৬ ডিসেম্বরের পূর্বাপরে – অমিতাভ গুপ্ত

শেয়ার করুন

‘আপনপাঠ’-এর ওয়েবজিনের পূর্ববর্তী সংখ্যায় লিপি-অলিপির ছলে এবং কবিতাযাপনের সূত্রে শারদোৎসবের স্মৃতি উদ্ধারের চেষ্টা করেছিলাম। এবারও রচনাসূচনায় একটু শারদোৎসব ফিরে এল। সে অবশ্য ১৯৯৬ সনের কথা।

কেমন ছিল ১৯৯৬ সনের আশ্বিন ঋতুটি? আকাশ কি ছিল স্বভাবত অকলঙ্ক? প্রতিটি কাশফুল ছিল শুভ্র? সদ্য ঘটে যাওয়া (১১ জুলাই) ঘটনার কালো ছায়া কি ছড়িয়ে ছিল না সেবারের সেপ্টেম্বরে?
     

জুলাই মাসে বাথানিটোলায় ‘উচ্চবর্ণের’ হিন্দুদের আক্রমণে নিহত হয় ২১জন দলিত, এই গণহত্যায় নির্বিচার অস্ত্র ব্যবহার হয়েছিল, খুন করা হয়েছিল শিশুদের, নারীদের। তথাকথিত উচ্চবর্ণের তথাকথিত নিম্নবর্গীয়দের উপর এরকম লজ্জাহীন প্রকাশ্য সন্ত্রাসের বীজ হয়তো অনেক আগেই রোপণ করা হয়েছিল। বীজাঙ্কুর থেকে বিষগাছ জাত হল ১৯৯২ সনের ৬ ডিসেম্বর। মনে রাখতে হয়, যে নির্বোধ রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে মৌলবাদের উদ্ভ্রান্ত চিতাধূমে ভারতবর্ষকে কালো করে তুলেছিল ৬ ডিসেম্বর, সেই চিতাধূমই ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে অযোধ্যা থেকে গুজরাটে আর বাথানিটোলায়। আসলে ৬ ডিসেম্বর সেই উন্মত্ত উন্মাদনার দিন যখন মানুষকে পশুতে রূপান্তরিত করার সূচনা করা যায় কিংবা বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া পশুর মতো অসহায় হয়ে উঠতে শুরু করে মানুষ। বাথানিটোলার কোনো মহিষ কি উপস্থিত হয়েছিল ১৯৯৬ সনের কোনো শারদোৎসবে, দেখেছিল বিস্মৃতিপ্রবণ ওই আনন্দবিহ্বল নরনারীকে, শুনেছিল শ্লোক থেকে নিঃসৃত মঙ্গলোচ্চারণ:

আকৃতি দৈত্যের মতো, হঠাৎ দেখলে ভয় হয়
মানুষের মতো নয়
সুসভ্য সুন্দর লোভী ঈর্ষাতুর বড়োলোক
তাই সে নির্বোধভাবে মেলে শান্ত চোখ
দেখে, এই বাথানিটোলার প্রান্তরে কোমল ঘাস শ্রাবণঝরার
শ্যামলের উপরে রৌদ্রে সুখাদ্যে ছড়ানো
তবু কেন লোভ থেকে ঈর্ষা থেকে মানুষেরা দৈত্য ডেকে আনে
আত্মপ্রতিচ্ছবি করে
কেন ঝরে পড়ে
মহিষাসুরের মতো প্রকৃত হিংসা—জন্তু, নিরুত্তরে
ধীরে ধীরে চলে যায়
অন্যত্র, আসন্ন উৎসবের মতন কোনো শারদীয়া অর্চনায়
সে জানে মহিষাসুরমর্দিনী পাঠ হবে জেনো মহৈশ্বর্য ছুঁতে
সে পড়েনি শ্রীচণ্ডীকাণ্ড তাই মৃদু অপ্রস্তুতে
চলে যায়
বাথানিটোলায়
ক্লান্ত বিদ্রুপের মতো দূর থেকে যেন শোনা যায়
সর্বস্যার্তিহরে দেবি নারায়ণী নমোহস্তুতে

বাথানিটোলার মহিষ . নির্বাচিত কবিতাপ্রয়াস, আপনপাঠ পৃষ্ঠা নং- ১১০-১১

যখন এই কবিতাটি রচিত হয়েছে, তখনও অবশ্য জানা যায়নি গুজরাটের নৃশংস গণহত্যা ঘটতে চলেছে অবিলম্বে। প্রকৃতপক্ষে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২-এর  বাবরিধ্বংস থেকে গুজরাটকাণ্ডের মধ্যে একটি স্বরন্যাস রচনা করে রেখেছে বাথানিটোলা যার প্রতিধ্বনি আজও নিত্য অনুরণিত হাথরাস থেকে বিভিন্ন সংখ্যালঘু ও দলিত ভারতীয় নাগরিকদের উপরে অত্যাচারের ধারাবাহিকতায়। রামরথ যাত্রা তথা গুজরাটকাণ্ডের পূর্বাভাসজনিত যন্ত্রণার কথা আগেই নিবেদন করেছি ‘বুলন্দ দরওয়াজা’ শিরোনামের দীর্ঘকবিতাটির প্রসঙ্গে।  গত শতকের শেষার্ধে এই যন্ত্রণার উৎসক্ষত যে সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা, তা অবশ্য ভারতীয় চরিত্রে স্বভাবজ নয়। সবাই জানেন , ইউরোপের বিখ্যাত থার্টি ইয়ার্স ওয়ার চলেছিল ধর্মীয় মৌলবাদের কারণেই এবং সপ্তদশ শতকের সূচনায় এই তিরিশ বছরের যুদ্ধ প্রায় সমগ্র ইউরোপকেই আচ্ছন্ন করেছিল। এরও আগে, ষোড়শ শতকে, অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতা নিয়ে দাঙ্গা করেছিল ইংল্যান্ডের প্রোটেস্ট্যান্ট আর ক্যাথলিক সম্প্রদায়ে বিভক্ত খ্রিস্টানরা। রক্তস্নাত ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসলেন প্রথম এলিজাবেথ, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বড়ো হতে শুরু করল আর সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে পড়ল উপনিবেশগুলিতে। নব্য উপনিবেশের যুগে, ভদ্রভাষায় যাকে পোস্টকলোনিয়াল এজ বলা হয় সেই সময়ে অর্থাৎ একালে, ইউরোপ বর্জিত এই দূষিত মৌলবাদ প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছে কয়েকটি তথাকথিত রাজনৈতিক দল, ভারতীয় সংস্কৃতির বিরোধিতা করে:

সমস্ত দুয়ার আজ টলে যায় অর্গলের দিকে
তবুও রয়েছি আমি, কোনো-এক পরিহাসকেশবকে নিজের নিরিখে
সাজিয়ে রাখব বলে                                শেষহেমন্তের কোলে ঝাঁপান জুড়েছে
মজুরানী, ওই তার হাতের নিটোল ভঙ্গি, অকস্মাৎ বেঁচে
ওঠা শিশুটির দ্রুত কলোচ্ছ্বাস 
                                                    মনে হয়, আজও
গড়ে উঠছে বিশাল রাসের মঞ্চ। চুড়ির আওয়াজমৃদুভাবে শোনা যাচ্ছে, নুপূরের। গ্ৰাম্য, নীচুপথে
বাঁক নিয়ে ফিরতেই চোখে পড়ে রাসপূর্ণিমার আলো
পড়েছে মস্‌জিদে

রাস, নির্বাচিত কবিতাপ্রয়াস, আপনপাঠপৃষ্ঠা নং- ৫০


অবিভাজ্য এই প্রেমই জ্যোৎস্নার মতো ছড়িয়ে রয়েছে ভারতীয় চেতনায়। এই প্রেমকে যারা চূর্ণ করতে চায়, আরাধ্য কেশবের পরিহাসমাত্র লাভ করে তারা, যেভাবে সমস্ত সাম্প্রদায়িকতাবাদ ইতিহাসের পরিহাসে বারবার আত্মহননের পরিণতি লাভ করে। তবু এত মৃত্যু এত হননের মধ্যেও আকাশে আকাশে ছড়িয়ে পড়ে রাসপূর্ণিমার আলো, জাগে মিলিত হৃদয়ের আভা। আকাশের সেই আভা মন্দিরের সঙ্গে মসজিদের কোনো ভিন্নতা মান্য করে না। মনে পড়ে গত শতকের আশির দশকে একটি মসজিদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে এই আভাকে আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম। বাড়ি ফিরে কবিতাটি লেখা হয়। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষেও এই সত্য চিত্রনিধানযোগ্য হয়েও টের পেতেই হয়, যারা শ্রমজীবী যারা নিম্নবর্গীয় যারা নির্যাতিত ও শোষিত হবে বলেই এসেছে এ শ্রেণিসমাজে তাদের দুঃখকে নিরাকৃত করা দূরে থাক, ৬ ডিসেম্বরের পূর্বাপরে রচিত সমস্ত ভয়ংকর সব মৌলবাদ তাদেরই পিষে ফেলে মারে। তাদের শিশুরা জন্ম নেয়, শিশুদের মায়েরা যথাসাধ্য দৃঢ় হাতে তাদের রক্ষা করে। তবু শিশুঘাতী নারীঘাতী সাম্প্রদায়িকতা কতবার, আরও কতবার তাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে কে জানে। বিশ শতকের দিনান্তবেলায় তরুণ কবি দেবর্ষির সঙ্গে ঘুরেছিলাম আলমগঞ্জে। বর্ধমানের এই নিভৃতাঙ্গনেই রয়েছে বহরাম সক্কা ফকিরের সমাধি। মরমীয় কবি বহরাম ছিলেন জাহাঙ্গীরের সমসাময়িক, পার্সিয়ান ভাষায় রচিত তাঁর অনবদ্য কবিতার তিনটি পুঁথি রয়েছে কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটিতে। নৃশংস এক যুদ্ধে নিহত কুতুবউদ্দিন, সের আফগান এবং অন্যান্য সৈনিকদের সমাধিস্থলের পঞ্চাশ মিটার দূরে বহরামের সাধনপীঠ। প্রসঙ্গত, বহরাম এবং সের আফগান ছিলেন একেবারেই সমসাময়িক, কুতুবউদ্দিনের সঙ্গে সের আফগানের লড়াইয়ের সময়ে হয়তো বহরাম মিনতি করেছিলেন, তারপর প্রার্থনাও করেছিলেন তাদের জন্য। অদূরে বিধ্বস্ত পঞ্চম শতকীয় মন্দিরস্থাপত্য। সেই সন্ধ্যায়ও আকাশে ছিল পূর্ণচন্দ্র, জোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছিল পীরের দরজার কাছে বসে থাকা একটি ভিখারির উপরে যে কোনো একদিন কৃষক ছিল; আজ মহাজগতের কাছে সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে ভিখিরি হয়েছে:

সশস্ত্র শান্তির পথে সন্ধ্যার মতন এই মুক্তাঞ্চল, ধীরে
গড়ে উঠছে। সবাই সমান হবে? সুখী হবে? রাতের তিমিরে

অন্তর্ঘাতের মতো আর কোনো মেঘ নেই? যে জীবন বৃষ্টিযাপনের
সে যেন উদিত চাঁদে দু’চোখ মেলেছে তাই জানালার শার্সি সন্তর্পনে

সরে গেল। কতদিন আগে কোন্ দয়ালু ফকির এই ভাঙাচোরা গ্ৰামে
একটি অজানা গাছ রেখেছিল। যার বীজাংকুর নেই। তারই স্মৃতিনামে

আজান ভেসেছে ব’লে ক্রমশ আলমগঞ্জে ছায়ার মতন আজ নম্র মহীরুহ
যে গ্ৰহে জীবন নেই সেসব দেশের মতো কীর্ণ হয় মৃত্তিকার ব্যূহ

দেবর্ষি, তরুণ কবি, মাঠেঘাটে ট্রাইবালদের গ্ৰামে ঘুরে ঘুরে ঘুরে
যেভাবে এখনো ভাবে মানুষের ভালো হবে। গ্লোবালাইজেশন নিয়ে উড়ে

চলে যায় ত্যক্ত শ্রম। কয়েকটি মন্দির। ভাঙা। মৌলবাদ। পরে সমঝোতা
যে যথেষ্ট হিন্দু নয় অথবা ইসলামী নয়, জমি নেই, লাঙলও যার

বোনের বিয়ের দেনা বুকে নিয়ে মহাজনদের ঘরে। মনে হয় এসব সন্ধ্যায়
সে কেন আড়ষ্ট? ভাবছে? জ্যোৎস্নায় সবাই এক? নক্ষত্রের দায়বদ্ধতায়

চাঁদের বুড়ির মতো সন্তানসন্ততি তার দুঃখকেই ধর্ম ব’লে চেনে
রাতের গভীরে যারা ঝ’রে যায় অথবা চরকা পিষে রাতকে ছেনেছে

জানালা খুলে গিয়েছিল। আমিও তো একবার দেখলাম আকাশের ঊর্ধ্বে ঈশানে‌
বহরাম সক্বা ফকির আজও বসে আছে। জানু পেতে। সে আমার আশঙ্কাটি জানে

আলমগঞ্জে, নির্বাচিত কবিতাপ্রয়াস, আপনপাঠপৃষ্ঠা নং- ১১৫-১৬

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *