যে-বছর চের্নোবিল – কুশাণ‌ গুপ্ত ( পর্ব ১০ )

শেয়ার করুন

দশ

শৈবা…

দুপুর একটা চল্লিশ নাগাদ সাম্প্রতিক বিশ্বকাপ ফুটবল লইয়া স্টাফরুমে মৃদুমন্দ আলোচনা চলিতেছিল। বস্তুত, ১৯৮৬ সনের বিশ্বকাপের দূরদর্শন-সম্প্রচার হইয়াছিল ব্যাপকরূপে এবং আপামর ভারতবাসী মাতিয়া উঠিয়াছিল মারাদোনা-জ্বরে। যদিও গ্রীষ্মাবকাশ ও বিশ্বকাপ অতিক্রান্ত হইবার পর তিনমাস কাটিয়া গিয়াছে, তথাপি এই প্রসঙ্গ কী করিয়া যেন আবার আসিয়া পড়িল।
ইংল্যান্ড-আর্জেন্টিনা ম্যাচের ওই গোলটা, স্পোর্টস টিচার দিলীপবাবু বলিলেন, মারাদোনা তুলনাহীন।

―তবে যাই বলুন, এমন ফাইন্যাল হয় না। গোটা জার্মানি ডিফেন্স একটা লোক তছনছ করে ভেঙে ফেলল, ভাবা যায়, নবেন্দু মুখ খুলিল।

―হ্যাঁ। বুরুচাগার ওই শেষ গোলটা, উফফ, তুলনাহীন।

এতক্ষণ উমাপদ চুপ করিয়া শুনিতেছিলেন। হঠাৎ, তিনি বলিলেন, তোমরা যা-ই বলো, সোভিয়েত ইউনিয়নকে অন্যায় ভাবে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বাকিরা চুপ করিয়া গেল। নবেন্দু মিটিমিটি হাসিতে লাগিল, তারপর বলিল, আপনি সত্যি পারেনও উমাদা!
কিন্তু উমাপদ দমিলেন না, ভাবলেশহীন, বলিলেন, বেলজিয়ামের সঙ্গে ম্যাচটা দেখেছ কি? নিরপেক্ষতা রেখেই বলো না, তোমাদের মতামত শুনি।

উমাপদ এই আলোচনায় অংশ লইলেও কার্যত তাঁহার, ফুটবল কেন, কোনো ক্রীড়া লইয়াই বিশেষ কোনো ব্যক্তিগত আগ্রহ কেউ কখনও দেখে নাই। অবশ্য তাঁহার বিবিধ সামাজিক কৌতূহল ও দায়বদ্ধতায় ক্রীড়া একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করিত। সুতরাং, এবারের বিশ্বকাপে পাড়ার ক্লাবের টিভিতে ম্যাচ দেখাইবার বন্দোবস্তে তিনি ছিলেন পুরোধা। কিছু সঙ্গী সমভিব্যাহারে উমাপদ উৎসাহ লইয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় সব ম্যাচ দেখিতে বসিতেন। অন্যান্য ম্যাচে তিনি নামমাত্র ও নিস্পৃহ দর্শক, কিন্তু সোভিয়েত ম্যাচে ছিলার ন্যায় টানটান। তাঁহার কাছে বিশ্বকাপ যেন ইউরোপের অপরাপর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক দেশের মতাদর্শের সংগ্রাম, এক তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। মূলপর্বে সোভিয়েত ভালো খেলিয়া নক আউট পর্বে উঠিতেই তিনি উল্লসিত হইয়া ওঠেন। ইহার পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন বেলজিয়ামের সম্মুখীন হয়। এই ম্যাচ, বলাই বাহুল্য, রুদ্ধশ্বাস হইয়াছিল। নির্ধারিত সময়ে মীমাংসা না হওয়ায় অতিরিক্ত সময়ে খেলা গড়ায়। বেলজিয়াম শেষাবধি জিতিয়া যায়। উমাপদ ডুকরাইয়া উঠেন―হারিয়ে দিল, সমাজতান্ত্রিক দেশটাকে হারিয়ে দিল।

সেই বৎসর সোভিয়েত টিমের কোচ ছিলেন ভ. লোবানভস্কি; ইউক্রেনের ডায়মন্ড কিয়েভ দলের স্বনামধন্য কোচ। সাতের দশক হইতে শুরু করিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের টপ লিগে ডায়মন্ড কিয়েভ তাঁহার আমলে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৬ সনের বিশ্বকাপে সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল দলের অধিকাংশ প্লেয়ার ছিলেন ডায়মন্ড কিয়েভ দল হইতে নির্বাচিত। তন্মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ক্ষিপ্র ফরওয়ার্ড ইগর বেলানভ এবং মিডফিল্ডার আলেক্সান্ডার জাভারভ। এ ব্যতীত গোলকিপার হিসাবে, স্পার্টাক মোস্কভা হইতে আনীত দাসায়েভ ততদিনে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিলেন।
উমাপদর অভিযোগ একেবারে ভিত্তিহীন, একথা বলা যায় না। প্রথমার্ধে, এমনকি দ্বিতীয়ার্ধেও আধিপত্যের বিচারে সোভিয়েত ইউনিয়ন তুলনামূলক ভাবে এগাইয়া ছিল। প্রথমার্ধে বেলানভের অসামান্য গোলে সোভিয়েত ১-০ ব্যবধানে এগাইয়া যায়। ইহার পরে বেলজিয়ামের শিফো দ্বিতীয়ার্ধে গোল পরিশোধ করেন। এই গোলটি অফসাইড কিনা তাহা লইয়া দ্বিমত থাকিতে পারিত। তবে বেলানভ অতঃপর দ্বিতীয় গোলটি করার পর বেলজিয়ামের দ্বিতীয় গোলটি লইয়া প্রশ্ন থাকিয়া যায়। এমনকি লাইন্সম্যান অফসাইডের ফ্ল্যাগ তুলিয়া পুনরায় নামাইয়া দেন। নিশ্চিত অফসাইডের এই গোলে খেলা দ্বিতীয়ার্ধে গড়ায়। বেলানভ হ্যাটট্রিক করিয়াও শেষ রক্ষা করিতে পারেন নাই।

অকস্মাৎ আলোচনা চলিতে চলিতে উমাপদর দৃষ্টি একটি শূন্য চেয়ারে পড়িল, তিনি বলিলেন, সত্যদা আজও আসেননি দেখছি।

সকলে নিরুত্তর রহিল। উমাপদ বলিলেন, নবেন্দু, আজ একবার সত্যদার বাড়ি যাই চলো, ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না।

ছুটির পরে দুই-চারদিন সত্যমাধব নামমাত্র আসিয়াছিলেন, তাও খুবই অনিয়মিত। উমাপদ লক্ষ করিয়াছেন, ইদানিং সত্য বিমর্ষ থাকিতেন, কথা বলিতে গেলেও বিশেষ উৎসাহ দেখাইতেন না। ইহার পরে ছুটি না লইয়াই তিনি কয়েক সপ্তাহ টানা অনুপস্থিত। ইহা লইয়া দু-একজন দু-একবার কথা বলিলেও এই প্রসঙ্গ অন্যান্য আলাপ-আলোচনায় ধামাচাপা পড়িয়া যায়।

এক্ষণে উমাপদ সম্পর্কে সামান্য দুই-চার কথা বলা আবশ্যক। ষাটের দশকে তরুণ উমাপদ জিলাশহরের স্কুলে যোগদান করিবার অনতিবিলম্বে তৎকালীন প্রৌঢ় নেতা দেবেন দাসের প্রভাবে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। চকমকরামপুর অঞ্চলে রক্তক্ষয়ী জমি-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়া মাস আটেক জেল খাটিয়া একমুখ দাড়ি ও সারা গায়ে উকুন লইয়া উমাপদ যখন আপন গৃহে ফিরিয়া আসেন তখন তাঁহার শিশুপুত্র নবদ্বীপ, এই আখ্যানে উল্লিখিত নবা, টলটল করিয়া হাঁটিতেছে। জেল খাটিয়া ফিরিবার পর উমাপদর আত্মবিশ্বাস আরও বাড়িয়া যায়। সাতের দশক ও আটের দশকে তিনি চকমকরামপুর অঞ্চলের অপরিহার্য কৃষক নেতা হইয়া উঠেন। এককথায় তাঁহার উপর জেলা নেতৃত্ব নির্ভর করিত। তিনি তাত্ত্বিক নেতা একেবারেই ছিলেন না, বরং মাটির নিকটবর্তী, মানুষের কাছাকাছি, দক্ষ সংগঠক।

অথচ, সাতের দশক হইতে শুরু করিয়া আটের দশকে তাঁহার নিজ হাতে তৈরি করা দুই চারজন নির্ভরযোগ্য কমরেড তাঁহাকে ছাড়িয়া সিপিআই(এম) দলে চলিয়া যায়। এই সেই সময়, যখন সিপিআই(এম)-সিপিআই শরিকি সংঘর্ষে অবিভক্ত জেলার গ্রামের মাটি কাঁপিয়া উঠিতে থাকে। সিপিআই ক্রমেই ভাঙিতেছে, সিপিআই(এম)-এর শক্তি আরও বাড়িতে লাগিল। এতদ্বিধ বিরোধ সত্ত্বেও, সকল প্রকার প্রাক নির্বাচনে উমাপদর ওয়ার্ডে বড়ো শরিক তাঁহার উপরেই নির্ভর করিত। শহরের অন্যান্য অধিকাংশ ওয়ার্ডে বামফ্রন্ট পিছাইয়া পড়িত, তথাপি উমাপদ ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে বামফ্রন্টের স্বচ্ছন্দ লিড আনিয়া দিতেন। সংক্ষেপে, এক রাজনৈতিক স্ববিরোধিতার মধ্যেও উমাপদ নিজের পার্টির প্রতি ছিলেন অনুগত-প্রাণ, আদ্যন্ত রাজনৈতিক। বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতর স্বার্থ পরিত্যাগ প্রয়োজন, এই মর্মে উমাপদ বামফ্রন্টের মিছিলে সর্বাগ্রে থাকিতেন।

উমাপদ পার্টিজান ছিলেন, অথচ তাঁহার সার্বজনীন সামাজিকতায় কোনো ঘাটতি ছিল না। বস্তুত, তাঁহার সামাজিক দায়বদ্ধতা কখনও-কখনও তাঁহার রাজনৈতিক অস্তিত্বকে ছাপাইয়া উঠিত। প্রিয় পাঠক, স্মৃতি হাটকাইয়া দেখুন, সাতের দশকে, এমনকি আটের দশকে, নিশ্চিত আপনারা এইরূপ কিছু ব্যক্তি প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, যাঁহারা ছিলেন যুগপৎ যুগের এবং কিয়দংশে হুজুগের, অথচ, সামাজিকতায় আদ্যন্ত দায়বদ্ধ।

যে সময়ে স্কুলে এইরূপ আলোচনা হইতেছিল, সেই সময়ে সত্যমাধব হাঁটিতে হাঁটিতে বড়বাজার এলাকা হইতে সঙ্গতবাজারে প্রবেশ করিলেন। হাতে ধরা গোটা কুড়ি খাম। আজ নতুনবাজার পোস্টাপিসে খাম শেষ হইয়া গিয়াছিল, অতঃপর হাঁটিতে হাঁটিতেই বড়বাজারের মা শীতলা মন্দির সংলগ্ন পোস্টাপিসে পৌঁছাইয়া গোটা কুড়ি খাম পাইয়াছেন। শতাধিক ঠিকানায় ‘নমো নারায়ণায়’ শীর্ষক চিঠি পাঠানো হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ ঠিকানা-সম্বলিত প্রেরকলিস্ট কাগজের ভিড়ে কোথায় হারাইয়া ফেলিয়াছেন, পত্রসংখ্যা চারশো হইতে কত দেরি সে বিষয়েও খেয়াল নাই। এ ব্যতীত, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যথা, রবীন্দ্রনগরের উল্লেখযোগ্য ডাক্তারদিগের এবং অধ্যাপকদিগের ঠিকানায় চিঠি চলিয়া গিয়াছে। উপরন্তু, পরিচিত ঠিকানাগুলি খেয়াল রাখিয়া যথোচিত এড়াইয়া চলিতে হয়, কেউ হস্তাক্ষর টের পাইলে বিপদের আশু সম্ভাবনা। এছাড়াও লোকচক্ষুর অন্তরালে লাল ডাকবাক্সে চিঠি ফেলিয়া আসিতে হয়। সাধারণত সাত সকালেই তিনি পত্র ফেলিয়া আসেন। নিকটে অমূল্য মণি, রত্ন লইয়া যাইবার মতন কী এক উৎকণ্ঠা তাঁহাকে যেন সর্বদা পীড়িত করিয়া রাখে। ইদানীং রাতের ঘুমে বিস্তর ব্যাঘাত ঘটিতেছে, স্কুল যাওয়া একরকম ছাড়িয়া দিয়াছেন, মর্নিং ওয়াক তো দূর, বাজার যাওয়া অবধি মাথায় উঠিয়াছে।

হাঁটিতে হাঁটিতে মাথায় সহসা আসিল, বড়বাজারের দুই ধারের দোকানগুলির উদ্দেশে পত্র পাঠাইলে কেমন হয়?

ওইদিনই বিকাল পৌনে পাঁচটা নাগাদ উমাপদ সাইকেলে করিয়া সত্যমাধবের গৃহে পৌঁছাইলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই নবেন্দুও তাহার রাজদূত লইয়া আসিবার কথা। উমাপদ গেট খুলিয়া বারান্দায় সত্যমাধবের স্ত্রীকে দেখিতে পাইলেন। উমাপদকে সত্যর স্ত্রী চিনিতেন। তাঁহাকে দেখিতে পাইয়াই বেণু মুখে সামান্য হাসি আনিয়া বলিলেন, আসুন উমাপদবাবু, অনেকদিন পরে আসা হল।
উমাপদ বারান্দায় প্রবেশ করিয়া বলিলেন, সত্যদা অনেকদিন স্কুলে আসেননি। কী ব্যাপার? শরীর খারাপ নাকি?

―শরীর খারাপ কিনা আমরা বুঝতে পারছি না। ও তো একরকম দরজা বন্ধ করে দিনরাত ঘরে পড়ে থাকে। বাড়ির কারুর সঙ্গে কথাটথা বলাও ছেড়ে দিয়েছে।

―বিশেষ কিছু ঘটেছে কি?

—সারাদিন দরজা বন্ধ করে কীসব লেখালিখি করে। মাঝে মধ্যে বেরোয়। বাজার করতেও যায় না।

―কী লেখেন?

―একটু অপেক্ষা করুন। আসছি।

বেণু ভেতরে গেলেন। ইতিমধ্যে নবেন্দু আসিয়া পৌঁছাইয়াছে। সে-ও সত্যমাধবের গৃহের বারান্দায় আসিয়া চেয়ারে বসিয়া কথোপকথন শুনিতেছিল।

বেণু ফিরিয়া আসিলেন। হাতে ধরা একটি নবলিপি আকৃতির সাদা কাগজ। উমাপদর দিকে বাড়াইয়া বলিলেন, এই দেখুন। এইসব লেখে।

উমাপদ পত্রটি পড়িতে লাগিলেন। চা-বিস্কুট সহযোগে পড়িতে পড়িতে তাঁহার ভ্রূ কুঞ্চিত হইতে লাগিল। নবেন্দু পাশ হইতে পত্রটি নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। তাহার মুখে হালকা বিদ্রূপের আভাস ফুটিয়া উঠিল।

উমাপদ পত্রটি বেণুকে ফিরাইয়া দিলেন। তারপর বলিলেন, সত্যদা এখন কোথায়?

―ভেতরে নিজের ঘরে।

―চলুন তো, গিয়ে দেখি একবার, বলিয়াই উমাপদ ভিতরের দিকে অগ্রসর হইতে উদ্যত হইলেন। বেণু আগে আগে চলিলেন। পেছনে উমাপদ ও নবেন্দু।

ভেতরে প্রবেশ করিয়া রান্নাঘর ও খাওয়ার দালান অতিক্রম করিয়া ডানদিকে বাঁক লইয়া দরজা বন্ধ ঘরের দিকে বেণু ইঙ্গিত করিলেন। কিন্তু বেণু কিছু বলিবার পূর্বেই উমাপদ দরজার বাহির হইতে ডাক ছাড়িলেন,

—সত্যদা। আমি উমা।

ভিতর হইতে কোনো উত্তর আসিল না।

এবার উমাপদ দরজার কড়া নাড়িয়া খানিক গলা চড়াইয়া ডাকিলেন— সত্যদা। ও সত্যদা। দরজা খুলুন। আমি উমাপদ।

কিছুক্ষণ পর ভিতর হইতে দরজা খুলিবার শব্দ হইল। সত্য বাহির হইয়া আসিলেন। পরনে একটি হাতকাটা বিবর্ণ ফতুয়া এবং ঘরে পরিবার ধুতি। উমাপদ লক্ষ করিলেন, সত্যর মুখে অবিন্যস্ত পাকা দাড়ি, চোখেমুখে স্পষ্ট উৎকণ্ঠার ছাপ।

উমাপদ ও নবেন্দুকে দেখিয়া সত্য কিছুটা বিব্রত হইলেন। কোনোমতে বলিলেন, তোমরা?

―স্কুলে আসেননি কেন এতদিন? কিছু জানিয়েও তো যাননি, উমাপদ বলিলেন।

―আসলে শরীরটা ঠিক…

―কী হয়েছে আপনার?

―না। মানে… একটু অসুবিধেয় আছি।

―বাড়িতে বসে বসে এ কী চেহারা বানিয়েছেন! আপনার বাইরে বেরুনো দরকার।

সত্য কোনো উত্তর করিলেন না। অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া লইলেন। কিন্তু উমাপদ আবার মুখ খুলিলেন:
আমরা একটা জিনিস দেখাব বলে আপনার কাছে এসেছি।

―কী?

―আমাদের সঙ্গে বেরোতে হবে। চলুন আমাদের সঙ্গে।

―কোথায় যাব?

―চলুন না। গেলেই দেখতে পাবেন।

―কী বলছ উমা? কোথায় যাব এখন?

―রেডি হয়ে নিন। আপনাকে নিয়ে আমি আর নবেন্দু যাব এক জায়গায়।

―এখন আমার শরীর ভালো নেই উমা। পরে যাব।

―আমরা আপনাকে নিয়ে যাব বলেই এসেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাকে বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে যাব।

―কী ছেলেমানুষি করছ উমা? আমি এখন কোথাও যাব না।

― চলুন, আপনার ভালো লাগবেই।

সত্য আবার মুখ ঘুরাইয়া দাঁড়াইয়া থাকিলেন। উমাপদ এবার জোর দিয়া বলিলেন, তৈরি হয়ে নিন সত্যদা। একজোড়া কেডস পরবেন শুধু। আমরা তিনজন একটু বেড়াতে যাব।

এই সময়ে বেণু আসিয়া বলিলেন, যাও, একটু ঘুরেই এসো না! উমাপদবাবু কি বাঘ না ভাল্লুক? সারাদিন ধরে বসে আছ। একটু ঘুরে এলে মন ভাল থাকবে।

―কিন্তু, যাবে কোথায়? —সত্য বলিলেন।

―ওটা সারপ্রাইজ সত্যবাবু, এবার নবেন্দু মুখ খুলিল।

সত্যবাবু একবার নিস্পৃহ স্বরে বলিলেন, ঠিক আছে। বলিয়া তিনি ভিতরের ঘরে ঢুকিলেন। মিনিট দুয়েক পরে বাহির হইয়া আসিলেন। ইহার পরে বাহিরে আসিয়া পাম্প শু পরিতে উদ্যত হইতেছেন, এমন সময় পাশে দণ্ডায়মান উমাপদ বলিয়া উঠিলেন, কেডস পরুন। মর্নিং ওয়াকের সময় যেটা পরেন। আমরা একটু বেড়াতে যাব।

সত্যমাধব আর কথা না বাড়াইয়া সিঁড়ির তলা হইতে তাঁহার কেডস বাহির করিলেন।

উমাপদ সাইকেল রাখিয়া নবেন্দুকে বলিলেন, নবেন্দু তোমার বাইকে আমরা যাব এখন। ঘণ্টাখানেকের ব্যাপার।

নবেন্দু জানাইল যে তাহার এই মুহূর্তে অন্য কোনো কাজ নাই।

নবেন্দু তাহার রাজদূতে চাপিবার অনতিপূর্বে উমাপদ তাহার কানের কাছে বলিলেন, গোপগড়ের রাস্তায় চলো স্টেশন ক্রস করে।

নবেন্দু চালকের সিটে চাপিল। ইহার পরে যথাক্রমে সত্যমাধব এবং উমাপদ সওয়ারি হইলেন।

জগন্নাথ মন্দির হইতে স্কুলবাজার হইয়া দ্রুত বটতলার চকে নবেন্দুর বাইক পৌঁছাইল। ইহার পরে কেরানিতলা অভিমুখে বাইক চলিল। সত্য একবার বলিলেন, আমরা কোথায় যাচ্ছি, উমা?

―চলুন না। আমাদের পরিচিত জায়গা। বহুকাল আগে আপনি আর আমি একসঙ্গে গিয়েছিলাম।

সত্য মনে করিতে চেষ্টা করিলেন, উমাপদ ও তিনি অতীতে একসঙ্গে কোথায় গিয়াছেন। স্মৃতি হাতড়াইয়াও বিশেষ কিছু পাইলেন না।

বাইক মহুয়া সিনেমা অতিক্রম করিয়া দ্রুত জল ট্যাঙ্ক পার করিল; লেভেল ক্রসিং-এর নিকটে পৌঁছাইল। অতঃপর লেভেল ক্রসিং পার করিয়া দ্রুত শহরের বাহিরে আসিয়া পড়িল।

―কোথায় নিয়ে যাচ্ছ, উমা? একবার আর্তস্বরে সত্য প্রশ্ন করিলেন।

উমাপদ এ-কথার উত্তর করিলেন না।

মিনিট কয়েকের মধ্যেই অতীব ঢালু ও বিসর্পিল পিচ রাস্তা ধরিয়া বাইক নামিতে লাগিল। ডানদিকে দৃষ্টিগোচর হইল গোপগড়ের টিলা। ইতস্তত বড়ো বড়ো আকৃতির পাথর পড়িয়া আছে। নির্জন টিলার উপরে দেখা যাইতেছে একটি প্রাচীন বাড়ির ভগ্নাবশেষ। রোদ মরিয়া গিয়াছে। উমাপদ বলিলেন, নবেন্দু, এখানে দাঁড়াও।

নবেন্দু বাইক থামাইল। উমাপদ ও সত্যমাধব নামিলেন। নবেন্দু বাইকটি পিচ রাস্তা হইতে টিলার গা ঘেঁষিয়া দাঁড় করাইল। কয়েকটি বোল্ডার ও নুড়ি টিলা হইতে নামিয়া আসিয়াছে। ইতিউতি কিছু ‘ল্যানটেনা ক্যামেরা’-সম্বলিত বুনো ঝোপ। এছাড়া কয়েকটি নয়নতারা গাছ।

গোপগড় নামের এই টিলাসম্বলিত উচ্চ অঞ্চলটি প্রকৃতপক্ষে ছোটনাগপুরের মালভূমির এক অংশ, যাহা শহরের এই প্রান্তে আসিয়া শেষ হইয়াছে। টিলাটির আনুমানিক উচ্চতা দেড়শ মিটার। এই অঞ্চল বড়ো বড়ো পাথর সম্বলিত, এবং এই অংশের মাটি রুক্ষ ও লালবর্ণ, যে রুক্ষতা বেলপাহাড়ি ও ঝাড়গ্রাম অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য। টিলার মাথায় যে বাড়ির ভগ্নাবশেষ দেখা যায় তাহা সাধারণে বিরাট রাজার বাড়ি নামে অভিহিত। যদিও এমন দাবির কোনও বস্তুগত তথা ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই।

উমাপদ বলিলেন, সত্যদা, আমরা গোপ কলেজের পাশে গোপগড়ের অন্য দিকটায় একবার ক্লাস সেভেনের ছেলেদের নিয়ে এসেছিলাম, আপনার মনে আছে?

সত্যর স্মরণে আসিল। সে প্রায় দুই দশক আগের কথা। তখন সত্যমাধব তরুণ, উমাপদ হয়তো আজিকার নবেন্দুর বয়সী। কী উপলক্ষে আসা হইয়াছিল, কিছুতেই মনে করিতে পারিলেন না।

―কিন্তু, এখানে আমাকে নিয়ে এলে কী করতে?

―এমনিই। জায়গাটায় যতবার আসি ভালো লাগে। অনেকদিন আমারও আসা হয়নি।

ইহার পরে উমা বলিলেন, নবেন্দু, ওপরে উঠবে নাকি?

―উঠলেই হয়, নবেন্দু বলিল।

উমাপদ এবার সত্যমাধবের দিকে তাকাইলেন, চলুন সত্যদা, ওপরে উঠি।

―আমি এই শরীরে উঠতে পারব না উমা। তোমরা ওঠো। আমি নীচে দাঁড়াই।

―এক যাত্রায় পৃথক ফল কী করে হয়? চলুন, এইটুকু পথ। খুব কঠিন কিছু নয়।

―আমি পারব না উমা। শরীরের অবস্থাও ভালো না আমার।

―আপনার শরীরে কিচ্ছু হয়নি। মনটাকে হালকা করুন। চলুন, সবাই মিলে উঠব। চলো হে নবেন্দু।

―ধুতি পরে কী করে অত উঁচুতে উঠব?

―আপনি তো ধুতি পরে রিপন কলেজে ফুটবল খেলেছেন। সামান্য পথ। চলুন উঠব একসঙ্গে।

অসহায় হইয়া সত্য দাঁড়াইয়া দোনামনা করিতেছেন। উমাপদ সত্যর পিঠে হাত রাখিলেন, তারপর বলিলেন―

আমাদের ওপর ভরসা রাখুন সত্যদা। আপনি পারবেন। বৌদিকে কথা দিয়ে এসেছি, আপনাকে সুস্থ ফিরিয়ে আনব।

একটু থামিয়াই উমাপদ বলিলেন, নবেন্দু, তুমি সত্যদার ঠিক পেছনে থাকো। অসুবিধে হলে দেখবে।

উমাপদ ধীরে ধীরে টিলায় উঠিতে লাগিলেন। ঠিক নির্দিষ্ট পথ নাই। তাহা হইলেও খাঁজ ধরিয়া উঠিতে বিশেষ অসুবিধা হয় না। সত্যর বুক ধড়ফড় করিতেছিল। কিছুটা উঠিলেন। পেছনে নবেন্দু আসিতেছে।

সামান্য উঠিয়া হাঁফ ধরিয়া গেল। উমাপদ কিছুটা এগাইয়া গিয়াছে। ডানদিকে একটা পাথরে হাত রাখিয়া বাঁ পা রাখিলেন। আরেক পা এগাইলেন। দুই-চার পা চলিবার পর টিলার ঢাল কিছুটা দুরূহ বোধ হইল। আশেপাশে কিছু গুল্মজাতীয় ঝোপ। টলিতে টলিতে সত্য একটা গাছ ধরিবার চেষ্টা করিলেন। সামান্য পা স্লিপ করিল। মুখ হইতে শব্দ বাহির হইল, আ আ পড়ে যাচ্ছি।

নবেন্দু বলিল, পা চেপে হাঁটুন। ভয় নেই। পড়বেন না। খাঁজে পা দিন।

সত্য আরও কিছুটা এগাইলেন। উমাপদ কোথায় অন্তর্হিত হইল? দম যেন শেষ হইয়া আসিতেছে।

কিছুটা পথ আরও হ্যাঁচড়-প্যাঁচড় করিয়া চলিলেন। টিলার মাথা আসিয়া গেল। উপর হইতে উমাপদ সহাস্য বদনে বলিলেন, এই তো সত্যদা, উঠে গেছেন। দেখুন, পারলেন। ইহার পরে ঘড়ি দেখিয়া উমাপদ বলিলেন, ঠিক ষোল মিনিট সময় নিয়েছেন।
নবেন্দুও উঠিয়া আসিল।
দম লইতে লইতে রাস্তার পেছন দিকে মুখ করিয়া টিলার পুরাতন বিরাট রাজার বাড়ির দিকে দেখিতেছিলেন সত্যমাধব। পূর্বে রাস্তা হইতে বাড়িটি দেখিয়াছেন। বটগাছ নামিয়া পুরানো ইটের দেওয়ালে ঝুরি বিস্তার করিয়াছে। চতুর্দিকে ফাটল, জরাজীর্ণ ইটের স্তূপ। উমার কথায় সম্বিৎ ফিরিল, সত্যদা, আপনার শরীর কিন্তু ঠিক আছে। হয়তো মন একটু খারাপ। ও কেটে যাবে। মর্নিং ওয়াক শুরু করুন আবার।

―একটা ক্রাইসিসের মধ্যে আছি উমা। জানি না… ঠিক বুঝতে পারছি না।

―কোনো ক্রাইসিস হয়নি সত্যদা। বাস্তবকে নিজের মেরিটে দেখুন। তাকে স্বীকার করুন, উমা একটু থামিলেন, তারপর বলিলেন, ঘরের ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসুন সত্যদা।

নবেন্দু বলিল, সত্যবাবু, স্কুল আপনাকে মিস করছে। আমরা। আপনার ছাত্ররা। স্কুলে আসুন তাড়াতাড়ি।

উমাপদ আঙ্গুল তুলিয়া বলিলেন, সত্যদা ওদিকটা একবার তাকিয়ে দেখুন।

সত্যমাধব ফিরিয়া তাকাইলেন। টিলার নীচে, বেশ কিছু নীচে আঁকাবাঁকা কালো পিচের রোগা পথ। আরও দূরে দৃষ্টিপথে পড়িল সবুজ জনবসতি পার করিয়া ফিতার মতন বাঁক লইয়া বহিয়া যাইতেছে কাঁসাই। সূর্য অস্ত যাইতেছে। জলের উপরে সূর্যাস্তের আভা পড়িয়াছে। এমন রাঙা আলোর এই চরাচর, যাহা পৃথিবীর সকল অবসাদ ধুইয়া দিতে চায়।

নামিবার সময় সত্য বিশেষ অসুবিধা বোধ করিলেন না। ফিরিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল।

টিলায় উঠিবার ও নামিবার শ্রম হইয়াছিল। হয়তো তাই সেই রাত্রে ঘুম হইল চমৎকার। পরের দিন ভোরে ঘুম ভাঙিয়া প্রাতকৃত্য সারিয়া বারান্দায় আসিলেন সত্যমাধব। হঠাৎ তাকাইয়া দেখিলেন, গেট খুলিয়া উমাপদ ঢুকিতেছে।

—উমা? এই সকালে?

—চলুন। একসঙ্গে মর্নিং ওয়াক যাওয়া হয়নি কতকাল। গান্ধীঘাট যাবেন নাকি?

বেণুর অনুরোধে এক কাপ চা উমাপদকে খাইতেই হইল। ইহার পরে জগন্নাথ মন্দির হইতে দুইজনে পিচ রাস্তা ধরিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে চলিলেন গান্ধীঘাট অভিমুখে। কারবালার মাঠ পার হইয়া মাটির বাঁধে উঠিলেন। ইহার পর লাল ধুলোর রাস্তা। মিনিট কুড়ির মধ্যে কাঁসাইয়ের পাড়ে আসিয়া দুইজনে পাশাপাশি বসিলেন। সত্য বলিলেন, আজ শরীরটা অনেকটা ভালো লাগছে উমা।

উমা বলিলেন, আজ স্কুলে আসুন।

―উমা, একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। তোমার সঙ্গে বিষয়টা আলোচনা করতে চাই।

― বেশ তো। বলুন।

― পরে জানাব তোমাকে। একটা বিয়ে সংক্রান্ত।

― বেশ। বলবেন। শুধু এটুকু বলি সত্যদা, যে সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ নিজের ওপরেই নির্ভর করে, সেখানে আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা অনেক বেশি। কিন্তু, যেখানে অন্যের বিষয় জড়িত, সেখানে সিদ্ধান্ত ভেবেচিন্তে নেওয়া উচিত।

ফিরিবার সময় উমা গান্ধীঘাটসংলগ্ন নিজ গৃহে ঢুকিয়া গেলেন। সত্য দ্রুত হাঁটিতেছিলেন। জগন্নাথ মন্দিরের ঠিক নীচে আসিয়া চোখে পড়িল ফাঁকা রাস্তার একপাশে একটি ছোটো আকৃতির টিয়া মাটিতে বসিয়া আছে। একটি কাক তাহাকে ঠুকরাইতেছে। টিয়াটি যুঝিতে পারিতেছে না। সত্য দেখিয়াই মুখে হুশ করিয়া একটা শব্দ করিলেন। কাকটি উড়িয়া পালাইল। কিন্তু টিয়াটি বসিয়া রহিল। তিনি নিকটে গিয়া ঝুঁকিলেন। পাখিটিকে স্পর্শ করিলেন। পাখিটি মৃদু ছটফট করিল। তথাপি উড়িল না।

টিয়াটি হাতে করিয়া তুলিয়া সত্য বাড়ি ঢুকিলেন। হাতে পাখিবুকের ধুকপুকুনি অনুভূত হইতেছিল। কিছুটা জল পাত্রে দিয়া মেঝেতে টিয়াটিকে রাখিলেন। টিয়াটি জল স্পর্শ করিল না। অতঃপর তিনি ড্রপারে খানিকটা জল লইয়া পাখির ঠোঁটের কাছে অল্প অল্প দিতে লাগিলেন। পাখিটি ঠোঁট তুলিয়া সামান্য জল খাইল।
টিয়াটি পূর্বের শূন্য খাঁচাটিতে জায়গা পাইল।
সন্ধ্যাবেলায় স্কুল হইতে ফিরিয়া কিছু ভেজানো ছোলা সত্যমাধব রান্নাঘর হইতে বারান্দায় আনিলেন। একটি দানা টিয়ার ঠোঁটের নিকট লইয়া গেলেন। টিয়াটি গরাদের ফাঁক দিয়া লাল ঠোঁট খুলিল। ছোলা মুখে লইল। ঠোঁটে উগরাইয়া কিছুটা খাইল বলিয়া মনে হইল। দ্বিতীয়বার ছোলা আঙ্গুলে লইয়া দিতে উদ্যত হইলেন। টিয়াটি এবার তার আঙুল দংশন করিল।

শিহরিত হইয়া সত্য অস্ফুটে উচ্চারণ করিলেন, শৈবা!

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

One Comment

  1. এই কিস্তিটি চেনা ব্যক্তিদের ভিড়ে, চেনা সময়ের ঘ্রাণ নিয়ে বড়ই মনোলোভা হয়ে উঠেছে। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ডিটেইলসের দিকে লেখকের নজর শ্রদ্ধা কাড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২