কুমায়ুন ভ্রমণ ও তার নানা কিস্‌সা – শিবু মণ্ডল (পর্ব ৮)

কুমায়ুন ভ্রমণ ও তার নানা কিস্‌সা – শিবু মণ্ডল (পর্ব ৮)

শেয়ার করুন

অষ্টম পর্ব

যত কাণ্ড ক্র্যাঙ্কস্‌ রিজে

স্বামী বিবেকানন্দের দেখানো পথ ধরেই কাঁসারদেবীর এই পাহাড় নানা লেখক, দার্শনিক, শিল্পী, সত্যানুসন্ধিৎসুদের কাছে যেন এক অনিবার্য গন্তব্য হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে নানা বিদগ্ধ মনীষীরা এখানে এসে ডেরা বাঁধেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ওয়াল্টার ইভান্স ভেন্তজ্‌, আলফ্রেড সোরেনসেন (শূন্যতা বাবা), জার্মান চিত্রশিল্পী, কবি ও দার্শনিক আরনেস্ট লুথার হফম্যান ও তাঁর পার্শি স্ত্রী রত্তি পেতিত যারা পরবর্তীতে লামা অনাগরিক গোবিন্দ ও লি গৌতমি গোবিন্দ নামে জনপ্রিয় হন।

কাঁসারদেবীতে ধ্যানালোকপ্রাপ্ত হয়ে বিবেকানন্দ যে-সময় পাশ্চাত্যে সনাতন ধর্মের প্রচার ও তাঁর হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের কাজে ব্যস্ত ঠিক সে-সময় আমেরিকাতে এক রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর সতের বছরের কিশোর পুত্রের মনে আসে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে এক গভীর ও নিষ্ঠাভরা জিজ্ঞাসা। আমেরিকার পুঁজিবাদী সমাজের রেসের ময়দান থেকে সে পালিয়ে যেতে চাইছে। সে পছন্দ করে সবসময় প্রকৃতির নির্জনতায় থাকতে। সেই কিশোরটি তখন বিবেকানন্দকে জানত কিনা জানা নেই তবে সে যে থিওসফিক্যাল ধ্যানধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল সেটা জানা যায়। সেই সময়কার তাঁর অভিজ্ঞতার কিছুটা এরকম- “I would take off all my clothing and lie there naked as I was born with my eyes shut, sometimes thinking of nothing. I always felt, as I still do, a very intimate relationship between my body and the sun as the source of life energy… the magnetism from the earth under me and the magnetism from the sun above me filled my body with such freshness and vigor that I would return home calm and happy and well”। যা তাঁর ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সেই কিশোরটিই ওয়াল্টার ইভান্স ভেন্তজ্‌ যিনি ১৯১৮ সাল নাগাদ বিভিন্ন দেশের ধর্মতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করতে করতে শ্রীলঙ্কা হয়ে ভারতে আসবেন। আলমোড়াতে এসে কাঁসারদেবী পাহাড়ে একটি এস্টেট কিনে সেখানে বসবাস করবেন ১৯৪১ সাল পর্যন্ত। এই সময়কালের মধ্যে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ঘুরে তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্ম নিয়ে প্রচুর গবেষণার পাশাপাশি ভারতীয় যোগ, বেদান্ত নিয়েও উৎসাহ দেখা যায় তাঁর। বৌদ্ধধর্মের নানা মূল্যবান পাণ্ডুলিপি উদ্ধার ও তাদের সংরক্ষণে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়ে গেছে। সিকিমের বৌদ্ধ ধর্মগুরু লামা সামদুপ-এর সাথে যৌথভাবে বিভিন্ন তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ করতে করতে তিনি বৌদ্ধধর্মের একজন প্রকৃত অনুগামী হয়ে ওঠেন। তবে তিনি জগৎজোড়া খ্যাতি পান বৌদ্ধধর্মের যেই অনুবাদ গ্রন্থটি সম্পাদনার মাধ্যমে সেটি হল ‘Tibetan Book of the Dead’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে আমেরিকায় ফিরে যাবার পরেও বেশ কয়েকবার ভারতে পাকাপাকিভাবে চলে আসার পরিকল্পনা করেন ওয়াল্টার। কিন্তু তা আর বাস্তবায়িত হয়ে ওঠেনি। অধরা থেকে যায় কাঁসারদেবীতে তাঁর আশ্রমে একটি বৌদ্ধমঠ ও ধ্যানকেন্দ্র গড়ে তুলবার স্বপ্নও। তবে তাঁর স্বপ্নটি বাস্তবায়িত করেন লামা অনাগরিক গোবিন্দ ও তাঁর চিত্রশিল্পী ও ফটোগ্রাফার স্ত্রী লি গৌতমী গোবিন্দ। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী হলেও দুজনেই ছিলেন অসম্ভব পাণ্ডিত্য ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। আধ্যাত্মিক জগতের পাশাপাশি চিত্রকলা, সাহিত্য, নৃত্য সহ নানা শিল্পকলার প্রতি তাঁরা ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। ১৯৩৪ এ শান্তিনিকেতনে গুরুদেবের আশ্রমে দুজনের পরিচয়—লামা অনাগরিক গোবিন্দ সেখানে শিক্ষক, আর রত্তি পেতিত সেখানে চিত্রকলা ও সঙ্গীতের ছাত্রী। সেই পরিচয় পরিণতি পায় ১৯৪৭ এ শুভ পরিণয়ে। বিবাহের পরেই রত্তি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন ও দুজনে কাঁসারদেবীতে চলে আসেন ওয়াল্টার ইভান্সের আশ্রমে। ওয়াল্টার ইভান্স-এর সাথে লামা অনাগরিক গোবিন্দের সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯৩১ এ দার্জিলিং-এ সর্বভারতীয় বৌদ্ধধর্ম মহাসমাবেশে। সেই থেকেই এই দুই বৌদ্ধ স্কলারের মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। আর সেই সম্পর্কের সূত্রেই ইভান্সের কাঁসারদেবীর আশ্রমে থাকতে শুরু করেন গোবিন্দ দম্পতি। এবং পরবর্তীতে সেখানে ড্রুকপা কাগ্ইয়্যু মতধারার একটি বৌদ্ধমঠ ও ধ্যানকেন্দ্র গড়ে তোলেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সময়কালের মধ্যে গোবিন্দ দম্পতি বেশ কয়েকবার তিব্বত ভ্রমণে গিয়েছিলেন। সেই সময়ের সেই দুঃসাহসিক ও রোমাঞ্চকর তিব্বত যাত্রাকে ভ্রমণের চাইতে অভিযানই বলা সঙ্গত হবে। প্রতি মুহূর্তের প্রতিকূল পরিস্থিতি ও আবহাওয়ায় অনিশ্চিত জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা তাঁদের দিয়ে প্রচুর ছবি আঁকিয়ে নিয়েছেন। লি গৌতমী সেইসব দুর্লভ দৃশ্য ও মুহূর্তকে ক্যামেরায় বন্দি করেছেন। লামা অনাগরিক গোবিন্দ পরে সেইসব রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন তাঁর বিশ্ববিখ্যাত বই, ‘The way of the White Clouds’-তে।

লামা অনাগরিক গোবিন্দ বৌদ্ধ ধর্মমতে দীক্ষিত হয়েছিলেন কিন্তু ডেনিশ নাগরিক আলফ্রেড সোরেনসেন কোনও বিশেষ ধর্মমতের অনুগামী না হয়েও, কোনও ধর্মীয় গুরুর কাছে দীক্ষিত না হয়েও একজন উচ্চমানের জন্মসিদ্ধ তপস্বী ছিলেন। সামান্য কৃষক পরিবারে জন্ম হলেও তাঁর পিতা একসময় সমস্ত জমিজমা বিক্রি করে দিলে দেশে দেশে ঘুরে গার্ডেনার হিসেবে জীবন নির্বাহ করতে থাকেন গাছপালার সাথে নীরবে কথা বলতে পারা আলফ্রেড। এই সময় ১৯২৯ সালে রবীন্দ্রনাথের সাথে নাটকীয়ভাবে তাঁর সাক্ষাৎ হয় ডারটিংটনে। আলফ্রেড রবীন্দ্রনাথকে বেঠোভেন এর কিছু রেকর্ড শোনান। সরল ও সহজ চৈতন্যের অধিকারী আলফ্রেডের সাথে আলাপ করে রবীন্দ্রনাথের মনে ধরে তাঁকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ জানায় নির্জনতা বিষয়ে পড়ানোর জন্য। ওয়াল্টার, আলফ্রেড ও আরনেস্ট এর মধ্যে একটি অদ্ভুত মিল হল যে এই তিনজনেই রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে বিশ্বভারতীতে কোনও না কোনও সময়ে সাময়িক শিক্ষকতার কাজ করেছেন। তবে আলফ্রেড কয়েক মাসের মধ্যেই এই কাজ থেকে অব্যাহতি নেন ও ভারতভ্রমণ শেষে ফিরে যান নিজের দেশে। পরে ১৯৩৪ সালে আলফ্রেড পাকাপাকিভাবে চলে আসেন ভারতে। এই দেশই যে তাঁর উপযুক্ত দেশ সেটা সে বুঝে গিয়েছিল ততদিনে। প্রথম ভারত সফরে রবীন্দ্রনাথ আলফ্রেডকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল পণ্ডিত নেহেরুর সাথে। আর এবারে সেই সূত্রেই সে চলে আসে বিনসারে। বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের তত্ত্বাবধানে থাকা খালি এস্টেটে গার্ডেনারের কাজে নিযুক্ত হন। শেষে নেহেরু পরিবারের মাধ্যমে পরিচয় হওয়া এক বন্ধুর দান করা ক্র্যাঙ্কস্‌ রিজের (কাঁসারদেবী পাহাড়টি এই নামেও পরিচিত) একফালি জমিতে গুহার মতো করে একটি পাথরের কুটির তৈরি করে সেখানেই একান্তে থাকতে শুরু করেন শূন্যতা। আলফ্রেড যখন সাধক রমণ মহর্ষির সাথে প্রথম সাক্ষাৎ করেন তখন এই শূন্যতা নামটি দিয়েছিলেন মহর্ষিই তাঁকে! গাছপালা ও পাখিসহ বেষ্টিত এই পাহাড়ি গুহায় শুধু আলফ্রেড, তার সঙ্গী একটি কুকুর ও তাঁর শূন্যতা! তবে শোনা যায় যে এই কুকুর নাকি কিছুতেই ঘেউ ঘেউ করত না। সেও শূন্যতার মতো নির্জনতার ভাষা জানত যে!

ওয়াল্টার ইভান্স ভেন্তজ্‌
লামা অনাগরিক গোবিন্দ ও লি গৌতমি গোবিন্দ
শূন্যতা বাবা

কাঁসার দেবীর মন্দির থেকে পাহাড়ের দক্ষিণ দিকে হেঁটে গেলেই ক্র্যাঙ্কস্‌ রিজ। ১৯৬০ সাল নাগাদ হিপি আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে ওঠার পর এই পাহাড় হিপি হিল নামে পরিচিতি লাভ করে। হিপি আন্দোলনের জোয়ারে কিছু পাশ্চাত্য বোহেমিয়ান শিল্পী, কবি, লেখক, গায়ক ও ভবঘুরের দল এখানে ভিড় জমাতে শুরু করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মনস্তত্ত্ব গবেষক টিমোথি ল্যারি—যিনি এলএসডি (LSD) সহ নানা সাইকোডেলিক ড্রাগ সেবন করার বিশেষ প্রবক্তা ও উৎসাহদাতা হিসেবে আমেরিকায় বিতর্কিত ছিলেন। এমন উদ্ভট গবেষণার কারণে তিনি ও তাঁর এক সহকর্মী অধ্যাপক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হন। এমনকি প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তখন টিমোথিকে “most dangerous man in America” বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। এরপর তারা ষাটের দশকে ক্র্যাঙ্ক রিজে এসে সাময়িক ডেরা বাঁধেন ও বিভিন্ন ড্রাগসকে ধ্যান ও আধ্যাত্মিক চৈতন্য লাভের অনুঘটকরূপে ব্যবহার করে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে থাকেন। তাঁদের এই বিচিত্র ধারার আত্মানুসন্ধানের পথকে অনুসরণ করে আরও অনেক পাশ্চাত্য শিল্পী, কবি, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের একটি দল ক্র্যাঙ্ক রিজে এসে বসবাস করতে শুরু করেন। বিট জেনারেশন লেখক ও কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ, পিটার অর্লোভস্কি, গায়ক বব ডিলান, রবার্ট থুরম্যান-রা এখানে এসেছিলেন ধ্যান অভ্যাস করে কিছু পাবার লক্ষ্যে। যে পথেই হোক, তারা তা কিছুটা হয়তো পেয়েছেন কিছুটা হয়তো পাননি। আর নতুন নতুন সৃষ্টির উল্লাসে বিশ্বকে আলোড়িত করেছেন। সেই বোহেমিয়ান ধারা আজও কিছুটা চোখে পড়ে কাঁসারদেবী পাহাড়ে।

কাঁসারদেবী থেকে যখন নেমে আসছি চারদিকে আলো আর আলো। নামতে নামতে ভাবছি আমি কি কিছু চাইতে এসেছিলাম কাঁসারদেবীর কাছে? জানি না। তবে এই যে চলার পথে দেখছি কত কিছু, জানছি কত কিছু, শিখছি অনেক এসবও তো এক না চাইতেই পাওয়া। কত মানুষের সাথে দেখা হল, কত অচেনা আপন হল। এই পাহাড়ের আলোকিত গাছপালা, রহস্যময়ী বাঁকের আকর্ষণ ও শিলার নির্বাক উপস্থিতি এরাও তো আমার জীবনের অঙ্গ হল। কালের অতীত থেকে কত ছবি ও চরিত্র উঠে এসে আমায় সঙ্গ দিল। কত কিছু ঘটল, কত কিছু ঘটছে—সবই তো আমার মধ্যেই ঘটছে। তবে আমি আর আলাদা করে কী চাইব! ভিন্ন আর কী খুঁজব? হাঁটতে হাঁটতে একসময় রাস্তায় নেমে এলাম। পাশেই ভগবান বুদ্ধের শান্তিবাণী ও মন্ত্র লেখা নানা রঙের পঞ্চরত্ন পতাকায় সাজানো সুন্দর ডোলমা রেস্টুরেন্ট। সময়ের কোনও হিসেব আর কারো মধ্যেই নেই। শুধু পেটে একটা চোরা টান।

কাঁসারদেবী মন্দির


গাড়ি ছুটে চলছে এক পাহাড় ছেড়ে সামনের আরেক পাহাড়ে। আমরাও জীবনে ছিলাম আবার জীবনেই ফিরছি। পথে কিছু পাব কিছু পাব না তবে এসবের মধ্যে একমাত্র মানসিক সাম্যই আমাদের কাম্য। এই পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ জীবনেরই এক প্রতিলিপি যেন। যা কিছু আসবে এই পথে ও পথের দু’ধারে তাঁকে গ্রহণ ও বর্জনের ঊর্ধ্বে উঠে একজন প্রকৃত দর্শকের মতো দেখো। দ্রষ্টা হও। এই সবই তো বলে গেছেন আমাদের পূর্বজ মনীষীরা ও আধ্যাত্মবাদের মার্গদর্শকেরা। আমরাও একটা মার্গে চলছি। আমরাও একটা দর্শকের ভূমিকায় আছি…

ছবি ও তথ্যঋণ:
১। HIMVAN.COM
২। KAFALTREE.COM
৩। GOOGLE.COM

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২