যমুনার তীর থেকে – সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী

শেয়ার করুন

রিজিয়া বানু শুয়ে আছেন। তার চারপাশে লোকজনের ভিড়। সেই ভিড়ে তার দুই ছেলেও আছে। সূর্য মাথার ওপর তেতে উঠেছে। গনগনে রোদ। তবে তাতে রিজিয়া বানুর সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। তিনি শান্ত ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন। পাশে যমুনা নদীর তিরতিরে সোঁতা। সেই সোঁতায় নরম হাওয়া। রিজিয়া বানুর দুই ছেলে চিৎকার করে ঝগড়া করছে। ছোটো ছেলে শহিদুল লোকজন এনেছে। সে তিরতিরে সোঁতার ওপর জঞ্জাল ফেলে একটা ঘর তৈরি করতে চায়। বড়ো ছেলে মফিদুলের বিষয় উলটো। সে কিছুতেই ওই সোঁতাটা বোজাতে দেবে না। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, যমুনা সূর্যের কন্যা ও মৃত্যুর দেবতা যমের ভগিনী। কয়েকটি জনপ্রিয় কিংবদন্তিতে তিনি যমী নামেও পরিচিত। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, যমুনার পবিত্র জল মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে মানুষকে নিস্তার দেয়। আর ঠিক এই জায়গাটা ধরেই মফিদুলের বিরুদ্ধে শহিদুল বলছে ও ওই হিন্দু মেয়ে নিকা করে হিন্দু হয়ে গেছে। তাই ও যমুনার তিরতিরে সোঁতা বোজাতে দেবে না। যদিও মফিদুল তা মানতে নারাজ।

দিল্লির ওয়াজিরাবাদ থেকে যমুনার জল অত্যন্ত দূষিত।সেই ওয়াজিরাবাদ থেকে খানিক দূরেই রিজিয়া বানু তার ছোটো ছোটো দুই ছেলেকে নিয়ে উঠে এসেছিল বছর ত্রিশেক আগে। পুব দিল্লিতে তাদের বস্তিতে আগুন লেগে পুড়ে গিয়েছিল। এক কথায় কপর্দকশূন্য হয়ে এখানে এসেছিল রিজিয়া বানু। আগুন লাগার পর থেকেই তার সোহাগের মিয়াকে আর খুঁজে পায়নি রিজিয়া বানু। কেউ বলে ঘরের সঙ্গে রিজিয়া বানুর মিয়াও পুড়ে গিয়েছিল, কেউ বলে ও সেসময় ওই ঘরে ছিলই না, বাইরে ছিল। ফিরে এসে পোড়া বস্তিতে রিজিয়া বানু এবং দুই পুত্র সন্তানকে খুঁজে না পেয়ে দিল্লি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আবার কেউ বলে রিজিয়া বানুর মিয়া অন্য জায়গায় ঘর বেঁধে সুখে পরিবার জীবনযাপন করছিল। যদিও এসব গল্প কথায় কান দেওয়ার সময় রিজিয়া বানুর কখনোই ছিল না। সে বড়ো কষ্টে একটু একটু করে যমুনার মরা সোঁতার ধারে গড়ে তুলেছিল তার সংসার। তবে মরা সোঁতার ধারে রিজিয়া বানুর এই জীবন তো নতুন কিছু নয়। জল জীবনেই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিল রিজিয়া বানু। ‘জলেই জন্ম, জলেই মৃত্যু, জলেই বসবাস; নাগরিক হয়েও তারা নিজ দেশে পরবাস’—এই পরিচয়েই ছোটো থেকে বেড়ে উঠেছে রিজিয়া বানু। শত শত বছর ধরে প্রচলিত সমাজ ও সভ্যতার প্রতি এক ধরনের উদাসীনতা ছিল রিজিয়া বানুর। বেঁচে থাকা ছাড়া যেন আর কোনো চাহিদাই ছিল না। নদীর স্রোত কিংবা বহমান বাতাসের মতোই ছিল তার জীবন। দেশের অতিপরিচিত প্রান্তিক যাযাবর গোষ্ঠী বেদে। একসময় শুধুই জলে বসবাস করলেও রিজিয়া বানুর ছোটোবেলাটা আদ্দেক জলে আদ্দেক ডাঙায় কেটেছে। পাড়ায় পাড়ায় তাকে ডাকত রিজিয়া বাইদ্যানি বলে। কোনো কোনো ভদ্দরলোকদের পাড়ায় তাকে জলের জিপসি বলেও ডাকত কেউ কেউ।তাদের একটি দল ছিল। সে দলে কেউ ছিল সাপুড়ে, কেউ ছিল ওঝা, কেউ আবার জড়িবুটি তৈরি করে গ্রাম ঘরে চিকিৎসার কাজও চালাত। তারা দল বেঁধে গান গাইতে গাইতে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেত—মোরা এক ঘাটেতে রাঁধি বাড়ি, মোরা আরেক ঘাটে খাই, মোদের সুখের সীমা নাই… আমরা সাপ খেলা দেখাই। সাপ সাধারণ মানুষের ভয়ের কারণ হলেও তাদের কাছে ছিল জীবনযাপনের উপকরণ। সাপ খেলা দেখানোর জন্য তারা সাধারণত গোখরো ও অজগরই বেশি পছন্দ করত। গোখরো পছন্দের কারণ গোখরো মাথার ফণা খানিকটা মাটির উপরে শূন্যে তুলে মেলে ধরতে পারে, যাতে থাকে দৃষ্টিনন্দন নকশা। তবে গোখরো বাঁশির সুরে নয়, তাদের দুলতে মাথা, হাঁটু ও কনুইয়ের দিকে দৃষ্টি স্থির করার লক্ষ্যেই দুলতে থাকে। তবে নির্বিষ সাপও রাখত তারা। সাধারণ হিসাবে তাদের পরিচয় সাপ খেলা দেখানো জনগোষ্ঠী হলেও, মূলত গ্রামের লোকেরা তাদের গ্রাম্য চিকিৎসক বলেই মানত। তারা বংশ পরম্পরায় গাছ-গাছড়া থেকে চিকিৎসা পদ্ধতির দাবিদার। তাদের মধ্যে যারা মূলত সাপ খেলা দেখাত তারা বাঁশি সহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে এবং নানা উপায়ে সাপের খেলা দেখাত।

সাপ অবশ্য বায়ুবাহিত শব্দ-তরঙ্গ অনুভব করে না, ফলে এতে সাপের সাড়া দেয়ার প্রশ্ন আসে না। এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরিত হয়ে তাদের পারিবারিক পেশায় রূপান্তরিত হয়েছিল। এতে ছিল কঠোর গোপনীয়তা। তাদের সম্প্রদায়ের সংসার, পরিবার ও সমাজ একেবারেই ভিন্ন। তাদের ছেলেরা সাধারণত কাজ করত না। তারা মেয়েরা যখন রোজগারে বাইরে যেত তখন সংসার ও বাচ্চা সামলাত বাপ-জ্যাঠারাই। তারাই পুরো ঘর গুছিয়ে পরিপাটি করে রাখত। তার মা কিন্তু স্বামীকে ভালোবাসা দিয়ে সবসময় আগলে রাখত। স্বামীকে বশে রাখতে কখনও শরীরে মালিশ করে দিত সাপের চর্বির তেল, কখনও আবার করে রাখত তাবিজ-কবজ। তাদের সমাজে সাধারণত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, যৌথ পরিবারের মতো প্রথাগুলো খুব একটা দেখা যেত না। সে ছিল স্বাধীনচেতা। কালু মিঞাকে স্বেচ্ছায় পছন্দ করে বিয়েতে সম্মত হয়। পারিবারিক ভাবে বিয়ের আয়োজন করা হয়। বর-কনে সহ উপস্থিত সবাই নাচ-গানের মাধ্যমে উৎসবে মেতে ওঠে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত সেসব দিনের স্মৃতি মনে পড়লে রিজিয়া বানুর চোখের কোণ দুটো চকচক করে উঠত। তবে আজ আর সেসব কিছুই নেই। বিয়ে নিয়ে তাদের সম্প্রদায়ের ছিল এক ভিন্নধর্মী রীতি। মুসলমান হলেও বিয়ের রীতি ডাঙ্গাবাসী থেকে একটু ভিন্ন। কালু মিঞার নৌকো থেকে রিজিয়া বানুকে তুলে নিয়ে এসেছিল। সেটাই ছিল তাদের বিবাহের প্রাথমিক শর্ত। এরপর হুজুরের সাহায্যে কলেমা পড়ানো হয়। দেনমোহরের কোনো বালাই ছিল না।দাম্পত্যে তাদের সুখের কোনো কমতি ছিল না। তবে মান-অভিমান যে একেবারেই ছিল না তা নয়। মানুষের মন বলে কথা! বিয়ে ভেঙে দেয়ার নিয়ম বেশ সহজ। দাম্পত্য কলহের কারণে বিয়ে-বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিলে রিজিয়া বানু স্বামীর নৌকা থেকে লাফ দিয়ে বাবার নৌকায় গেলেই তালাক হয়ে যায়। তাদের বিয়ের কোনো নিবন্ধন ছিল না। কিন্তু তাদের বন্ধন ছিল হৃদয়ের, তাই এতগুলো বছরেও তা ভাঙেনি।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *