শিল্প-সাহিত্যর ইতিহাস পড়া কেন? – রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন


শিল্প-সাহিত্যর ইতিহাস পড়ে কী হবে? তার থেকে কীই বা লাভ হয়? বহু দশক ধরে ছাত্রছাত্রীরা বাংলা সাহিত্যর ইতিহাস পড়ে আসছেন। পরীক্ষার স্বার্থে কিছুদিন তার কিছু কিছু মনেও রাখেন। তারপর সব ভোঁভাঁ। বিশেষ করে যারা বাণিজ্য ও বিজ্ঞান শাখায় পড়াশুনো করেন, তাঁদের পক্ষে বড়ু চণ্ডীদাস, মুকুন্দ চক্রবর্তী, রামপ্রসাদ সেন প্রমুখের নাম জানা কি আদৌ দরকার? আরও নির্দিষ্ট করে বললে, কলা বিভাগের (এখন বলা হয় মানবিকী বিদ্যা), যেসব ছাত্রছাত্রী কলেজে ঢুকে অর্থনীতি, রাজনৈতিক ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনোবিদ্যা ইত্যাদি পড়বেন, শিল্প-সাহিত্যর ইতিহাস জেনে তাঁদেরই বা কী উপকার হবে?

প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়ার কথা ইংরিজি, উর্দু, বাঙলা, ফার্সি, হিন্দি সাহিত্য নিয়ে যাঁরা প্রাক্-স্নাতক ও স্নাতক স্তরের পাঠক্রম ঠিক করেছেন তাঁদের। পাঠক্রমের অনেককিছু সম্পর্কে আপত্তি থাকলেও, এই ব্যাপারে আমি একটা উত্তর দিতে পারি। জানি না পাঠক্রম রচয়িতাদের মাথায়ও সেটি ছিল বা আছে কিনা।

আমার উত্তর এই : শিল্প-সাহিত্যর দুটি দিক আছে; নান্দনিক ও ঐতিহাসিক। সাহিত্যকর্মর বিচার এই দুটি দিক দিয়েই করতে হয়। শিল্প-সাহিত্যর ইতিহাস জানা না থাকলে যথার্থ সাহিত্যরুচি গড়ে ওঠে না। খুব অল্প বয়সে (০-১৬) সাহিত্যর ইতিহাস পড়িয়ে কোনো লাভ হয় না। কিন্তু একটু পরিণত বয়সে শিল্প-সাহিত্যর ইতিহাস পড়লে একটি বিষয়ে অন্তর্দৃষ্টি মেলে (যদিও সকলের তা নয়)। সেটি এই : এক এক পর্ব অন্তর শিল্প-সাহিত্যর আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু, ভাষা, ভাব, রীতি ও নীতি চোখে-পড়ার মতো পাল্‌টে যায়। আর এই পাল্‌টানোর পেছনে কাজ করে বিভিন্ন সামাজিক, ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি কারণ। বিশেষ করে যে লেখকরা দীর্ঘজীবী হন ও দীর্ঘকাল ধরে লেখেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কথাটি স্পষ্ট ধরা পড়ে। রবীন্দ্রনাথের সন্ধ্যাসঙ্গীত (১৮৮২) পড়ে বঙ্কিমচন্দ্র মুগ্ধ হয়েছিলেন, আবার বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫) পড়ে ভাটপাড়ার সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতরা খুবই বিরক্ত হন। এই দুটি ঘটনা থেকে বোঝা যায় : বিষয়টি নিতান্ত ব্যক্তিগত নয়। বঙ্কিমের সাহিত্যরুচি তাঁর সময়ের তুলনায় এগিয়ে ছিল। অন্যদিকে, ভাটপাড়ার পণ্ডিতরা গদ্যে লেখা উপন্যাস ব্যাপারটিই জানতে পারেন নি। অতীতের ভারতী বা আরও আগের বঙ্গদর্শন-এ যত লেখা বেরিয়েছিল সেগুলির মধ্যে পুরনো রুচি ও নতুন রুচির সহাবস্থান দেখা যায়। রাজনীতির প্রসঙ্গে লেখা কবিতা (যেমন, হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের ‘নেভার- নেভার’ ) ছিল নতুন রুচির কবিতা। আর শিব-অন্নদা নিয়ে তাঁরই কবিতাটি ( বঙ্গদর্শন প্রকাশিত) পুরনো রুচির অনুবর্তন মাত্র। একই লেখকের একই সময়ের দুটি রুচির রচনা আদৌ অপ্রত্যাশিত নয়। কৈশোর-যৌবনের রচনায় প্রাচীন রুচিই ছিল প্রধান; পরবর্তীকালে ইংরিজি সাহিত্য পড়ার ফলে নতুন রুচি গড়ে ওঠে, পরের দফার রচনায় তার ছাপ পড়ে। আবার একই সঙ্গে পুরনো রুচির লেখাও ছাপা হয়।

যখন বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্র-রচনাবলী বেরতে শুরু করল (১৯৩৯), রবীন্দ্রনাথ তার মধ্যে একটি কবিতার প্রুফ দেখে হতবাক। প্রুফ-এর পাশেই তিনি লিখলেন ‘এ কবিতাটি অসহ্য পুনরাবৃত্তি/ সংশোধনের অতীত/ এটা পরিত্যাজ্য’। রুচি পরিবর্তন এমনই জিনিস। নিজের লেখা সম্পর্কে কিছুটা মায়া থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু ঐ কবিতাটির মধ্যেকার পুনরুক্তি পরিণত রবীন্দ্রনাথের সয় নি।

তাই শিল্প-সাহিত্যর ইতিহাস পড়লে রুচি পবিবর্তনের হদিশ পাওয়া যায়। বড় কবিই হোন বা ছোটো কবিই হোন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবির ধ্যানধারণাও অল্পবিস্তর ঘুরে যায়। তার একটি উদাহরণ আগেই দিয়েছি। এমন রুচি-পরিবর্তন সব যুগে সব লেখকের ক্ষেত্রেই ঘটে। সাহিত্যর ইতিহাস পড়লে (মানে, ঠিকমতো বুঝে পড়লে) এই রুচি-পরিবর্তনের নিশানা ধরা পড়ে।

এইখানে একটি কথা। সাহিত্যর ইতিহাস লেখার সময়ে কোন্ কোন্‌ কবি সহিত্যিককে বেছে নেওয়া হবে, আর কে কে বাদ পড়বেন তারও একটা দিকনির্দেশ পাওয়া যায়। পুরনো আমলের সাহিত্যর সঙ্কলনে এমন সব সাহিত্যিকের নাম থাকে যাঁদের বই তাঁদের আত্মীয়-স্বজন ছাড়া আর কেউ পাতা উল্‌টেও দেখেননি। এই ধরণের গ্রহণ ও বর্জনের মধ্যে দিয়েই প্রধান লেখকদের সূচি তৈরি হয়। ১৯৪০এ প্রকাশিত ইন্টারমিডিয়েট বেঙ্গলি সিলেকশন্‌স্‌-এ হারাণচন্দ্র রক্ষিত, নিখিলনাথ রায়, মোহম্মদ বরকতুল্লাহ্ প্রমুখের লেখাও ছাপা হয়েছে। পদ্যাংশে বরদাচরণ মিত্র, সরোজকুমারী দেবী, প্রমথনাথ রায়চৌধুরী, প্যারীমোহন সেনগুপ্ত―এঁদের কবিতা আছে। এখন আর এঁদের নাম কে মনে রেখেছে? সাহিত্যর ইতিহাসে এঁদের নাম ১৯৫০এর দশকের পর থেকে আর পাওয়া যায় না।

আমার বক্তব্য সংক্ষেপে এই : সাহিত্যরুচি বলে কোনো নির্বিশেষ সর্বযুগে প্রযোজ্য রুচি নেই। সময়-এর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই রুচিভেদ হওয়াটাই নিয়ম, ব্যতিক্রম নয়। শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাসও শেষ বিচারে যিনি লিখছেন তাঁর ব্যক্তিগত ও সমকালীন রুচির প্রতিফলন।
তাহলে কি ক্লাসিক বলে কিছু নেই? আগে, আমার ক্লাসিক কেন চিরায়ত বইতে সেই নিয়ে আলোচনা করেছি। এখানে তার উল্লেখ করে ক্ষান্ত থাকি।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *