কুমায়ুন ভ্রমণ ও তার নানা কিস্‌সা – শিবু মণ্ডল (পর্ব ১০ : শেষ পর্ব)

কুমায়ুন ভ্রমণ ও তার নানা কিস্‌সা – শিবু মণ্ডল (পর্ব ১০ : শেষ পর্ব)

শিবু মণ্ডল

শেয়ার করুন

দশম পর্ব

সব শেষ-এরও এক নতুন শুরু থাকে

এই যে এখন এক ছুটির সকালে যখন আমি হরিদ্বারের সরকারি আবাসনে বসে লেখাটা লিখছি ঠিক সেই সময়ে মৌসুমি মাসিমা নিশ্চয়ই গানের রেওয়াজ সেরে এককাপ চা নিয়ে বসেছে ব্যালকনিতে। কাজের মেয়েটি হয়তো চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। হাঁক দিতে দিতে চেনা মাছ বিক্রেতার সাইকেলটি এসে দাঁড়াল নীচের রাস্তায়। ‘ভালো চিতল আছে দিদি দেবো নাকি?’ ‘না, রে গতকালকের কাটাপোনা রয়ে গেছে, একলা মানুষ কত আর খাবো রে!’ মাছওয়ালা গলিতে ক্রিকেট খেলতে থাকা বাচ্চাগুলিকে সাইড কেটে ঘণ্টি বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে গেল। ন’টা বেজে গেছে। ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে তো আর দুপুরের আগে সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না। তবে তার আলো পড়ে সদ্য হলুদ রং হওয়া সামনের ফ্ল্যাটের দেওয়াল ঝলমল করছে। তার কচি কলাপাতা রঙের ব্যালকনি দেখে হয়তো রানিখেত ও বিনসারের স্মৃতি মনে পড়ে।

সকালের পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটা এক নেশার মতো আমার কাছে। মাসিমার কাছে যেমন গানের নেশা। সেই নেশার লোভে এক সকালে সূর্য ওঠার আগে আগেই বেড়িয়ে পড়েছিলাম একলা। রেস্টহাউস থেকে রাস্তাটি উঠে ডানদিকে বেঁকে নেমে গেছে লোয়ার ম্যাল রোডে! রানিখেতের এই অঞ্চলটি ঘিরে আছে অনেক অবসরপ্রাপ্ত সেনা ও ধনীদের বাংলো। তারই মাঝে কোনও কোনও টিলার উপরে দু’চারটে ঘর নিয়ে স্থানীয় লোকালয়। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই একটি করে ঝাঁকড়া চুলের কুকুর বাঁধা আছে। দোতলা ঘরগুলির নীচে গোয়ালঘর, তার মধ্যেই ঢাঁই করে রাখা সারা বছরের জ্বালানি কাঠ। ম্যালরোড দিয়ে মাঝে মধ্যে হেঁটে যাচ্ছে রাশভারী চেহারার কিছু প্রৌঢ়! হাতে তাদের সবার একটি করে ছড়ি। ট্র্যাকস্যুট ও ক্যানভাসের জুতো পড়া দুটি যুবক রান প্র্যাকটিস করছে। সেনাবাহিনীতে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত নিচ্ছে নিশ্চয়ই। ফেরার পথে দেখি মৌসুমি মাসিমা রেস্টহাউসের কাছেই বাঁদিকে একটি টিলায় পাইনের বনে পাথরের চাতালে বসে আছে। ততক্ষণে পুব আকাশে রেস্টহাউসের লাল টিনের ছাদের ওপার থেকে উঁকি দিয়েছে ততোধিক লালরঙের সূর্য। পাইনের ঝিরিঝিরি পিচ্ছিল পাতা থেকে হালকা কুয়াশা কেটে গিয়ে নরম আলোর ছোঁয়া লেগেছে।

প্রতিটি মানুষের একান্ত নিজস্ব কিছু কথা থাকে, অন্যকে বলার মতো কিছু গল্প থাকে। শহরের কংক্রিটের দেওয়াল একটি মানুষের জীবনযাপনের সারাক্ষণের সাক্ষী থেকেও সেই মানুষটির দুঃখ-কষ্ট-অভিমানগুলো চাপা দিয়ে রাখে। অথচ পাহাড় তার নিবিড় সবুজের একটু স্পর্শ দিয়েই সেই মানুষটির মনের গোপন কুঠুরি উন্মুক্ত করে দেয়। দুদিনের সাক্ষী থেকেও মানুষের জীবনের সেই অন্য কোথাও না-বলা গল্পগুলি হিমালয় তার মনোরম উপত্যকায় পাইনের বনের মতো, পাখির বাসার মতো, একটি ঝরনার গতির মতো, সুন্দর করে সাজিয়ে রেখে দেয়। সেদিন মাসিমার জীবনেরও কত কথা, কত গল্প শুনলাম। সেই কোন্ ষোল বছর বয়সেই বিয়ে। তারপর শুরু সংসারজীবন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সে বুঝতে পারে বয়সে অনেকটাই বড়ো স্বামী সংসার করার চাইতে সমাজ পরিবর্তনে বেশি আগ্রহী, সমাজবিপ্লবের পথেই তাঁর অটুট বিশ্বাস! নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে গিয়ে মাঝে মধ্যেই গা-ঢাকা দিয়ে থাকে সে। যতটুকু একসাথে থাকা হয়, কথা হয় তাতে দুজনেই বুঝতে পারে দুমেরুর বাসিন্দা তারা। একজনের মাথায় কীভাবে সংসার সুখের হবে, অন্যজনের চেতনায় তখন শ্রেণী-সংগ্রামের মাধ্যমে এক বিকল্প সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলবার স্বপ্ন! পুঁজিবাদের পচন ধরা একটা সমাজব্যবস্থা থেকে শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণীকে মুক্ত করে তাদের হাতে রাজত্বের অধিকার তুলে দেওয়া যাদের বৈপ্লবিক নেশা তাদের আর কে কবে ধরে রাখতে পেরেছে! নকশালবাড়ি আন্দোলনই তখন তাদের পথ! চারু মজুমদার তাদের নেতা! স্বামীর পরামর্শ মতোই মাসিমা তখন উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে! কলেজ পাশ করার পর চাকরিটিও হয়ে যায়। ততদিনে তিনটি সন্তানের জননী। চাকরি-বাকরি সামলে তিনটি সন্তানকে লালন-পালন করা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল তার কাছে। শ্বশুরবাড়ি আর বাপের বাড়ি থেকে সবরকম সহায়তা পেলেও দায়িত্বটা মূলত তার একার কাঁধেই ছিল। ততদিনে স্বামী পুরুলিয়ার জঙ্গলে কোনও এক অজানা আস্তানায় স্থায়ী ডেরা বেঁধেছে; সেখানেই স্থানীয় আদিবাসী সমাজ নিয়েই এক অন্য জগৎ তাঁর! সেখানকার মানুষের চিকিৎসা ও তাদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোই তাদের ব্রত–শুধু এটুকু তথ্যই জানে তার সবচেয়ে কাছের মানুষটি সম্পর্কে সে আর কিছুই জানতে পারে না। ততদিনে নেতাদের চরমপন্থী সিদ্ধান্ত, খুনখারাপি ও অরাজকতার আন্দোলন এবং তার বিপরীতে রাষ্ট্রীয় দমন ও সন্ত্রাস একটা জন-আন্দোলনকে শেষ করে দিয়েছে। নকশাল আন্দোলনের রোমান্টিকতা যুব সমাজের চোখ থেকে খুলে পড়ে গেছে ততদিনে। আন্দোলনের সাথে জড়িত অনেকেই রাজনীতির মূল স্রোতে ফিরে এসেছে। কেউ কেউ নিজের মতো কেরিয়ার গড়ে নিয়েছে। কেউ কেউ সেই শ্রেণী-সংগ্রামের আদর্শ মেনে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সেইসব শোষিত-পীড়িত মানুষদের পাশে থেকে নিঃস্বার্থভাবে আড়ালে-আবডালে কাজ করে গেছে, এখনো কেউ কেউ করে যাচ্ছে—শ্রেণী-সংগ্রাম তো আর শেষ হয়ে যায় না! যে নকশালবাড়ি আন্দোলন শ্রেণী-সংগ্রামকে এক অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল সেই ইতিহাস তো লাল অক্ষরে লিখিত হয়ে আছে, কিন্তু এর বাইরে আগে-পরে যে মানুষগুলি আড়ালে থেকে নিঃস্বার্থভাবে সমাজ বদলের বীজ বপন করে যাচ্ছে তাদের কথা অথবা মৌসুমি মাসিমার মতো একলা নারীদের জীবনসংগ্রামের কথা কোথাও লিখিত হবে না।

—জানো তো ওঁ কিন্তু আমাকে পড়াশুনো করে স্বনির্ভর হতে সবসময় উৎসাহ দিত। ওঁর ইচ্ছতেই তখন আমি স্কুটার চালানোও শিখি! ওঁ ওঁর আদর্শের জায়গায় ঠিক ছিল, কিন্তু আমার কথা হল তবে বিয়ে কেন করলে? আর বিয়ে যখন করলই তখন ওঁর কি কর্তব্য ছিল না সংসারের দায়িত্ব সমানভাবে পালন করা, বলো?

মাসিমার মধ্যে এক জিজ্ঞাসা, এ জিজ্ঞাসা হতাশা থেকে নাকি রাগ থেকে বেরিয়ে আসছে এটা বাইরে থেকে আমরা কেউই কখনও বুঝতে পারব না। তবে একজন নারীর সম্পূর্ণ একা জীবন সংগ্রামে লড়াই করে সমাজে টিকে থাকা ও প্রতিষ্ঠা পাবার পরেও কোথাও যেন এক অসম্পূর্ণতা তার হৃদয়কে পীড়া দেয়। নকশাল করা মেসোমশাই নিজের অপারগতার কথা স্বীকার করে নিয়ে মাসিমাকে পুনরায় বিবাহ করে নেবার জন্য বলেছিল। বলেছিল মনমতো জীবনসঙ্গী বেছে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করবার জন্য। কিন্তু মাসিমা তা করেননি সমাজের কথা ভেবে, সন্তানদের কথা ভেবে! আমরা কালকের কথা ভেবে জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপ ফেলি, কিন্তু কাল কি আমাদের কথা ভাবে? নয়তো কেন সেই কাল এসেই একমাত্র পুত্র সন্তানটিকে গ্রাস করে নেবে। সদ্য পড়াশুনা শেষ করে চাকরিতে জয়েন করতে যাওয়া পুত্রটি এক পথ দুর্ঘটনায় মারা গেল যেদিন, সেদিন মাসিমার মনের কী অবস্থা হয়েছিল সেটা আমি কখনোই জানতে পারব না! শুধু এটুকু অনুভব করতে পারছি একটি কাঁধের নিশ্চিত আশ্রয়ের অভাব সে নিশ্চয়ই বোধ করেছিল। সেই কঠিন নিঃশ্বাসের স্মৃতিভার কিছুটা কি সেদিন সে সেই হিমালয়ের কাঁধে ফেলে এসেছিল!

বাস কখন কীভাবে ভরে ভরে আসছে আর বেরিয়ে যাচ্ছে তা আমাদের বোধগম্য হচ্ছিল না। সবাই যখন তাকিয়ে আছে দলের তিন পুরুষ সদস্যের সিদ্ধান্তের দিকে, তখন আমরাও হতবুদ্ধি হয়ে বাস স্ট্যান্ডের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছোটাছুটি করেও বাসে সিট পাচ্ছি না। এমন সময় একটি ফড়ে লোক এসে ট্যাক্সির কথা বলল। স্বরূপদা রাজিও হয়ে গেল। রোগা প্যাটকা লোকটি সোজাভাবে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারলেও গন্ধ দিয়ে তার জাত বিচার করা যাচ্ছিল। হলদোয়ানি থেকে হরিদ্বারের প্রায় পাঁচ-ছয় ঘণ্টার পথ। এই রাতে এতটা পথ ট্যাক্সিতে সফর করা সেফ্‌ হবে কি? আমার মনে প্রশ্ন জাগে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি রাতের দিকে এদিকের ট্যাক্সি ড্রাইভারদের বেশিরভাগই ড্রিঙ্ক করে গাড়ি চালায়। সেই কথা ভেবে সেই রাতে জার্নি না করে হোটেলে থেকে যাওয়াই স্থির হল।

পরদিন সকালে যখন সবাই হরিদ্বারের প্রথম বাসে উঠে বসলাম আকাশে তখন একটু একটু করে মেঘ জমতে শুরু করেছে। সূর্য তখনও ওঠেনি অথচ তার একফালি লাল আভা মেঘের শরীরে প্রতিফলিত হয়ে এক অপার্থিব ভোরের দৃশ্যপট রচনা করেছে। গাড়ি ছেড়ে দিতেই রাতের ভ্যাপসা গরমের স্মৃতি শরীর থেকে ঝরে পড়ল। জুনের সাতাশ তারিখ হয়ে গেছে আজ। সাগর থেকে বয়ে আনা জল বাতাস আর ধরে রাখতে পারছে না। আবহাওয়া দপ্তরও বর্ষার আগমনি ঘোষণা করে দিয়েছে। বাসস্ট্যান্ডের গেটের বাইরে বাঁদিকে একটি মোবাইল কোম্পানির টাওয়ারে তখন একটি ঈগল পাখি বসে। বেশ উঁচুতে হলেও টাওয়ারের প্ল্যাটফর্মে ঈগলের বাসাটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হয়তো অতীতে সেখানে কোনও গাছ ছিল, সেই গাছেই ঈগল পাখিটির বাসা ছিল। নাগরিক স্বার্থে গাছটি কাটা পড়েছে, ভেঙেছিল পাখিটির বাসাও। তবে পাখিটি তার জায়গা ছেড়ে যেতে চায়নি বলে টাওয়ার হবার পর সেখানেই নতুন করে বাসা বেঁধেছে! তার ঋজু ঘাড়টি নেড়ে নেড়ে আমাদেরকে সে বিদায় জানাচ্ছে নাকি বিদ্রুপ করছে ঠিক বোঝা গেল না!

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২