দেবেশ রায়: একটি ব্যক্তিগত প্রতিবেদন – স্বপন পাণ্ডা

দেবেশ রায়: একটি ব্যক্তিগত প্রতিবেদন – স্বপন পাণ্ডা

শেয়ার করুন

দেখতে দেখতে দেবেশদার চুরাশিতম জন্মদিন এসে পড়ল। চলে যাবার পর, আমাদের সাহিত্যের সর্বকালের এক মহান ‘কথােয়াল’ দেবেশ রায়ের প্রথম জন্মদিন। তাঁর শূন্যতা কখনও পূরণ হবার নয়, বস্তুত, এমন মাপের কোনাে লেখকেরই স্থান, অন্য কারও দ্বারা পূরণ হয় না। তাঁকে যে টানা লিখতে দেখেছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর কথা শুনেছি, তর্ক-বিতর্কে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ হতে দেখেছি, সামাজিক এবং নিভৃত ব্যক্তিগত পরিসরে কিছু সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত্রি যাপন করতে পেরেছি, এসব সত্যিই আজ ‘অলীক’। সেই সব ব্যক্তিগত মুহূর্তের কিছু কথাবার্তাই এ লেখার আশ্রয়, তাই শিরােনাম— দেবেশ রায়: একটি ব্যক্তিগত প্রতিবেদন। সবাই জানেন, ‘প্রতিবেদন’ শব্দটিকে খবর কাগজের প্রাত্যহিকী থেকে মুক্ত করে উপন্যাসের জোরালাে বিকল্প হিসেবে দেবেশ রায়ই ব্যবহার করেন তাঁর একাধিক লেখায়, পরে সমগ্র প্রতিবেদন হিসেবে সেগুলি প্রকাশিত হয়েছে। আমার এই আলােচনা তাে আর উপন্যাস নয়, তবু তাঁরই থেকে ঋণ নিয়ে একটু বৈঠকি আলােচনার বিকল্প হিসেবে শব্দটি ব্যবহার করছি। বৈঠকি, কেন-না, এ আলােচনায় তত্ত্বকথা নয়, দেবেশ সাহিত্যের নিবিড় বিচার-পুনর্বিচার নয়, এতে আছে ব্যক্তি দেবেশ রায়ের সঙ্গে অন্তরঙ্গ বিনিময়ের কিছু মুহূর্তের বিবরণ। সে বিনিময়ে একদিকে আছে নীরব মুগ্ধতা, অন্যদিকে শুধু দেবেশ রায় এবং দেবেশ রায়ের ‘বখােয়াজি’।

বছর কুড়ি আগে, বন্ধু সােহারাব, সােহারাব হােসেন ফোন করে বলল, আমাদের আর এক বন্ধু সুকান্তি, সুকান্তি দত্তকে নিয়ে ও বিকেলের দিকে আসছে, গন্তব্য, দেবেশ রায়। আমাকেও সঙ্গে নিতে চায় ওরা। আমাদের চিলেকোঠার ছােট্ট ঘরে খানিক গল্পসল্প করে আমরা তিনজন পৌঁছলাম বল্মীক আবাসনের চারতলার ফ্ল্যাটে। সেই আমার প্রথম বল্মীক। বসার জায়গার চারপাশ জুড়ে বই বই বই আর দুই বাংলার অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিন– একেবারে কেতাব-মঞ্জিল। সােহারাব, সুকান্তি ওদের নতুন বই দেবেশদাকে দিল, পাওয়ামাত্র, কোনাে কথা না বলেই, অনেকক্ষণ ধরে পাতা ওলটাতে লাগলেন। পরেও ধারাবাহিক ভাবে দেখেছি, ওঁর এটা একটা অভ্যেস। নতুন বইপত্র হাতে পেলে, বহুক্ষণ কথা না বলে সেগুলি দেখা, একেবারে ফ্রন্ট কভার, ব্লার্ব থেকে ব্যাক কভার। তারপর কথা বলতে শুরু করতেন এবং এটাও সবার জানা, মনভােলানাে দায়সারা আনুষ্ঠানিক কথা তাঁর খরজিহ্বায় আসত না কখনও। তা সেদিন, ওঠার সময় আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাছেই তাে থাকেন, আসেন না কেন? কী লিখছেন-টিখছেন, কিছুই তাে জানি না। সেই শুরু। এরপর দশক জুড়ে ওই চারতলার সিঁড়ি ভেঙে ওঠা-নামা, অসংখ্য ব্যক্তিগত ও পারিবারিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকা। শুনেছি অনেক কথা, বলেছি সামান্যই। তবে নানা প্রসঙ্গ নানা সময় আড্ডার অবসরে একবার সুযােগ বুঝে উস্কে দিতে পারলে, ব্যস। মহাবাচস্পতি দেবেশ রায় মেতে উঠতেন তর্কে। তর্কের একটু ভঙ্গি দেখাতে পারলে কথা খুলতে থাকত তাঁর। আর এ ব্যাপারে ওস্তাদি দেখাত বন্ধু, বিশিষ্ট লেখক গৌতম সেনগুপ্ত। গৌতম হয়তাে দুষ্টুমি করেই কথা বার করতে বলে বসল, এখন এসব কী বলছেন দেবেশদা, আপনি তাে আগে একথা বলতেন, ওই যে প্রতিক্ষণ অফিসে এইসব বলেছিলেন, এখন তাে পালটি খেলে চলবে না। দেবেশদা হেসে বলতেন, ওসব কবে কী বলেছি ভুলে যান ভুলে যান, এখন এই বলছি, শুনে রাখুন। এই মজা প্রায়ই। এমন কত যে আড্ডা! কথা উঠত গল্প-উপন্যাসের গড়ন-চলন— তার বিবিধ টেকনােলজির তত্ত্বকে ঘিরে। বাংলা সাহিত্যের পাঠক-লেখকের আশ্চর্য মূলত বিচ্ছেদ আর অনাত্মীয়তার প্রসঙ্গ ঘুরে-ফিরে আসত মাঝে-মধ্যেই। সেসব কথা কোনাে কোনাে দিন বাড়ি ফিরে একটু লিখে রাখতাম। সে সব কথাই আজ পাঠকের সঙ্গে একটু ভাগ করে নেওয়া ছাড়া এ লেখার আর কোনাে উদ্দেশ্য নেই। যদিও বহু বহু দিন-রাত, বহু অবিস্মরণীয় কথাই বিস্মরণের অতলে ডুব দিয়েছে। যা গেছে যে দিন গেছে, তার জন্য শােক-সন্তাপে মনটা নিথর হয়ে যায়, কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ শুনতে পাই তাঁর স্বরগ্রাম, দূরে কোথায় দূরে কী নিয়ে যেন তর্কে মেতে আছেন, কেউ তাঁকে থামাতে পারছে না— একসময় কোন্ কথায় যেন নিজেই আচমকা ঘেমে গিয়ে উল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠেন আঃ কী নভেলাইজেশন… বলেছি না, আনসার্টেনটি ছাড়া মহৎ শিল্প হয় না…

১৪ জানুয়ারি, ২০১৩
সন্ধ্যা

বাংলাদেশ নিয়ে কথা হচ্ছিল—খুব উদ্দীপ্ত হয়ে বললেন, ওরা অসাধারণ লিখছে, অসাধারণ। শাহিন আখতার, সালমা বাণী, শহিদুল জহির–ওদের পাওয়ার, ভাষা, সাহস, শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না–আমি তাে অবাক হয়ে যাই। শাহিনের এই বইটা নিয়ে যান, আপনাকে বলেই দিচ্ছি, হাতছাড়া করতে চাই না, অসাধারণ কাজ। কী করে ও ভাবল। বইটার নাম ‘সখী রঙ্গমালা’। ওদেশের মেয়েরা তাে আমাকে লিখে লিখে বিস্মিত করে দিচ্ছে। ওদের কমলকুমারের মতাে একজন অভিভাবক দরকার। কেউ নেই তেমন। আমাকে মাঝে মাঝেই যেতে হয়, ওদের ডাকাডাকি—না করতে পারি না।
ওখানে ওরা অনেকে আমাকে গুরু বলে মানে, এই আর কি, আবেগটা একটু বেশি। তা একদিন তাে একজন বলে বসলেন, দাদা আপনে তাে গুরুকে পিছনে ফেলে দিসেন। জিজ্ঞেস করলাম, কে আমার গুরু? কার কথা বলছেন? বলল, কেন রবীন্দ্রনাথ। আমি বললাম গল্পগুচ্ছটা আবার ভালাে করে পড়ুন, ভালাে করে কিন্তু। তাে পড়তে শুরু করল। পড়ে-টড়ে একদিন ফোনে জানাল, দাদা, এ যে মুশকিল হয়ে গেল—বললাম, কী? আমাকে যে গুরু গুরু করেন, এবার বুঝলেন তাে আমাদের সব্বার আসল গুরু কে?
শহিদুল জহিরের ওই যে কি নাম, নামটা বলুন তাে—হ্যাঁ ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ আমি কোথায় যেন প্রশংসা করে লিখলাম, আর ও মরে গেল। একজন বলল—দাদা, অর তাে চাদ্দিকে আপনেরই বই, একেবারে গুরুর থান বানাইয়া বসবাস করত। আমি দেখলাম, ওর বাক্য গঠন, দেখা, এমনকি ওরকম একটা নাম দেওয়া—সর্বত্র আমি কোথাও যেন আছি। এটা অনুসরণ নয়, অনুকরণ তাে নয়ই—এ হল রক্তের ভেতরে কোথাও বয়ে চলা..

২৯ জানুয়ারি, ২০১৩
সকাল

দিন পনেরাে পরে শাহিনের বইটা পড়ে ফেরৎ দিতে গেছি। আমার ভালােলাগটুকু জানাতেই, ‘সখী রঙ্গমালা’ হাতে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে লাগলেন—আমি নানা লেখায় যে উপন্যাসের স্বপ্ন দেখিয়েছি, কল্পনা করেছি, শাহিনের উপন্যাস একেবারে তা-ই। কেমন লাগল বলুন, চমৎকার না! কী করে যে লিখল। অবাক লাগে, ওর ‘পালাবার পথ নেই’ ভালাে লাগেনি। ভাবলাম কী লিখবে বুঝে গেছি। কিন্তু এটায় চমকে দিল। লেখকরাই পারে এমন বিস্ময়-বিমূঢ় করে দিতে। ওরা আমাকে যে-ভাবে পড়েছে, এখানে কেউ তেমন না।
জানতে চাই, আপনার প্রভাব, উত্তরাধিকার কি কারও মধ্যে… বললেন—দেখুন, ওপর ওপর আমার প্রভাব আছে অনেকের মধ্যে, নাম-টাম, তার ওপর আখ্যান এই শব্দ তাে আকছার যে যেভাবে পারে ব্যবহার করে চলেছে। কিন্তু গল্প-উপন্যাসের কাছে একটাই কাজ দাবি—সৌন্দর্যসৃষ্টি, বাকি ওই ইতিহাস-টিতিহাস, সমাজ, এটা-ওটা সবই তার পায়ে পায়ে চলে।

২১ মার্চ, ২০১৩
রাত্রি

সেদিন স্বপ্নময় বলছিল বাড়িতে শরৎবাবু সাজানাে পড়তেই পারছি না। বললাম পড়বেন কী সব তাে রাবিশ। এক্কেবারে রাবিশ রাবিশ। দীপেন বলত ‘বামুনের মেয়ে’, ‘অরক্ষণীয়া’ ভালাে। আমার তাে ওই একটা গল্প ‘অভাগীর স্বর্গ’ আর রবীন্দ্রনাথের ৫০ নিয়ে ‘তােমার দিকে চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই’ ছাড়া কিসসু না। রবীন্দ্রনাথ পড়াই হল না। নৌকাডুবি মাস্টারপিস। আনা কারেনিনা তাঁর ভালাে লাগল না। জবাব দিয়েছেন ‘যােগাযােগ’-এ। শরৎবাবু লেডি ডাক্তার ইত্যাদি বললেন শেষটা নিয়ে, বুঝতেই পারেননি। বাঙালি রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিম কিসসু পড়েনি। সীতারাম অসামান্য। লিখব। বাজে বলতে আনন্দমঠ। ঠিক বলেছেন তত্ত্ব এসে মাটি করে দিয়েছে। চন্দ্রশেখর অসামান্য। তবে নবকুমার কপালকুণ্ডলার সাক্ষাৎদৃশ্য বিশ্বসাহিত্যে অমন নভেলিস্টিক ইভেন্ট আর নেই।
——————


সমরেশ বসু দুর্দান্ত ন্যারেটর। যা ইচ্ছে করতে পারতেন। দাঁড় করিয়ে দিতেন। কী বললেন? ঠিক নভেলিস্ট নয়, গল্প। অসামান্য সব গল্প। দীপেন বলত, লেখক বেশি লিখে লিখেই নষ্ট হয়, না লিখে হয় না। সমরেশ প্রমাণ।
——————


মানিকবাবুকে দেখুন, যা খুশি নিয়ে একটা-দুটো বাক্য লিখেই সবটা দাঁড় করিয়ে দেন, কী পাওয়ার! কী যে পাওয়ার!

১৭ ডিসেম্বর, ২০১৩
দুপুর

দেবেশদার জন্মদিন। দেখা করতে গিয়েছি। ভেতরের ঘরে। সামনে জলচৌকি। কাগজপত্র। প্রিয় শেফার কলমে কিছু লিখছেন, কাটছেন… ইশারায় বসতে বললেন। কাজ শেষ হলে বললেন—লিখতে ভালাে লাগছে। লিখছি, সেই কবে থেকে লিখেই তাে চলেছি। এই তাে এটা বেরােচ্ছে (এক তাড়া পুফ দেখালেন)।
পাঠকরা সব গেল কোথায়—এই নিয়ে কথা উঠল। কথা চলতে চলতে সমরেশদা বললেন, কেউ পড়ে না কিছু। দেবেশদা বললেন, কোনােদিন পাঠকের কথা ভেবে তাে লিখিনি। তাছাড়া আমার সাড়ে তিনজন পাঠক। তবে কি জানেন, পাঠক নেই তাে এই ৬০ বছর ধরে, মানে আমি তাে ১৭ বছর বয়েস থেকে এই এতদিন লিখে যাচ্ছি। কেউ কেউ তাে পড়ে না কি?

সমরেশদা—না না ও সবাই বলে পড়েছি, কেউ পড়ে না। তাের লেখাও। বলে হয়তো দেবেশদা পড়েছি, পড়ে না।

দেবেশদা—ওরকম আমাকে ফ্রাস্ট্রেট করিস না। লিখবাে কী করে। লিখতে তাে হবে। কেউ নেই কেউ পড়ে না, না না তা হয় না। তবে আমি তাে বলেছি আগেই, বাঙালি পাঠক নালায়েক পাঠক। বঙ্কিম কি পড়েছে।

রবীন্দ্রনাথ তাে কিছু পড়া শুরুই হয়নি…

তা বলে কি লিখব না? না না, তা হয় না…

শুনুন, একটা কথা বলছি… ভেবে দেখবেন… সাহিত্য হল আসলে হাউলি খাটা, গাব পাকানাে। আমি উত্তরবঙ্গের লােক তাে, আপনি কি জানেন কাকে বলে হাউলি খাটা? স্বীকার করলাম, জানি না। কথাটাই তাে শুনিনি কোনােদিন। তাহলে শুনুন, ধরুন, কারও বাড়িটা ভেঙে পড়েছে, আপনি দেখলেন, আর কাজে লেগে পড়লেন। সৌজন্য নয়, বেগার খাটা নয়, এ হল নিছক এক সহনাগরিকের প্রতি ভালােবাসা, দায়িত্ব নয় কিন্তু, বাধ্যবাধকতা নেই, তবু আপনি সারাদিন খেটে দিলেন। কোনাে প্রত্যাশা নেই যে, সে একদিন আপনার বাড়ি সারাতে আসবে বলে আপনি খাটলেন। যখন রাজনীতি করতাম, চাষীরা বলতেন, কী দেবেশদা হাউলি খাটতে আইছেন। ওদের টাইম সেন্সটা অদ্ভুত, আমাদের মতাে না, বললাম কাল কখন আসব, ওরা বলল, আসেন না। কখন আসব? বিকেলে? বলল, আসেন না। আমি জানি ফসলের সময়টা বাদ দিয়ে যেতে হয়, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত নয়, তারপরে। কেরােসিন নেই জ্বালবে না। অন্ধকারেই কথা হবে। সাহিত্য হল ওই অন্ধকারে ভালােবাসার কথাবার্তা বলা-টলা আর কি! কোনাে এক্সপেক্টেশান ছাড়াই। সুতরাং, হ্যাঁ লিখে যেতে হবে, ভালােবেসে যেতে হবে …

প্রিয় পাঠক, এ লেখার সব কথাই দেবেশ রায়ের। এত আলস্য, এত অশিক্ষা অথচ লেখক হবার অত্যুচ্চ আশা ও তা প্রচারের অদম্য লালসার সময়সন্ধিতে বিমূঢ় হয়ে দেবেশ রায়ের এই সব কথাগুলিই আমার মতাে এক অক্ষম লেখককে আজও জাগিয়ে রাখে…

দেবেশ রায়
দেবেশ রায়
শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

One Comment

  1. ভালো লাগলো। লেখা একরকমের হাউলিখাটা। নাহলে লেখাই যাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২