মহিলা ক্রিকেটে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারতীয় ক্ষুদেরা – সপ্তক সান্যাল
সৌম্যা তিওয়ারির মারা আড়া পাঞ্চ যখন কভারে দুই পায়ের মাঝখান দিয়ে গলালেন ইংরেজ ফিল্ডার, তখনই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ভারতীয় ক্রিকেটাররা বাউন্ডারি অতিক্রম করে উচ্ছাসে চলে এলেন মাঠের ভেতর। বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাসে তখন রীতিমতো ফেটে পড়ছে পোচেস্ট্রুম থেকে সারা ভারত।
শেফালী-শ্বেতা-হৃষিতা-তিতাস-রিচা-পার্শভিদের সাফল্য যেন আনন্দের জোয়ার এনে দিয়েছে ভারতীয়দের মধ্যে।
টুর্নামেন্টের শুরুতে শুধুমাত্র শেফালী-রিচা ছাড়া বাকি প্রত্যেকেই ছিলেন একেবারে আনকোরা। তবে পারফরমেন্স বিচার করলে কিন্তু প্রতিষ্ঠিত নামেদের ছাপিয়ে ভারতের জয়ে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন অন্যরা। পারফরমেন্সের লিডারবোর্ড যদি দেখা হয় তবে দেখা যাবে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান স্কোরার শ্বেতা শেরাওয়াত(২৯৭) এবং সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি পার্শভি চোপড়া(১১)। দুজনেই নিজেদের পারফরমেন্স ১০০ শতাংশ দিয়ে ভারতকে দাবিদার করেছেন বিশ্বজয়ের।
পারফরমেন্সের বিচারে শ্বেতা সমগ্র টুর্নামেন্টেই ছিলেন উল্লেখযোগ্য। টুর্নামেন্ট একজন ওপেনার হিসেবে শুরু করলেও দলের প্রয়োজনে বিভিন্ন জায়গায় ব্যাট করেছেন শ্বেতা এবং সব জায়গাতেই থেকেছেন একইরকম সফল।
শুরুতেই দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচে ১৬৭ রান তাড়া করতে নেমে যেমন সফলভাবে ৫৭ বলে ৯২ রান করে জয়ের ভিত তৈরী করেছিলেন, তেমনই স্কটল্যান্ড ম্যাচে ছয় নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ১০ বলে ৩১ রানের ইনিংস খেলে যান তিনি। তেমনই স্পিন বোলার পার্শভি একার হাতে শ্রীলংকা ম্যাচ উপহার দেন ভারতকে। সেই ম্যাচের পার্শভির বোলিং ফিগার বলেছিল মাত্র ৫ রান দিয়ে ৪টি উইকেট নিয়েছেন তিনি।
টুর্নামেন্টে একমাত্র অস্ট্রেলিয়া ছাড়া বাকি সমস্ত দলকে পর্যুদস্ত করে ভারত। তবুও ফাইনালে যেন কোথাও একটা অদৃশ্য ভয় কাজ করছিল সমর্থকদের মনে। ভয়টা চোকিং এর, বিভিন্ন বড়ো ম্যাচের বিভিন্ন সময়ে যার গ্রাসে ভারতীয় ক্রিকেট হাতছাড়া করে এসেছে ট্রফি। কিন্তু গত রবিবার ফাইনালে যেন সেই চিরাচরিত চোকিংকে দূরে সরিয়ে সমস্ত বিভাগেই প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডকে পরাজয়ের শিকলে বেঁধে ফেলল ভারত। শুরুতেই তিতাস সাধুর আটোসাটো বোলিং ইংল্যান্ডকে বাধ্য করলো শট নিতে গিয়ে উইকেট দিয়ে আসতে এবং সঙ্গে অঞ্জনা দেবী হাজির ছিলেন নিজের দুরন্ত বোলিং ও ফিল্ডিং দক্ষতা নিয়ে। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ও প্লেয়ার অফ দ্য সিরিজ গ্রেস স্ক্রিভেন্সকে আউট করার পর পার্শভি চোপড়ার বলে রায়না ম্যাকডোনাল্ড-গের যে ক্যাচটা কভারে একপ্রস্থ ঝাঁপিয়ে ধরলেন অঞ্জনা, তাতেই যেন ইংল্যান্ডের পরাজয়ের ভাগ্য লেখা হয়ে গিয়েছিল অনেকটাই।
এরপর তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে ইংল্যান্ড দল ১৭.১ ওভারে ৬৮ রানে সবকটি উইকেট হারিয়ে ফেলে।
জবাবে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা বেশ আক্রমণাত্মক করেন শেফালী ভার্মা। তিনি শুরুতে প্রায় ১৪০ স্ট্রাইক রেটে ১৫ রান করেন। অন্য ওপেনার শ্বেতা ব্যর্থ হলেও ভারতের সমস্যা হয়নি সৌম্য তিওয়ারি এবং গোঙ্গাদি তৃষা স্থিতধী ইনিংস খেলায়। তিওয়ারি ৩৭ বলে ২৪ রান করে থাকেন অপরাজিত এবং তৃষা ২৯ বলে ২৪ রান করে নিজেদের দলকে বিশ্বজয়ের দিকে এগিয়ে দেন। এরপর হৃষিতা বসু ব্যাট করতে নামলেও একটু বল খেলে কোনো রান করেননি তিনি। এরপর চতুর্দশ ওভারের শেষ বলটি তিওয়ারি কভার দিয়ে মারার সঙ্গে সঙ্গেই মাঠে ঢুকে উচ্ছাস শুরু করেন ভারতীয়রা। সেই সঙ্গেই শেফালী হয়ে যান প্রথম মহিলা বিশ্বজয়ী ভারত অধিনায়ক।
এই টুর্নামেন্ট থেকে দীর্ঘদিনের বেশ কিছু সম্পদ পেল ভারত। শ্বেতা শেরাওয়াতকে আগামীদিনে ভারতীয় টপ অর্ডারে স্মৃতি-শেফালীর পর তিন নম্বরে দেখা যেতেই পারে। যেহেতু জেমাইমা রডরিগেজ সেইভাবে ধারাবাহিক নন, সেইদিক থেকে দেখলে তিন নম্বরে শ্বেতার অবস্থান অনেকটাই সুবিধা করে দিতে পারে পরে নামা হরমনপ্রীত-রিচার জন্য। এছাড়া তিতাস সাধুকে তো লম্বা রেসের ঘোড়া হিসেবে দেখছেন অনেকেই। তিতাস যেমন জোরে বল করতে পারেন, তেমনই ব্যাট হাতেও বড়ো শট নিতে পারেন তিনি। সুতরাং তিতাস সাধুর দলের থাকা ব্যাটিং গভীরতা বাড়াবে বলেই আশা করা যায়। এছাড়া রেণুকা সিং ঠাকুরের সঙ্গে তার বোলিং জুড়িও বেশ জমবে বলেই ধরে নিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
এরই মধ্যে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো বিসিসিআই কর্তৃক মহিলাদের আই পি এলের ঘোষণা। ঠিক এইভাবেই ১৬ বছর আগে পুরুষদের প্রথম কুড়ি ওভারের বিশ্বকাপ চলাকালীন বোর্ড আই পি এলের ঘোষণা করে ও ভারত বিশ্বজয়ী হয়। ১৬ বছর পরে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলো।
বিশ্বজয়ী ভারত; সেই দলে বাঙালি, শেষ শীতের মরশুমে ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে আনন্দের আর কি হতে পারে?