ভোজ কয় যাহারে (অষ্টম পর্ব) : ঝিঙে – সত্যম ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

অষ্টম পর্ব

তখন কলকাতায় মানে বেলঘড়িয়াতে মেসে থাকি। এবারে বেলঘড়িয়াকে কলকাতা বলা যায় কি যায় না এই বিষয় নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতেই পারে বা করতেও শুনেছি, কিন্তু আজ থেকে কুড়ি বছরেরও বেশি সময় আগে আমার মতো উত্তরবঙ্গের মফঃস্বলের ছেলের কাছে নৈহাটি-ব্যান্ডেলও কলকাতা ছিল আর বেলঘড়িয়ার তো কথাই উঠবে না কারণ শিয়ালদা থেকে মেইন লাইনে বেলঘড়িয়া তিন নম্বর স্টেশন।

যাই হোক, সেই বেলঘড়িয়ার যতীন দাস নগরে মেসে থাকতাম। মনাদা, কালাদা, ধলাদা, দুলালদা—যাদের ওই চত্বরে হোটেল বা দোকান তারাই আমাদের অভিভাবক। আশপাশের মেসের বালুরঘাটের দেবাই-বাবাই বা আমাদের মেসের মেদিনীপুরের সুনীল-সুন্দরবনের দীপক এরাই ছিল বিভিন্ন সময়ের সুখদুঃখের সাথী। রান্নার মাসি আসেনি। কুছ পরোয়া নেহি। নিজেরাই বাসন মাজলাম, ডাল-আলুসেদ্ধ আর ভাত রান্না হল। হৈ হৈ করে খাওয়া-দাওয়া হল। ভালোই ছিল মনে হয় দিনগুলো। আজ এত বছর পরে এসে পেছন ফিরে তাকালে অঞ্জন দত্তর সিনেমায় নচিকেতার গাওয়া কে আছো কোথায় গানটা খুব মনে পড়ে।

যাই হোক, বেলঘড়িয়া নিয়ে কথা বলতে গেলে মূল প্রসঙ্গে আসতে দেরি হয়ে যাবে। মেস জীবন মানেই হাড়-হাভাতের জীবন। দশ জন দশ রকম অর্থনৈতিক ভিত্তির বাড়ি থেকে এসেছে। সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। সবার মতো করেই চলতে হবে। তাই তখন বিড়াল লাফিয়ে টপকাতে পারবে না এমন পরিমাণ ভাত সবাই একবারে খাই, হয়তো শুধু ডাল আর ভাজা দিয়েই। মাছ বা ডাল-তরকারি যাই হোক না কেন রান্নার মাসি তা বাটিতে বেড়ে দিয়ে যান আর বিশাল বড়ো হাঁড়িতে ভাত থাকে। থালায় হাঁড়ি থেকে ভাত নিয়ে কোন্ বাটির মাছটা বড়ো বা তরকারি বেশি আছে তা খুব ভালো করে পরখ করে দেখে তোলা হয়।

এহেন মেস জীবনে মাসিরাই আশা, মাসিরাই ভরসা। কারণ তারা না আসলে খুব বড়োজোর একবেলা বা দু-বেলা নিজেরা রান্না করে খাওয়া হবে, তারপর থেকে হোটেল। আর হোটেল মানেই গাঁটের কড়ি খরচ। সে মেসেও তাই। কিন্তু মেসে অনেক সস্তা বা একবারে দেওয়া আছে মাসের শুরুতে ইত্যাদি ইত্যাদি। আর হোটেলে খেলে ভাতের থেকে রুটির খরচ অনেক কম।

আমরা যে পাড়ায় থাকতাম তার একদম মোড়ের মাথায় ছিল দুলালদার হোটেল। দুলালদা কট্টর ইস্টবেঙ্গল আর কথার সাগর। আর হোটেলের রান্না এতই অখাদ্য যে দুলালদাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হত কাস্টমার ধরার জন্য। আমরা ভালো হোটেলে যাবার জন্য মূল রাস্তা দিয়ে না গিয়ে অলিগলি ধরতাম যাতে দুলালদাকে এড়ানো যায়। কিন্তু কোনোদিন ভুলে গেলেই সমস্যা। মূর্তিমান তিনি রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে মিষ্টি করে বলবেন— এসো, আজ ঝিঙেপোস্ত করেছি। এবারে না কাটাতে পেরে হয়তো বাধ্য হয়ে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি একটা বড়ো গামলা বা কড়াই এর মধ্যে ভর্তি ঝোল জাতীয় একটা পদার্থ আর তার মধ্যে ঝিঙের টুকরো খাবি খেতে খেতে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমাদের অবস্থাও তখন তাদের মতনই। কারণ সেই ঝিঙেপোস্ত নামক পদার্থটি দিয়ে রুটি খেতে হবে। চোখে জল চলে আসত বাড়ির ঝিঙেপোস্তর কথা মনে পড়ে।

আর অদ্ভূত ট্র্যাজেডি হচ্ছে গল্প এখানেই শেষ নয়। খাওয়া হয়ে গেলে দুলালদা বলবেন—কি মায়ের হাতের ঝিঙেপোস্তের কথা মনে পড়ে গেল না? একবার যদি কেউ হ্যাঁ না বলে অন্য কিছু বলেছে, ব্যস, তাহলেই হয়ে গেল। তাকে আটকে ভাট বকবে হোটেল বন্ধ না করা অব্দি। সেজন্য কোনোক্রমে খাবার গিলে প্রশ্নের যা কিছু একটা উত্তর দিয়ে কেটে পড়াই হত টার্গেট। তারপর মেসের ঘরে ফিরে বিছানায় শুয়ে মনে মনে হিসেব করতাম যে বাড়ি যাবার আর কতদিন বাকি আর কবে বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতের সেই অসাধারণ ঝিঙেপোস্তটা খেতে পারব।

তবে ঝিঙে পোস্ত ছাড়াও চমৎকার হয় দেখি এখন বৌয়ের হাতে, আলু-কালোজিরে-কাঁচালঙ্কা দিয়ে। কেউ আবার দয়া করে ভাববেন না আমি হোমমিনিস্ট্রির বাউন্সার সামলানোর জন্য এসব বলছি। এছাড়াও মুগডালে ঝিঙে দিয়ে সুস্বাদু। পথ্য হিসেবে বা গরমের দিনে লোকাল মাছের কালোজিরে-কাঁচালঙ্কার পাতলা ঝোলে আলু পটলের সাথে সঙ্গত করতে ঝিঙের জুড়ি মেলা ভার। কিছু কিছু ঝিঙে আবার একটু তেতো হয়। আর একটু ছোটো, বেঁটে, মোটা এক ধরনের ঝিঙে বাজারে পাওয়া যায় যার স্বাদ সাধারণ ঝিঙের থেকে অনেক বেশি।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *