বর্ষশেষের কলকাতা : কলকাতার ক্রিকেট (পর্ব ৪) – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

বর্ষশেষের কলকাতা : কলকাতার ক্রিকেট (পর্ব ৪) – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

চতুর্থ পর্ব

১৯০০ সাল। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্যের আধুনিক সময়ের সূত্রপাতের শ্রেষ্ঠ শতকের সমাপ্তিতে আগমন ঘটছে বিংশ শতাব্দীর। স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশদের কাছে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বাঙালির ক্ষেত্রে বিষয়টির বর্ণনা পাওয়া যায় বিমল মিত্র-র ‘সাহেব-বিবি-গোলাম’ উপন্যাসে।

তখন লর্ড কার্জনের সময়। বাংলা ভাগের ঘটনা তখনও ঘটেনি, কিন্তু ভিতরে ভিতরে চেষ্টা ভালো মতোই চলছে। কয়েক বছরের মধ্যেই তার জের দেখা যাবে।

তবে এখানে উল্লেখ করা যাক, ক্রিকেট তখন কলকাতায় বেশ জনপ্রিয়। বেশ কিছু বাঙালি ক্লাব আসতে আসতে জমিয়ে বসছে। এমন সময় নতুন শতাব্দীর প্রথমেই কলকাতায় CCC বনাম MCC (Madras Cricket Club) এর মধ্যে ম্যাচের আয়োজন করা হয়, ৫ বলের এই ম্যাচে ইডেনে মাদ্রাজের দল অসাধারণ নৈপুণ্যের নিদর্শন রেখেছিল তা আমরা ম্যাচের বর্ণনা থেকেই বুঝতে পারি।

প্রাচীন ইতিহাসের গবেষক, সাফোকের এডওয়ার্ড ডিউইং যিনি নিজেও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতেন, তাঁর পুত্র রবার্ট যিনি ৭ বছর পরে ইউরোপীয় দলের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেন, তিনি ছিলেন মাদ্রাজের ওপেনার।

মাদ্রাজের পূর্ত দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার স্টুয়ার্ট ডুরান্ড পিয়ার্স এই দলে ছিলেন। এর ভাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রয়্যাল নেভির অফিসার ছিলেন, পিতা আর্নল্ড ক্রিশ্চিয়ান মাদ্রাজ আর্মির অফিসার ছিলেন।

শিক্ষাবিদ ও যাজক তথা ক্রিকেটার চার্লস কিং-এর পুত্র আইনজীবী MCC (মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব) এর হয়ে প্রথম শ্রেণি ও ডারহ্যামের হয়ে মাইনর কাউন্টি খেলা হেনরি কিং ছিলেন মাদ্রাজ দলে।

এমনকি অনেক পরে, সেই ১৯২৫ পঞ্চম জর্জের সার্জেন্ট হিসেবে কাজ করা মিলিটারি ডাক্তার আর্চিবল্ড নিকোলাস ফ্লেমিং মাদ্রাজ দলে ছিলেন।

মাদ্রাজের বাকিদের ও CCC দলের কোনও খেলোয়াড় সম্পর্কে তেমন কোনও তথ্য পাওয়া যায় না।

মাদ্রাজের প্রথম ইনিংসে দেখা যাচ্ছে তাঁরা ৩২২ রান করে। ব্রিউইস ৭১, স্টিভেনসন ৮৩ ও স্টুয়ার্ট পিয়ার্স ৫৯ করেন। CCC এর পক্ষে উইগ্রাম ৩ উইকেট নেন। হার্স্ট, উড ও মোরান ২টি করে উইকেট নেন।

CCC এর পক্ষে মোরান ১১৮ করলেও পেইন ৩৯ ছাড়া কেউ দাঁড়াতে না পারায় ২৩১ রান ওঠে। সাইমন্ডস ৫টি, ফ্লেমিং ৩ টি ও ম্যানসন ২টি উইকেট নেন।

এরপর মাদ্রাজ ২২৮/৬ তুলে দ্বিতীয় ইনিংসে ডিক্লেয়ার্ড দেয়। এডিংটন ৪৬ ও পিয়ার্স অপরাজিত ৬২ করেন। মোরান আবার ৪ উইকেট নেন।

৩২০ তাড়া করে CCC তোলে মাত্র ১৬১। হার্স্ট ৪৩ ও উইগ্রাম ৩৬ করেন। সাইমন্ডস ৪টি ও ফ্লেমিং ৩ টি নেন।

এর ঠিক দুই বছর পরে ১৯০২-০৩ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি অথেন্টিক নামে একটি দল এসে পৌঁছায় ভারতে। নামেই অক্সফোর্ড; দলে কেমব্রিজের খেলোয়াড়রাও ছিলেন।

এই সফরকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছিল একটি ক্রিকেটীয় ট্রাভেলগ ‘TEN THOUSAND MILES THROUGH THE INDIA AND BURMA’। লিখেছিলেন, অক্সফোর্ডের ছাত্র সিসিল হেল্ড্যাম। বইটির সাব টাইটেল ছিল ‘An account of the Oxford University authentic Cricket tour with Mr. K.J.Key in The year of The Coronation Durbar’।

লন্ডনের JM Dent and CO থেকে ১৯০৩ সালে প্রকাশিত ও Ballantyne Hanson and CO এর Ballantyne Press থেকে মুদ্রিত বইটির উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল, To Everard Britten Holmes, founder, manager, freind of The Oxford University Authentics।

সিসিল হেল্ড্যাম এই সফরের বিবরণ সেই সময়ে The Sportsman, The Daily Express, The Tatler, The Pioneer, Times of India এবং The Indian Sporting Times এ লিখতেন। তারই ভিত্তিতে এই বইটি সংকলিত বা গ্রন্থিত হয়।

কলকাতা সম্পর্কে যা লিখেছিলেন তা রীতিমতো বিস্ময়ের উদ্রেক করে “প্রাসাদের নগর, জনাকীর্ণ ও দুর্গন্ধময় নগর, ব্রিটিশ শাসনের সদর দপ্তর, যার পৌরসভা চলে বাবুদের অপশাসনে, ভারতের সর্বাধিক বাণিজ্য-সমৃদ্ধ শহর, যেখানে মৃত্যুহার সর্বোচ্চ; সুয়েজের পূর্বে শীতের সময় সবথেকে সুখদায়ক ও আনন্দদায়ক শহর; গ্রীষ্ম ও বর্ষায় ভয়ঙ্কর রাত্রির শহর―এটাই কলকাতা”।

শুধু এইটুকুতেই থেমে থাকেননি। প্রথমেই প্রসংশা করেছেন বিদ্যুৎ চালিত ট্রামের। তারপরেই সমালোচনা করেছেন ‘ghari Walla’ অর্থাৎ গাড়ি চালকদের। অত্যন্ত হতাশার সঙ্গে জানিয়েছেন যে এই শহরে দেশের সর্বোচ্চ ‘white population’ তাছাড়াও অজস্র পর্যটক, বাণিজ্যিক ও অন্যান্য কারণে সারা বছর যাতায়াত করে কিন্তু দুর্ভাগ্য যে এখনকার গাড়ি চালকরা যে “Language of rulling class” বোঝে না শুধু তাই নয়, তাঁরা রাস্তাঘাট ও চেনে না। প্রতিটি বাড়ি, দোকান ও নিজেদের দেওয়া ডাক নামে ডাকে, একটা অদ্ভুত নিজেদের খিচুড়ি ইংরেজি বলে, নাহলে একেকটা এলাকার নামকরণ করে এমন কোনো লোকের নামে যে সেখানে ৫০ বছর আগে জীবিত ছিল, ফলে চৌরঙ্গী থেকে ক্লাইভ স্ট্রিট নিয়ে যেতে বললে হাওড়া নিয়ে চলে যায়, এমনকি ‘ক্লাইভ- ই স্ট্রিট’ বা ‘হেয়ার- ই স্ট্রিট’ বা ‘ইডেন গার্ডেন’ বললেও চেনে না, ফলে হেল্ড্যাম এর দাবী, ভারতে যদি শিক্ষার প্রসার শুরু করা হয় তাহলে গাড়ি ওয়ালাদের থেকে শুরু করা যেতে পারে।

অতঃপর বিচিত্র পেশার মানুষের কলকাতার বর্ণনা, বিভিন্ন ঘাট, হাই কোর্ট, ব্ল্যাক হোল, জি পি ও, মনুমেন্ট, প্রভৃতির বর্ণনা ও সবেতেই ক্লাইভকে খুঁজে ফেরার চেষ্টা বিদ্যমান। এক জায়গায় চার্ণক কে প্যাট্রিয়ার্ক অফ বেঙ্গল বলে দাবী করা হয়েছে।

তবে অবশ্যই বর্ণনা আছে ময়দানের রাস্তার ধারের বিচিত্র ফুল গাছের ও ক্যাসুরিনা এভিনিউ এর সৌন্দর্যের।

যাই হোক, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সঙ্গে ম্যাচে বাংলার বিখ্যাত ব্যক্তিদের আগমন ঘটে ইডেনে। তালিকায় কোচবিহারের মহারাজার নাম আছে (১০)।

বেঙ্গলের গাইস (প্রথম ইনিংসে ৪টি), হিলিং (প্রথম ইনিংসে ৪টি) ও গৌল্ড (ম্যাচে ৫টি) এর জন্য দ্বিতীয় ইনিংস ছাড়া অক্সফোর্ড সুবিধা করতে পারেনি (১০৬ ও ২৭৫/৫)। হর্নবি ৫২, চিনারি ৫৭ ও হলিন্স ৬২ করেন। বেঙ্গল কোনও মতে ড্র করে (১০৬ ও ১৩৯/৫)।

ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব অবশ্য বিশ্রী ভাবে হারে। হর্নবি ১১১, অধিনায়ক কী ৯৬, হলিন্স ৯০, চিনারি ৭৪ করেন। উইলিয়াম ম্যাচে দশ উইকেট নেন।

এর ঠিক দুই বছর পরে আরেকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ কলকাতায় খেলা হয়েছিল।

ইন্ডিয়ান ডেইলি নিউজের আর ইংলিসম্যান ওভারল্যান্ড মেলের খবর জানাচ্ছে (১/১২/১৯০৪) রঞ্জি ভারতে এসেছেন। ‘মোটরে’ ভারত ঘুরবেন। মনে করা হচ্ছে যে লর্ড হক-ও আসবেন। এলে রঞ্জি তাঁকে নিয়ে নিজের পুরোনো স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যাবেন। এই খবরটা অবশ্য ২৫শে নভেম্বরের। কারণ এগুলো সাপ্তাহিক সংখ্যায় বেরোত যা বিলেতে পাঠানো হত।

যাই হোক, এরপরে ইংলিসম্যান ওভারল্যান্ড জানাচ্ছে রঞ্জি, আর্চি ম্যাকলারেন, হলিন্স-রা কলকাতায় খেলবেন। এও জানা গেল লর্ড হক জেনারেল স্পেন্স এর দলের বিরুদ্ধে I Zingari দলের হয়ে খেলবেন। খেলা হবে কলকাতায় ইডেন গার্ডেনে (ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের মাঠ) ২৪, ২৬ ও ২৭ তারিখ।

ইংল্যান্ডে ক্রিকেটের ক্লাবগুলো একটু অন্যরকম। ওখানে কাউন্টি দলগুলো আসলে ক্লাব। কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাব। এছাড়াও কিছু অভিজাত ক্লাব ছিল। সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন আইনে তৈরি। আমাদের এখানকার ক্লাবের মতো। যেমন হার্লেকুইন্স, আই জিঙ্গারী ইত্যাদি। এরা মাঝে মধ্যে ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচও খেলত। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিরা এদের সদস্য হতেন। আই জিঙ্গারী যে কোনোদিন ভারত সফর করেছিল এটা এর আগে কেউ তেমন একটা জানত না।

জেনারেল স্পেন্স (১৮৫৩-১৯৩৪) ছিলেন মেজর জেনারেল। দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধে ছিলেন। বুওর যুদ্ধে ছিলেন। এই সফরের সময় বেরিলিতে পোস্টেড। প্রথম শ্রেণির খেলায় ১৩ ম্যাচে ১টি শতরান সহ ৫৮১ রান করেন। লব বোলিং করতেন; অনিয়মিত।

ইংল্যান্ড ও ল্যাঙ্কশায়ারের অধিনায়ক ম্যাকলারেন প্রথম ব্যক্তি হিসেবে প্রথম শ্রেণির খেলায় এক ইনিংসে ৪০০ করেন। অনেক পরে সেই ১৯২১ সালে যখন ওয়ারউইক আর্মস্ট্রং এর দল ইংল্যান্ডে গিয়ে ইংল্যান্ডকে টেস্ট সিরিজ ৩-০ ম্যাচে হারায় তখন গোটা সফরে তারা দুইবার হারের সম্মুখীন হয়। সেটা ম্যাকলারেন এর দলের বিরুদ্ধে একটা প্রথম শ্রেণির ম্যাচে।

যাই হোক, ঘটনাচক্রে দলের নাম বদলে যায় ও স্পেন্স একাদশ ইউনাইটেড প্রভিন্স নামে ম্যাচ খেলে আই জিঙ্গারীর বিরুদ্ধে। কারণ স্পেন্স নিজেই আই জিঙ্গারীর হয়ে খেলেন।

পুলান আর উইলসন ওপেন করতে নামেন। কিন্তু পুলান ১৪ আর উইলসন ১৩ করে যথাক্রমে উইগ্রাম আর ম্যাকফার্সন এর বলে আউট হন। আলেকজান্ডার ও কনওয়ে-রীস দুজনেই ৩১ করেন। শেষের দিকে ডেভনের হয়ে ৯টা মাইনর কাউন্টি ম্যাচ খেলা রাজপুত রেজিমেন্টের রবার্ট ট্যাটন আরুনডেল ৩০ করলে ইউনাইটেড প্রভিন্স ১৭৭ রান করে আউট হয়ে যায়। উইগ্রাম একাই ৬ উইকেট নেন, ম্যাকফার্সন ৩ উইকেট ও আইটচিসেন ১টা।

জবাবে আই জিঙ্গারী এক ওপেনার মার্শাল ও তিন নম্বরে নামা কিংটন কে hoar এর বলে শুরুতেই হারায়। উইগ্রাম ও একার ডগলাস ইনিংস সামলান। একার-ডগলাস ৭৯ ও উইগ্রাম ২৯ করেন। স্পেন্স ৩৩ ও কক্স ২২ করেন। hoar ৫টি, লয়েড ২টি ও পুলান আর উইলসন ১ টা করে উইকেট নেন। আই জিঙ্গারী ১৬৭ রানের বেশি তুলতে পারেনি।

দ্বিতীয় ইনিংসে ইউনাইটেড প্রভিন্স এর ব্যাটিং তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায় ফ্রেডরিক ও উইগ্রামের সামনে। আরুনডেল ৯ নম্বরে নেমে ৫৭ আর এগারো নম্বরে নেমে hoar অপরাজিত ২৮ না করলে ১০০ রানের গন্ডি টপকাতে পারতো না। জে ডি গাইসের মতো ক্রিকেটার ১৭ রানে আউট হন; এটি ইনিংসের তৃতীয় সর্বোচ্চ রান ছিল। উইগ্রাম ৪টে , ফ্রেডরিখ ৩টে ও আইটচিসেন ২টো উইকেট পান। ইউনাইটেড প্রভিন্স ১৬২/৯ তুলে ডিক্লেয়ার্ড দিয়ে দেয়।

জবাবে আই জিঙ্গারী ৬ উইকেটে ৯৪ রান তোলে। কক্স ২৩ করেন। hoar ৩ উইকেট নেন। পুলান ২টি উইকেট পান। এই ম্যাচে লর্ড হক (০ ও ১৭) ব্যর্থ হন।

বাদবাকি খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রথম মহাযুদ্ধে মৃত উইলিয়াম কিংটন ইউরোপীয় দলের হয়ে একটা ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেছিলেন।

উইগ্রাম তিনটে ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেছিলেন ইউরোপীয় দলের হয়ে।

একার ডগলাস ১৮৯৭ সালে ইটনের হয়ে, ১৯০৯ সালে বি ব্রাদার্স ও ১৯২৩-২৫ পশ্চিম কেন্টের হয়ে খেলেন।

এদিকে বাংলায় তখন বেজে উঠেছে বঙ্গভঙ্গের দামামা। এই সময় বাংলার আয়তন ছিল ১,৮৯,০০০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা ছিল ৭৮.৫ মিলিয়ন। বাংলার পূর্বাঞ্চল ভৌগোলিক এবং অপ্রতুল যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে পশ্চিমাঞ্চল হতে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল।

১৯০৩ সালে প্রথম বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবসমূহ বিবেচনা করা হয়। তখন বাংলা থেকে চট্টগ্রাম কে বিচ্ছিন্ন করা এবং ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে আসাম প্রদেশে অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্রস্তাবও ছিল। তেমনিভাবে ছোটো নাগপুরকে মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার একটি প্রস্তাব ছিল।

১৯০৪ সালের জানুয়ারিতে সরকারীভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয় এবং ফেব্রুয়ারিতে লর্ড কার্জন বঙ্গের পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে এক সরকারি সফরের মাধ্যমে এই বিভক্তির ব্যাপারে জনমত যাচাইয়ের চেষ্টা করেন।

পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্য, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহী (দার্জিলিং বাদে) বিভাগ এবং মালদা জেলা, আসাম প্রদেশের সঙ্গে একীভূত হয়ে এই নতুন প্রদেশ গঠন করবে। এর ফলে বঙ্গ শুধু তার বৃহৎ পূর্বাঞ্চলই হারাবে না, তাকে হিন্দীভাষী পাঁচটি রাজ্যও মধ্যপ্রদেশকে ছেড়ে দিতে হবে। অন্যদিকে পশ্চিমে সম্বলপুর জেলা ও মধ্যপ্রদেশের পাঁচটি ওড়িয়া জেলার সামান্য অংশ বঙ্গকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়।

ফলে বঙ্গের আয়তন দাঁড়ায় ১,৪১,৫৮০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা ৫৪ মিলিয়ন ।

নতুন প্রদেশটির নামকরণ করা হয় পূর্ববঙ্গ যার রাজধানী হবে ঢাকা এবং অনুষঙ্গী সদর দফতর হবে চট্টগ্রাম। এর আয়তন হবে ১,০৬,৫০৪ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা হবে ৩১ মিলিয়ন যাদের মধ্যে ১৮ মিলিয়ন মুসলিম ও ১২ মিলিয়ন হিন্দু। এর প্রশাসন একটি আইন পরিষদ ও দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি রাজস্ব বোর্ড নিয়ে গঠিত হবে এবং কলকাতা হাইকোর্টের অধিকার বজায় থাকবে।

এই রকম ডামাডোলের পরিস্থিতিতে ইডেনে খোদ লর্ড কার্জনের উপস্থিতিতে ৩০,৩১ ডিসেম্বর ১৯০৪ ও ২ জানুয়ারি ১৯০৫ সালে কলকাতায় বসে বার্ষিক ক্রিকেটের আসর। এবার আই জিঙ্গারী বনাম ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব।

আই জিঙ্গারী দলের অধিনায়ক ছিলেন লর্ড হক। আর ক্যালকাটা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক এল পি ই পাঘ। ইনি পরে ইউরোপীয়ান এসোসিয়েশনের সভাপতি হন। এই ম্যাচে ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলতে নামেন রঞ্জি।

ঘটনা হল ১৯৫০ এর দশকে বালিগঞ্জ ক্রিকেট ক্লাবের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আগে অবধি সম্ভবত কোনো ভারতীয় ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলেনি। সম্ভবত বলছি কারণ জনৈক ‘ফ্রামজী’ ১৮৮৬ সালে CCC এর হয়ে খেলেন। এখন ফ্রামজী যদি পার্সি হন তাহলে তিনিই প্রথম ভারতীয়। না হলে রঞ্জি অবধারিত প্রথম ভারতীয়। এছাড়া আর্চি ম্যাকলারেন ও খেলেছিলেন।

যাই হোক, প্রথম দিন আই জিঙ্গারী প্রথম ব্যাট করতে নামল। ওপেনার একার ডগলাস ও কিংটন। ৭ রান করে কিংটন হিকলের বলে রঞ্জির হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট। নামলেন আর্চি ম্যাকলারেন।

বেশ কিছু সময় বাদে রঞ্জি আবার ক্যাচ ধরলেন। এবার একার ডগলাস। ৩০ করে উইলসন এর বলে আউট। এলেন মেজর কক্স। এবার ম্যাকলারেন ৩৬ করে উইকেট কিপার এর হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হলেন মার্শালের বলে। নামলেন লর্ড হক।

দলের রান আস্তে আস্তে পৌঁছল ১৪৮ রানে। কক্স আউট হলেন কার্টিস-হেওয়ার্ডের হাতে ক্যাচ দিয়ে। হকের ব্যাটিং দেখে ইংলিসম্যান লিখেছিল ১৯০২-০৩ মরশুমে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি অথেনটিক্স এর পর এমন ব্যাটিং দেখা যায়নি। উইকেটের চারপাশে মেরে রান তুলছিলেন তিনি। ইতিমধ্যে স্পেন্স ২ করে আউট। স্লিপে হিকলের হাতে ক্যাচ দিয়ে কার্টিস-হেওয়ার্ডের বলে। দল লাঞ্চে গেল।

লাঞ্চের পর ইংলিশ নেমেই শূন্য করে আউট হলেন কার্টিস-হেওয়ার্ডের বলে। ম্যাকলারেন ৩৮ করে অপরাজিত থাকলেও টার্নার ১৫ করে আউট। সব মিলিয়ে ৩৪৬ রান তোলে আই জিঙ্গারী। ম্যাকফার্নন শেষের দিকে পিটিয়ে ৩৬ করেন। হক অনবদ্য ১৪৮ করেন।

এর আগে ১৮৮৯-৯০ সালে ভার্ণনের দলের হয়ে ল্যাঙ্কশায়ারের আর্থার গিবসন ও ১৯০২-০৩ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি অথেনটিক্স এর হয়ে ল্যাঙ্কশায়ারেরই আলবার্ট হর্নবী ইডেনে সফররত দলের হয়ে শতরান করেন। লর্ড হক তৃতীয়।

কার্টিস হেওয়ার্ড ৬টি উইকেট নেন। হিলারি ১টি, উইলসন ২টি ও হিকলে ১টি উইকেট পান।

চারটের সময় ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব নামে। পাঘ ও রঞ্জি। পাঘ এল বি ডব্লু হন আইনকেনসনের বলে ৫ করে। দিনের শেষে রঞ্জি ২৭ ও উইনকওয়ার্থ ২ করে ব্যাটিং। CCC ৩৫/১।

শেষ দুদিনের খেলার বিস্তারিত বিবরণ খুব বেশি নেই। তারপরেও যা আছে তা তুলে ধরছি। রঞ্জি আর গাইজ ছাড়া কেউ দাঁড়াতে পারেনি প্রথম ইনিংসে। রঞ্জি ৩২ করেন। গাইজ ৩১। ম্যাকফার্সন ৩টি, atkinson ৩টি উইগ্রাম ৩টি ও ফ্রেডরিখ ২টি উইকেট পান। উল্লেখ করা যায় ম্যাচটি টুয়েলভ-আ-সাইড ছিল।

এরপর আই জিঙ্গারী ৯ উইকেটে ২৭৬ তুলে ডিক্লেয়ার্ড দিয়ে দেয়। কিংটন ১২২ করে চতুর্থ খেলোয়াড় হন যিনি সফররত দলের বিরুদ্ধে শতরান করেন। ম্যাকলারেন ৮৭ করেন। হক (৪) ব্যর্থ হন। স্টুয়ার্ট ৪টি, হজসন ২টি, উইলসন, হিকলে ও হিলারী ১টি করে উইকেট পান।

জয়ের জন্য অসম্ভব ৪৫৭ রান তাড়া করে ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব। পাঘ (অপরাজিত ৬৯) ও রঞ্জি পিটাতে থাকেন। সেই বিশ্ববিখ্যাত লেগ গ্ল্যান্স এ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে ইডেন। প্রথম উইকেট জুটিতে ১০০ হয়ে যায়। রঞ্জি শতরান করেন।

সেই ১৮৮৯-৯০ সালে ভার্ণনের দলের বিরুদ্ধে এডমুন্ড গ্রীনওয়ে শতরান করেছিলেন। সেটাই সফররত দলের বিরুদ্ধে প্রথম স্থানীয় দলের খেলোয়াড়ের শতরান। তাছাড়া এটাই প্রথম কোনও ভারতীয় ক্রিকেটারের ইডেনে শতরান। এতদিন আমরা জানতাম যে পালওয়ানকার বিঠঠল প্রথম ভারতীয় যিনি ইডেনে এই কৃতিত্ব দেখান। কিন্তু এই ম্যাচের স্কোর সেই ধারণা ভেঙে দিল। রঞ্জিই এই কৃতিত্বের অধিকারী। তিনি ১৩২ করে যখন আউট হন তখন ২১১ রান। তখনও হাতে ৫ উইকেট বাকি। কিন্তু এমন সময় ধ্বস নামে। যদিও পাঘ উইকেটে অনড় থেকে ম্যাচ ড্র করে দেন। হিকলে (২২), হজসন(২৫), হিলারী (৩০), উইনকওয়ার্থ (২৫) সবাই লড়েছিলেন। CCC ৯ উইকেটে ৩৬৩ তোলে।

উইগ্রাম ৩, ম্যাকফার্সন ২, স্পেন্স ১ টি উইকেট পান। ফ্রিডরিখ ৩টে উত উইকেট পান। ম্যাচ ড্র।

এবার একটু নজর করা যাক কিছু খেলোয়াড়ের দিকে।

জেমস স্পেন্স ছিলেন মেজর জেনারেল। তিনি আফগান যুদ্ধে-বুওর যুদ্ধে ছিলেন। এই ম্যাচের সময় তিনি বেরিলিতে পোস্টেড। প্রথম শ্রেণির খেলায় ৫৮১ রান, তিনটি হাফ সেঞ্চুরি, একটি সেঞ্চুরি তিনি করেন।

আর্নেস্ট রবার্ট ম্যালিং ইংলিশ একটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেন গ্লোস্টার্স এর হয়ে।

রয়াল নেভির C E Atchinson গোটা সাতেক ম্যাচ অন্তত খেলেছিলেন যদিও সেগুলো প্রথম শ্রেণির নয়।

লর্ড হক ইংল্যান্ডের ক্যাপ্টেন ছিলেন। তিনি ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আর্জেন্টিনা ও দক্ষিণ আফ্রিকায় দল নিয়ে এসেছিলেন এর আগে। ইয়র্কশায়ারের ক্রিকেটার। ইংলিশ ক্রিকেটের কিংবদন্তি চরিত্র।

আর্চি ম্যাকলারেন অনবদ্য ক্রিকেটার ছিলেন। রঞ্জির এডিজি ছিলেন বহুদিন। ইংল্যান্ডের ও ল্যাঙ্কশায়ার এর ক্যাপটেন, প্রথম শ্রেণির খেলায় প্রথম কোয়াড্রুপল সেঞ্চুরি (৪২৪) তিনিই করেন।

ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের পাঘের কথা আগেই বলেছি।

রঞ্জির কথাও সবাই জানে। নতুন করে কি বলবো?

উইনকওয়ার্থ ক্যালকাটার হয়ে নিয়মিত খেলতেন।

জে ডি গাইজ সেই যুগের দারুণ খেলোয়াড়। দুটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ ও খেলেন। তারমধ্যে একটা ভারতের হয়ে প্রথম বেসরকারি টেস্ট। তাঁর দ্বিতীয় পুত্রও কলকাতায় জন্মান। ভারতে প্রচুর ম্যাচ খেলেন। এমনকি নিয়মিত কাউন্টি ও মাইনর কাউন্টি খেলতেন। ১৯২৬-২৭ সালে এম সি সির বিরুদ্ধে ভারতের হয়ে বেসরকারি টেস্ট ও খেলেন। জে ডি গাইজ এর জন্মও কলকাতায়।

হেনরি জোসেফ হিলারী টর্নব্রিজ স্কুলের হয়ে খেলতেন। কলকাতায় ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কনফারেন্স এর সেক্রেটারি হন, পরে পোর্ট কমিশনারের সেক্রেটারি হন। ক্যালকাটা পোর্ট ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।

আরুনডেলের কথা আগে বলেছি, ওঁর ভাই নিয়মিত মাইনর কাউন্টিতে ডেভনের হয়ে ৬২ টি ম্যাচ খেলেন।

কার্টিস হেওয়ার্ড ক্যালকাটার নিয়মিত ক্রিকেটার ছিলেন। হিকলেও তাই।

হজসন হলেন ক্রিস্টোফার লেফরয় হজসন। তিনিও নিয়মিত খেলতেন।

স্টুয়ার্ট ও নিয়মিত খেলতেন। ১৯১২ সালে এম সি সির হয়ে হার্টফোর্ডশায়ারের বিরুদ্ধে খেলেন।

আগামীদিনে আরও হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস খুঁজে আনার চেষ্টা করব।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২