বাবরিকাণ্ড এবং সম্প্রীতির সময় (২য় পর্ব) – সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী
২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর দেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর নেবেন রঞ্জন গগৈ। তিনি আগেই জানিয়েছিলেন, অবসর নেওয়ার আগেই তিনি অযোধ্যার বিতর্কিত জমি মামলার রায় দিয়ে যেতে চান। সেই অনুযায়ী তাঁর নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে প্রতিদিন শুনানি হয়েছে। ৬ আগস্ট থেকে কোনও বিরতি ছাড়াই টানা শুনানি চলে আসছিল অযোধ্যা মামলার। ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত এই মামলার শুনানির পর রায়টিকে সংরক্ষিত রাখেন প্রধান বিচারপতি। অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয়, রায়দানের কথা। তার আগে নিজের চেম্বারে ডেকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যসচিব এবং ডিজির সঙ্গে কথা বলেন প্রধান বিচারপতি। কাঁটায় কাঁটায় সকাল ১০টায় সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছে গেলেন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে শুরু অযোধ্যা মামলার ঐতিহাসিক রায়। প্রধান বিচারপতি ছাড়াও বেঞ্চে রয়েছেন বিচারপতি এসএ বোবদে, ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, অশোক ভূষণ এবং এস আব্দুল নাজির। শীর্ষ আদালতের এক নম্বর ঘরে হয় রায়দান পর্ব। সোয়া দশটায় বিচারপতিরা সেই ঘরে প্রবেশ করেন। এরপর রায়ের কপিতে সই করে রায় পড়তে শুরু করেন প্রধান বিচারপতি। তখন ঘড়িতে ঠিক সাড়ে দশটা।
পাঁচজন বিচারপতির ঐকমত্য ঐতিহাসিক রায়ের যা সারমর্ম –
• অযোধ্যার মূল বিতর্কিত জমি রামলালার। ওই জমি পাবে ‘রাম জন্মভূমি ন্যাস’। শর্তসাপেক্ষে মূল বিতর্কিত জমি পাবে হিন্দুরাই।
• সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে অন্যত্র ৫ একর জমি দেওয়া হবে।
• বিকল্প জমি পাবে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড।
• তারা সেখানে মসজিদ তৈরি করতে পারবে।
• সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড বিতর্কিত জমির অধিকার দাবি করতে পারে না।
• কেন্দ্রকে বোর্ড অব ট্রাস্ট গঠনের জন্য তিন মাস সময় দেওয়া হল।
• বিতর্কিত জমি তুলে দেওয়া হবে সেই বোর্ড অব ট্রাস্টের হাতে।
• ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে বিতর্কিত জমিতেই মন্দির নির্মাণ হবে।
• আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার খননের ফলে যে সব জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছে, তাতে স্পষ্ট, সেগুলি নন ইসলামিক। বাবরের সহযোগী মির বাকি মসজিদ তৈরি করেছিলেন, বললেন প্রধান বিচারপতি।
• বাবরি মসজিদ কোনো ফাঁকা জায়গায় তৈরি হয়নি, কবে মসজিদ তৈরি হয়েছিল, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়, হিন্দুরা বিশ্বাস করেন এখানেই রামের জন্মভূমি ছিল, বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে জমির মালিকানা ঠিক করা সম্ভব নয়। কেন-না এএসআই এ কথা বলেনি, যে তার নীচে মন্দিরই ছিল। তবে বিতর্কিত জমিতে দ্বাদশ শতকের কাঠামো ছিল, এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করে সুপ্রিম কোর্টও। সীতা রসোই, রাম চবুতরা, ভাণ্ডার গৃহের অস্তিত্ব ওই জায়গার ধর্মীয় সত্যতার প্রমাণ। কারও বিশ্বাস যেন অন্যের অধিকার না হরণ করে।
• মসজিদের নীচে কাঠামো ছিল, তবে কাঠামো থেকেই কোনও দাবি করা যায় না।
• সর্বসম্মতিক্রমে শিয়া ওয়াকফ বোর্ডের এসএলপি খারিজ সুপ্রিম কোর্টের। একই সঙ্গে নির্মোহী আখড়ার আর্জিও খারিজ বিচারপতিদের।
• এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় যুক্তিযুক্ত ছিল, আইনি ভিত্তিতেই জমির মালিকানা স্থির করা উচিত: সুপ্রিম কোর্ট।
বাবরি মসজিদ নিয়ে এই রায়দানের পরে কেটে গেছে অনেকটা সময়। ইসলাম ধর্মাবলম্বী যে জনগোষ্ঠীর সমগ্র অধিকার হরণ করে এই রায়দান করা হল তাঁরা কেউই টুঁ-শব্দটি করলেন না, যেন আরএসএস পরিচালিত এই সরকার বা তার বিচারব্যবস্থার কাছ থেকে এর বেশি আর কিছুই আশা করেন না তাঁরা। এর মধ্যে কোভিড অতিমারি এল, কয়েক কোটি ভারতবাসীর কর্মচ্যুতি হল। অতিমারির দিনে রাস্তায় পড়ে, বিনা চিকিৎসায়, ভয়াবহ ক্ষুধায়, কর্মহীনতার হতাশায় মারা গেলেন কয়েক লক্ষ ভারতবাসী। আর তার মধ্যেই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষের সংজ্ঞা বদলিয়ে দিতে উদ্যত হল আরএসএস পরিচালিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ৫ আগস্ট ২০২০ তারিখে নব্য ভারত অথবা হিন্দু ভারতের সূচনা ঘটিয়ে রামমন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন ৫০ কেজি রুপোর ইট দিয়ে। এই ভারতেই লক্ষাধিক কোভিড সংক্রমণ ঘটছে প্রতিদিন, নতুন করে বেকার হয়েছেন ২০ কোটি ভারতবাসী, নব্য কৃষিবিলের বিরুদ্ধে ধরনায় বসা কৃষকদের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় আসতে রাজি নন হিন্দু রাষ্ট্রের সৃষ্টিকর্তা প্রধানমন্ত্রীজি। দিল্লির প্রচণ্ড ঠান্ডায় কৃষক মরছেন, দেশের অন্নদাতাগণ বিপন্ন হয়ে পড়ছেন, আর ভক্তগণ তালি বাজিয়ে হিন্দু রাষ্ট্রের দিন গুনছেন।