব’ লিখি। জাঁ ককতোকে লেখা আপলিনের চিঠির একটা পংক্তি ‘পাখিটি আঙুল দিয়ে গান করে’ আমাকে তুমুল নাড়া দেয়। ঐ শিরোনামে একটি নভেলার উন্মেষ ঘটে। ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা হস্তান্তরের দ্বান্দ্বিক বাতাবরণে লিখি ‘রেড লাইট এরিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর’।

সব লেখাই হয়তো বা নিজেকে লেখা(তবে আত্মরতি নয়।)। শেষবেলায় একটা আত্মজৈবনিক বড় গদ্যে মন স্থির করতে চাইছি।

গৌতম চক্রবর্তী:  বাজারে একটা কথা চালু আছে যে লেখার মধ্য দিয়ে একজন লেখকের ক্যাথারসিস হয়। আপনার মত কি তাই?

রবি সেন: সমর্থনের প্রশ্রয়ে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ক্যাথারসিসের বাংলা করেছেন পরমা নিষ্কৃতি। আমি মনে করি এটি একটা অপচিন্তা বা প্রতীতি-গ্রীক দার্শনিক আরিস্তু’র নান্দনিক ভাবনা থেকে যা উৎসারিত। কয়েক শতাব্দী ধরে ইউরোপের সাহিত্য-শিল্পকে প্রভাবিত করেছে। রুশ সাহিত্য অনেকটাই এর প্রভাব এড়িয়ে গেছে। রবি ঠাকুর তার এক সুন্দর সম্ভাবনাপূর্ণ নাটক ‘ডাকঘর’-এ অমলকে চিরনিদ্রায় পাঠালেন। এটি একটি অন্তর্ঘাত যা উপনিষদীয় ভাবনাচিন্তা ও ক্যাথারসিসের যোগফল। আমি আমার একটা ছোটগল্পে ‘কবির বুক ও মাথা’-য় প্রশ্ন রেখেছিলাম সুধা যখন ফুল নিয়ে অমলের খোঁজে আসবে তখন সুধাকে আমরা কী বলবো। ব্রেশট এই ক্যাথারসিসের বিপরীতে epic theater বা dialectical theater-এর তত্ব খাড়া করেছিলেন। Alienation effect-এর কথা বলেছিলেন।     

গৌতম চক্রবর্তী:  এখন আপনি কি লিখছেন?

রবি সেন: আটটি দশক অতিক্রম করেছি। সব লেখাই হয়তো নিজেকে লেখা। তবে আত্মরতি নয় । কাশ্মীর প্রসঙ্গ আমাকে ব্যাথিত ও ক্ষুব্ধ করে । তাই কাশ্মীর নিয়ে একটা লেখা লিখছি। একটা ছোটগল্পই।

গৌতম চক্রবর্তী: ছয় দশক ধরে সাহিত্যচর্চার পর আপনার উপলব্ধি কি? ভবিষ্যৎ লেখকদের জন্য কি বার্তা দিতে চান?

রবি সেন: এতক্ষণ ধরে তো আমার একটা অনুভব-উপলব্ধির কথাই বললাম।

আমাদের চোখের সামনে পৃথিবী এক বিশ্রী চেহারা নিচ্ছে। তাই চিন্তা করতে সাহসী হও- লিখতে সাহসী হও। তুমি social being। সমাজের প্রতি তোমার দায়বদ্ধতা আছে, থাকবে। তোমার লেখার অভিমুখও তাই হবে। ক্যাথারসিসের লেখকদের মতো যেন মনে না হয় লেখা অ-সামাজিক।  

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২