ভোজ কয় যাহারে (চতুর্থ পর্ব) : বেঁধে বেঁধে থাকি – সত্যম ভট্টাচার্য

ভোজ কয় যাহারে (চতুর্থ পর্ব) : বেঁধে বেঁধে থাকি – সত্যম ভট্টাচার্য

সত্যম ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

বাবা শিক্ষকতা করতেন আমরা যে মফস্বলে থাকতাম তার থেকে আনুমানিক পনেরো কিলোমিটার মতো দূরত্বের একটি গ্রামের স্কুলে। বড়ো রাস্তায় বাস থেকে নেমে তারপর সাইকেল চালিয়ে বাবারা সবাই সেখানে পৌঁছতেন। এ সমস্ত সেই সব দিনের কথা যখন লোকে হা বলতে হাওড়া বুঝলেও বা বলতে বাইক বুঝত না। তাই জীবনটা ছিল অন্যরকম।

দুর্গাপুজো-বিজয়া বা ওই জাতীয় যে কোনো উৎসব অনুষ্ঠানের পর আমরা সেই গ্রামে যেতাম। সকালের পর ধরা যাক, বারোটা নাগাদ সেখানে উপস্থিত হয়ে এ-বাড়ি, সে-বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে আর এটা-সেটা খাওয়াদাওয়া করতে করতে একসময় এমন অবস্থা হত মনে হত যেন আর হাঁটতে পারছি না। মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ ছিল। পরিবার পরিবারে মিল ছিল। আড়ম্বরের থেকে আন্তরিকতা অনেক বেশি ছিল সেইসব দিনগুলোতে। এখনকার মতো এতটা একা হয়ে যাইনি আমরা তখন।

যাই হোক, এরকমই একবার বাবার এক সহশিক্ষক তথা বন্ধুর বাড়িতে সন্ধেবেলায় খেয়েছিলাম বাঁধাকপির ঘণ্ট আর রুটি। খুব সাধারণ খাওয়া। কিন্তু কী যে জাদু ছিল তার মধ্যে যে তিরিশ বছর পর আজও বাঁধাকপি খেতে বসলেই সেই সন্ধ্যায় খাওয়া রুটি আর বাঁধাকপির কথা মনে পড়ে যায়। ঈষৎ মোটা কিন্তু তুলোর মতো নরম রুটি আর তার সাথে মুক্তোর মতো দানা ছড়ানো মটরশুঁটি দিয়ে বাঁধাকপি।

সব মানলাম যে সেই বাঁধাকপি ছিল সদ্য ক্ষেত থেকে তুলে আনা গোবরসারের, সব, কিন্তু কী সেই এক্স ফ্যাক্টর যা ত্রিশ বছর পর আজও সেই বাঁধাকপির স্মৃতিকে মাথায় অমন উজ্জ্বল করে রেখেছে! ভাবলে অবাক হতে তো হয় বটেই।

আসলে রান্নার সাথে মনে হয় মিশে ছিল এমন এক ভালোবাসা বা আন্তরিকতা যা রান্নাটিকে অমন এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। জীবন মনে হয় তখন বেঁধে বেঁধে থাকারই অন্য আরেক নাম ছিল।

সরস্বতী পুজোর আগের রাতে পাড়ায় আমরা যারা পুজো করতাম তারা রাত জাগতাম। সে রাতে হত পিকনিক আর এইসব পিকনিকেই আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মিলীত হত। তো সেইসব পিকনিকে আশপাশের বাড়ির কাকিমা-জেঠিমারাই রান্না করে দিতেন আমাদের। তখন নিতান্তই ছোটো আমরা। তাই কীই-বা আর পিকনিকের খাবার যোগাড় হবে। বেশিরভাগই হত বাঁধাকপির তরকারি আর ডিমের ঝোল। বাড়ি থেকে এককাপ করে চাল আর একটা করে ডিম নিয়ে যাবারও সিস্টেম ছিল এই সব পিকনিকে। আর খরচ বাঁচানোর জন্য আমাদের একজনের দায়িত্বই পড়ত বাঁধাকপি চুরি করবার। আশপাশের কারুর জমি থেকে একখানা বাঁধাকপি তুলতে পারলেই কম্ম সারা।

আবার এরকমও হয়েছে যে কাকিমা রেঁধে দিচ্ছেন তাদের বাড়ির জমি থেকেই হয়তো সেবারের বাঁধাকপিটি চুরি করা হয়েছে। এদিকে তিনি রাঁধছেন আর বলছেন, বাহ্… খুব ভালো বাঁধাকপি এনেছিস রে অথবা এটা ভালো নয়, এইসব। আর পরদিন সকালে যখন দেখছেন জমিতে বাঁধাকপি কম আর বুঝতে পারছেন রাতের অন্ধকারে আমরাই এই কাণ্ড ঘটিয়েছি আর তিনি কী পরিমাণ বোকাই না হয়েছেন, তখন বাপবাপান্ত করে আমাদের সরস্বতী পুজো মাথায় তুলে দিচ্ছেন। আবার দুপুর না হতেই সব ভুলে হয়তো ডেকে বলছেন খিচুড়ি খেয়ে যাস। ওই যে বললাম জীবন তখন এরকম বেঁধে বেঁধে থাকারই আরেক নাম ছিল।

এত কথা বলে আসল কথাটাই বলা হত না। সেই বাঁধাকপি কড়াইতে দেবার পর যা জল ছাড়ত তাতে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকত না। কিন্তু সকলেরই তো বাড়ির কাজকর্ম আছে। তাই অনেকবারই এরকম হয়েছে যে শুধু সেদ্ধ হয়েছে সবুজ সবুজ বাঁধাকপিই খেতে হয়েছে। কিন্তু শৈশবের সে গরম ভাতে তার যা স্বাদ, আহা!

এত কিছু পালটে গেলেও গ্রামের দিকের স্কুলে সরস্বতী পুজোর যে খাবার খাওয়ানো হয় তা কিন্তু আজও সেই খিচুড়ি আর বাঁধাকপি, সাথে কম দামে পেলে কখনও চাটনি। তবে খিচুড়ির সাথে বাঁধাকপির একটা অবিচ্ছেদ্য বন্ধন আছে। তা ঘণ্ট সহযোগেই হোক অথবা পাঁচমিশালি ঘ্যাঁট তরকারি। আর উভয়তেই বাঁধাকপির ব্যবহার তাকে খোলতাই করে তোলে বই-কি!

সিজনের শেষ দিকে যখন আর সাধারণভাবে বাঁধাকপির ঘণ্ট খেতে ইচ্ছে করত না,তখন মা বাঁধাকপিকেই একটু অন্যভাবে রাঁধতেন। ঘণ্ট রাঁধার সময় যেরকম ঝিরিঝিরি করে কাটা হয় তা না কেটে পাতাগুলো অল্প বড়ো বড়ো থাকবে। ভাপিয়ে জল ফেলে দিয়ে তাতে আতপচাল আর আলু দিয়ে ডালনা। কী যে স্বাদ! যারা খাননি, আতপচাল- ঘি-গরমমশলা সহযোগে এই পদটি ট্রাই করতে পারেন। অথবা কালো জিরে, কাঁচালঙ্কা, আলু সহযোগে বাঁধাকপি ভাজা। ডালের সাথে চমৎকার। আর বাঁধাকপির পকোড়া! শীতের সন্ধ্যায় চা আর মুড়ি সহযোগে আড্ডা জমাতে তার জুড়ি মেলা ভার।

তাই যেভাবে বাঁধাকপির একটি পাতা আরেকটির সাথে গায়ে গায়ে লেগে তাকে সুন্দর করে তোলে, সেরকমই গায়ে গায়ে লেগে বেঁধে বেঁধে থেকে বাঁচারই আরেক নাম ছিল জীবন আর তারই অপরিহার্য অঙ্গ ছিল বাঁধাকপি।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২