পাঁচ
কাজ না থাকলে যা হয় আর কি। পরদিন সকালে আমরা সকলেই ঘুম থেকে উঠলাম অনেক দেরিতে। তবে এছাড়াও একখানা কারণ আছে। একপ্রস্থ নাটক হয়ে গিয়েছে ভোর ভোর। তাপসের সহকর্মী অগ্রজ শ্রদ্ধেয় তপনদা গিয়েছিল টয়লেটে। এবারে সেখানে তো গুচ্ছের কল এবং আরও যা যা থাকে। এবারে তপনদা ঘুম চোখে কোন্টা ঘোরাতে গিয়ে কোন্টা ঘুরিয়ে দিয়েছে। ঐ ঠান্ডায় শাওয়ারের জল গায়ে পড়ে ভিজে পুরো একসা। আর তার সাথে পরিত্রাহি চিৎকার—বাবা গো মা গো ফোয়ারা গো। যাই হোক, সেই কম্পনরত তপনদাকে তো সেখান থেকে এনে গা হাত পা মুছিয়ে শোয়ানো হয়েছে বেডে। কিন্তু তপনদা শুধু কেঁপেই যাচ্ছে। কোনো কথাই বলতে পারছে না। আর গা-হাত-পা ঠান্ডা হয়ে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। কোনো উপায় না থাকাতে তপনদাকে তখন গরম হবার খানিক আরক খাইয়ে দেওয়া হল। খানিকপর ঠিক হল তপনদা আর আমরাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
তারপর ঘুম থেকে উঠে শুধু যেন মনে হচ্ছে আজ সারাদিন আমাদের কোনো কাজ নেই। সমস্ত কাজ কাল। কারণ কালই তো আমাদের বিমান ধরে মুক্তিনাথ যাওয়া। সেটাই মাথার ভেতরে তখন মুখ্য হয়ে স্থান ধারণ করে আছে। কোল্ড ডেসার্ট কেমন হয় দেখব। দেখতে হবে ভূগোল বইয়ে পড়া হলুদ ভূমিরূপে ছোটো ছোটো কাঁটাওয়ালা গাছের দেশ। আবার যতটুকু জানি মুক্তিনাথই পৃথিবীর একমাত্র জায়গা যেখানে নারায়ণ শিলা পাওয়া যায়।
তাই কী কী দেখব এই নিয়েই আমরা আলোচনা করতে করতে যখন রাস্তায় এলাম ততক্ষণে প্রায় বেলা এগারোটা বেজে গিয়েছে। পোখরার ডিসেম্বর মাসের ঠান্ডায় মাঝে মাঝেই আমাদের কাঁপুনি দিয়ে যাচ্ছে মচ্ছপুছারের দিক থেকে ভেসে আসা হিমেল বাতাস। সাথে আবার একখানা মিষ্টি রোদও আছে। এইসব চারিদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ এক পাহাড়ের মাথায় দৃষ্টি পড়াতে দেখা গেল এক সুউচ্চ মন্দির মতো সেখানে এবং খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল ওটিই পোখরার বিখ্যাত ওয়ার্ল্ড পিস প্যাগোডা। এবং সেখানেই আমাদের তখনও অব্দি যাওয়া হয়নি। অতএব আর কী? সমস্ত আলস্যকে সেই মুহূর্তের জন্য চোখের জলে বিদায় জানিয়ে ঠিক হল যে আমরা ওই ওয়ার্ল্ড পিস প্যাগোডায় যাব। যেতে হবে এপাড় থেকে নৌকো নিয়ে। তারপর পাহাড় চড়তে হবে।
যাই হোক, নৌকোয় করে তো পৌঁছলাম অভিষ্ট গন্তব্যে। এবং তারপরই ধাক্কাটা লাগল। ওপরে যাবার দুরকম ব্যবস্থা। এক পায়ে হেঁটে দুই হেলিকপ্টারে করে। তার মানে সামান্য পায়ে হেঁটেই যে প্যাগোডায় পৌঁছে যাব ব্যাপারটা ঠিক সেরকমের নয়। কিন্তু কী আর উপায়?
অতঃপর শুরু হইল আমাদের চড়ন। এবং চিরকালের কুঁড়ে আমি সেই প্রথম জানলাম পাহাড় চড়া কী বিষম বস্তু হতে পারে। যদিও তারপর থেকে বন্ধুদের পাল্লায় তার চাইতেও অনেক উঁচু পাহাড় চড়েছি বা ট্রেক করেছি, কিন্তু সেই প্রথম পাহাড়ে ওঠা এখনও মনে স্পষ্ট হয়ে আছে।
যদিও খুব যে একটা উঁচু এমন নয়। সুন্দর চারিদিক। যত উঠছি যেন পাখির চোখে দেখতে পাচ্ছি পোখরা শহরকে। তাপস ভিডিও করছিল। আর তপনদা একটু গুম হয়ে চলছিল। কারণ তাপস আগেই তপনদাকে না করে দিয়েছে কোনোরকম বাজে কথা বলতে। আর তাই তপনদার কথা বলাতেই সমস্যা হচ্ছে।
যা হোক, ঘেমে-নেয়ে একসা হয়ে পাহাড়ের ওপরের সেই ওয়ার্ল্ড পিস প্যাগোডায় পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের প্রায় দুপুর হয়ে গেল। কিন্তু আনুমানিক দু ঘণ্টার চড়াই পর্বের পর যে দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম তা এককথায় অনির্বচনীয়। সামনে শ্বেতশুভ্র পিস প্যাগোডা। তাতে তথাগত বিরাজমান এক বিশেষ ভঙ্গিতে। অনেক নীচে পোখরা শহর। আর মচ্ছপুছারে যেন এবারে আর আমাদের মাথার ওপরে নয়। ঠিক চোখ বরাবর।
![](https://aponpath.com/wp-content/uploads/2022/07/ওয়ার্ল্ড-পিস-প্যাগোডা-scaled.jpg)
ভালো লাগছিল। এই প্রচণ্ড ক্লান্তিকর চড়াইয়ের পর ওমন একখানা দৃশ্যের মাঝে বসে ক্লান্তিতে ঝিমুতে ঝিমুতে কেন জানি কানে বাজছিল শক্তির সেই লাইন- “ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি”। ছবিটবি তুলে এবারে নামার পালা। কাল আবার যাওয়া আছে যে।
![](https://aponpath.com/wp-content/uploads/2022/07/পাখির-চোখে-পোখরা-scaled.jpg)